আবাসা আয়াত ১৬
كِرَامٍۢ بَرَرَةٍۗ ( عبس: ١٦ )
Kiraamim bararah. (ʿAbasa ৮০:১৬)
English Sahih:
Noble and dutiful. ('Abasa [80] : 16)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
(যারা) মহা সম্মানিত পূত-পবিত্র। (আবাসা [৮০] : ১৬)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
(যারা) সম্মানিত ও পুণ্যবান (ফিরিশতা)। [১]
[১] চরিত্রের দিক দিয়ে তাঁরা হলেন সম্মানিত; অর্থাৎ, শ্রদ্ধেয় এবং বুযুর্গ। আর কর্মের দিক দিয়ে তাঁরা পুণ্যবান ও পবিত্র। এখান থেকে জানা যায় যে, কুরআন বহনকারী (হাফেয এবং আলেমগণ)-কেও চরিত্র এবং কর্মের দিক দিয়ে 'কিরামিম বারারাহ'র মূর্ত-প্রতীক হওয়া উচিত। (ইবনে কাসীর) হাদীসেও 'সাফারাহ' শব্দ ফিরিশতাদের জন্য ব্যবহার হয়েছে। নবী (সাঃ) বলেছেন, "যে কুরআন পাঠ করে এবং তাতে সুদক্ষ হয়, সে 'কিরামিম বারারাহ'র সাথে - অর্থাৎ, সম্মানিত পুণ্যবান ফিরিশতাগণের সাথী হবে। আর যে কুরআন পাঠ করে কিন্তু কষ্টের সাথে (আটকে আটকে) পাঠ করে তার জন্য ডবল সওয়াব রয়েছে।" (সহীহ বুখারী তাফসীর সূরা আবাসা, মুসলিম নামায অধ্যায়, কুরআনে সুদক্ষ হওয়ার মাহাত্ম্যের পরিচ্ছেদ)
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
(যারা) মহাসম্মানিত ও নেককার।
3 Tafsir Bayaan Foundation
যারা মহাসম্মানিত, অনুগত।
4 Muhiuddin Khan
যারা মহৎ, পূত চরিত্র।
5 Zohurul Hoque
সম্মানিত, গুণান্নিত।
6 Mufti Taqi Usmani
যারা অতি মর্যাদাসম্পন্ন, পুণ্যবান।
7 Mujibur Rahman
(ঐ লেখকগণ) মহৎ ও সৎ।
8 Tafsir Fathul Mazid
নামকরণ:
عَبَسَ আবাসা শব্দের অর্থ ভ্রুকুঞ্চিত করা বা মুখ ভার করা। প্রথম আয়াতে উল্লিখিত এ শব্দ থেকে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
সূরায় কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে:
যেমন সমাজের দুর্বল মানুষদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রভাব ও বিত্তশালীদের প্রতি মনোনিবেশ করার কারণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তিরস্কার করা, কুরআনের গুরুত্ব ও মর্যদার বর্ণনা কয়েকটি নেয়ামতের দিকে ভাবনার দৃষ্টিতে দেখার নির্দেশ এবং আখিরাতের ভাল মন্দের প্রতিদান ইত্যাদি।
১-১৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
সূরাটি সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। একদা নাবী (সাঃ) কুরাইশ নেতাদের নিয়ে আলোচনা করছিলেন এ আশায় যে, হয়তো তারা ইসলাম গ্রহণ করবে। এমতাবস্থায় হঠাৎ ঐ মাজলিসে আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম (রাঃ) উপস্থিত হয়ে বলেন : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাঃ) ! আমাকে সঠিক পথ দেখান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটু বিরক্তি ভাব পোষণ করে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তাই নাবী (সাঃ)-কে সতর্ক করে এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। (তিরমিযী সূরা আবাসার তাফসীর)
আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম (রাঃ) অনেক আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। (ইবনু কাসীর) আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে খুবই সমাদর করতেন। (মুসনাদে আবূ ইয়ালা হা. ৩১২৩) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যুদ্ধে যাওয়াকালে তাকে প্রায়ই মদীনার প্রশাসকের দায়িত্ব দিয়ে যেতেন। ঐতিহাসিকগণ বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বদর, ওহুদ ও বিদায় হাজ্জসহ মোট ১৩ বার মদীনা ত্যাগকালে তাকে মদীনার দায়িত্ব দিয়ে যান। (ইবনু হাজার, আল ইসাবাহ হা. ৫৭৫৯) বেলাল তাহাজ্জুতের আযান দিতেন আর আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম ফযরের আযান দিতেন। (সহীহ বুখারী হা. ৬১৭) এসব ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পক্ষ হতে বিশেষ মর্যাদা দানের ফল। এ মর্যাদার কারণ হল তার শানে উক্ত আয়াতগুলো নাযিল হওয়া।
এ ধরণের দরিদ্র কয়েকজন সাহাবীর ব্যাপারে আরো কিছু আয়াত নাযিল হয়েছে যারা সর্বদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে থাকতেন। মক্কার কাফিররা তিরস্কার করে বলত : হে মুহাম্মাদ! এ লোকগুলোকেই কি আল্লাহ তা‘আলা বেছে নিয়ে আপনার ওপর অনুগ্রহ করেছেন? আর আমরা এদের আনুগত্য করব? এদের সরিয়ে দিন। তাহলে আমরা আপনার অনুসারী হতে পারি। তখন সূরা আন‘আমের ৫২-৫৩ নম্বর আয়াত নাযিল হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تَطْرُدِ الَّذِیْنَ یَدْعُوْنَ رَبَّھُمْ بِالْغَدٰوةِ وَالْعَشِیِّ یُرِیْدُوْنَ وَجْھَھ۫ﺚ مَا عَلَیْکَ مِنْ حِسَابِھِمْ مِّنْ شَیْءٍ وَّمَا مِنْ حِسَابِکَ عَلَیْھِمْ مِّنْ شَیْءٍ فَتَطْرُدَھُمْ فَتَکُوْنَ مِنَ الظّٰلِمِیْنَﮃوَکَذٰلِکَ فَتَنَّا بَعْضَھُمْ بِبَعْضٍ لِّیَقُوْلُوْٓا اَھٰٓؤُلَا۬ئِ مَنَّ اللہُ عَلَیْھِمْ مِّنْۭ بَیْنِنَاﺚ اَلَیْسَ اللہُ بِاَعْلَمَ بِالشّٰکِرِیْنَ)
“যারা তাদের প্রতিপালককে সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ডাকে তাদেরকে তুমি বিতাড়িত কর না। তাদের কর্মের জবাবদিহির দায়িত্ব তোমার নয় এবং তোমারও কোন কর্মের জবাবদিহির দায়িত্ব তাদের নয় যে, তুমি তাদেরকে বিতাড়িত করবে; করলে তুমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আমি এভাবে তাদের একদলকে অন্যদল দ্বারা পরীক্ষা করেছি যেন তারা বলে, ‘আমাদের মধ্যে কি এদের প্রতিই আল্লাহ অনুগ্রহ করলেন? আল্লাহ কি কৃতজ্ঞ লোকদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত নন?” (সূরা আন‘আম ৬: ৫২-৫৩)
الْأَعْمٰي অন্ধ ব্যক্তি দ্বারা উদ্দেশ্য আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম।
(وَمَا يُدْرِيْكَ) অর্থাৎ
أي شئ يجعلك عالما بحقيقة أمره؟
কোন্ জিনিস তোমাকে তার প্রকৃত ব্যাপার অবগত করেছে? অর্থাৎ তুমি তার প্রকৃত ব্যাপার জাননা।
এ আয়াতগুলো প্রমাণ করছে, নাবী (সাঃ) গায়েব জানতেন না। তিনি কেবল ততটুকুই জানতেন যতটুকু তাকে ওয়াহীর মাধ্যমে জানানো হত। আর এও প্রমাণ করে যে, তিনি দীনের কোন বিধান লুকাননি। যদি গোপন করতেন তাহলে তাঁকে তিরস্কারমূলক আয়াতগুলো গোপন করতেন। আয়িশাহ (রাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি বলবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহ তা‘আলার দীনের কোন কিছু গোপন করেছেন সে তাঁর প্রতি মিথ্যারোপ করবে।
ইমাম রাযী (রহঃ) বলেন : নাবীদেরকে যারা নিষ্পাপ মনে করে না, তারা এ ঘটনা থেকে দলীল গ্রহণ করে নাবী (সাঃ)-কে গুনাহগার বানাতে চায়। অথচ এটি কোন গুনাহর বিষয় নয়। কেননা এ অন্ধ সাহাবী পূর্ব থেকেই মুসলিম ছিলেন।
