আন-নযিআ'ত আয়াত ৩৩
مَتَاعًا لَّكُمْ وَلِاَنْعَامِكُمْۗ ( النازعات: ٣٣ )
Mataa'al lakum wali an 'aamikum. (an-Nāziʿāt ৭৯:৩৩)
English Sahih:
As enjoyment [i.e., provision] for you and your grazing livestock. (An-Nazi'at [79] : 33)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
এ সমস্ত তোমাদের আর তোমাদের গৃহপালিত পশুগুলোর জীবিকার সামগ্রী। (আন-নযিআ'ত [৭৯] : ৩৩)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
এসব তোমাদের ও তোমাদের পশুদের ভোগের সামগ্রী।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
এসব তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুগুলোর ভোগের জন্য।
3 Tafsir Bayaan Foundation
তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুগুলোর জীবনোপকরণস্বরূপ।
4 Muhiuddin Khan
তোমাদের ও তোমাদের চতুস্পদ জন্তুদের উপকারার্থে।
5 Zohurul Hoque
তোমাদের জন্য ও তোমাদের গবাদি-পশুর জন্য খাদ্যের আয়োজন।
6 Mufti Taqi Usmani
তোমাদের নিজেদের ও তোমাদের পশুদের ভোগের জন্য।
7 Mujibur Rahman
এ সবই তোমাদের ও তোমাদের জন্তুগুলির ভোগের জন্য।
8 Tafsir Fathul Mazid
২৭-৩৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
যারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করতঃ বলে : আমরা মারা গেলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব, কোন অস্তিত্ব থাকবে না, কিভাবে আবার সৃষ্টি করা সম্ভব? তাদের এরূপ চিন্তাধারাকে খণ্ডন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: সৃষ্টিগতভাবে তোমরা অধিক মজবুত না আকাশ? না, বরং আকাশ সৃষ্টিগতভাবে তোমাদের চেয়ে অধিক মজবুত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لَخَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ أَكْبَرُ مِنْ خَلْقِ النَّاسِ وَلٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُوْنَ)
“মানব সৃজন অপেক্ষা আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টি অবশ্যই অনেক বড় কাজ; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এটা জানে না।” (সূরা মু’মিন ৪০: ৫৭০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
(أَوَلَيْسَ الَّذِيْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضَ بِقٰدِرٍ عَلٰٓي أَنْ يَّخْلُقَ مِثْلَهُمْ ط بَلٰي ق وَهُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيْمُ)
“আর যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি সক্ষম নন এদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে? হ্যাঁ তিনি মহান স্রষ্টা ও মহা জ্ঞানী।” (সূরা ইয়াসিন ৩৬ : ৮১)
অতএব আকাশ সৃষ্টি করার চেয়ে পুনরায় মানুষকে জীবিত করা আল্লাহ তা‘আলার নিকট অতি সহজ ব্যাপার।
بَنٰهَا এ অংশটুকুর তাফসীর হলো পরের আয়াত
(رَفَعَ سَمْكَهَا فَسَوَّاهَا)
অর্থাৎ তিনি অত্যন্ত উঁচু, প্রশস্ত ও সমতল করে আকাশ সৃষ্টি করেছেন। তারপর অন্ধকার রাতে চমকিত ও উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজি ঐ আকাশের গায়ে বসিয়ে দিয়েছেন।
فَسَوَّاهَا বা সুবিন্যাস্ত করেছেন : অর্থাৎ তাকে এমন আকৃতি ও গঠন প্রদান করা, যাতে কোন প্রকার খুঁত, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ফাটল থাকেনা।
أَغْطَشَ অর্থ : أظلم অর্থাৎ আঁধার করা, আর أَخْرَج অর্থ أبرز বা বের করা, প্রকাশ করা। আয়াতে نهارها এর স্থানে ضحاها ব্যবহার করা হয়েছে এ জন্য যে, চাশতের সময়টা খুবই উত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ সময়। এর ভাবার্থ হলো : দিনকে সূর্য দ্বারা উজ্জ্বল করেছেন।
دَحَاهَا অর্থাৎ জমিনকে বিস্তৃত করেছেন। এ আয়াত প্রমাণ করে যে, জমিনকে সৃষ্টি করা হয়েছে আকাশ সৃষ্টি করার পর। এ আয়াত এবং
ثم استوي إلي السماء
এ আয়াতের মাঝে কোন বৈপরিত্য নেই। কারণ আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে জমিনকে অবিস্তৃত অবস্থায় সৃষ্টি করেছেন, তারপর আকাশ সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর জমিনকে বিস্তৃত করেছেন। অনেক বিদ্বানগণ বলেছেন : এখানে بعد বা পরে শব্দটি مع বা সাথে অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ তিনি আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, দিন ও রাত ইত্যাদি সৃষ্টি করার সাথে সাথে জমিনকে বিস্তৃত করেছেন। যেমন নিন্মোক্ত আয়াতগুলোতে بعد বা পরে শব্দটি مع বা সাথে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(عُتُلٍّۭ بَعْدَ ذٰلِکَ زَنِیْمٍ)
“কঠোর স্বভাবের তা সত্ত্বেও কুখ্যাত।” (সূরা কলাম ৬৮ : ১৩)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَقَدْ کَتَبْنَا فِی الزَّبُوْرِ مِنْۭ بَعْدِ الذِّکْرِ اَنَّ الْاَرْضَ یَرِثُھَا عِبَادِیَ الصّٰلِحُوْنَ)
“আমি অবশ্যই লাওহে মাহফুযে যা লেখার তা লেখার পর নাযিলকৃত আসমানী কিতাবে লিখে দিয়েছি যে, আমার সৎকর্মশীল বান্দাগণ পৃথিবীর অধিকারী হবে।” (সূরা আম্বিয়া ২১: ১০৫, ফাতহুল কাদীর)
(أَخْرَجَ مِنْهَا مَا۬ءَهَا.....)
