আল ফালাক্ব আয়াত ৫
وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ اِذَا حَسَدَ ࣖ ( الفلق: ٥ )
Wa min shar ri haasidin iza hasad (al-Falaq̈ ১১৩:৫)
English Sahih:
And from the evil of an envier when he envies." (Al-Falaq [113] : 5)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
এবং হিংসুকের অনিষ্ট হতে, যখন সে হিংসা করে। (আল ফালাক্ব [১১৩] : ৫)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
এবং অনিষ্ট হতে হিংসুকের, যখন সে হিংসা করে। [১]
[১] হিংসা তখন হয়, যখন হিংসাকারী হিংসিত ব্যক্তির নিয়ামতের ধ্বংস কামনা করে। সুতরাং তা থেকেও পানাহ চাওয়া হয়েছে। কেননা, হিংসাও এক জঘন্যতম চারিত্রিক ব্যাধি; যা মানুষের পুণ্যরাশিকে ধ্বংস করে ফেলে।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
‘আর অনিষ্ট হতে হিংসুকের [১], যখন সে হিংসা করে [২]।’
[১] তৃতীয় বিষয় হচ্ছে, حسد যার শাব্দিক অর্থ হিংসা। হিংসার মানে হচ্ছে, কোন ব্যক্তিকে আল্লাহ্ যে অনুগ্রহ, শ্রেষ্ঠত্ব বা গুণাবলী দান করেছে তা দেখে কোন ব্যাক্তি নিজের মধ্যে জ্বালা অনুভব করে এবং তার থেকে ওগুলো ছিনিয়ে নিয়ে এ দ্বিতীয় ব্যক্তিকে দেয়া হোক, অথবা কমপক্ষে তার থেকে সেগুলো অবশ্যি ছিনিয়ে নেয়া হোক- এ আশা করা। তবে কোন ব্যক্তি যদি আশা করে অন্যের প্রতি যে অনুগ্রহ করা হয়েছে তার প্রতিও তাই করা হোক, তাহলে এটাকে হিংসার সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। সুতরাং, হিংসার মূল হলো, কারও নেয়ামত ও সুখ দেখে দগ্ধ হওয়া ও সে নেয়ামতের অবসান কামনা করা। হিংসার কারণেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর ইহুদীরা জাদু করেছিল, হত্যার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল।
তাছাড়া ইহুদী, মুশরিক ও মুনাফিকরা মুসলিমদের ইসলামের নেয়ামত পাওয়া দেখে হিংসার অনলে দগ্ধ হত। তাই এ সূরা যেন কুরআনের শেষের দিকে এসেছে মুসলমানদেরকে তাদের নেয়ামত এবং এ নেয়ামতের কারণে তাদের প্রতি হিংসুকদের হিংসা করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যেই এসেছে। [আদ্ওয়াউল বায়ান] রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি হিংসা পোষনকারীর সংখ্যা জগতে অনেক। এ কারণেও বিশেষভাবে হিংসা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ ব্যাপারে নির্দেশ প্ৰদান করা হয়েছে। [তাবারী] এই হিংসা হারাম ও মহাপাপ। এটাই আকাশে কৃত সর্বপ্রথম গোনাহ এবং এটাই পৃথিবীতে কৃত সর্বপ্রথম গোনাহ। আকাশে ইবলীস আদম আলাইহিস সালাম এর প্রতি এবং পৃথিবীতে আদমপুত্র তার ভাইয়ের প্রতি হিংসা করেছিল। [কুরতুবী]
[২] এখানে বলা হয়েছে, ‘হিংসুক যখন হিংসা করে’ অর্থাৎ তার মনের আগুন নিভাবার জন্য নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে কোন পদক্ষেপ নেয়, তার হিংসাকে প্রকাশ করে, সেই অবস্থায় তার অনিষ্টকারি তা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ্র আশ্রয় চাওয়া হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর]
3 Tafsir Bayaan Foundation
আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে’।
4 Muhiuddin Khan
এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে।
5 Zohurul Hoque
''আর হিংসাকারীর অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে।’’
6 Mufti Taqi Usmani
এবং হিংসুকের অনিষ্ট হতে, যখন সে হিংসা করে।
7 Mujibur Rahman
এবং অনিষ্টতা হতে হিংসুকের, যখন সে হিংসা করে।
8 Tafsir Fathul Mazid
Please check ayah 114:6 for complete tafsir.
