আর রহমান আয়াত ২৫
فَبِاَيِّ اٰلَاۤءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ ࣖ ( الرحمن: ٢٥ )
Fabi ayyi aalaaa'i Rabbikumaa tukazzibaan. (ar-Raḥmān ৫৫:২৫)
English Sahih:
So which of the favors of your Lord would you deny? (Ar-Rahman [55] : 25)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
অতএব (হে জ্বিন ও মানুষ!) তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ কোন্ নি‘মাতকে অস্বীকার করবে? (আর রহমান [৫৫] : ২৫)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
অতএব তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ কোন্ অনুগ্রহকে মিথ্যাজ্ঞান করবে? [১]
[১] এ (পানির জাহাজ)গুলোর মাধ্যমে ভারবহন ও যাতায়াতের যে সব সুবিধা রয়েছে, তার বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। অতএব এও আল্লাহর নিয়ামত।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
কাজেই তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহে মিথ্যারোপ করবে?
3 Tafsir Bayaan Foundation
সুতরাং তোমাদের রবের কোন্ নিআমতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে ?
4 Muhiuddin Khan
অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে?
5 Zohurul Hoque
সুতরাং তোমাদের প্রভুর কোন্ অনুগ্রহ তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে?
6 Mufti Taqi Usmani
সুতরাং তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন নি‘আমতকে অস্বীকার করবে?
7 Mujibur Rahman
সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?
8 Tafsir Fathul Mazid
১৪-২৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষ ও জিন সৃষ্টির মূল উপাদান ও তাঁর কয়েকটি মহান নিদর্শনের কথা নিয়ে এসেছেন।
মানুষকে সৃষ্টি করেছেন صَلْصَالٍ বা এমন শুকনো মাটি হতে যাতে কোন কিছু দ্বারা আঘাত করলে আওয়াজ হয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন- صلصال দুর্ঘন্ধময় পঁচা মাটি। এখানে মানুষ বলতে আদম (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। যাঁর প্রথমত মাটি থেকে আকার তৈরি করা হয় অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাতে ‘রূহ্’ ফুঁকে দেন। অতঃপর আদম (আঃ)-এর বাম পাঁজরের হাড় হতে হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন এবং তাদের উভয়ের মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টির ধারাবাহিকতা চলতে থাকে।
আর জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন। অন্যত্র আল্লাহ বলেন :
(وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُوْنٍ وَالْجَآنَّ خَلَقْنٰهُ مِنْ قَبْلُ مِنْ نَّارِ السَّمُوْمِ)
“আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি গন্ধযুক্ত কর্দমের শুষ্ক ঠন্ঠনা মৃত্তিকা হতে, এর পূর্বে আমি জীনকে সৃষ্টি করেছি ধোঁয়াহীন আগুন হতে।” (সূরা হিজ্র ১৫ : ২৬-২৭)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : ফেরেশতাদেরকে নূর দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে যার বর্ণনা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে। (সহীহ মুসলিম হা. ২৯৯৬)
(رَبُّ الْمَشْرِقَيْنِ وَرَبُّ الْمَغْرِبَيْنِ)