হাফেয ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এ আয়াতটি পূর্বের আয়াতের তাফসীর।
أَرْسٰهَا অর্থাৎ পাহাড়গুলোকে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছেন। আকাশ-জমিন, চন্দ্র-সূর্যকে বিস্তৃত করা, জমিনে পানির উৎস সৃষ্টি করা, দিন-রাতসহ সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষ ও পশুর ভোগের জন্য। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা এত সুন্দর করে আকাশ সৃষ্টি করলেন, তাকে সুবিন্যন্ত করলেন, তারকা দ্বারা সুসজ্জিত করলেন, দিন-রাত দিলেন, জমিন দিলেন, তা থেকে পানি উদ্গত করলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। তাই আমাদের উচিত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই মানুষকে পুনরুত্থিত করবেন এবং এটা আল্লাহ তা‘আলার জন্য অত্যন্ত সহজ।
২. সব কিছু আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেছেন মানুষের উপকারার্থে আর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য।
৩. আকাশ ও জমিনের সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
9 Fozlur Rahman
তোমাদের ও তোমাদের পশুদের উপকারের জন্য।
10 Mokhtasar Bangla
৩৩. হে মানব সমাজ! এ সব কিছু তোমাদের এবং তোমাদের পশুজগতের উপকরার্থেই তৈরি করা হয়েছে। বস্তুতঃ যিনি এ সৃষ্টিকুল সৃষ্টি করলেন তিনি এদের সৃষ্টির কাজকে নতুনভাবে পুনর্বার সম্পন্ন করতে অপারগ নন।
11 Tafsir Ibn Kathir
২৭-৩৩ নং আয়াতের তাফসীর
যারা মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস করতো না তাদের সামনে আল্লাহ তাআলা যুক্তি পেশ করছেন যে, আকাশ সৃষ্টি করার চেয়ে মৃত মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করা আল্লাহর নিকট বহুগুণে সহজ ব্যাপার। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ
لَخَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ اَكْبَرُ مِنْ خَلْقِ النَّاسِ
অর্থাৎ “আসমান ও জমীন সৃষ্টি করা মানুষ সৃষ্টি অপেক্ষা বহুগুণে কঠিন কাজ।" (৪০:৫৭) অন্য এক আয়াতে আল্লাহ পাক বলেনঃ
اَوَ لَیْسَ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ بِقٰدِرٍ عَلٰۤى اَنْ یَّخْلُقَ مِثْلَهُمْ بَلٰى وَ هُوَ الْخَلّٰقُ الْعَلِیْمُ
অর্থাৎ “যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সমর্থ নন? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি মহা স্রষ্টা, সর্বজ্ঞ।” (৩৬:৮১) ।
তিনি অত্যন্ত উঁচু, প্রশস্ত ও সমতল করে আকাশ সৃষ্টি করেছেন। তারপর অন্ধকার রাত্রে চমকিত ও উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজি ঐ আকাশের গায়ে বসিয়ে দিয়েছেন। তিনি অন্ধকার কৃষ্ণকায় রাত্রি সৃষ্টি করেছেন। দিনকে উজ্জ্বল এবং আলোকমণ্ডিত করে সৃষ্টি করেছেন। জমীনকে তিনি বিছিয়ে দিয়েছেন। পানি এবং খাদ্যদ্রব্যও তিনি বের করেছেন। সূরা হা-মীম সাজদায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, আকাশের পূর্বেই জমীন সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে যমীনের বিস্তৃতিকরণ আকাশ সৃষ্টির পরে ঘটেছে। এখানে এটাই বর্ণনা করা হচ্ছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং বহু সংখ্যক তাফসীরকার এ রকমই বর্ণনা করেছেন। ইবনে জারীরও (রঃ) এই উক্তিটি পছন্দ করেছেন। পাহাড়সমূহকে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছেন। তিনি বিজ্ঞানময় এবং অভ্রান্ত ও সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর সৃষ্টজীবের প্রতি দয়ালু ও পরম করুণাময়।