নামকরণ :
الصّٰفّٰتِ শব্দটি বহুবচন, এর একবচন হল صافة অর্থ সারিবদ্ধ হয়ে থাকা। সূরায় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা বলতে ফেরেশতাদেরকে বুঝানো হয়েছে। অত্র সূরার প্রথম আয়াত ও ১৬৫ নম্বর আয়াতে এ শব্দটি উল্লেখ রয়েছে, সেখান থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
এটি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সূরা। সূরার শুরুতে আনুগত্যশীল কয়েক শ্রেণির ফেরেশতার শপথ করে আল্লাহ তা‘আলার একত্বের কথা বলা হয়েছে, কাফির-মুশরিকরা পুনরুত্থানকে অসম্ভব মনে করে অথচ তা সত্য-সে কথা তুলে ধরা হয়েছে। জালিমদেরকে দলবদ্ধভাবে হাশর করা হবে, ভ্রান্ত পথের অনুসৃতরা অনুসারীদেরকে দোষারোপ করবে, কিন্তু তাতে কোন উপকার হবে না, বরং সবাই জাহান্নামে যাবে, জান্নাতীদের আরাম-আয়েশের কথা এবং জাহান্নাম ও তার অধিবাসীদের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম রাসূল নূহ (আঃ)-এর মধ্য হতে জাতির যারা মহা প্লাবন থেকে বেঁেচ গিয়েছিল এবং যারা নিমজ্জিত হয়েছিল তাদের কথা, ইবরাহীম (আঃ)-এর মূর্তি ভাঙার ঐতিহাসিক ঘটনা এবং পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানীর ঘটনা, মূসা (আঃ) ও ফির‘আউনের ঘটনা, ইউনুস (আঃ)-এর ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে। সূরার শেষের দিকে মুশরিকদের কর্তৃক ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার কন্যা বলে সাব্যস্ত করা থেকে আল্লাহ তা‘আলার পবিত্রতা ঘোষণা করা, নাবী-রাসূল ও যারা দীনের অনুসারী তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার সহযোগিতার আশ্বাস এবং সর্বশেষ যাদের আঙ্গিনায় আযাব চলে আসে তাদের সকাল যে খুবই ভয়াবহ হয় তা আলোচনা করা হয়েছে।
১-৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ)-সহ অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে
الصفات , الزجرات , التاليات
শব্দগুলো দ্বারা ফেরেশতাদের বুঝানো হয়েছে এবং তাদেরই তিনটি বিশেষণ উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথম বিশেষণ হচ্ছে : (وَالصّٰـٓفّٰتِ صَفًّا) ‘শপথ! তাদের যারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।’ الصّٰـٓفّٰتِ শব্দটি صف থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ কোন জনসমষ্টিকে এক সরল রেখায় সন্নিবেশিত করা (কুরতুবী)। তাই আয়াতের অর্থ হল সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো ফেরেশতাগণ।
অন্যত্র আল্লাহ ফেরেশতাদের সম্পর্কে বলেন :
(وَّإِنَّا لَنَحْنُ الصَّآفُّوْنَ - وَإِنَّا لَنَحْنُ الْمُسَبِّحُوْنَ)
“আর আমরা তো সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান। এবং আমরা তাসবীহ পাঠে নিয়োজিত আছি।” (সূরা সফফাত ৩৭ : ১৬৫-১৬৬)
ফেরেশতারা আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যপূর্ণ কাজে প্রাচীরের ন্যায় সারিবদ্ধ। ইবনু আব্বাস (রাঃ), হাসান বাসরী (রহঃ) প্রমুখ বলেন : ফেরেশতারা সদাসর্বদা শূন্যপথে সারিবদ্ধ হয়ে আল্লাহ তা‘আলার আদেশের অপেক্ষায় থাকে। যখনই কোন আদেশ করা হয় তখনই তা কার্যে পরিণত করে।
শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ :
আলোচ্য আয়াত থেকে জানা গেল যে, দীনের প্রত্যেক কাজে নিয়ম ও শৃঙ্খলা ও উত্তম রীতি-নীতির প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত এবং এটা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়। বলাবাহুল্য, আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত হোক আর তাঁর অন্য যে-কোন আদেশ পালন হোক, সারিবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে এলোমেলোভাবে একত্রিত হয়েও ফেরেশতারা করতে পারত। কিন্তু এহেন বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে তাদেরকে সারিবদ্ধ হওয়ার কথা বলে উক্ত গুণটিকে উত্তম এবং প্রশংসনীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সালাতে সারিবদ্ধ বা কাতারবদ্ধ হওয়ার গুরুত্ব : বস্তুত অত্র আয়াতে মানবজাতিকেও ইবাদতের সময় সারিবদ্ধ হওয়ার প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে এবং জোর তাকিদ দেওয়া হয়েছে।
