আল্লাহ তা'আলা বলেন, ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বড় অত্যাচারী ও অবাধ্য আর কে হতে পারে যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে, তার ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলে এবং ঝুটমুট এই দাবী করে বসে যে, সে আল্লাহ হতে প্রেরিত? এই ব্যক্তি অপেক্ষা বড় অপরাধী ও গুনাহগার আর কেউ হতে পারে কি? এ কথা তো কোন স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন ও বোকা লোকের কাছেও গোপনীয় নয়। তাহলে বুদ্ধিমান ও নবীদের কাছে কিভাবে এটা গোপন থাকতে পারে। যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করে সে সত্যবাদী হাক বা মিথ্যাবাদী হাক, আল্লাহ তার সুকর্ম ও কুকর্মের উপর দলীল কায়েম করে থাকেন যা সূর্যের চেয়েও অধিক প্রকাশমান। সুতরাং যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সঃ) ও মুসাইলামা কাযযাবকে দেখেছে সে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ঠিক এভাবেই করতে পারবে যেভাবে দিনের আলো ও রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। এখন দু’জনের স্বভাব-চরিত্র, কার্যাবলী এবং কথাবার্তার মধ্যে তুলনা করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে যে, মুহাম্মাদ (সঃ)-এর কথা ও কাজের মধ্যে কি পরিমাণ সততা ও সত্যবাদিতা ছিল, আর মুসাইলামা কাযযাব সাজাহ এবং আসওয়াদ আনসারীর মধ্যে কি পরিমাণ মিথ্যা ও বেঈমানী ছিল।
আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন মদীনায় আগমন করেন তখন জনগণ তার আগমনে খুবই খুশী ছিল। তার আগমনে যারা খুশী হয়েছিল আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। আমি যখন প্রথমবার তাঁকে দেখি তখনই আমার অন্তর এই সাক্ষ্য দেয় যে, কোন মিথ্যাবাদী লোকের চেহারা এমন নূরানী (আলোকময়) কখনই হতে পারে না। আমি সর্বপ্রথম তার মুখে যে কথা শুনি তা ছিল নিম্নরূপঃ
“হে লোক সকল! তোমরা পরস্পর একে অপরকে সালাম করবে, তার সফলতার জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, গরীব ও ক্ষুধার্তদেরকে পেট পুরে খাওয়াবে, আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখবে এবং রাত্রে উঠে সালাত আদায় করবে যখন লোকেরা ঘুমিয়ে থাকে, তাহলে তোমরা নিঃসন্দেহে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
যমান ইবনে সা'লাবা (রাঃ) তাঁর গোত্র বানু সাদ ইবনে বকরের পক্ষ হতে প্রতিনিধি হয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করেন এবং তাকে বলেনঃ “আচ্ছা বলুন তো, এই আকাশকে কে এমন উঁচু করে সৃষ্টি করেছেন?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “আল্লাহ।” এরপর লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করেনঃ “ কে এই পাহাড়কে এমনভাবে যমীনে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন?” উত্তরে নবী (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ।” লোকটি আবার প্রশ্ন করেনঃ “এই যমীনকে কে বিছিয়ে রেখেছেন?” নবী (সঃ) জবাবে বলেনঃ “আল্লাহ।” লোকটি পুনরায় প্রশ্ন করেনঃ “আপনাকে ঐ সত্তার কসম দিয়ে বলছি যিনি ঐ উঁচু আকাশ বানিয়েছেন, এই বড় বড় পাহাড়গুলো যমীনে গেড়ে দিয়েছেন এবং এতো বড় ও প্রশস্ত যমীন ছড়িয়ে দিয়েছেন, তিনিই কি আপনাকে সমস্ত মানুষের জন্যে রাসূল করে পাঠিয়েছেন?