৬২-৬৫ নং আয়াতের তাফসীর:
(اَلَآ اِنَّ اَوْلِیَا۬ئَ اللہِ....... ذٰلِکَ ھُوَ الْفَوْزُ الْعَظِیْمُ)
পূর্বের আয়াতে অবাধ্য ব্যক্তিদের কথা আলোচনা করার পর এখানে আল্লাহ তা‘আলার ওলীদের মর্যাদা ও সম্মানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। আওলিয়া শব্দটি ওলীর বহুবচন। যার শাব্দিক অর্থ নিকটবর্তী, নৈকট্যশীল। ইসলামের পরিভাষায় ওলী হলেন, যারা ইসলামের সকল রুকনের ওপর বিশ্বাস করতঃ আমল করেন এবং সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করেন। যেমন ৬৩ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নিজেই বলে দিয়েছেন। সুতরাং যারা আল্লাহ তা‘আলার আদেশকে পালন করেন এবং নিষেধ থেকে বিরত থাকেন এবং সর্বত্র তাক্বওয়া অবলম্বন করেন তারাই আল্লাহ তা‘আলার ওলী। আল্লাহ তা‘আলার ওলী হবার জন্য কারামত প্রকাশ করা আবশ্যক নয়, সংসার ছেড়ে বন-জঙ্গলে বেড়াতে হবে না, দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে না। কিছু লোক সমাজের এক শ্রেণির অর্ধ-উলঙ্গ, নোংরা এবং সালাত ও দীনের অন্যান্য ইবাদতের কোন খোঁজ-খবর নেই এমন ব্যক্তিদেরকে ওলী হিসেবে বুঝে থাকে এবং তাদেরকে অনেক বড় কিছু মনে করে থাকে। আসলে তারা আল্লাহ তা‘আলার ওলী নয়, ওরা হল শয়তানের ওলী। কারণ আল্লাহ তা‘আলার একজন ওলী কখনো শরীয়ত নির্দেশিত ফরয কাজ বর্জন করতে পারে না।
প্রকৃত ওলীদের মর্যাদা হল তাদের কোন ভয় নেই এবং দুশ্চিন্তাও নেই। এটা ইহকাল ও আখিরাত উভয় জগতে থাকবে। তারা দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কাউকে ভয় করবে না, তাদের রিযিকের ভয় থাকবে না, কোন অনিষ্টের ভয় থাকবে না। আখিরাতে কবরে তাদের কোন ভয় থাকবে না, হাশরের ময়দানে কোন ভয় থাকবে না। মোট কথা সকল প্রকার ভয় থেকে তারা নিরাপদে থাকবে এবং তারা কোন দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না। এ দুটি জিনিসে ভয় না থাকা এবং দুশ্চিন্তা না থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কাউকে বলা হয় আপনাকে অনেক অর্থ-সম্পদ দেয়া হবে কিন্তু সর্বদা আপনি ভয়ে থাকবেন এবং দুশ্চিন্তায় থাকবেন, যেকোন সময় আপনাকে কেউ আক্রমন করতে পারে বা কোন ক্ষতি করতে পারে, তাহলে কি সে ব্যক্তি সে অর্থ নেবে? না, কারণ তার শান্তি ও নিরাপত্তা বলতে কিছু থাকবে না। সে দুশ্চিন্তায় মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বে।
তাদের জন্য আরো রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে সুসংবাদ। দুনিয়াতে সুসংবাদ হল সুন্দর প্রশংসা, অন্তরের প্রশান্তি, মু’মিনদের প্রতি অন্তরে ভালবাসা, সত্য স্বপ্ন এবং সকল কাজে সহজতা দান। আর আখিরাতে সকল বিপদ থেকে মুক্তি দান করে জান্নাত লাভ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللّٰهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلٰ۬ئِكَةُ أَلَّا تَخَافُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَأَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِيْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ)
“নিশ্চয়ই যারা বলে: আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, অতঃপর অবিচলিত থাকে, তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় ফেরেশতা এবং বলেঃ তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার সুসংবাদ পেয়ে আনন্দিত হও।” (সূরা ফুসসিলাত ৪১:৩০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(لَا يَحْزُنُهُمُ الْفَزَعُ الْأَكْبَرُ وَتَتَلَقّٰهُمُ الْمَلٰ۬ئِكَةُ ط هٰذَا يَوْمُكُمُ الَّذِيْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ)
“মহাভীতি তাদেরকে চিন্তাযুক্ত করবে না এবং ফেরেশতাগণ তাদেরকে অভ্যর্থনা করবে এ বলে, ‘এ তোমাদের সে দিন যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেয়া হয়েছিল।’’ (সূরা আম্বিয়া ২১:১০৩)