সাহাবী হুযাইফাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তিনটি বিষয়ে আমাদেরকে সকল মানুষের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আমাদের কাতারগুলোকে করা হয়েছে ফেরেশতাদের কাতারের মতো। সমস্ত জমিনকে আমাদের জন্য মাসজিদ (সিজদা দেয়ার উপযুক্ত) করে দেয়া হয়েছে এবং এর মাটিকে আমাদের জন্য পবিত্র করে দেয়া হয়েছে যখন পানি না পাওয়া যাবে। (সহীহ মুসলিম হা. ৫২২)
জাবির ইবনু সামুরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : “ফেরেশতারা তাদের প্রতিপালকের সামনে যেভাবে দণ্ডায়মান হয় তোমরা সালাতে সেভাবে দণ্ডায়মান হও না কেন? সাহাবীগণ বলেন : আমরা বললাম, ফেরেশতারা কিভাবে দণ্ডায়মান হয়? তিনি বললেন : তাঁরা প্রথম কাতার পরিপূর্ণ করে নেয় এবং কাতারগুলোকে মিলিয়ে নেয়।” (সহীহ মুসলিম হা. ৪৩০)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতে আমাদের কাঁধের ওপর হাত রেখে বলতেন সোজা হও, আগ পিছ থেকো না। অন্যথায় তোমাদের অন্তরে অনৈক্য সৃষ্টি হবে। (সহীহ মুসলিম হা. ৪৩২) সুতরাং সালাতে কাতার পূর্ণ করা এবং সোজা করার গুরুত্ব অপরিসীম। এটা ঐক্যের প্রতীক, ভেদাভেদ দূরীকরণের মাধ্যম এবং ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির উপায়।
দ্বিতীয় বিশেষণ হচ্ছে : الزّٰجِرٰتِ এটা زجر থেকে উৎপন্ন। অর্থ হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া, ধমক দেয়া। এ বলে এখানে সে সকল ফেরেশতাদের বিশেষণ বর্ণনা করা হয়েছে যারা মেঘমালা হাঁকিয়ে নিয়ে যায়। অথবা যে সকল ফেরেশতারা বিভিন্ন ওয়াজ নসিহত এবং নাবীদের কাছে যে ওয়াহী করা হয় তার মাধ্যমে মাখলুককে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য কাজ হতে বাধা দেয়।
তৃতীয় বিশেষণ হচ্ছে : التَّالِيَاتِ দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার যিক্র আদায়কারী ও কালাম তেলাওয়াতকারী ফেরেশতাদেরকে বুঝানো হয়েছে। যারা সকাল সন্ধ্যায় উক্ত কাজে নিয়োজিত।
আল্লাহ তা‘আলা এ সকল আনুগত্যশীল ফেরেশতাদের শপথ করে বলছেন, তোমাদের প্রতিপালক একক, তাঁর কোন শরীক নেই। এভাবে শপথ করে আল্লাহ তা‘আলার এককত্ব বা তাওহীদের বাণী উল্লেখ করার কারণ হল মক্কার মুশরিকরা বহু মা‘বূদে বিশ্বাসী এবং একজন মা‘বূদ হওয়া অস্বীকার করত ও এতে আশ্চর্যবোধ করত।
যেমন আল্লাহ বলেন :
(أَجَعَلَ الْاٰلِهَةَ إلٰهًا وَّاحِدًا ﺊ إِنَّ هٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ)
“সে কি বহু উপাস্যের স্থানে একজন মাত্র উপাস্য সাব্যস্ত করে দিয়েছে? বস্তুত এটা এক আশ্চর্য ব্যাপার।” (সূরা সোয়াদ ৩৮ : ৫)
আল্লাহর এককত্বের প্রমাণস্বরূপ পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “তিনি আসমান ও জমিন এবং উভয়ের মাঝে অবস্থিত সব কিছুর প্রতিপালক এবং তিনি সকল উদয় স্থলের প্রতিপালক।” সুতরাং মা‘বূদ একজন, আর তিনি হলেন আল্লাহ।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِلٰهُكُمْ إِلٰهٌ وَّاحِدٌ ج لَآ إِلٰهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمٰنُ الرَّحِيْمُ)
“আর তোমাদের মা‘বূদ একমাত্র আল্লাহ। তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য মা‘বূদ নেই। তিনি করুণাময়, অতি দয়ালু।” (সূরা বাকারাহ ২ : ১৬৩)
অতএব যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্যান্য দেব-দেবীর পূজা করে সেসব দেব-দেবী প্রকৃত মা‘বূদ নয়, তারা ইবাদত পাওয়ার হকদার নয়। ইবাদত পাওয়ার প্রকৃত হকদার হলেন তিনি যিনি আকাশ ও জমিনসহ সব কিছু সৃষ্টি করেছেন, তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ তা‘আলা। তাই আমরা তাঁর ইবাদত করব, অন্য কারো নয়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. ফেরেশতারা যেভাবে কাতারবদ্ধ হয়ে মিলিয়ে দাঁড়ায় অনুরূপ মানুষেরও উচিত সালাতে একজন অপরজনের সাথে মিলে দাঁড়ানো, মাঝখানে কোন ফাঁকা না রাখা।
২. সকল কিছুর প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই।
৩. ফেরেশতারা যেভাবে সুন্দর করে দায়িত্ব পালন করে মানুষেরও উচিত অনুরূপ সুন্দরভাবে আল্লাহ তা‘আলার দেয়া দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করা।
৪. সকল ইবাদতের হকদার একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, যেহেতু তিনিই সকল কিছুর স্রষ্টা।