১২-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্বে দাঊদ (عليه السلام)-কে যে সকল নেয়ামত দেয়া হয়েছিল তার বর্ণনা দেয়ার পর পুত্র সুলাইমান (عليه السلام)-কে যে সকল নেয়ামত বা মু‘জিযাহ দান করা হয়েছিল তার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে।
আল্লাহ তা‘আলা সুলাইমান (عليه السلام)-কে অনেক বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন, তন্মধ্যে সূরা নামলের ১৫-৪৪ নং আয়াতের তাফসীরে দুটি উল্লেখ করা হয়েছে। বাকীগুলো সূরা সোয়াদে উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে অত্র আয়াতগুলোর সাথে সম্পৃক্তগুলো উল্লেখ করা হল।
(১) আল্লাহ তা‘আলা বায়ু প্রবাহকে সুলাইমান (عليه السلام)-এর অনুগত করে দিয়েছিলেন। তাঁর হুকুম মত বায়ু তাঁকে তাঁর ইচ্ছামত স্থানে বহন করে নিয়ে যেত। তিনি সদলবলে বায়ুর মাধ্যমে নিজ সিংহাসনে সওয়ার হয়ে দু‘মাসের পথ একদিনে পৌঁছে যেতেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلِسُلَیْمٰنَ الرِّیْحَ عَاصِفَةً تَجْرِیْ بِاَمْرِھ۪ٓ اِلَی الْاَرْضِ الَّتِیْ بٰرَکْنَا فِیْھَاﺚ وَکُنَّا بِکُلِّ شَیْءٍ عٰلِمِیْنَ)
“এবং সুলাইমানের বশীভূত করে দিয়েছিলাম প্রচণ্ড বায়ুকে; সে বায়ু তার আদেশক্রমে প্রবাহিত হত সে দেশের দিকে যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি; প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে আমি সম্যক অবগত।” (সূরা আম্বিয়া ২১:৮১)
(২) তামার ন্যায় শক্ত পদার্থকে আল্লাহ তা‘আলা সুলাইমান (عليه السلام)-এর জন্য তরল ধাতুতে পরিণত করেছিলেন। যেমন
(وَاَسَلْنَا لَھ۫ عَیْنَ الْقِطْرِ)
‘আমি তার জন্য গলিত তামার এক প্রস্রবন প্রবাহিত করে দিলাম।’ এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ঐ গলিত ধাতু উত্তপ্ত ছিল না। বরং তা দিয়ে অতি সহজে পাত্রাদি তৈরি করা যেত। সুলাইমান (عليه السلام)-এর পর থেকেই তামা গলিয়ে পাত্রাদি তৈরি করা শুরু হয় বলে ইমাম কুরতুবী বর্ণনা করেছেন। পিতা দাঊদের জন্য ছিল লোহা গলানোর মু‘জিযাহ আর পুত্র সুলাইমানের জন্য তামা গলানোর মু‘জিযাহ। এজন্যই আয়াতের শেষে বলা হয়েছে; ‘হে দাঊদের ক্বাওম! কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে খুব অল্পই কৃতজ্ঞ।’
(৩) জিন জাতিকে তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন। ফলে তিনি যখন কোন কাজের ইচ্ছা করতেন তখন সে কাজ তাঁর সামনে তাদের দ্বারা করিয়ে নিতেন। তারা সুলাইমান (عليه السلام)-এর ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, মূর্তি অর্থাৎ কাঁচের, তামার ইত্যাদির প্রতিচ্ছবি, বড় বড় পাত্র, ডেগ ইত্যাদি নির্মাণ করত এবং সাগরে ডুব দিয়ে তলদেশ থেকে মূল্যবান মণি-মুক্তা, হীরা তুলে আনত।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنَ الشَّیٰطِیْنِ مَنْ یَّغُوْصُوْنَ لَھ۫ وَیَعْمَلُوْنَ عَمَلًا دُوْنَ ذٰلِکَﺆ وَکُنَّا لَھُمْ حٰفِظِیْنَ)
“এবং শয়তানদের মধ্যে কতক সুলাইমানের জন্য ডুবুরীর কাজ করত, তা ব্যতীত অন্য কাজও করত; আমি তাদের রক্ষাকারী ছিলাম।” (সূরা আম্বিয়া ২১:৮২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَالشَّیٰطِیْنَ کُلَّ بَنَّا۬ئٍ وَّغَوَّاصٍ ﭴﺫوَّاٰخَرِیْنَ مُقَرَّنِیْنَ فِی الْاَصْفَادِﭵ)
“এবং অধীন করেছিলাম শয়তানদেরকেও, যারা ছিল ইমারত নির্মাণকারী ও ডুবুরী। এবং আরও অনেককে, যারা শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকত।” (সূরা সোয়াদ ৩৮:৩৭-৩৮)
مَّحَارِيْب শব্দটি محراب -এর বহুবচন। অর্থ হলো, উঁচু জায়গা অথবা সুন্দর অট্টালিকা।
تَمَاثِيْل শব্দটি تماثيل-এর বহুবচন। অর্থ হলোন প্রতিমা, মূর্তি। তবে ইসলামে মূর্তি তৈরি করা নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি কোন ছবি অংকন করবে (প্রাণী জাতীয়) আল্লাহ তা‘আলা তাকে শাস্তি দেবেন যতক্ষণ না সে তাতে রূহ দিতে পারবে। কিন্তু সে কোন দিন তাতে রূহ দিতে পারবে না। (সহীহ বুখারী হা: ২২২৫) جِفَان শব্দটি جفنة-এর বহুবচন। অর্থ হলো, বিরাট পাত্র।
الْجَوَاب শব্দটি جابية-এর বহুবচন। ঐ হাউজকে বলা হয় যাতে পানি আসতে থাকে।
قُدُوْرٍ অর্থ ডেগ আর راسيات অর্থ স্বস্থানে স্থাপিত। এ সকল ডেগ পাথর খোদাই করে নির্মাণ করা হত, যা স্থানান্তর করার যোগ্য ছিল না।