মু’মিন ব্যক্তির যখন মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন সাদা চেহারাবিশিষ্ট ফেরেশতারা সাদা কাপড় নিয়ে উপস্থিত হয় এবং বলে: হে পবিত্র আত্মা প্রশান্ত ও সুগন্ধির দিকে বের হয়ে আসো, প্রভু তোমার প্রতি রাগান্বিত নন। তখন আত্মা তার মুখ দিয়ে এমনভাবে বের হয়ে আসবে যেমন পাত্র থেকে পানির ফোয়ারা বের হয়ে আসে। (মুসাননাফ আব্দুর রাযযাক হা: ৬৭৩৭, সহীহ)
উমার (رضي الله عنهما)
হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি: আল্লাহ তা‘আলার বান্দাদের মাঝে এমন বান্দাও রয়েছেন যারা নাবীও নন এবং শহীদও নন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে যে সম্মান দিয়েছেন সে জন্য কিয়ামতের দিন নাবীরা এবং শহীদগণ তাদের মত হবার আকাক্সক্ষা করবে। বলা হল হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল! তাদের সম্পর্কে সংবাদ দিন এবং তাদের এমন কি আমল, হয়তো শুনে তাদেরকে ভালবাসবো। তিনি বললেন: তারা এমন মানুষ, আত্মীয় সম্পর্ক ছাড়াই আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য অন্যদেরকে ভালবাসে এবং আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য অপরকে সম্পদ দান করে। আল্লাহ তা‘আলার শপথ তাদের চেহারা আলোকজ্জ্বল হবে, তারা নূরের মিম্বারে থাকবে। যখন মানুষ ভয় করবে তারা তখন ভয় করবে না, মানুষেরা যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে তখন তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে না। অতঃপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন। (আবূ দাঊদ হা: ৩৫২৭, সহীহ)
সুতরাং আমাদের সর্বদা চেষ্টা করতে হবে আমরা যেন আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃত ওলী হতে পারি। ফলে আমরা দুনিয়াতেও সফল হবো এবং আখিরাতেও সফল হবো।
(وَلَا یَحْزُنْکَ قَوْلُھُمْﺭ ..... ھُوَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ)
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন যে, কাফির-মুশরিকরা তোমাকে অপবাদ ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করাসহ যে সমস্ত কথা-বার্তা বলে তা যেন তোমাকে দুশ্চিন্তিত, ব্যথিত, দুর্দশাগ্রস্ত না করে। কারণ তারা যা বলে তা তোমার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। তোমাকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারবে না, এবং সম্মানও দিতে পারবে না। কারণ সম্মান সবই আল্লাহ তা‘আলার নিকট, তিনি যাকে খুশি সম্মানিত করেন আবার যাকে খুশি অপমানিত করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْعِزَّةَ فَلِلّٰهِ الْعِزَّةُ جَمِيْعًا)
“যে ব্যক্তি সম্মান লাভ করতে চায় (সে জেনে রাখুক), সকল সম্মান আল্লাহরই জন্য।” (সূরা ফাতির ৩৫:১০) যে তাঁর আনুগত্য করে আল্লাহ তা‘আলা তাকেই সম্মান দান করে থাকেন, যেমন
আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন:
(يَقُوْلُوْنَ لَئِنْ رَّجَعْنَآ إِلَي الْمَدِيْنَةِ لَيُخْرِجَنَّ الْأَعَزُّ مِنْهَا الْأَذَلَّ ط وَلِلّٰهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُوْلِه۪ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ وَلٰكِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَ)
“তারা বলে: আমরা যদি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করি, তবে সেখান হতে সম্মানিতরা অবশ্যই হীনদেরকে বহিস্কার করবে; কিন্তু মান-সম্মান তো আল্লাহরই, তাঁর রাসূল এবং মু’মিনদের; কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।” (সূরা মুনাফিকূন ৬৩:৮)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করার মাধ্যমে তাঁর কাছে সম্মান খুঁজতে হবে, আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা সম্মান দিতে পারেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সত্য প্রচারে কারো তিরস্কারমূলক কথায় মন খারাপ করা যাবে না।
২. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কেউ সম্মান বা অসম্মান দান করতে পারে না।
৩. যারা আল্লাহ তা‘আলার বন্ধু তাদের আখিরাতে কোন দুঃখ-কষ্ট থাকবে না।
৪. যারা ভাল কাজ করবে তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে সুসংবাদ।