‘তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের নিয়ন্ত্রণকারী’ অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের উদয়স্থলদ্বয় এবং অস্তস্থলদ্বয়ের মালিক। গ্রীষ্মকালে সূর্য সোজা পূর্বদিক বরাবর উদয় হয়, যার ফলে দিন বড় হয় আর রাত হয় ছোট। আর শীতকালে সূর্য পূর্বদিকের দক্ষিণ পার্শ্ব হতে উদয় হয়ে পশ্চিম দিকের দক্ষিণ পার্শ্বে অস্ত যায়, যার ফলে দিন ছোট হয় আর রাত হয় বড়। এ জন্য বলা হয়েছে দু’ উদয়াচল ও দু’ অস্তাচল।
তাছাড়াও সূর্য প্রতিদিনের উদয় ও অস্ত উভয় স্থলের তারতম্য হয়। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
(فَلَآ أُقْسِمُ بِرَبِّ الْمَشٰرِقِ وَالْمَغٰرِبِ)
“আমি শপথ করছি উদয়াচল ও অস্তাচলের প্রতিপালকের।” (সূরা আল মা‘আ-রারিজ ৭০ : ৪০)
(مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيٰنِ)
‘তিনি দুই সমুদ্রকে প্রবাহিত করেন যারা পরস্পর মিলিত হয়’ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : مرج-এর অর্থ ارسل বা প্রবাহিত করেন।
الْبَحْرَيْنِ দু সমুদ্র বলতে মিষ্টি পানি ও লোনা পানিবিশিষ্ট।
ইবনু জায়েদ বলেন- يَلْتَقِيٰنِ অর্থাৎ দুটি সমুদ্র পাশাপাশি প্রবাহিত হয় কিন্তু একটি অন্যটির সাথে সংমিশ্রণ হতে বাধা দেয় কারণ উভয়ের মাঝে রয়েছে বিশাল অন্তরায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَھُوَ الَّذِیْ مَرَجَ الْبَحْرَیْنِ ھٰذَا عَذْبٌ فُرَاتٌ وَّھٰذَا مِلْحٌ اُجَاجٌﺆ وَجَعَلَ بَیْنَھُمَا بَرْزَخًا وَّحِجْرًا مَّحْجُوْرًا)
“তিনিই দু’ দরিয়াকে মিলিতভাবে প্রবাহিত করেছেন, একটি মিষ্ট, সুপেয় এবং অপরটি লোনা, বিস্বাদ; উভয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন এক অন্তরায়, এক অনতিক্রম্য ব্যবধান।” (সূরা আল ফুরকান ২৫ : ৫৩) এ সম্পর্কে সূরা ফুরকান-এর ৫৩ নম্বর আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
(يَخْرُجُ مِنْهُمَا اللُّؤْلُؤُ وَالْمَرْجَانُ)
অর্থাৎ মিষ্টি ও লোনা পানিবিশিষ্ট উভয় সমুদ্র হতে উৎপন্ন হয় মুক্তা ও প্রবাল, অথচ এগুলো পাওয়া যায় একটি সমুদ্র হতে, কিন্তু উভয়টির ওপর এর প্রয়োগ করা হয়েছে এরূপ প্রয়োগ বৈধ ও সঠিক। যেমন আল্লাহ বলেন :
( يٰمَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنْكُمْ)
‘হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্য হতে কি রাসূলগণ তোমাদের কাছে আসেনি। (সূরা আন‘আম ৬ : ১৩০) এটা সুস্পষ্ট কথা যে, রাসূল শুধুমাত্র মানুষের মধ্য হতেই এসেছেন, জিনদের মধ্য হতে কোন জিন রাসূল আসেনি। তাহলে এখানে যেমন মানব ও দানবের মধ্য হতে রাসূল আগমনের কথা প্রয়োগ শুদ্ধ হয়েছে, তেমনি এ আয়াতের দুটি সমুদ্রের ওপরই মুক্তা ও প্রবাল উৎপন্ন হওয়ার প্রয়োগ সঠিক হয়েছে।
اللُّؤْلُؤُ মুক্তা যা প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত জিনিস। الْمَرْجَان- কেউ বলেছেন : ছোট মুক্তাকে বলা হয়, আবার কেউ বলেছেন : বড় মুক্তাকে বলা হয়। ইবনু জারীর কতক সালাফদের থেকে এ বর্ণনা নিয়ে এসেছেন। ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ বলেন : মারজান হলো লাল মোহর। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন : (وَمِنْ كُلٍّ تَأْكُلُوْنَ لَحْمًا طَرِيًّا وَّتَسْتَخْرِجُوْنَ حِلْيَةً تَلْبَسُوْنَهَا) “তোমরা প্রত্যেকটি থেকেই টাটকা গোশত খাও এবং আহরণ কর মণি-মুক্তার অলঙ্কার যা তোমরা পরিধান কর।” (সূরা ফাতির ৩৫ : ১২)