9 Fozlur Rahman
এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে।”
10 Mokhtasar Bangla
৫. আমি তাঁর নিকট হিংসুক যখন হিংসা করে তখন তার অনিষ্ট থেকে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
11 Tafsir Ibn Kathir
আশ্রয় প্রার্থনা করার দুইটি সূরা
হযরত যার ইবনে জায়েশ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ)কে বলেনঃ “হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এ সূরা দুটিকে (সূরা ফালাক ও সূরা নাসকে) কুরআনের অন্তর্ভুক্ত বলেন না।” তখন হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) বলেনঃ “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাকে বলেনঃ قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ বলুন।” তিনি তা বললেন। তারপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে বললেনঃ “আপনি قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ বলুন।” তিনি তা বললেন। সুতরাং আমরা ওটাই বলি যা নবী করীম (সঃ) বলেছেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ রিওয়াইয়াত সহীহ বুখারীতেও বর্ণিত হয়েছে)
মুসনাদে আবী ইয়ালা প্রভৃতি কিতাবে উল্লিখিত আছে যে, হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এ দুটি সূরাকে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত বলে লিখেননি। এবং এগুলােকে কুরআনের অংশ বলে মনে করতেন না। কারী এবং ফকীহদের নিকট প্রসিদ্ধ উক্তি এই যে, হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এদু’টি সূরাকে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে লিখতেন না। সম্ভবতঃ তিনি নবী করীম (সঃ)-এর কাছে শুনেননি। তারপর হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাঁর কথা থেকে ফিরে জামাআতের মতামতের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। সাহাবায়ে কিরাম এ দু’টি সূরাকে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যার নুসখাহ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
সহীহ মুসলিমে হযরত উকবা ইবনে আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেন, “তােমরা কি দেখােনি যে, ঐ রাত্রে আমার উপর এমন কতকগুলাে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যেমন আয়াত আর কখনাে অবতীর্ণ হয়নি।” তারপর তিনি এ সূরা দু’টি তিলাওয়াত করেন।(এহাদীসটি মুসনাদে আহমদে জামে তিরমিযী এবং সুনানে নাসায়ীতেও বর্ণিত হয়েছে।ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটিকে হাসান সহীহ্ বলেছেন।)
মুসনাদে আহমদে হ্যরত উকবাহ ইবনে আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “আমি মদীনার গলি পথে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে তাঁর উটের লাগাম ধরে যাচ্ছিলাম, এমন সময় তিনি আমাকে বললেনঃ “এসাে এবার তুমি আরােহণ করাে।” আমি চিন্তা করলাম যে, তার কথা না শােনা অবাধ্যতা হবে, তাই আরােহণ করতে সম্মত হলাম। কিছুক্ষণ পর আমি নেমে গেলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) আরােহণ করলেন। তারপর তিনি বললেনঃ “ হে উকবাহ (রাঃ)আমি কি তােমাকে দু'টি উৎকৃষ্ট সূরা শিখিয়ে দিবাে না?” আমি আর করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) হ্যা, অবশ্যই আমাকে শিখিয়ে দিন! তখন তিনি আমাকে قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ এবং قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ পাঠ করালেন। অতঃপর উট হতে নেমে রাসূলুল্লাহ (সঃ) নামায পড়ালেন এবং নামাযে এ সূরা দু'টি পাঠ করলেন তারপর তিনি আমাকে বললেন! হে উকবাহ (রাঃ)! আমি সূরা দু’টি পাঠ করেছি তা তুমি লক্ষ্য করেছাে তাে? শােনাে, ঘুমােবার সময় এবং দাড়ানাের সময় এ সূরা দু’টি পাঠ করবে।” (জামে তিরমিযী, সুনানে আবী দাউদ এবং সুনানে নাসায়ীতেও এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।)
