নামকরণ:
ইবরাহীম (عليه السلام) একজন অন্যতম উলুল আযম (শ্রেষ্ঠ পাঁচজনের একজন) নাবী। ইবরাহীম (عليه السلام) কর্তৃক মক্কার জন্য, নিজের জন্য, ছেলে ইসমাইলের জন্য এবং সারা জাহানের মু’মিনদের জন্য দু‘আ ও আল্লাহ তা‘আলার কৃতজ্ঞতা সম্পর্কে এ সূরার ৩৫-৪১ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে, সে ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
সূরার শুরুতে কুরআন অবতীর্ণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছে তাদের মাতৃভাষায় রাসূল প্রেরণ, মূসা (عليه السلام) ও বানী ইসরাঈলদের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত, শুকরিয়া আদায় ও অনাদায়ের ফলাফল এবং পূর্ববর্তী কয়েকটি জাতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। রাসূলগণ মানুষ ছিলেন, তাদের ওপর উম্মাতের অবাধ্য লোকেরা যে সকল নির্যাতন করত তার বিবরণ, কাফিরদের সৎ আমলের উপমা, কিয়ামতের মাঠে শয়তানের বক্তব্য এবং যারা দুনিয়াতে ঈমান ও সৎ আমল করবে তারা কবরেও ঈমানের ওপর অটল থাকতে পারবে এই সম্পর্কে সূরার মাঝে আলোচনা করা হয়েছে। তারপর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর কথাসহ কাফিরদের আখিরাতে যে অপমানজনক শাস্তি দেয়া হবে সে সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে।
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর:
الٓرٰ-(আলিফ-লাম-রা) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহ সম্পর্কে সূরা বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর সঠিক উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন।
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন অবতীর্ণের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। আর তা হল তিনি তাঁর নাবীর ওপর এই কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন যাতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানব জাতিকে কুফর, ভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে ঈমান, হিদায়াত ও জ্ঞানের আলোর দিকে নিয়ে আসতে পারেন। যেমন
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(هُوَ الَّذِيْ يُنَزِّلُ عَلٰي عَبْدِه۪ اٰيٰتٍۭ بَيِّنٰتٍ لِّيُخْرِجَكُمْ مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَي النُّوْرِ)
“তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ অবতীর্ণ করেন, তোমাদেরকে সকল প্রকার অন্ধকার হতে আলোর দিকে আনার জন্য।” (সূরা হাদীদ ৫৭:৯)
তবে যে কেউ ইচ্ছা করলেই হিদায়াত গ্রহণ করতে পারবে না, এমনকি আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা না করলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বয়ং কাউকে ইচ্ছা করলেও হিদায়াত দিতে পারবেন না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّكَ لَا تَهْدِيْ مَنْ أَحْبَبْتَ وَلٰكِنَّ اللّٰهَ يَهْدِيْ مَنْ يَّشَا۬ءُ)
“তুমি যাকে ভালবাস, ইচ্ছা করলেই তাকে সৎ পথে আনতে পারবে না। তবে আল্লাহই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন।” (সূরা কাসাস ২৮:৫৬)
বরং হিদায়াত সে ব্যক্তিই পাবে আল্লাহ তা‘আলা যার জন্য ইচ্ছা করবেন এবং তাওফীক দেবেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَللّٰهُ وَلِيُّ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا يُخْرِجُهُمْ مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَي النُّوْر)
“মু’মিনদের অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ। তিনি তাদেরকে অন্ধকারসমূহ হতে আলোর দিকে নিয়ে আসেন।” (সূরা বাক্বারাহ ২:২৫৭)
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাজ হল মানব জাতিকে হিদায়াতের রাস্তা দেখিয়ে দেয়া। কথাটি যদিও এখানে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে বলেছেন, কিন্তু তা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, কারণ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চিরদিন থাকার জন্য আসেননি, তিনি একদিন চলে যাবেন এবং চলে গেছেনও বটে। তাঁর পর মানব জাতিকে সঠিক পথ দেখানোর দায়িত্ব পালন করবে তাঁর ওয়ারিশ আলেমগণ, তাই আলেমগণ সঠিক পথ দেখানোর পর আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেবেন, যার ভাগ্যে হিদায়াতের মর্যাদা রয়েছে সে-ই তা পাবে। সুতরাং মানব জাতিকে কুরআন দেয়া হয়েছে এজন্য যে, তারা এ থেকে হিদায়াতের পথ গ্রহণ করবে আর আলেমদের উচিত হবে তারা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী মানব জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দেবেন, কোন তরীকাহ, মত, পথ ও দলের দিকে নয়।
আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ব্যতীত কেউ সঠিক পথ লাভ করতে পারবে না। সঠিক পথ পাওয়ার অন্যতম একটি মাধ্যম হল তাঁর রাসূলের অনুসরণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَآ أَرْسَلْنَا مِنْ رَّسُوْلٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللّٰهِ)
“রাসূলকে একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তার আনুগত্য করা হবে।” (সূরা নিসা ৪:৬৪)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: আকাশ ও জমিনে যা কিছু রয়েছে সব কিছুর সৃষ্টি, পরিচালনা, রিযিক ও সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র তিনি। তিনি যা বলেন তাই হয়, তিনি যেভাবে চালান সেভাবেই চলে এবং তিনি যাকে যতটুকু পরিমাণ রিযিক দেয়ার ইচ্ছা করেন সে ততটুকুই রিযিক পায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لِلّٰهِ مَا فِي السَّمٰوٰتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ)
“আকাশ এবং পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর।” (সূরা বাক্বারা ২:২৮৪)
সুতরাং যারা আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকার করবে, আল্লাহ তা‘আলার সার্বভৌমত্বকে মেনে নিবে না তারাই কাফির তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।
অতএব সে সমস্ত ইঁদুর কপালে লোকদের বিবরণ তুলে ধরছেন যারা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের জীবনের ওপর প্রাধান্য দেয় তথা আখিরাতের প্রতি ঈমান আনে না, আখিরাতকে ভয় করে পাপ ও আল্লাহ তা‘আলাদ্রোহী কাজ বর্জন করে না এবং দীন-ধর্মের কোন পরওয়া না করে লাগামহীন চলাফেরা করে । আর মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার পথে চলতে ও আসতে বাধা দেয়। আল্লাহ তা‘আলার পথে মানুষকে বাধা দেয়ার অনেক পদ্ধতি ও দিক রয়েছে; যেমন ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো, ইসলামী শিক্ষার ব্যাপারে কুধারণা সৃষ্টি করা, যারা দীন মেনে চলে তাদেরকে বিভিন্ন নামে ও উপাধি দিয়ে ব্যঙ্গ করা ও শারীরিক নির্যাতন করে ইসলামের পথে চলতে ও আসতে বাধা দেয়া। অনেকেই ইসলামের পথে চলতে চায় কিন্তু কেউ পারিবারিক কারণে, রাষ্ট্রীয় কারণে বা অন্য জাতির চাপের কারণে ইসলাম গ্রহণ ও তার পথে চলতে পারে না। মোট কথা যে কোন উপায়ে ইসলামের পথে বাধা এবং তাতে বক্রতা সৃষ্টি করা, তা যে কোন পদ্ধতি ও উপায়ে হোক আল্লাহ তা‘আলাদ্রোহী কাজ, তারা সুদূর গোমরাহীতে রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
أَنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الْأَئِمَّةُ الْمُضِلُّونَ
আমি আমার উম্মতের পথভ্রষ্ট নেতাদের ব্যাপারে বেশি ভয় করি। কারণ তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে এবং সঠিক পথে চলতে বাধা দিবে। (মুসনাদে আহমাদ হা: ২৬৯৩৯, সহীহুল জামে হা: ১৫৫১, সহীহ)
সুতরাং যারা আখেরাতের ওপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিবে, মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার পথে আসতে ও চলতে বাধা দেয় এবং ইসলামের নামে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট, অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করতে চায়। আমাদের উচিত এদের প্রপাগাণ্ডায় প্ররোচিত না হয়ে আল্লাহ তা‘আলা যে দীন দিয়ে যুগে যুগে রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং সর্বশেষ নাবী ও রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে চয়ন করেছেন তাঁর সে দীনের পথে বহাল থাকা এবং মানুষের মাঝে তার প্রচার করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য।
২. আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ব্যতীত কেউ সঠিক পথ লাভ করতে পারবে না।
৩. আখিরাতের ওপর ইহকালের প্রাধান্য দেয়া যাবে না।
৪. আলেমদের উচিত মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়া, কোন মত, তরীকাহ বা দলের দিকে নয়।