১০৮-১১১ নং আয়াতের তাফসীর:
ইউসুফ (عليه السلام) এর জীবনী বিস্তারিত তুলে ধরার পর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবীকে নির্দেশ দিচ্ছেন বলে দাও পূর্বের নাবীরা যেমন সঠিক জ্ঞান ও তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে তাঁর দিকে দাওয়াত দিয়েছেন আমিও তাওহীদের পথ অবলম্বন করে তাঁর দিকে দাওয়াত দিচ্ছি। তবে এ দাওয়াতী কাজ শুধু আমি একাই করি না, বরং আমি ও আমার অনুসারী যারা সবাই এ কাজ করে।
সুতরাং যারাই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উম্মত বলে দাবি করবে তাদের উচিত ও আবশ্যক হল নিজে সৎ আমল করা এবং মানুষদেরকে আল্লাহ তা‘আলার পথে ডাকা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা। আর তাঁকে সর্বপ্রকার দোষ-ত্র“টি থেকে পবিত্র রাখা। এটাই ছিল সকল নাবীগণের কাজ। তাঁরা মানুষদেরকে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের দিকে আহ্বান করতেন।
উক্ত আয়াতে একজন দাঈ ইলাল্লাহ বা আল্লাহ তা‘আলার পথে আহ্বানকারীর পাঁচটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে:
(১) (الدَّعْوَةُ إِلَي اللّٰهِ)
আল্লাহ তা‘আলার দিকে আহ্বান; অর্থাৎ কোন দল, মত, পথ ও মাযহাব বা তরীকার প্রতি দাওয়াত নয়, বরং দাওয়াত হতে হবে সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার দিকে তথা আল্লাহ তা‘আলার দীন ইসলামের প্রতি। আর দীন ইসলামের প্রতি দাওয়াতের প্রথম পদক্ষেপ হবে তাওহীদ বা আল্লাহ তা‘আলার একত্ব ও আকীদাহ বিশ্বাস এর প্রতি দাওয়াত। অতঃপর ইসলামের অন্যান্য ইবাদতের প্রতি। এটাই হল নাবী-রাসূলদের দাওয়াতী নীতি ও পদ্ধতি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ পদ্ধতি তাঁর সাহাবী তথা উম্মাতকে শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন প্রসিদ্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেন: যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুয়ায বিন জাবাল (রাঃ) কে ইয়ামানে দাওয়াতের জন্য প্রেরণ করেন তখন তাকে নির্দেশ দেন: “সর্বপ্রথম তুমি যে বিষয় দাওয়াত দেবে তাহল এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ বা একত্বতার প্রতি যেন তোমার প্রথম দাওয়াত হয়। তারা যদি তোমার এ তাওহীদের দাওয়াত পূর্ণভাবে মেনে নেয় অতঃপর তাদের জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাত ও দিনে তোমাদের ওপর পাচঁ ওয়াক্ত সালাত ফরয করে দিয়েছেন, এভাবে যাকাত ও অন্যান্য কথা বললেন। (সহীহুল বুখারী হা: ১৩৯৫, সহীহ মুসলিম হা: ১৯)
অতএব আলিমদের দাওয়াত হতে হবে সর্বপ্রথম তাওহীদ বা আকীদা বিশ্বাসের দিকে, কারণ আকীদাহ বিশ্বাসই হলো সবকিছুর মূল, আকীদাহ বাতিল হলে সবকিছু বাতিল হয়ে যায়।
(২) (عَلٰي بَصِيْرَةٍ)
“জ্ঞান-বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণসহকারে” অর্থাৎ যে বিষযের প্রতি দাওয়াত দেব সে বিষয় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকতে হবে। না জেনে, না বুঝে প্রমাণহীন আমল-আখলাক ও ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি দাওয়াত দিলে হিদায়াতের পরিবর্তে গুমরাহির বেশি সম্ভাবনা থাকে।
(৩) (أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِيْ)