মুসনাদে আহমদের অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উকবাহ ইবনে আমিরকে (রাঃ) প্রত্যেক নামাযের শেষে এ দু’টি সূরা তিলাওয়াত করার নির্দেশ দিয়েছেন। (এ হাদীসটিও সুনানে আবী দাউদ, জামে তিরমিযী এবং সুনানে নাসায়ীতে বর্ণিত আছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটিকে গারীব বা দুর্বল বলেছেন।)
অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হে উকবাহ্ (রাঃ) তুমি আশ্রয় প্রার্থনা করার এ সূরা দু’টি পাঠ করাে, কেননা এ দু'টি সূরার মত সূরা তুমি কখনাে পড়বেই না”।
হযরত উকবাহ্ ইবনে আমির (রাঃ) সম্পর্কিত হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উটের উপর তিনিও আরােহণ করেছিলেন। ঐ হাদীসের কোন কোন বর্ণনায় এও রয়েছে যে, হযরত উকবাহ (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) সূরা দু’টি আমার কাছে তিলাওয়াত করার পর আমাকে তেমন আনন্দিত হতে না দেখে বলেনঃ “সম্ভবতঃ তুমি এ সূরা দু'টিকে খুব সাধারন সূরা মনে করেছে । জেনে রেখাে যে, নামাযে পড়ার ক্ষেত্রে এ সূরা দুটির মত কিরআত আর নেই।” | সুনানে নাসাঈতে রয়েছে যে, এ দু'টি সূরার মত সূরা কোন আশ্রয় প্রার্থীর জন্যে আর নেই।
অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উকবাহ্র (রাঃ) দ্বারা এ সূরা দু’টি পাঠ করিয়ে নেয়ার পর বললেন, আশ্রয় প্রার্থনার মত সূরা এ দু'টি সুরার মত আর নেই।”
এক রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ সূরা দু’টি ফজরের নামাযে পাঠ করেন।
অন্য একটি হাদীসে আছে যে, হযরত উকবাহ ইবনে আমির (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বাহনের পিছনে পিছনে যাচ্ছিলেন এবং তাঁর পায়ে হাত রেখে বলছিলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সূরা হূদ অথবা সূরা ইউনুস শিখিয়ে দিন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “সূরা ফালাক অপেক্ষা অধিক উপকার দানকারী কোন সূরা আর নেই। (এ হাদীসটি ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।)
আর একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর চাচা হযরত আব্বাস (রাঃ)কে বলেনঃ আমি আপনাদেরকে জানাচ্ছি যে, আশ্রয়প্রার্থীদের জন্যে এ দু'টি সূরার চেয়ে উত্তম আর কোন সূরা নেই।
অন্য এক হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ দু’টি সূরা এবং সূরা ইখলাস সম্পর্কে বলেছেনঃ “চারটি আসমানী কিতাবে এ তিনটির মত সূরা আর একটিও অবতীর্ণ হয়নি।
মুসনাদে আহমদে হযরত আ’লা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লােক বলেনঃ আমরা এক সফরে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে ছিলাম। সওয়ারীর সংখ্যা ছিল কম, তাই পালাক্রমে আমরা আরােহণ করছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ)একজন সাহাবীর মাথায় হাত রেখে তাকে একটি সূরা পড়ালেন এবং বললেনঃ “নামায পড়ার সময় এ সূরা দু’টি (সূরা ফালাক ও সূরা নাস) পাঠ করবে।” সম্ভবতঃ ঐ সাহাবীর নাম উকবাহ ইবনে আ'মিরই (রাঃ) হবে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
হযরত আবদুল্লাহ আসলামী ইবনে আনীস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর বুকে হাত দিয়ে বললেনঃ “বলাে।” হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) কি বলবেন তা বুঝতে পারলেন না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) পুনরায় বললেন। “বলাে।” হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) তখন قُلْ هُوَ اللّٰهُ اَحَدٌ বললেন। রাসূলুল্লাহ
(সঃ) আবার বললেনঃ “বলো।” হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ ـ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ বললেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) পুনরায় বললেনঃ “বলাে।” হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) তখন قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ বললেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এভাবেই আশ্রয় প্রার্থনা করবে। আশ্রয় প্রার্থনা করার মত এ রকম সূরা আর নেই।”