মাছ লোনা ও মিষ্টি উভয় পানিতেই হয়ে থাকে, কিন্তু মণি-মুক্তা শুধু লোনা পানির মধ্যেই পাওয়া যায়, মিষ্টি পানিতে না। (ইবনু কাসীর)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : আকাশ হতে যখন বৃষ্টি বর্ষণ হয় তখন সমুদ্রের ঝিনুক তাদের মুখ খুলে দেয়। বৃষ্টির যে ফোঁটা ঝিনুকের মাঝে পড়ে সেটাই মুক্তা হয়। (সনদ সহীহ, ইবনু আবী হাতেম- হা. ১৮৭৩৩-৪)
(وَلَهُ الْجَوَارِ الْمُنْشَاٰتُ)
‘পবর্ত সমতুল্য জাহাজসমূহ তাঁরই নিয়ান্ত্রণাধীন, যা সমুদ্রের বুকে চলাচল করে’ الْجَوَارِ হলো جارية-এর বহুবচন অর্থ হলো চলমান, الْمُنْشَاٰتُ অর্থ সুউচ্চ। অর্থাৎ সমুদ্রে চলমান পাহাড়সম উচ্চ জাহাজসমূহ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার নিয়ন্ত্রণাধীন।
সূরা শূরাতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمِنْ اٰيٰتِهِ الْجَوَارِ فِي الْبَحْرِ كَالْأَعْلَامِ)
“তাঁর মহা নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত হল পর্বত সদৃশ সমুদ্রে চলমান নৌযানসমূহ।” (সূরা শূরা- ৪২ : ৩২)
‘উমায়রাহ্ ইবনু সা‘দ বলেন : একদা আমি ‘আলী (রাঃ)-এর সাথে ফুরাত নদীর তীরে ছিলাম। নদীতে একটি বিরাট জাহাজ চলে আসছিল। জাহাজটিকে দেখে ‘আলী (রাঃ) ঐ জাহাজটির দিকে ইশারা করে
(وَلَهُ الْجَوَارِ الْمُنْشَاٰتُ فِي الْبَحْرِ كَالْأَعْلَامِ)
আয়াতটি পাঠ করেন। অতঃপর বলেন : যিনি এ পর্বত সদৃশ জাহাজকে নদীতে চালিত করছেন ঐ আল্লাহ তা‘আলার কসম! আমি ‘উসমান (রাঃ)-কে হত্যা করিনি হত্যা করার ইচ্ছাও করিনি এবং হত্যাকারীদের সাথে শরীকও ছিলাম না। (ইবনু কাসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মানব ও দানব সৃষ্টির মূল উপাদান জানলাম।
২. গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে সূর্যের উদয় ও অস্তে পার্থক্য রয়েছে।
৩. মণিমুক্তা ও প্রবাল উৎপাদনের প্রক্রিয়া ও স্থান জানলাম।
৪. সমুদ্রে পাহাড়সম জাহাজ চলে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কৃপায়।
9 Fozlur Rahman
অতএব, তোমরা তোমাদের প্রভুর কোন্ নেয়ামতটি অস্বীকার করবে?
10 Mokhtasar Bangla
২৫. তবে হে জিন ও মানব জাতি! তোমরা নিজেদের রবের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত পর্যাপ্ত নিআমতের কোন্ কোন্ নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?!
11 Tafsir Ibn Kathir
১৪-২৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা বর্ণনা করছেন, তিনি মানুষকে বেজে ওঠা খোলার মত শুষ্ক মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। আর জ্বিনকে সৃষ্টি করেছেন নিধূম অগ্নিশিখা হতে। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ফেরেশতাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে নূর (জ্যোতি) হতে, জ্বিনদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে নিধূম অগ্নিশিখা হতে এবং আদম (আঃ)-কে ঐ মাটি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে যার বর্ণনা তোমাদের সামনে করা হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অতঃপর আল্লাহ তা'আলা তাঁর কোন নিয়ামতকে অস্বীকার না করার হিদায়াত দান করেন। এরপর তিনি বলেনঃ তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের নিয়ন্তা। অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের দুই উদয়াচল এবং গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের দুই অস্তাচল। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ
فَلَاۤ اُقْسِمُ بِرَبِّ الْمَشٰرِقِ وَ الْمَغٰرِبِ اِنَّا لَقٰدِرُوْنَ
