৪-৬ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা'আলা পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে মুশরিকদের একটি অজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন যা তার সত্তা সম্পর্কে ছিল। এখানে তিনি তাদের অন্য একটি অজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছেন যা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সত্তার সাথে সম্পর্কযুক্ত। তারা নবী (সঃ)-কে বলে- তুমি এই কুরআনকে অন্যদের সাহায্যবলে নিজেই বানিয়ে নিয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, এটা তাদের অত্যাচার ও মিথ্যামূলক কথা যা তারা নিজেরাও জানে। কিন্তু তাদের জানা কথারও বিপরীত কথা তারা বলছে।
কখনো কখনো তারা গলা উঁচু করে বলে যে, পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের কাহিনীগুলো তিনি লিখিয়ে নিয়েছেন এবং ঐগুলোই সকাল সন্ধ্যায় তাঁর মজলিসে পঠিত হয়। তাদের এটাও এমন একটা মিথ্যা কথা যে, এটা মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। কেননা, শুধু মক্কাবাসী নয়, বরং দুনিয়া জানে যে, আমাদের নবী (সঃ) নিরক্ষর ছিলেন। না তিনি লিখতে জানতেন পড়তে জানতেন। নবুওয়াতের পূর্বের চল্লিশ বছরের জীবন তিনি মক্কাবাসীদের মধ্যেই কাটিয়েছেন। তাঁর এ জীবন তাদের মধ্যে এমনভাবে কেটেছে যে, তার এ দীর্ঘ জীবনের মধ্যে এমন একটি ঘটনা ঘটেনি যার ফলে তাঁর প্রতি কোন প্রকার দোষারোপ করা যেতে পারে। মক্কাবাসী তাঁর এক একটি গুণের উপর পাগল ছিল। তাঁর মধুর চরিত্র এবং উত্তম ব্যবহারে তারা এমনভাবে মুগ্ধ ছিল যে, তাকে তারা মুহাম্মদ আমীন (সঃ) বলে অত্যন্ত স্নেহের সুরে আহ্বান করতো। কোন এমন অন্তর ছিল যাতে তিনি বাসা বাঁধেননি? কোন এমন চক্ষু ছিল যাতে তার মর্যাদা প্রকাশিত হয়নি? কোন এমন সমাবেশ ছিল যেখানে তাঁর সম্পর্কে উত্তম আলোচনা হয়নি? কোন এমন লোক ছিল যে তাঁর বুযর্গী, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্থতা ও সততার উক্তিকারী ছিল না? অতঃপর তাকেই যখন মহান আল্লাহ উচ্চতম সম্মানে সম্মানিত করলেন, আসমানী অহীর তাঁকে আমীন বানানো হলো, তখন শুধু বাপ-দাদার রীতি-নীতি ও কু-প্রথা উঠে যেতে দেখে ঐ নির্বোধের দল তাঁর শক্ত হয়ে দাঁড়ায়, তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করে দেয় এবং তার প্রতি নানারূপ মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে। তাঁর সম্পর্কে তারা নানারূপ মন্তব্য করে। কেউ তাকে কবি বলে, কেউ বলে যাদুকর এবং কেউ বলে পাগল। কি করে তারা তাদের বাপ-দাদাদের অজ্ঞতাপূর্ণ রীতি-নীতি ও কু-প্রথা ঠিক রাখতে পারে এই চিন্তাতেই তারা সদা নিমগ্ন থাকে। তারা এ চিন্তাও করতে থাকে যে, কোনক্রমেই যেন তাদের মিথ্যা ও বাজে উপাস্যদের পতাকা উল্টোমুখে পতিত হয় এবং অজ্ঞতার অন্ধকারে পরিপূর্ণ দুনিয়া আল্লাহর জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়। এখন তাদেরকে মহান আল্লাহর পক্ষ হতে জবাব দেয়া হচ্ছেঃ হে নবী (সঃ)! তুমি বলে দাও- এই কুরআন তো তিনিই অবতীর্ণ করেছেন যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমুদয় রহস্য অবগত আছেন। যার থেকে এক অণু-পরিমাণ জিনিসও লুক্কায়িত নয়। এতে অতীতের যেসব ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। তার সবই সত্য। ভবিষ্যতে যা কিছু ঘটবার বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেগুলোও সত্য। যা কিছু হবে সবই আল্লাহর কাছে সমান। তিনি অদৃশ্যকে ঐ ভাবেই জানেন যেমন তিনি জানেন দৃশ্যকে।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেন যে, তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। তাঁর এ কথা বলার কারণ হলো যাতে মানুষ তার থেকে নিরাশ না হয়ে যায়। তারা যেন এ আশা করতে পারে যে, তারা যত কিছু অন্যায় ও দুস্কার্য করুক না কেন, পরে যদি তারা শুদ্ধ অন্তঃকরণে সমস্ত পাপ হতে তাওবা করতঃ তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে তিনি তাদের পূর্বের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দিবেন। এরূপ আশা পেয়ে হয়তো তারা তাদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হবে এবং মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টির সন্ধানী হবে।
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা কতই না মহান ও দয়ালু যে, যারা তার চরম অবাধ্য ও শত্রু, যারা তার প্রিয় রাসূল (সঃ)-কে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কষ্ট দিচ্ছে, তাদেরকেও তিনি নিজের সাধারণ করুণার দিকে আহ্বান করছেন! যারা তাকে মন্দ বলছে, তাঁর রাসূল (সঃ)-কে খারাপ বলছে তাদেরকেও তিনি ক্ষমা করে দেয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন এবং তাদের সামনে ইসলাম ও হিদায়াত পেশ করছেন! নিজের উত্তম কথাগুলো তাদেরকে বুঝাতে রয়েছেন! যেমন অন্য আয়াতে তিনি ত্রিত্ববাদী খৃষ্টানদের ত্রিত্ববাদিতার বর্ণনা দেয়ার পর তাদের শাস্তির কথা উল্লেখ করতঃ বলেন
اَفَلَا یَتُوْبُوْنَ اِلَى اللّٰهِ وَ یَسْتَغْفِرُوْنَهٗ وَ اللّٰهُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ
অর্থাৎ “তারা কি আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতঃ তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (৫:৭৪) তিনি আর এক জায়গায় বলেনঃ
اِنَّ الَّذِیْنَ فَتَنُوا الْمُؤْمِنِیْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتِ ثُمَّ لَمْ یَتُوْبُوْا فَلَهُمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ وَ لَهُمْ عَذَابُ الْحَرِیْقِ
অর্থাৎ “নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাসী নর-নারীদের বিপদাপন্ন করেছে এবং পরে তাওবা করেনি তাদের জন্যে আছে জাহান্নামের শাস্তি, আছে দহন যন্ত্রণা।” (৮৫:১০)।
হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃ “আল্লাহর এই দয়া ও দানের প্রতি লক্ষ্য করুন যে, যারা তাঁর বন্ধুদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তাদেরকে তিনি তাওবা ও রহমতের দিকে আহ্বান জানাচ্ছেন। (এটা কত বড় দয়া ও সহনশীলতার পরিচায়ক)!”