সুনানে নাসায়ীর অন্য একটি হাদীসে রয়েছে যে, হযরত জাবির (রাঃ)-এর নিকট রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ সূরা দু’টি পাঠ শুনলেন। তারপর বললেন এগুলাে পড়তে থাকবে। পড়ার মত এ রকম সূরা আর পাবে না।
উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত একটি হাদীস পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) রাত্রিকালে যখন বিছানায় যেতেন তখন তিনি সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করে হাতের উভয় তালুতে ফু দিয়ে সারা দেহের যতােটুকু উভয় হাতের নাগালে পাওয়া যায় ততােটুকু পর্যন্ত হাতের ছোঁয়া দিতেন। প্রথমে মাথায়, তারপর মুখে এবং এরপর দেহের সামনের অংশে তিনবার এভাবে হাত ফিরাতেন।
ইমাম মালিক (রাঃ)-এর ‘মুআত্তা’ গ্রন্থে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন অসুস্থ হতেন তখন এ দু’টি সূরা পাঠ করে তিনি সারা দেহে ফু দিতেন। রাসূলুল্লাহর (সঃ) অসুস্থতা যখন মারাত্মক হয়ে যেতাে তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) আউযুবিল্লাহ পাঠ করে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হস্তদ্বয় তাঁরই সারা দেহে ফিরাতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর এরূপ করার কারণ ছিল রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পবিত্র ও বরকতময় হাতের স্পর্শ তারই দেহে পৌঁছিয়ে দেয়া।
এক হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) জ্বিন এবং মানুষের কু-দৃষ্টি হতে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। এ দু'টি সূরা অবতীর্ণ হওয়ার পর তিনি এ সূরা দু’টিকে গ্রহণ করেন এবং বাকি সব ছেড়ে দেন। (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসায়ী (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিজী হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।)
১-৫ নং আয়াতের তাফসীর
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, فَلَق সকাল বেলাকে বলা হয়। আওফী (রঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেও এটাই বর্ণনা করেছেন। কুরআন কারীমেরই অন্য জায়গায় فَالِقُ الْاِصْبَاحِ রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এটাও বর্ণিত আছে যে, فلق এর অর্থ হলো মাখলুক। হযরত কা'ব আহবার (রাঃ) বলেন যে, فَلَق হলো জাহান্নামের একটি জায়গা। ঐ জায়গার দরজা খোলা হলে তথাকার আগুনের উত্তাপ এবং ভয়াবহতায় জাহান্নামের সমস্ত অধিবাসী চীৎকার করতে শুরু করে। একটি মারফু হাদীসেও উপরোক্ত হাদীসেরই প্রায় অনুরূপ উক্তি রয়েছে। কিন্তু ওটাকে মুনকার হাদীস বলা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, فَلَق জাহান্নামের নাম। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, প্রথমটিই সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য উক্তি। অর্থাৎ فَلَق এর অর্থ হলো সকাল বেলা। ইমাম বুখারীও (রঃ) একথাই বলেছেন এবং এটাই নির্ভুল।
সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর অপকারিতার মধ্যে জাহান্নাম, ইবলীস ও ইবলীসের সন্তান সন্ততিও রয়েছে। غَاسِقٍ এর অর্থ হলো রাত। اِذَا وَقَبَ এর অর্থ হলো সূর্যাস্ত। অর্থাৎ যখন অন্ধকার রাত উপস্থিত হয়। ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, আরবের লোকেরা সুরাইয়া নক্ষত্রের অস্তমিত হওয়াকে غَاسِقٍ বলে। অসুখ এবং বিপদ আপদ সুরাইয়া নক্ষত্র উদিত হওয়ার পর বৃদ্ধি পায় এবং ঐ নক্ষত্র অস্তমিত হওয়ার পর অসুখ বিপদ আপদ কেটে যায়।