অর্থাৎ “আমি শপথ করছি উদয়াচল ও অস্তাচলের অধিপতির।” (৭০:৪০) গ্রীষ্মকালে ও শীতকালে সূর্য উদিত হওয়ার দুটি পৃথক জায়গা এবং অস্তমিত হওয়ারও দুটি পৃথক জায়গা। ওখান হতে সূর্য উপরে উঠে ও নীচে নেমে আসে। ঋতুর পরিবর্তনে এটা পরিবর্তিত হতে থাকে। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ
رَبُّ الْمَشْرِقِ وَ الْمَغْرِبِ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِیْلًا
অর্থাৎ “তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের রব, তিনি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই, সুতরাং তাকেই কর্মবিধায়ক বানিয়ে নাও।" (৭৩:৯) তাহলে এখানে মাশরিক ও মাগরিব দ্বারা এর জাতকে বুঝানো হয়েছে, আর দুটি মাশরিক ও দুটি মাগরিব দ্বারা বুঝানো হয়েছে সূর্যোদয়ের দুটি স্থানকে এবং সূর্যাস্তের দুটি স্থানকে। উদয় ও অস্তের দুটি করে পৃথক পৃথক স্থান থাকার মধ্যে মানবীয় উপকার ও কল্যাণ রয়েছে বলে আবারও আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলছেনঃ “হে মানব ও জ্বিন জাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে? তার ক্ষমতার দৃশ্য অবলোকন কর যে, দুটি সমুদ্র সমানভাবে চলতে রয়েছে। একটির পানি লবণাক্ত এবং অপরটির পানি মিষ্ট। কিন্তু না ওর পানি এর পানির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে এর পানিকে লবণাক্ত করতে পারে, না এর পানি ওর সাথে মিশ্রিত হয়ে ওর পানিকে মিশ্র করতে পারে! বরং দুটোই নিজ নিজ গতিতে চলছে! উভয়ের মধ্যে এক অন্তরায় রয়েছে। সুতরাং না এটা ওটার সাথে এবং ওটা এটার সাথে মিশ্রিত বা মিলিত হতে পারে। এটা নিজের সীমানার মধ্যে রয়েছে এবং ওটাও নিজের সীমানার মধ্যে রয়েছে। আর কুদরতী ব্যবধান দুটোর মধ্যে রেখে দেয়া হয়েছে। অথচ দুটোরই পানি মিলিতভাবে রয়েছে। সূরায়ে ফুরকানের নিম্নের আয়াতের তাফসীরে এর পূর্ণ ব্যাখ্যা গত হয়েছেঃ
وَ هُوَ الَّذِیْ مَرَجَ الْبَحْرَیْنِ هٰذَا عَذْبٌ فُرَاتٌ وَّ هٰذَا مِلْحٌ اُجَاجٌ وَ جَعَلَ بَیْنَهُمَا بَرْزَخًا وَّ حِجْرًا مَّحْجُوْرًا
অর্থাৎ “তিনিই দুই দরিয়াকে মিলিতভাবে প্রবাহিত করেছেন, একটি মিষ্ট সুপেয় এবং অপরটি লোনা, খর; উভয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন এক অন্তরায়, এক অনতিক্রম্য ব্যবধান।” (২৫:৫৩)।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা আসমানের সমুদ্র ও যমীনের সমুদ্রকে বুঝানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন যে, আসমানে যে পানির ফোঁটা রয়েছে এবং যমীনের সমুদ্রে যে ঝিনুক রয়েছে, এ দুটোর মিলনে মুক্তা জন্ম লাভ করে। এ ঘটনাটি তো সত্য বটে, কিন্তু এই আয়াতের তাফসীর এভাবে করা ঠিক বলে মনে হচ্ছে না। কেননা, এ আয়াতে এ দুটি সমুদ্রের মাঝে বারযাখ বা অন্তরায় থাকার বর্ণনা রয়েছে যা এটাকে ওটা হতে এবং ওটাকে এটা হতে বাধা দিয়ে রেখেছে। এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, এ দুটো সমুদ্র যমীনেই রয়েছে। এমনকি দুটো মিলিতভাবে রয়েছে। কিন্তু মহান আল্লাহর কুদরতে দুটোর পানি পৃথক থাকছে। আসমান ও যমীনের মাঝে যে ব্যবধান রয়েছে ওটাকে بَرْزَخ ও حِجْرًا مَّحْجُوْرًا বলা হয় না। এ জন্যে সঠিক উক্তি এটাই যে, এ দুটো যমীনেরই সমুদ্র যে দুটোর বর্ণনা এ আয়াতে রয়েছে, একটি যে আসমানের এবং অপরটি যমীনের তা নয়। আয়াতে বলা হয়েছে যে, উভয় সমুদ্র হতে উৎপন্ন হয় মুক্তা ও প্রবাল, অথচ এগুলো পাওয়া যায় আসলে একটি সমুদ্র হতে, কিন্তু দুটোর উপর এর প্রয়োগ হয়েছে এবং এরূপ প্রয়োগ বৈধ ও সঠিক। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ
یٰمَعْشَرَ الْجِنِّ وَ الْاِنْسِ اَلَمْ یَاْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنْكُمْ
অর্থাৎ “হে দানব ও মানবের দল! তোমাদের কাছে কি তোমাদেরই মধ্য হতে রাসূলগণ আসেনি?” (৬:১৩০)
আর এটা প্রকাশ্য কথা যে, রাসূল শুধু মানুষের মধ্য হতেই হয়েছেন, জ্বিনদের মধ্য হতে কোন জ্বিন রাসূল রূপে আসেনি। তাহলে এখানে যেমন মানব ও দানবের মধ্য হতে রাসূল আগমনের প্রয়োগ শুদ্ধ হয়েছে, অনুরূপভাবে এই আয়াতেও দুটো সমুদ্রের উপরই মুক্তা ও প্রবাল উৎপন্ন হওয়ার প্রয়োগ সঠিক হয়েছে। অথচ এগুলো উৎপন্ন হয় শুধু একটিতে।
لُؤْلُؤٌ অর্থাৎ মুক্তা তো একটি সুপ্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত জিনিস। আর সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ছোট মুক্তাকে মারজান বলা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন যে, মারজান বলা হয় বড় মুক্তাকে। এও বলা হয়েছে যে, উত্তম ও উচ্চমানের মুক্তাকে মারজান বলে। কারো কারো মতে লাল রঙ এর জওহর বা মূল্যবান পাথরকে মারজান বলা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন যে, মারজান বলা হয় লাল মোহরকে। অন্য আয়াতে রয়েছেঃ
وَ مِنْ كُلٍّ تَاْكُلُوْنَ لَحْمًا طَرِیًّا وَّ تَسْتَخْرِجُوْنَ حِلْیَةً تَلْبَسُوْنَهَا
অর্থাৎ “তোমরা প্রত্যেকটা হতে বহির্গত গোশত খেয়ে থাকো যা টাটকা হয় এবং পরিধানের অলংকার বের করে থাকো।” (৩৫:১২) মাছ তো লোনা ও মিষ্ট উভয় পানি হতেই বের হয়ে থাকে, কিন্তু মণি-মুক্তা শুধু লোনা পানির সমুদ্রে পাওয়া যায়, মিষ্ট পানির সমুদ্রে নয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, আসমানের পানির যে বিন্দু সমুদ্রের ঝিনুকের মুখে সোজাভাবে পড়ে তাতেই মুক্তার সৃষ্টি হয়। আর যখন ঝিনুকের মধ্যে পড়ে না তখন আম্বর (সুগন্ধি দ্রব্য বিশেষ) জন্ম লাভ করে। মেঘ হতে বৃষ্টি বর্ষণের সময় ঝিনুকও মুখ খুলে দেয়। তাই এই নিয়ামতের বর্ণনা দেয়ার পর আবার বলেনঃ তোমাদের যে প্রতিপালকের এসব অসংখ্য নিয়ামত তোমাদের উপর রয়েছে তার কোন নিয়ামতকে তোমরা অস্বীকার করবে?
এরপর আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ সমুদ্রে বিচরণশীল পর্বত প্রমাণ অর্ণবপোতসমূহ তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন, যেগুলো হাজার হাজার মণ মাল এবং শত শত মানুষকে এদিক হতে ওদিকে নিয়ে যায়। এটাও আল্লাহ তা'আলারই নিয়ন্ত্রণাধীন। এই বিরাট নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি পুনরায় বলেনঃ এখন বল তো, তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ তোমরা অস্বীকার করবে?
হযরত উমরাহ ইবনে সুওয়ায়েদ (রঃ) বলেনঃ “আমি একদা হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ)-এর সাথে ফুরাত নদীর তীরে ছিলাম। নদীতে একটি বিরাট জাহাজ চলে আসছিল। জাহাজটিকে আসতে দেখে হযরত আলী (রাঃ) ঐ জাহাজটির দিকে হাতের ইশারা করে وَ لَهُ الْجَوَارِ الْمُنْشَـئٰتُ فِی الْبَحْرِ كَالْاَعْلَامِ -এই আয়াতটি পাঠ করেন। অতঃপর বলেনঃ “যিনি এই পর্বত প্রমাণ জাহাজকে নদীতে চালিত করেছেন ঐ আল্লাহর কসম! আমি হযরত উসমান (রাঃ)-কে হত্যাও করিনি, হত্যা করার ইচ্ছাও করিনি এবং হত্যাকারীদের সাথে শরীকও ছিলাম না।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)