এ আয়াত থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে, শীয়াদের দাবী মিথ্যা, বানোয়াট। কেননা তারা বলে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে যে কুরআন শিক্ষা দিয়েছিলেন, যাকে ‘মুসহাফে ফাতেমা’ বলা হয় তা এ কুরআনের চাইতে তিনগুণ বড় এবং বর্তমান কুরআনের একটি হরফও সেখানে নেই। (আশ শীয়া ওয়াস সুন্নাহ, ইহসান ইলাহী জহীর, পৃ : ৮০-৮১)
(مَنِ اسْتَغْنٰي)
অর্থাৎ যারা তোমার হিদায়াত থেকে বিমুখ হয়, তোমার হিদায়াত প্রয়োজন মনে করে না, অথচ তুমি তাদের নিয়েই ব্যস্ত। হিদায়েতের মালিক তুমি নও বরং তোমার দায়িত্ব কেবল পৌঁছে দেয়া, তুমি তাই কর।
(وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكّٰ)
অর্থাৎ তোমার কাজ তো কেবল প্রচার করা। সুতরাং এই শ্রেণির কাফিরদের পেছনে পড়ে থাকার কোন প্রয়োজন নেই।
(كَلَّآ إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ)
অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ! তুমি যে কাজ করেছো তা উচিত হয়নি। এ সূরা তোমার ও যারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায় তাদের জন্য শিক্ষা। অতএব আগামীতে যেন এরূপ না হয়। (তাফসীর মুয়াসসার)
তাই দাওয়াতী কাজে গরীব-মিসকীন ও নিম্নশ্রেণির মানুষ উপেক্ষা করে চলা আদৌ উচিত নয়। কারণ কার ভাগ্যে হিদায়াত আছে আর কার দ্বারা ইসলামের উপকার হবে তা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কেউ জানে না।
(فَمَنْ شَا۬ءَ ذَكَرَه۫)
অর্থাৎ যে ব্যক্তির নিকট সত্যের দাওয়াত পৌঁছেছে এখন সে ইচ্ছা করলে যেন সত্য কবুল করতঃ আমল করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ قف فَمَنْ شَا۬ءَ فَلْيُؤْمِنْ وَّمَنْ شَا۬ءَ فَلْيَكْفُرْ)
“বল: ‘সত্য তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে এসেছে; সুতরাং যার ইচ্ছা ঈমান আনুক ও যার ইচ্ছা কুফরী করুক।” (সূরা কাহ্ফ ১৮: ২৯)
অতঃপর এ উপদেশবাণীর অবস্থান ও মর্যাদার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(فِيْ صُحُفٍ مُّكَرَّمَةٍ)
বা সম্মানিত সহিফা অর্থাৎ লওহে মাহফূজে লিপিবদ্ধ যার মর্যাদা সুউচ্চ এবং যা সকল প্রকার নাপাকি ও কম-বেশি থেকে পবিত্র।
(بأَيْدِيْ سَفَرَةٍ) سافر
এর অর্থ হলো: দূত। ইমাম বুখারী ও ইবনু জারীরসহ অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে سفرة হলো ফেরেশতা। আর এটাই সঠিক। (ইবনু কাসীর) অর্থাৎ ফেরেশতারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলদের মাঝে দূতের কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকে।
(كِرَامٍ ۭبَرَرَةٍ)
অর্থাৎ কুরআন বহনকারী ফেরেশতারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী এবং কাজকর্ম, কথায় পূত পবিত্র ও উত্তম। তাই প্রতিটি মু’মিন যারা কুরআনের ধারক বাহক তাদের এমন চরিত্রের অধিকারী হওয়া দরকার। আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন :
الماهر بالقرآن مع السفرة الكرام البررة، والذي يقرأ القرآن ويتتعتع فيه، وهو عليه شاق، له أجران
যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং সে তাতে সুদক্ষ সে কিরামিম বারারাহ বা সম্মানিত পূন্যবান ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে কিন্তু কষ্টের সাথে (পড়তে গেলে আটকে যায়) তার জন্য দ্বিগুণ নেকী রয়েছে। (সহীহ মুসলিম হা. ৭৯৮)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম <-এর ফযীলত জানতে পারলাম।
২. যারা সাগ্রহে দীন গ্রহণ ও শিক্ষা নিতে চায় তাদেরকে সে বিষয়ে সময় ও সুযোগ করে দেয়া আবশ্যক তিনি যেই হোক না কেন।
৩. কুরআনের ধারক-বাহকদের কেমন চরিত্রের অধিকারী হওয়া উচিত তা জানতে পারলাম।
৪. কুরআন তেলাওয়াতকারীদের ফযীলত জানলাম।
9 Fozlur Rahman
যারা সম্মানিত ও পুণ্যবান।
10 Mokhtasar Bangla
১৬. যারা স্বীয় প্রতিপালকের নিকট সম্মানিত এবং প্রচুর কল্যাণকর ও আনুগত্যপূর্ণ কাজ সম্পাদনকারী।
11 Tafsir Ibn Kathir
১-১৬ নং আয়াতের তাফসীর
বহু তাফসীরকার লিখেছেন যে, একদা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) কুরায়েশ নেতাদেরকে ইসলামের শিক্ষা, সৌন্দর্য ও আদর্শ সম্পর্কে অবহিত করছিলেন এবং সেদিকে গভীর মনোযোগ দিয়েছিলেন। তিনি আশা করছিলেন যে, হয়তো আল্লাহ্ তা'আলা তাদেরকেই ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য দান করবেন। ঐ সময়ে হঠাৎ আব্দুল্লাহ্ ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ) নামক এক অন্ধ সাহাবী তাঁর কাছে এলেন। ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ) বহু পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। প্রায়ই তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কাছে হাযির থাকতেন এবং ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। মাসআলা মাসায়েল জিজ্ঞেস করতেন। সেদিনও তার আচরিত অভ্যাসমত এসে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন এবং সামনে অগ্রসর হয়ে তাঁর প্রতি তার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মহানবী (সঃ) তখন একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এ জন্যে তিনি আব্দুল্লাহ্ (রাঃ)-এর প্রতি তেমন মনোযোগ দিলেন না। তাঁর প্রতি তিনি কিছুটা বিরক্তও হলেন। ফলে তার কপাল কুঞ্চিত হলো। এরপর এই আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ্ তা'আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ হে রাসূল (সঃ)। তোমার উন্নত মর্যাদা ও মহান চরিত্রের জন্যে এটা শোভনীয় নয় যে, একজন অন্ধ আমার ভয়ে তোমার কাছে ছুটে এলো, ধর্ম সম্পর্কে কিছু জ্ঞান লাভের আশায়, অথচ তুমি তার দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অহংকারী ও উদ্ধতদের প্রতি মনোযোগী হয়ে গেলে? পক্ষান্তরে সে ব্যক্তি তোমার কাছে এসেছিল, তোমার মুখ থেকে আল্লাহর বাণী শুনে পাপ ও অন্যায় হতে। বিরত থাকার সম্ভাবনা ছিল তার অনেক বেশী। সে হয়তো ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতো। অথচ তুমি সেই অহংকারী ধনী লোকদের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করলে এ কেমনতর কথা? ওদের সৎ পথে নিয়ে আসতেই হবে এমন দায়িত্ব তো তোমার উপর নেই। ওরা যদি তোমার কথা না মানে তবে তাদের দুষ্কৃতির জন্যে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে না। অর্থাৎ ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে বহু ছোট, ধনী-গরীব, সবল-দুর্বল, আযাদ-গোলাম এবং পুরুষ ও নারী সঝই সন। তুমি সবাইকে সমান নসীহত করবে। হিদায়াত আকার হাতে রয়েছে। আল্লাহ যদি কাউকে সৎ পথ থেকে দূরে রাখেন তবে তাৰ বুহস্য তিনিই জানেন, আর যদি কাউকে সৎপথে নিয়ে আসেন সেটার বৃহস্যও তিনিই ভাল জানেন।