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যখন আল্লাহ তা'আলা যমীন সৃষ্টি করেন তখন তা দুলতে শুরু করে। সূতরাং তিনি তখন পাহাড় সৃষ্টি করে যমীনের বুকে স্থাপন করে দেন। ফলে যমীন স্থির ও নিশ্চল হয়ে যায়। এতে ফেরেশতামণ্ডলী খুবই বিস্মিত হন। তাঁরা আল্লাহকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ের অপেক্ষাও অধিক শক্ত অন্য কিছু আছে কি?" তিনি উত্তরে বলেন! হ্যা আছে। তা হলে লোহা।” ফেরেশতাগণ পুনরায় প্রশ্ন করেনঃ “লোহা অপেক্ষাও কঠিনতর কিছু আছে কি?" আল্লাহ তা'আলা জবাবে বলেনঃ “হ্যা, আছে। তা হলো আগুন। ফেরেশতারা আবার জিজ্ঞেস করেনঃ “আগুন অপেক্ষাও বেশী কঠিন কিছু কি আছে?” আল্লাহ তা'আলা উত্তর দেনঃ “হ্যা আছে। তা হলো পানি।” তাঁরা পুনরায় প্রশ্ন করেন “পানির চেয়েও বেশী কঠিন কিছু আছে কি?” তিনি জবাবে বলেনঃ “হ্যা, আছে। তা হচ্ছে বাতাস।" তারা আবারও প্রশ্ন করেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সৃষ্টির মধ্যে বায়ু অপেক্ষাও অধিক কঠিন কিছু কি আছে? তিনি জবাব দেনঃ “হ্যা আছে। সে হলো ঐ আদম সন্তান যে তার ডান হাতে যা খরচ (দান) করে বাম হাত তা জানতে পারে না।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণনা করা হয়েছে)
হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আল্লাহ যখন যমীন সৃষ্টি করেন তখন তা কাঁপতে থাকে এবং বলতে থাকেঃ “আপনি আমার উপর আদম (আঃ)-কে এবং তাঁর সন্তানদেরকে সৃষ্টি করলেন যারা আমার উপর তাদের ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ করবে এবং আমার উপরে অবস্থান করে পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়বে? তখন আল্লাহ তা'আলা পাহাড় স্থাপন করে যমীনকে স্থির ও নিশ্চল করে দেন। তোমরা বহু সংখ্যক পাহাড় পর্বত দেখতে পাচ্ছ। আরো বহু পাহাড় তোমাদের দৃষ্টির অগোচরে রয়েছে। পর্বতরাজি স্থাপনের পর যমীনের স্থির হয়ে যাওয়া ঠিক তেমনিই ছিল যেমন উট যবেহ করার পর ওর গোশত কাঁপতে থাকে এবং কিছুক্ষণ কম্পনের পর স্থির হয়ে যায়।” (এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আবু জাফর ইবনে জারীর (রঃ)। কিন্তু এটা অত্যন্ত গারীব বা দুর্বল হাদীস)
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ এসব কিছু তোমাদেরও তোমাদের জন্তুগুলোর উপকারের জন্যে ও উপভোগের জন্যে (সৃষ্টি করা হয়েছে)। অর্থাৎ যমীন হতে কূপ ও ঝর্ণা বের করা, গোপনীয় খনি প্রকাশিত করা, ক্ষেতের ফসল ও গাছ-পালা জন্মাননা, পাহাড়-পর্বত স্থাপন করা ইত্যাদি, এগুলোর ব্যবস্থা আল্লাহ করেছেন যাতে তোমরা জমীন হতে পুরোপুরি লাভবান হতে পার। সবকিছুই মানুষের এবং তাদের পশুদের উপকারার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে। ঐসব পশুও তাদেরই উপকারের উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন। তারা কোন পশুর গোশত ভক্ষণ করে, কোন পশুকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে এবং এই পৃথিবীতে সুখে-শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করে থাকে।