১২-১৫ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ ঐ লোকদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছেন যারা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়া সম্পর্কে ভয় করে। যদিও তারা নির্জনে অবস্থান করে, যেখানে কারো দৃষ্টি পড়বে না; তথাপিও তারা আল্লাহর ভয়ে তার অবাধ্যতামূলক কাজ করে না এবং তাঁর আনুগত্য ও ইবাদত হতে বিমুখ হয় না। আল্লাহ তা'আলা তাদের পাপরাশি মার্জনা করে দিবেন। যেমন সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছেঃ “সাত প্রকারের লোককে আল্লাহ তাঁর আরশের ছায়ায় এমন দিনে স্থান দিবেন যেই দিন তাঁর (আরশের) ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না।” তাদের মধ্যে এক প্রকার হলো ঐ ব্যক্তি যাকে এক সম্ভ্রান্ত বংশীয়া সুন্দরী মহিলা (ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে, কিন্তু সে উত্তরে বলেঃ “আমি আল্লাহকে ভয় করি (সুতরাং আমি তোমার সাথে এ কাজে লিপ্ত হতে পারি না)।” আর এক প্রকার হলো ঐ ব্যক্তি যে-গোপনে দান করে, এমনকি তার ডান হাত যা দান করে বাম হাত তা জানতে পারে না।”
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, সাহাবীগণ বলেনঃ "হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার সামনে আমাদের অন্তরের যে অবস্থা থাকে, আপনার সাহচর্য হতে পৃথক হওয়ার পর আমাদের অন্তরের ঐ অবস্থা আর থাকে না। (তাহলে কি আমরা মুনাফিকের মধ্যে গণ্য হবে?)।” তাঁদের এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বলেনঃ “তোমাদের প্রতিপালকের সাথে তোমাদের অবস্থা কি থাকে?” জবাবে তারা বললেনঃ “প্রকাশ্যে ও গোপনে আমরা ‘আল্লাহকেই আমাদের প্রতিপালক বলে স্বীকার করে থাকি।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “(তা হলে নিশ্চিন্ত থাকো,) তোমাদের এটা নিফাক বা কপটতা নয়।" (এ হাদীসটি হাফিয আবূ বকর আল বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ তোমরা তোমাদের কথা গোপনেই বল অথবা প্রকাশ্যে বল, তিনি তো অন্তর্যামী। অর্থাৎ তোমাদের অন্তরের খবরও তিনি জানেন। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টজীব হতে বে-খবর থাকবেন, এটা তো অসম্ভব। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তো সূক্ষ্মদর্শী ও সবকিছুই সম্যক অবগত।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ এরপর স্বীয় নিয়ামতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ তিনিই তো তোমাদের জন্যে ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন এটা স্থিরতার সাথে বিছানো রয়েছে। এটা মোটেই হেলা-দোলা করছে না। ফলে তোমরা এর উপর শান্তিতে বিচরণ করছে। এটা যেন নড়া-চড়া করতে না পারে তজ্জনে আল্লাহ পাক পাহাড় পর্বতকে এতে পেরেক রূপে মেরে দিয়েছেন। এতে তিনি পানির প্রস্রবণ প্রবাহিত করেছেন। বিভিন্ন প্রকারের উপকার তিনি এতে রেখে দিয়েছেন। এটা হতে তিনি ফল ও শস্য উৎপন্ন করছেন। তোমরা এখানে যথেচ্ছা ভ্রমণ করতে রয়েছে। এখানে তোমরা ব্যবসা বাণিজ্য করে অর্থ উপার্জন করতে রয়েছে। এভাবে তিনি তোমাদের জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করেছেন। তোমরা জীবিকা অর্জনের জন্যে চেষ্টা তদবীর করছে এবং আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা তোমাদের চেষ্টাকে সফল করছেন।
এর দ্বারা জানা গেল যে, জীবনোপকরণ লাভ করার জন্য চেষ্টা করা নির্ভরশীলতার পরিপন্থী নয়। যেমন মুসনাদে আহমাদে হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “তোমরা যদি আল্লাহর উপর যথাযোগ্য ভরসা করতে তবে তিনি তোমাদেরকে ঐভাবেই জীবিকা দান করতেন যেমনভাবে পাখীকে জীবিকা দান করে থাকেন, পাখী সকালে খালি পেটে যায় এবং সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে। (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহও (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন) সুতরাং পাখীর সকাল-সন্ধ্যায় জীবিকার সন্ধানে গমনাগমন করাকেও নির্ভরশীলতার অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হয়েছে। কেননা, উপকরণ সৃষ্টিকারী এবং ওটাকে সহজকারী একমাত্র আল্লাহ রাব্বল আলামীনই বটে। কিয়ামতের দিন তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন مَنَاكِب-এর অর্থ নিয়েছেন প্রান্ত এবং এদিক ওদিকের স্থান। হযরত কাতাদাহ (রঃ) প্রমুখ মনীষী বলেন যে, مَنَاكِب দ্বারা পাহাড় পর্বতকে বুঝানো হয়েছে।
হযরত বাশীর ইবনে কা'ব (রঃ) এ আয়াতটি পাঠ করার পর তাঁর ঐ দাসীকে, যার গর্ভে তাঁর সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল, বলেনঃ “তুমি যদি مَنَاكِب এর সঠিক তাফসীর বলতে পার তবে আমি তোমাকে আযাদ করে দিবো।” তখন ঐ দাসীটি বলে যে, এর দ্বারা পাহাড় উদ্দেশ্য। হযরত বাশীর (রঃ) তখন হযরত আবূ দারদা (রাঃ)-কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেন যে, এটা সঠিক তাফসীরই বটে।