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ) যখন এসেছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উবাই ইবনে খালুফের সাথে কথা বলছিলেন। এরপর থেকে নবী (সঃ) হযরত ইবনে উন্মি মাকতুম (রাঃ)-কে খুবই সম্মান করতেন এবং তাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানাতেন।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেনঃ আমি ইবনে উম্মি মাকতূম (রাঃ)-কে কাদেসিয়ার যুদ্ধে দেখেছি যে, তিনি বর্ম পরিহিত অবস্থায় কালো পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ যখন ইবনে উন্মি মাকতুম (রাঃ) এসে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বললেনঃ “আমাকে দ্বীনের কথা শিক্ষা দিন”, তখন কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সামনে উপস্থিত ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাদেরকে ধর্মের কথা শোনাচ্ছিলেন আর জিজ্ঞেস করছিলেনঃ “বল দেখি, আমার কথা সত্য কি-না?” তারা উত্তরে বলছিলঃ “জ্বী, আপনি যথার্থই বলছেন। তাদের মধ্যে উত্বা ইবনে রাবীআহ, আবু জাহল ইবনে হিশাম এবং আব্বাস ইবনে আবদিল। মুত্তালিবও ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) মনে প্রাণে চাচ্ছিলেন যে, এরা যেন মুসলমান হয়ে যায় এবং সত্য দ্বীন গ্রহণ করে। এমনি সময়ে ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ) এসে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে কুরআনের কোন একটি আয়াত শুনিয়ে আল্লাহর কথা শিক্ষা দিন!” ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ)-এর কথা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কাছে অসময়োচিত মনে হলো, তিনি মুখ ফিরিয়ে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। তাদের সাথে কথা শেষ করে ঘরে ফেরার সময় রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর মাথা ছিল নীচু, চোখের সামনে ছিল অন্ধকার। এই আয়াত ততক্ষণে নাযিল হয়ে গেছে। তারপর থেকে নবী (সঃ) ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ)-কে খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন এবং অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তাঁর কথা শুনতেন। আসা-যাওয়ার সময়ে জিজ্ঞেস করতেন যে, তাঁর কোন প্রয়োজন আছে কি-না, কোন কথা আছে কি-না এবং কোন কিছু তিনি চান কি-না। এখানে উল্লেখ্য যে, হাদীসের সংজ্ঞায় এই বর্ণনাটি গারীব এবং এর সনদ সম্পর্কেও কথা আছে।
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “বিলাল (রাঃ) রাত থাকতেই আযান দেয়, সুতরাং তখন তোমরা পানাহার করবে, আব্দুল্লাহ্ ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ) আযান না দেয়া পর্যন্ত খেতে থাকবে, তার আযান শোনা মাত্র পানাহার বন্ধ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) ইনি সেই দৃষ্টিহীন লোক যার সম্পর্কে সূরা عَبَسَ وَ تَوَلّٰۤى ـ اَنْ جَآءَهُ الْاَعْمٰى অবতীর্ণ হয়েছে। ইনিও মুআযযিন ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ছিল ত্রুটিপূর্ণ, পাশের লোকেরা যখন বলতো যে, সুবহে সাদেক হয়ে গেছে তখন তিনি আযান দিতেন।