একটি মারফু হাদীসে রয়েছে যে, غَاسِقٍ হলো নক্ষত্রের নাম। কিন্তু এ হাদীসের মারফু হওয়ার কথা সত্য নয়। কোন কোন তাফসীরকার বলেন যে, غَاسِقٍ এর অর্থ হলো চাঁদ। তাফসীরকারদের দলীল হলো মুসনাদে আহমদে বর্ণিত একটি হাদীস, যাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর হাত ধরে চাঁদের প্রতি ইশারা করে বললেনঃ “আল্লাহর কাছে ঐ غَاسِقٍ এর অপকারিতা হতে আশ্রয় প্রার্থনা কর।"
অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, غَاسِقٍ اِذَا وَقَبَ দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছে। উভয় উক্তির মধ্যে সহজেই সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে বলা যেতে পারে যে, এটা হলো চাদের ক্রমবৃদ্ধি এবং নক্ষত্ররাজির আত্মপ্রকাশ ইত্যাদি। এসব কিছু রাত্রিকালেই হয়ে থাকে এবং যখন রাত্রির আগমন ঘটে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
গ্রন্থিসমূহের উপর পড়ে পড়ে ফুৎকারকারিণীরা অর্থাৎ যাদুকর নারীগণ।
হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, যেই মন্ত্র পাঠ করে সাপে কাটা রোগীর উপর ফু দেয়া হয় এবং ভূত প্রেত তাড়ানোর জন্যে ফু দেয়া হয় এগুলো শিরকের খুবই কাছাকাছি। অন্য হাদীসে রয়েছে যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে এসে বললেনঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ) আপনি কি রোগাক্রান্ত?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেন “হ্যা” হযরত জিবরাঈল (আঃ) তখন নিম্নের দু'আ দু'টি পাঠ করেনঃ
بِسْمِ اللّٰهِ اَرْقِيْكَ مِنْ كُلِّ دَاءٍ يُؤْذِيْكَ وَمِنْ شَرِّ كُلِّ حَاسِدٍ وَعَيَّنَ اللّٰهُ يَشْفِيْكَ
অর্থাৎ “আল্লাহর নামে আমি আপনাকে ফু দিচ্ছি সেই সব রোগের জন্যে যা আপনাকে কষ্ট দেয়, প্রত্যেক হিংসুকের অনিষ্ট ও কুদৃষ্টি হতে আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করুন। এই রোগ দ্বারা সম্ভবতঃ ঐ রোগকেই বুঝানো হয়েছে যে রোগে তিনি যাদুকৃত হওয়ার পর আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা স্বীয় রাসূল (সঃ) কে সুস্থতা ও আরোগ্য দান করেন। এতে হিংসুটে ইয়াহুদীদের যাদুর প্রভাব নস্যাৎ হয়ে যায়। তাদের সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়া হয়। তারা চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে যাদু করা সত্ত্বেও তিনি যাদুকারীদেরকে কোন কটু কথা বলেননি এবং ধমকও। দেননি। আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ) কে সুস্থতা ও আরোগ্য দান করেন।
মুসনাদে আহমদে হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) এর উপর একজন ইয়াহূদী যাদু করেছিল। এই কারণে নবী (সঃ) কয়েকদিন পর্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। তারপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) এসে তাঁকে জানান যে, অমুক ইয়াহূদী তার উপর যাদু করেছে এবং অমুক অমুক কুঁয়ায় গ্রন্থি বেঁধে রেখেছে। সুতরাং তিনি যেন কাউকে পাঠিয়ে ঐ গ্রন্থি খুলিয়ে আনেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) লোক পাঠিয়ে তখন কুঁয়া থেকে ঐ যাদু বের করিয়ে আনান এবং গ্রন্থিখুলে ফেলেন। ফলে যাদুর প্রভাব কেটে যেতে শুরু করে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ। (সঃ) ঐ ইয়াহুদীকে এ সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি। এবং তাকে দেখে। কখনো মুখও মলিন করেননি।
সহীহ বুখারীতে কিতাবুত তিব্বে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর যাদু করা হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ ভেবেছিলেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রীদের কাছে গিয়েছেন, অথচ তিনি তাদের কাছে যাননি। হযরত সুফইয়ান (রঃ) বলেন যে, এটাই যাদুর সবচেয়ে বড় প্রভাব। এ অবস্থা হওয়ার পর একদিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে আয়েশা (রাঃ)! আমি আমার প্রতিপালককে জিজ্ঞেস করেছি এবং তিনি আমাকে জানিয়েছেন। দু’জন লোকে আমার কাছে আসেন। একজন আমার মাথার