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “হ্যা, ঐ আল্লাহরই কসম যে, তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন।” অতঃপর লোকটি নবী (সঃ)-কে আল্লাহর কসম দিয়ে সালাত, যাকাত, হজ্ব এবং সাওমের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং নবীও (সঃ) আল্লাহর কসম খেয়ে খেয়ে উত্তর দিতে থাকেন। তখন লোকটি নবী (সঃ)-কে বলেনঃ “আপনি সত্য বলেছেন। যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন সেই সত্তার কসম করে বলছি যে, আমি এর উপর বেশীও করবো না কমও করবো না। বরং সঠিকভাবে এর উপরই আমল করবো।” সুতরাং এই পরিমাণ আমলই তার জন্যে যথেষ্ট হয়ে যায় এবং তিনি নবী (সঃ)-এর সত্যতার উপর ঈমান আনয়ন করেন। কেননা, তিনি দলীল প্রমাণাদি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। হাসসান ইবনে সাবিত (রাঃ) বলেনঃ لَو لَم تَكُن فيهِ آياتٌ مُبَيَّنَةٌ ـ كانَت بَداهَتُهُ تُنبيكَ بِالخَبَرِ অর্থাৎ ‘যদি তাঁর কাছে সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণাদি নাও থাকতো তথাপি তার চেহারার পবিত্রতা, সরলতা এবং অকপটতা স্বয়ং তাঁর সততা ও সত্যবাদিতার দলীল ছিল।”
কিন্তু মুসাইলামা কাযাবকে চক্ষুষ্মনদের যে কেউ দেখেছেন, তিনিই তার অশ্লীল কথন, দুষ্কার্য এবং তার নবুওয়াতের দাবীর ভন্ডামি দেখে যা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে, এই ফলাফল পেয়ে গেছেন যে, সে কিরূপ নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার ছিল! আল্লাহ তা'আলার এই উক্তি اَللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَۚ-اَلْحَیُّ الْقَیُّوْمُ ﳛ لَا تَاْخُذُهٗ سِنَةٌ وَّ لَا نَوْمٌ অর্থাৎ “আল্লাহ (এইরূপ যে) তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য নেই; তিনি চিরঞ্জীব, সংরক্ষণকারী । না তন্দ্রা তাঁকে আচ্ছন্ন করতে পারে, আর না নিদ্রা।” (২:২৫৫) আর মুসাইলামার উক্তিঃ يَاضِفْدَعُ بِنْتُ ضِفْدَ عِيْنَ نَقِّىْ كَمْ تُنَقِّيْنَ لَا الْمَاءَ تَكْدِرِيْنَ وَلَا الشَّارِبَ অর্থাৎ “হে ব্যাঙসমূহের সন্তান ব্যাঙ! তুমি আর কত ঘেনর ঘেনর করবে? তুমি এর দ্বারা পানিও ঘোলা করতে পারবে না এবং পানি পানকারীও পান করা থেকে বিরত থাকবে না।” ঐ যালিমের আর একটা অহী হচ্ছে, لَقَدْ اَنْعَمَ اللهُ عَلَى الْحُبْلٰى اِذَا خَرَجَ نَسْمَةً تَسْعٰى مِنْ بَيْنِ صِفَاقِ وَحِشٰى অর্থাৎ “আল্লাহ তাআলা গর্ভবতী নারীর উপর বড় রকমের ইহসান করেছেন যে, অন্ত্রের মধ্য হতে একটি জীবন্ত আত্মা বের করেছেন। তার আরো উক্তি হচ্ছে اَلْفِيْلُ مَالْفِيْلُ وَمَا اَدْرٰكَ مَاالْفِيْلُ لَهٗ ذَنْبٌ قَصِيْرٌ وَخَرْطُوْمٌ طَوِيْلٌ অর্থাৎ “হাতী, হাতী কি? তুমি কি জান হাতী কি? ওর রয়েছে ছোট লেজ ও লম্বা শুড়। আরো বলেছে- وَالْعَاجِنَاتُ عَجْنًا وَالْخَابِزَاتُ خُبْزًا وَاللَّاقِمَاتُ لَقْمًا اِهَالَةً وَسَمَنًا اِنَّ قُرَيْشًا قَوْمٌ يَّعْتَدُوْنَ অর্থাৎ “আটা খমীরকারিণীদের শপথ! রুটী তৈরীকারিণীদের শপথ! তরকারী ও ঘিয়ে খাবারের গ্রাস ডুবিয়ে ভক্ষণকারিণীদের শপথ! কুরায়েশরা খুবই সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। এখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পবিত্র অহী এবং ঐ মিথ্যাবাদীর বাজে ও অশ্লীল কথার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, শিশুরাও তার কথা শুনে বিদ্রুপ করবে। এ জন্যেই আল্লাহ তাআলা তাকে লাঞ্ছিত করেছেন এবং হাদীকার দিন তাকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তার সঙ্গী সাথীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং তার উপর লা'নত বর্ষিত হয়। তার লোকেরা তাওবা করে সিদ্দীকে আকবর (রাঃ)-এর নিকট আগমন করে এবং ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে শুরু করে। ঐ সময় তিনি তাদেরকে বলেনঃ “মুসাইলামার কোন কুরআন শুনাও তো দেখি।” তখন তারা তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু তিনি নাছোড় হয়ে যান এবং তাদেরকে বলেনঃ “অবশ্যই তোমাদেরকে শোনাতে হবে, যাতে অন্যেরাও শুনে নেয় এবং তারা এই কথাগুলো রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অহীর সাথে তুলনা করে অহীর শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে।” তখন তারা মুসাইলামার ঐ কথাগুলো শুনিয়ে দেয় যা আমরা উপরে নকল করেছি। তখন আবু বকর (রাঃ) তাদেরকে বলেনঃ “ওরে হতভাগ্যের দল! তোমাদের জ্ঞান ও বিবেক কোন দিকে গিয়েছিল? আল্লাহর শপথ! এরূপ কথা তো কোন নির্বোধের মুখ দিয়েও বের হবে না।”