সুপ্রসিদ্ধ মত এই যে, তার নাম আবদুল্লাহ্ (রাঃ)। কেউ কেউ বলেন যে, তাঁর নাম আমর (রাঃ)। অবশ্য এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
كَلَّآ اِنَّهَا تَذْكِرَةٌ অর্থাৎ না, এই আচরণ অনুচিত, এটা তো উপদেশ বাণী। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয়তো এই সূরা অথবা ইলমে দ্বীন প্রচারের ব্যাপারে মানুষের মাঝে ইতর-ভদ্র নির্বিশেষে সমতা রক্ষার উপদেশ, যে, তাবলীগে দ্বীনের ক্ষেত্রে ছোট-বড়, ইতর-দ্র সবাই সমান। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, تَذْكِرَة দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হয়েছে।
যে ইচ্ছা করবে সে এটা স্মরণ রাখবে। অর্থাৎ আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং সকল কাজ-কর্মে তাঁর ফরমানকেই অগ্রাধিকার দিবে ? ক্রিয়া ذَكَرَ সঙ্গীয় যমীর বা সর্বনাম দ্বারা অহীর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই সূরা, এই নসীহত তথা সমগ্র কুরআন সম্মানিত ও নির্ভরযোগ্য সহীফায় সংরক্ষিত রয়েছে, যা অতি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। যা অপবিত্রতা হতে মুক্ত এবং যা কমও করা হয় না বা বেশীও করা হয় না।
سَفَرَة অর্থ ফেরেশতাগণ, তাঁদের পবিত্র হাতে কুরআন রয়েছে। এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত যহহাক (রঃ) এবং হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ)-এর উক্তি। অহাব ইবনে মুনাব্বাহ্ (রঃ) বলেন যে, سَفَرَة দ্বারা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর সাহাবীদেরকে বুঝানো হয়েছে। কাতাদা (রঃ) বলেন। যে, তারা হচ্ছেন কুরআনের পাঠকগণ। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এটা নতী ভাষার শব্দ, যার অর্থ হলো কারিগণ। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-এর মতে এর দ্বারা ঐ ফেরেশতাদেরকেই বুঝানো হয়েছে যারা আল্লাহ্ এবং তার মাখলুকের মাঝে সাফীর বা দূত হিসেবে রয়েছেন। তিনি এটাকেই সঠিক উক্তি বলেছেন।
যারা মানুষের মধ্যে সমঝোতা, আপোষ-মীমাংসা এবং কল্যাণের জন্যে চেষ্টা করেন তাদেরকে সাফীর বা দূত বলা হয়। যেমন কবি বলেনঃ
وما ادع السفارة بين قومى ـ وما امشى بغش ان مشيت
অর্থাৎ “আমি আমার সম্প্রদায়ের মাঝে দৌত্যকার্য পরিত্যাগ করি না এবং আমি চললে অচৈতন্য হয়ে চলি না।”
ইমাম বুখারী (রঃ) বলেন যে, এখানে سَفَرَة দ্বারা ফেরেশতাদেরকেই বুঝানো হয়েছে যারা আল্লাহ্ তা'আলার নিকট হতে অহী ইত্যাদি নিয়ে আসেন। তাঁরা মানুষের মাঝে শান্তি রক্ষাকারী দূতদেরই মত। তাদের চেহারা সুন্দর, পবিত্র ও উত্তম এবং তাঁদের চরিত্র ও কাজকর্মও পূত-পবিত্র ও উত্তম। এখান হতে এটাও জানা যায় যে, কুরআন পাঠকদের আমল-আখলাক অর্থাৎ কাজকর্ম ও চরিত্র ভাল হতে হবে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে ও তাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করে সে মহান ও পূত-পবিত্র লিপিকর ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কুরআন পাঠ করে তার জন্যে দ্বিগুণ পুণ্য রয়েছে।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)