“আমি এবং আমার অনুসারীরা” অতএব যে আলিম দাওয়াত দেবেন, তাকে সকল পীর মুরশিদ ও দল, তরীকার অনুসরণ বর্জন করে ব্যক্তি হিসেবে ও দাওয়াতের বিষয়ে একমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনুসারী হতে হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনুকরণ ইবাদত কবূলের অন্যতম শর্ত, তা লঙ্ঘিত হলে এ দাওয়াত আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হতে পারে না। অতএব কোন মুজতাহিদ, মুফতী, পীর-মুর্শিদ ও বুজুর্গের অনুসরণ নয় বরং অনুসরণ হবে শুধু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের।
(৪) (وَسُبْحٰنَ اللّٰهِ)
“আল্লাহ তা‘আলা পূত পবিত্র” দাওয়াতের প্রতিটি কথা ও কাজে আল্লাহ তা‘আলাকে শির্কমুক্ত ও পূত পবিত্র রাখতে হবে এবং সে সঠিক বিষয়ের প্রতি দাওয়াত দিতে হবে।
(৫) (وَمَآ أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ)
“আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই” অতএব একজন আলিম বা দাঈকে আকীদাহ-বিশ্বাস, আমল-আখলাক ও ইবাদত-বন্দেগী সকল ক্ষেত্রে শির্ক মুক্ত হতে হবে। আলিম সমাজের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো আল্লাহ তা‘আলার প্রতি আহ্বান করা। আর এক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়সমূহ অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে নচেৎ দাওয়াতে সার্থক ও সফল হওয়া সম্ভব হবে না।
(إِلَّا رِجَالًا نُّوْحِيْ إِلَيْهِمْ)
অর্থাৎ সকল নাবী-রাসূলই পুরুষ ছিলেন, কোন নাবী-রাসূল মহিলা ছিলেন না।
(حَتّٰي إِذَا اسْتَيْأَسَ الرُّسُلُ)
অর্থাৎ যখন রাসূলগণ তাদের সম্প্রদায়ের লোকেদের থেকে ঈমানের আশা থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন এবং তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে এরূপ বিশ্বাস তাদের চলে আসল তখন তাদের কাছে আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য এসেছিল। অতএব যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকেসহ আল্লাহ তা‘আলা রাসূলদেরকে কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। আর যারা অপরাধী, আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হয় তাদের থেকে তিনি শাস্তি প্রত্যাহার করেন না। বরং তিনি কিছু সময়ের অবকাশ দেন, যখন তিনি শাস্তি দেয়া উপযুক্ত মনে করেন তখন শাস্তি দেন।
(مَا كَانَ حَدِيْثًا يُّفْتَرٰي)
ইউসুফ (عليه السلام) এর জীবন কাহিনী শুনে অনেকে মনে করতে পারে যে, এটা একটা মিথ্যা ঘটনা যা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রচনা করেছেন। না, এটা কোন মিথ্যা ঘটনা নয় এবং বাণীও নয়, বরং এ কিতাব পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যায়নকারী এবং সকল কিছুর বিশদ বর্ণনাকারী। যারা এ কুরআন নিয়ে গবেষণা করবে তাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা এবং যারা ঈমান আনবে তাদেরকে এ কিতাব সঠিক পথ দেখাবে ও তাদের প্রতি করুনা হয়ে থাকবে।
সুতরাং আমরা যদি দৃঢ় ঈমানের সাথে কুরআনের মর্মার্থ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি তাহলে তা থেকে শিক্ষা নিতে পারব এবং তা আমাদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেবে ও রহমত হয়ে থাকবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নাবীর দাওয়াতী মূলনীতি ছিল একটাই যে, আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ বা একত্ববাদের প্রতি আহ্বান ও শির্ক হতে বিরত রাখা।
২. পুরুষের ওপর মহিলার নেতৃত্ব দেয়া ঠিক নয়। কারণ তা অশান্তি ও ব্যর্থতার কারণ। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা কোন মহিলাকে নবুওয়াতের দায়িত্ব দেননি।
৩. দুনিয়া আখিরাতের তুলনায় অতি নগণ্য, আখিরাতই স্থায়ী এবং মু’মিনের জন্য চির সুখের স্থান। সুতরাং আখিরাতকেই সর্বাবস্থায় প্রাধান্য দেয়া উচিত।