কথিত আছে যে, অজ্ঞতার যুগে আমর ইবনুল আস (রাঃ) মুসাইলামার নিকট গমন করেন। সে তার বন্ধু ছিল। তখন পর্যন্ত আমর ইবনুল আস (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেননি। মুসাইলামা তাঁকে জিজ্ঞেস করেঃ “হে আমর! আপনাদের লোকের উপর (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সঃ-এর উপর) এখন কি অহী অবতীর্ণ হয়েছে?” উত্তরে ইবনুল আস (রাঃ) বলেনঃ “আমি তাঁর সঙ্গীদেরকে এক ব্যাপক অথচ সংক্ষিপ্ত সূরা পাঠ করতে শুনেছি।” সে জিজ্ঞেস করলোঃ “ সেটা কি?” আমর (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ وَالْعَصْرِ ـ اِنَّ الْاِنْسَانَ لَفِىْ خُسْرٍ (শেষ পর্যন্ত)! মুসাইলামা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললোঃ “আমার উপরও এমনি এক অহী অবতীর্ণ হয়েছে।” আমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘সেটা কি? সে জবাবে বললোঃ يَا وَبَرُ، يَاوَبَرُ، اِنَّمَا اَنْتَ اُذْنَانِ وَصَدَرٌ وَسَائِرُكَ حَقْرٌ وَنَقْرٌ অর্থাৎ “হে অবর, হে অবর (এক প্রকার জন্তু) তোমার দু'টি কান ও একটি বক্ষ প্রতীয়মান হচ্ছে, এ ছাড়া তোমার সারা দেহই বাজে।" অতঃপর সে আমার (রাঃ)-কে বললোঃ “হে আমর (রাঃ)! আমার অহী কেমন মনে হলো?" আমর ইবনুল আস (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহর কসম! আপনিতো নিজেও জানছেন যে, আপনার অহী যে মিথ্যা এতে আমার কোনই সন্দেহ নেই।" যখন একজন মুশরিকেরও এই অবস্থা যে, নবী (সঃ)-এর সত্যবাদী হওয়া ও মুসাইলামার মিথ্যাবাদী হওয়া তার কাছেও গোপনীয় নয়, তখন চক্ষুষ্মনদের কাছে এটা কিরূপে গোপন থাকতে পারে? তাই আল্লাহ পাক বলেনঃ وَ مَنْ اَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرٰى عَلَى اللّٰهِ كَذِبًا اَوْ قَالَ اُوْحِیَ اِلَیَّ وَ لَمْ یُوْحَ اِلَیْهِ شَیْءٌ وَّ مَنْ قَالَ سَاُنْزِلُ مِثْلَ مَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ অর্থাৎ “ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বড় অত্যাচারী আর কে হতে পারে যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে অথবা বলে- আমার উপর অহী করা হয়েছে, অথচ তার উপর কিছুই অহী করা হয়নি, আর বলে- আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন অনুরূপ আমিও অবতীর্ণ করতে পারি?" (৬:৯৩) আর এই আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ فَمَنْ اَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرٰى عَلَى اللّٰهِ كَذِبًا اَوْ كَذَّبَ بِاٰیٰتِهٖؕ-اِنَّهٗ لَا یُفْلِحُ الْمُجْرِمُوْنَ অর্থাৎ “সুতরাং ঐ ব্যক্তির চেয়ে অধিক অত্যাচারী কে হবে যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে, অথবা তার আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে? নিশ্চয়ই এমন পাপাচারীদের কিছুতেই মঙ্গল হবে না। অনুরূপভাবে ঐ ব্যক্তিও বড় অত্যাচারী যে ব্যক্তি ঐ সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, যে সত্য রাসূলগণ আনয়ন করেছেন এবং ওর উপর দলীল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন হাদীসে এসেছেঃ “আল্লাহর নিকট ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বড় যালিম ও দুর্ভাগা যে ব্যক্তি কোন নবীকে হত্যা করেছে অথবা কোন নবী তাকে হত্যা করেছেন।”