কাছে এবং অন্যজন আমার পায়ের কাছে বসেন 'আমার কাছে অর্থাৎ শিয়রে যিনি বসেছিলেন, তিনি দ্বিতীয়জনকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “এর অবস্থা কি?” দ্বিতীয়জন উত্তরে বললেনঃ “এঁর উপর যাদু করা হয়েছে। প্রথম জন প্রশ্ন করলেনঃ “কে যাদু করেছে?" দ্বিতীয়জন জবাব দিলেনঃ “লুবাইদ ইবনে আসাম। সে বান্ যুরাইক গোত্রের লোক। সে ইয়াহূদীদের মিত্র এবং মুনাফিক।" প্রথম জন জিজ্ঞেস করলেনঃ “কিসের মধ্যে যাদু করেছে?" দ্বিতীয়জন উত্তর দিলেনঃ “মাথার চুলে ও চিরুণীতে। প্রথমজন প্রশ্ন করলেনঃ “কোথায়, তা দেখাও।” দ্বিতীয়জন উত্তর দিলেনঃ “খেজুর গাছের বাকলে, পাথরের নিচে এবং যারওয়ান কূপে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ কূপের কাছে গমন করলেন এবং তা থেকে ওসব বের করলেন। ঐ কূপের পানি ছিল যেন মেহদীর রঙ। ওর পাশের খেজুর গাছগুলোকে ঠিক শয়তানের মাথার মত মনে হচ্ছিল। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ): এ কাজের জন্যে তার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সঃ) একথা শুনে বললেনঃ “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। তিনি আমাকে নিরাময় করেছেন ও সুস্থতা দিয়েছেন। আমি মানুষের মধ্যে মন্দ ছড়ানো পছন্দ করি না।”
অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কোন একটা কাজ করেননি। অথচ তাঁর মনে হতো যে, তিনি ওটা করেছেন। এটাও বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ) নির্দেশক্রমে ঐ কূপে মাটি ভর্তি করে দেয়া হয়। এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, ছয় মাস পর্যন্ত রাসূলুল্লাহর (সঃ) এরূপ অবস্থা ছিল।
তাফসীরে সালাবীতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ইয়াহূদীদের একটা ছেলে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমত করতো। ঐ ছেলেটিকে ফুসলিয়ে ইয়াহুদীরা রাসূলুল্লাহর (সঃ) কয়েকটি চুল এবং তাঁর চুল আঁচড়াবার চিরুনীর কয়েকটি দাঁত হস্তগত করে। তারপর তারা ওগুলোতে যাদু করে। এ কাজে সবচেয়ে বেশী সচেষ্ট ছিল লুবাইদ ইবনে আসাম। এরপর যাদুর গ্রন্থি বা সুরাইক যারওয়ান নামক কূপে স্থাপন করে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার স্ত্রীদের কাছে গমন না করেও তাঁর মনে হতো যে তিনি তাদের কাছে গমন করেছেন। এইমন ভুলো অবস্থা দূরীকরণের জন্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) সচেষ্ট ছিলেন, কিন্তু এরকম অবস্থা হওয়ার কারণ তাঁর জানা ছিল না। ছয় মাস পর্যন্ত ঐ একই অবস্থা চলতে থাকে। তারপর উপরোল্লিখিত ঘটনা ঘটে। দুজন ফেরেশতা এসে কথােপকথনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন হযরত আলী (রাঃ), হযরত যুবায়ের (রাঃ) এবং হযরত আম্মার (রাঃ) কে পাঠিয়ে কূপ থেকে যাদুর গ্রন্থিগুলো বের করিয়ে আনেন। ঐ যাদুকৃত জিনিষগুলোর মধ্যে একটি ধনুকের রঞ্জু ছিল, তাতে ছিল বারোটি গ্রন্থি বা গেরো। প্রত্যেক গেরোতে একটি করে সূচ বিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তারপর আল্লাহ তা'আলা এ সূরা দু’টি অবতীর্ণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ সূরা দু’টির এক একটি আয়াত পাঠ করছিলেন আর ঐ গ্রন্থিসমূহ একটি একটি করে আপনা আপনি খুলে যাচ্ছিল। সূরা দু'টি পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে সমস্ত গেরোই খুলে যায় এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এদিকে হযরত জিবরাঈল (আঃ) উপরোল্লিখিত দু'আ পাঠ করেন। সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা কি ঐ নরাধমকে ধরে হত্যা করে ফেলবো রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “না, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি মানুষের মধ্যে অনিষ্ট ও বিবাদ ফাসাদ সৃষ্টি করতে চাই না।”এ বর্ণনায় গারাবাত ও নাকারাত রয়েছে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।