৩৯-৪০ নং আয়াতের তাফসীর
আরো দু'প্রকার কাফিরের এ দু’টি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন সূরায়ে বাকারার শুরুতে দু'শ্রেণীর দু’টি উপমা বর্ণনা করা হয়েছে, একটি আগুনের উপমা এবং একটি পানির উপমা। আর যেমন সূরায়ে রা’দে মানুষের অন্তরে স্থান ধারণকারী ইলম ও হিদায়াতের এরূপই আগুন ও পানির দুটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। ঐ দু’টি সূরায় ঐ আয়াতগুলোর পূর্ণ তাফসীর গত হয়েছে। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্যে।
প্রথমটি হচ্ছে ঐ কাফিরদের দৃষ্টান্ত যারা অন্যদেরকেও কুফরীর দিকে আহ্বান করে থাকে এবং মনে করে যে, তারা হিদায়াতের উপরই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। কিন্তু ওটা শুধু তাদের কল্পনা মাত্র। তাদের দৃষ্টান্ত তো হলো এরূপ যেমন কোন পিপাসার্ত লোক মরুভূমিতে দূর থেকে চকচকে বালু দেখতে পায় এবং ওকে পানির তরঙ্গ মনে করে বসে।
قِيْعَة শব্দটি قَاعَ শব্দের বহুবচন, যেমন جَارَ শব্দটির বহুবচন হলো جِبْرَة এবং قَاعَ শব্দের বহুবচন قِيْعَان ও এসে থাকে, যেমন جَارَ শব্দের বহুবচন جِيْرَان ও আসে। قَاعَ শব্দের অর্থ হলো জনশূন্য প্রশস্ত ও বিস্তীর্ণ মরুভূমি। এরূপ মরুভূমিতেই মরীচিকা দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে। দুপুরের সময় এরূপই মনে হয় যে, পানির প্রশস্ত সমুদ্র তরঙ্গায়িত হচ্ছে। মরুভূমির উপর দিয়ে চলতে চলতে যখন কোন লোক পিপাসায় কাতর হয়ে ছটফট করে এবং ওষ্ঠাগত প্রাণ হয়ে যায়, আর উড্রান্তের মত পানির খোঁজে ফিরতে থাকে, তখন সে ওটাকে পানি মনে করে সেখানে পৌছে যায়। কিন্তু গিয়ে দেখে যে, সেখানে এক ফোটা পানিরও কোন নাম-নিশানা নেই। দ্রুপ এই কাফিররাও মনে করে নিয়েছে যে, তারা খুব ভাল কাজই করছে। কিন্তু কিয়ামতের দিন তারা দেখতে পাবে যে, তাদের কাছে একটা পুণ্যও নেই। হয়তো তাদের পুণ্য তাদের বদ নিয়তের কারণে নষ্ট হয়ে গেছে অথবা শরীয়ত মোতাবেক না হওয়ার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। মোটকথা, সেখানে পৌছবার পূর্বেই তারা জাহান্নামীদের তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। সুতরাং সেখানে তারা হয়ে গেছে সম্পূর্ণ শূন্য হস্ত। হিসাব গ্রহণের সময় স্বয়ং মহিমান্বিত ও প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ সেখানে বিদ্যমান। তিনি এক এক করে প্রত্যেকটি আমলের হিসাব গ্রহণ করছেন এবং ঐ কাফিরদের একটি আমলও পুণ্যের যোগ্যরূপে পাওয়া যাচ্ছেনা।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, কিয়ামতের দিন ইয়াহূদীদেরকে জিজ্ঞেস করা হবেঃ “দুনিয়ায় তোমরা কার উপাসনা করতে?” উত্তরে তারা বলবেঃ “আমরা আল্লাহর পুত্র (নাউযুবিল্লাহ) উযায়ের (আঃ)-এর উপাসনা করতাম।” তখন তাদেরকে বলা হবেঃ “তোমরা মিথ্যা কথা বলছো, আল্লাহর কোন পুত্র নেই। তারপর তাদেরকে প্রশ্ন করা হবেঃ “আচ্ছা, এখন তোমরা কি চাও?” তারা জবাবে বলবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা খুবই পিপাসার্ত। সুতরাং আমাদেরকে পানি পান করিয়ে দিন!” তখন তাদেরকে বলা হবেঃ “তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না (ঐ যে পানি দেখা যায়, সেখানে যাও কেন)?” অতঃপর দূর থেকে তারা জাহান্নামকে তেমনই দেখবে যেমন দুনিয়ায় মরীচিকা দেখা যায়। সুতরাং তারা পানি মনে করে ওদিকে দৌড় দেবে এবং সেখানে পৌছলেই তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