এ সকল নেয়ামতরাজির বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এ নির্দেশ প্রদান করেছেন যে, তারা যেন মহান আল্লাহ তা‘আলার শুকুরগুজারী হয়।
আবূ আব্দুর রহমান আল হুখুলী বলেন: সালাত আদায় করা একটি শুকরিয়া, সিয়াম পালন করা একটি শুকরিয়া, অনুরূপভাবে প্রত্যেক ভাল কাজ একটি শুকরিয়া। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার কাছে সর্বোত্তম সালাত হলো দাঊদ (عليه السلام)-এর সালাত, তিনি প্রথম অর্ধরাত ঘুমাতেন, এক তৃতীয়াংশ নফল সালাত পড়তেন, আর এক ষষ্ঠাংশ ঘুমাতেন। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪১৯)
বায়তুল মুক্বাদ্দাস নির্মাণ ও সুলাইমান (عليه السلام)-এর মৃত্যুর বিস্ময়কর ঘটনা:
সুলাইমান (عليه السلام)-এর তিন নং মু‘জিযায় উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা জিন জাতিকে তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন। ফলে তিনি যখন কোন কাজের ইচ্ছা করতেন তখন সে কাজ তাঁর সামনে জিনের দ্বারা করিয়ে নিতেন। এ সুযোগে তিনি তাদের দ্বারা বাইতুল মুক্বাদ্দাস পুনঃনির্মাণের কাজ করিয়ে নিলেন। মূলত বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নির্মাণ সর্বপ্রথম ফেরেশতাদের মাধ্যমে অথবা আদম (عليه السلام)-এর কোন সন্তানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় কা‘বা গৃহের ৪০ বছর পর। অতঃপর স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ইয়া‘কূব (عليه السلام) তা পুননির্মাণ করেন। প্রায় হাজার বছর পর দাঊদ (عليه السلام) তার পুননির্মাণ শুরু করেন এবং সুলাইমান (عليه السلام)-এর হাতে তা সমাপ্ত হয়। কিন্তু মূল নির্মাণ কাজ শেষ হলেও আনুসঙ্গিক কিছু কাজ তখনও অবশিষ্ট থেকে যায়। এমন সময় সুলাইমান (عليه السلام)-এর মৃত্যুকাল ঘনিয়ে আসে। এ কাজগুলো অবাধ্যপ্রবণ জিনদের ওপর ন্যস্ত ছিল। তারা সুলাইমান (عليه السلام)-এর ভয়ে কাজ করত। তারা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারলে কাজ ফেলে পালাতো। ফলে নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তখন সুলাইমান (عليه السلام) আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে তাঁর কাঁচ নির্মিত মেহরাবে প্রবেশ করলেন। যাতে বাইরে থেকে ভেতরে সবকিছু দেখা যায়। তিনি বিধানানুযায়ী ইবাদতের উদ্দেশ্যে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে গেলেন, যাতে রূহ বেরিয়ে যাবার পরেও লাঠিতে ভর দিয়ে দেহ স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। সেটাই হল। আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে তাঁর দেহ উক্ত লাঠিতে ভর করে এক বছর দাঁড়িয়ে থাকল। দেহ পচলো না, খসলো না বা পড়েও গেল না। জিনেরা ভয়ে চলে যায়নি। ফলে তারা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কাজ শেষ করে ফেলল। এভাবে কাজ সমাপ্ত হলে আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে কিছু উইপোকা লাঠি খেয়ে ফেলার কারণে তা ভেঙ্গে পড়লে তিনি দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে যান। তখন জিনেরা বুঝতে পারল সুলাইমান (عليه السلام) অনেক আগেই মারা গেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: জিনেরা যদি গায়েবের খবর জানত তাহলে তারা এ শাস্তিমূলক নির্মাণ কাজ করত না। অতএব জানা গেল জিনেরাও গায়েবের খবর জানে না। এ বিষয়ে জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই আছে। কোন নাবী-রাসূল, আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যশীল ফেরেশতাদেরও এ জ্ঞান নেই।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সুলাইমান (عليه السلام)-এর প্রতি যে সকল নেয়ামত দান করা হয়েছিল সে সম্পর্কে জানা গেল।
২. কৃতজ্ঞ বান্দাদের সংখ্যা খুবই কম। আর অকৃতজ্ঞ লোকদের সংখ্যাই বেশি। সুতরাং দল বড় হলেই মনে করা যাবে না যে, এরাই সঠিক পথের অনুসারী।
৩. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কেউ অদৃশ্যের খবর জানেন না, এমনকি নাবী রাসূলগণও নয় এবং জিনেরাও নয়।
৪. মৃত্যুর নির্ধারিত সময় উপস্থিত হলে নাবী-রাসূল যে-ই হোক না কেন এক মুহূর্তও সুযোগ থাকে না। যদিও নাবীদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হয়।
৫. আল্লাহ তা‘আলা কোন কাজ করতে চাইলে তা যে কোন উপায়ে করিয়ে নেন।