৩৫-৩৭ নং আয়াতের তাফসীর:
(وَقَالَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا....)
উক্ত আয়াতে মুশরিকদের একটি ভুল ধারণা দূর করছেন। মুশরিকরা বলে: আমরা আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদত করি এবং শিরক করি, আমাদের বাপ-দাদারাও করেছিল এবং তাঁরই ইচ্ছায় অনেক জন্তু হারাম করে নিয়েছি। যেমন বাহিরা, সায়েবা, ওসিলা, হাম, ইত্যাদি। (এগুলোর পরিচয় সূরা মায়িদার ১০৩ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে) আামাদের এসকল কর্মে যদি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা না থাকত তাহলে তিনি আমাদেরকে এসব কাজ করতে সামর্থ্য দিতেন না এবং বাঁধা দিতেন। মুশরিকদের সাথে তাল মিলিয়ে অনেকে বলে থাকে: আমরা যে পাপ কাজ করি তা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় করি, আল্লাহ ইচ্ছা না করলে করতে পারতাম না। তাদের এসব ভুল ধারণার জবাব দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তাদের পূর্বের লোকেরা এসব বলেছিল, কিন্তু শাস্তি থেকে রেহাই পায়নি। এসব কাজের প্রতি যদি আল্লাহর ইচ্ছা থাকত তাহলে আল্লাহ কি শাস্তি দিতেন? কখনো না, তিনি যে কাজ ইচ্ছা করেন বা ভালবাসেন সে কাজের জন্য কাউকে শাস্তি দেবেন না, বরং তাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন।
আয়াতের পরের অংশ আরো সুস্পষ্ট করে দিয়েছে; তিনি যুগে যুগে রাসূল প্রেরণ করে ঐ জাতিকে শিরক থেকে বাধা প্রদান করেছেন। যদি শিরক পছন্দ করতেন তাহলে রাসূল প্রেরণ করে বাধা দিতেন না। বরং আরো উৎসাহ দিতেন। সুতরাং তাদের দাবী মিথ্যা ও ভ্রান্ত। আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা করেন তা দু’ প্রকার:
১. الإرادة الكونية
জাগতিক বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা, অর্থাৎ দুনিয়াতে যা কিছু হয় সব আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় হয়। যা তিনি ভালবাসেন তা এবং যা ভালবাসেন না তাও এ ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত।
২. الإرادة الشرعية
শরয়ী বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা। যা আল্লাহ তা‘আলা ভালবাসেন তা এ ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা কুফর, শিরক, পাপ কাজ ভালবাসেন না। তাই এগুলো আল্লাহ তা‘আলার এ ইচ্ছায় হয় না, ফলে তিনি এসব কাজের জন্য মানুষকে শাস্তি দেবেন।
(وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ....)
এখানে মূলত আল্লাহ তা‘আলার একত্বের কথা বলা হয়েছে। সকল ভ্রান্ত মা‘বূদদেরকে ছেড়ে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর নির্দেশ বাস্তবায়ন করার জন্যই আল্লাহ প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট যুগে যুগে বহু নাবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। সকলেই দাওয়াত দিয়েছেন এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার, সকল বাতিল মা‘বূদকে বর্জন করার।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَآ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَّسُوْلٍ إِلَّا نُوْحِيْٓ إِلَيْهِ أَنَّه۫ لَآ إِلٰهَ إِلَّآ أَنَا فَاعْبُدُوْنِ)
“আমি তোমার পূর্বে যখন কোন রাসূল প্রেরণ করেছি তার প্রতি এ ওয়াহী করেছি, ‘আমি ব্যতীত অন্য কোন সত্য মা‘বূদ নেই; সুতরাং আমারই ইবাদত কর।’’ (সূরা আম্বিয়া ২১:২৫)
তাগুতের তাফসীর সূরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুতরাং, যারা নাবীদের দেখানো পথ অনুযায়ী তাগুতকে বর্জন করে এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করেছে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সঠিক পথের হিদায়াত দান করেছেন। আর যারা নাবীদের মত চলেনি তাদের ওপর পথভ্রষ্টতার বাণী অবধারিত হয়ে গেছে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(هُوَ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كٰفِرٌ وَّمِنْكُمْ مُّؤْمِنٌ)
“তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ হয় কাফির এবং কেউ হয় মু’মিন।” (সূরা তাগাবুন ৬৪:২)
সুতরাং প্রত্যেকের উচিত রাসূলগণ যে পথের দিকে আহ্বান করেছেন সে পথেরই অনুসরণ করা। কেননা সেটাই হল সঠিক পথ আর বাকিগুলো হল শয়তানের পথ।
(إِنْ تَحْرِصْ عَلَي...)
এখানে বলা হচ্ছে যে, হিদায়াত দান করার একমাত্র মালিক আল্লাহ। রাসূল যতই চেষ্টা ও আশা করুক না কেন আল্লাহ যদি হিদায়াত দান না করেন তাহলে রাসূল কোন মানুষকেই হিদায়াত দান করতে পারবেন না। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন আবার যাকে ইচ্ছা গোমরাহ করেন। এ প্রকার হিাদয়াত হল (هداية التوفيق) হিদায়াতুত তাওফীক: সরল সঠিক পথের দিশা দান করতঃ তার ওপর মজবুত ও অটুট থাকার তাওফীক দান করা। এ প্রকার হিদায়াত শুধুমাত্র আল্লাহর হাতে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(إِنَّكَ لَا تَهْدِيْ مَنْ أَحْبَبْتَ وَلٰكِنَّ اللّٰهَ يَهْدِيْ مَنْ يَّشَا۬ءُ)
“তুমি যাকে ভালবাস, ইচ্ছা করলেই তাকে সৎ পথে আনতে পারবে না। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎ পথে আনয়ন করেন।” (সূরা ক্বাসাস ২৮:৫৬)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(مَنْ يُّضْلِلِ اللّٰهُ فَلَا هَادِيَ لَه۫ ط وَيَذَرُهُمْ فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ)
“আল্লাহ যাদেরকে পথভ্রষ্ট করেন তাদের কোন পথপ্রদর্শক নেই, আর তাদেরকে তিনি তাদের অবাধ্যতায় উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে ছেড়ে দেন।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৮৬)
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করে ভাল-মন্দ উভয় পথ দেখিয়ে দেয়ার পর তাকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। সে চাইলে সৎ পথ গ্রহণ করতে পারে, আবার অসৎ পথও গ্রহণ করতে পারে। তবে তিনি উভয় পথের ফলাফলও জানিয়ে দিয়েছেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানুষ কুফরী, অন্যায় ও পাপ কাজ করুক এটা আল্লাহ তা‘আলা ভালবাসেন না।
২. প্রত্যেক যুগে নাবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দিয়ে।
৩. হিদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তাই শুধু তাঁর কাছে হিদায়াত চাইতে হবে।