এটা দৃষ্টান্ত হলো অনুসৃত লোকদের। এখন দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হচ্ছে অনুসরণকারী লোকদের, যারা মোটেই জ্ঞান রাখতো না। তারা পূর্ব বর্ণিত কাফিরদের অন্ধ অনুকরণ করতো। যাদের উপমা দেয়া হয়েছে গভীর সমুদ্রতলের অন্ধকারের সাথে, যাকে আচ্ছন্ন করে তরঙ্গের উপর তরঙ্গ, যার ঊর্ধ্বে মেঘপুঞ্জ, অন্ধকারপুঞ্জ স্তরের উপর স্তর, এমনকি সে হাত বের করলে তা আদৌ দেখতে পাবে না। এই অবস্থা ঐ অনুসরণকারী কাফিরদের হবে যারা নেতৃস্থানীয় কাফিরদেরকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে থাকে। যাদের তারা অনুসরণ করে তাদেরকেও তারা সঠিকভাবে চিনে না। তারা ন্যায়ের উপর আছে কি অন্যায়ের উপর আছে সেটাও তারা জানে না। তারা তাদের পিছনে চলতে রয়েছে, কিন্তু তারা তাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এ খবর তারা রাখে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা হয়ে থাকে যে, কোন একজন অজ্ঞ লোককে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “তু কোখায় যাচ্ছ?” উত্তরে সে বলেঃ “আমি এই লোকটির সাথে যাচ্ছি।” আবার তাকে প্রশ্ন করা হয়ঃ “এ লোকটি কোথায় যাচ্ছে?” জবাবে সে বলেঃ “তা তো আমি জানি না।” যেমন সমুদ্র তরঙ্গায়িত হচ্ছে তেমনই এই কাফিরের কানে এবং চোখের উপর পর্দা পড়ে রয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহ তাদের অন্তরের উপর ও কানের উপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন (শেষ পর্যন্ত)।” অন্য আয়াতে রয়েছে-
اَفَرَءَیْتَ مَنِ اتَّخَذَ اِلٰهَهٗ هَوٰىهُ وَ اَضَلَّهُ اللّٰهُ عَلٰى عِلْمٍ وَّ خَتَمَ عَلٰى سَمْعِهٖ وَ قَلْبِهٖ وَ جَعَلَ عَلٰى بَصَرِهٖ غِشٰوَةً
অর্থাৎ “তুমি কি ঐ ব্যক্তিকে দেখনি যে তার প্রবৃত্তিকে তার মা'বুদ বানিয়ে নিয়েছে, আর আল্লাহ তাকে জ্ঞানের উপর পথভ্রষ্ট করেছেন এবং তার কানের উপর ও অন্তরের উপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন ও তার চোখের উপর পর্দা ফেলে দিয়েছেন?।” (৪৫:২৩)
হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) বলেছেন যে, এই ধরনের লোক পাঁচটি অন্ধকারের মধ্যে থাকে। তার কথা, কাজ, যাওয়া, আসা এবং পরিণাম অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ যাকে জ্যোতি দান করেন। তার জন্যে কোন জ্যোতিই নেই। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যাকে হিদায়াতের জ্যোতি দান না করেন সে হিদায়াত শূন্য থাকে এবং অজ্ঞতার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে ধ্বংসের মধ্যে পতিত হয়। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ مَنْ یُّضْلِلِ اللّٰهُ فَلَا هَادِیَ لَهٗ অর্থাৎ “আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্যে কোন হিদায়াতকারী নেই।” (৭:১৮৬) এটা ওরই মুকাবিলায় বলা হয়েছে যা মুমিনদের উপমার বর্ণনায় বলা হয়েছিল যে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ-নির্দেশ করেন তাঁর জ্যোতির দিকে। আমরা মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি যে, তিনি যেন আমাদের অন্তরে নূর সৃষ্টি করেন এবং আমাদের ডানে এবং বামেও যেন নূর বা জ্যোতি দান করেন। তিনি যেন আমাদের জ্যোতি বাড়িয়ে দেন এবং ওটাকে খুবই বড় ও বেশী করেন।