১৩-১৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
পূর্বের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা বাহ্যিক ও দৈহিক নেয়ামত উল্লেখ করার পর এখানে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করছেন তা হল : যে আল্লাহ তা‘আলা আকাশ-জমিনের সবকিছুর মালিক সে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য এমন এক দীন শরীয়ত হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন যা সব ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র। সে দীন হল ইসলাম, এ শ্রেষ্ঠ দীন দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার বুকে শ্রেষ্ঠ মানুষদের প্রেরণ করেছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন হলেন ‘উলূল আযম’ রাসূল। যথা : নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। পৃথিবীর সূচনা লগ্ন থেকে শেষ নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত যত নাবী-রাসূল পৃথিবীতে এসেছেন সকলের ধর্মের মূলনীতি ছিল একটি, তা হলো এক আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদত করতে হবে, যিনি ব্যতীত আর কোন সত্য মা‘বূদ নেই।
প্রশ্ন হতে পারে, সর্বপ্রথম নাবী আদম (আঃ)-এর কথা উল্লেখ না করে নূহ (আঃ) দ্বারা শুরু করা হল কেন? অথচ তিনি প্রথম নাবী! উত্তর : আদম (আঃ)-এর যুগে কোন কুফর ও শির্ক ছিল না; কারণ তিনি দীন নিয়েই পৃথিবীতে আসেন এবং তা পালন করেন। সর্বপ্রথম ধর্মের নামে সুধারণা নিয়ে শির্কের প্রর্বতন করা হয় নূহ (আঃ)-এর যুগে। তাই তাঁকে দিয়ে দীনের দাওয়াত শুরু করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّيْنَ مِيْثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُّوْحٍ وَّإِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسٰي وَعِيْسَي ابْنِ مَرْيَمَ ص وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِّيْثَاقًا غَلِيْظًلا)
“আর স্মরণ কর! যখন আমি শপথ গ্রহণ করেছিলাম নাবীদের কাছ থেকে এবং তোমার কাছ থেকে, নূহ, ইবরাহীম ও ঈসা ইবনু মারইয়ামের কাছ থেকে আর তাদের থেকে গ্রহণ করেছিলাম অতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি।” (সূরা আহ্যাব ৩৩ : ৭)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمَآ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَّسُوْلٍ إِلَّا نُوْحِيْٓ إِلَيْهِ أَنَّه۫ لَآ إِلٰهَ إِلَّآ أَنَا فَاعْبُدُوْنِ)
“আমি তোমার পূর্বে যখন কোন রাসূল প্রেরণ করেছি তার প্রতি এ ওয়াহী করেছি যে, ‘আমি ব্যতীত অন্য কোন সত্যিকার মা‘বূদ নেই; সুতরাং আমারই ‘ইবাদত কর।’ (সূরা আম্বিয়া- ২১ : ২৫)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আমরা রাসূলগণ বৈমাত্রেয় ভাই। (পিতা একই মাতা ভিন্ন) কিন্তু আমাদের সকলের ধর্ম এক ও অভিন্ন।
(أَنْ أَقِيْمُوا الدِّيْنَ)
অর্থাৎ সকল নাবীদের প্রতি এ মর্মে ওয়াহী করেছেন যে, তোমরা দীন তথা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান, রাসূলদের আনুগত্য ও তাওহীদের সাথে সকল ইবাদত সম্পাদন কর। এটাই সকল নাবীদের দীন, যদিও নিয়ম-পদ্ধতিতে কিছু পার্থক্য ছিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَّمِنْهَاجًا)
“আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছি একটি নির্দিষ্ট শারীয়ত ও একটি নির্দিষ্ট পথ।” ( সূরা মায়িদা ৫ : ৪৮)
(وَلَا تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ)
অর্থাৎ ধর্মের ভেতর দলাদলি ও মতানৈক্য সৃষ্টি করিও না। এ আয়াতে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত রাখা ফরয ও বিভেদ সৃষ্টি করা হারাম বলা হয়েছে। ধর্ম বলে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে যা সকল নাবীদের ধর্ম। সুতরাং ধর্মের ওপর ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে, বিভিন্ন দল ও মতে বিভক্ত হয়ে ফেরকা তৈরি করা যাবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّ الَّذِيْنَ فَرَّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِيْ شَيْءٍ إِنَّمَآ أَمْرُهُمْ إِلَي اللّٰهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَفْعَلُوْنَ)
“নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দীনকে (বিভিন্ন মতে) খণ্ড বিখণ্ড করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোন দায়িত্ব তোমার নয়; তাদের বিষয় আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন।” (সূরা আনআম ৬ : ১৫৯)
জামা‘আতী জিন্দেগীর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :
জামা‘আতবদ্ধ হয়ে জীবন-যাপন করা প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর আবশ্যক, দলে দলে বিভক্ত হওয়া হারাম। মুসলিমদেরকে জামা‘আতবদ্ধ হয়ে বসবাস করার প্রতি ইসলাম যে গুরুত্ব দিয়েছে তা বর্ণনাতীত। পবিত্র কুরআনে সূরা আলি ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللّٰهِ جَمِيْعًا وَّلَا تَفَرَّقُوْا)
“আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রশিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের নির্দেশ করেছেন এবং দল-উপদলে বিভক্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। (ইবনু কাসীর) ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা সম্প্রীতির আদেশ করেন এবং দল-উপদলে বিভক্তি হতে নিষেধ করেন। কেননা, দলাদলিতেই ধ্বংস, আর জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপনেই নাজাত। (কুরতুবী)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের তিনটি বিষয়ে সন্তুষ্ট, আর তিনটি বিষয়ে অসন্তুষ্ট হন। তিনি তোমাদের জন্য সন্তুষ্ট হন যে, তোমরা তাঁরই ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। আর তোমরা আল্লাহ তা‘আলার রজ্জুকে সৃদৃঢ় ও সম্মিলিতভাবে ধারণ করবে, দলে দলে বিভক্ত হবে না। আর তোমাদের জন্য অপছন্দ করেন- মানুষের কথা নিয়ে টানা-হেঁচড়া করা, অযথা বেশি বেশি প্রশ্ন করা এবং সম্পদ নষ্ট করা। (সহীহ মুসলিম হা. ১৭১৫)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ
যে ব্যক্তি মুসলিমদের জামা‘আত থেকে অর্ধ-হাত পরিমাণও দূরে সরে গেল সে ইসলামের বন্ধন তার কাঁধ থেকে সরিয়ে নিল। (আবূ দাঊদ হা. ৪৭৫৮, সহীহ)
তিনি আরো বলেন :
يَدُ اللّٰهِ مَعَ الجَمَاعَةِ
জামা‘আতীদের সাথেই আল্লাহ তা‘আলার হাত। (তিরমিযী হা. ২১৬৬, সহীহ)
সুতরাং মুসলিমরা যতদিন জামা‘আতবদ্ধ হয়ে জীবন-যাপন করেছে ততদিন তারা পৃথিবী শাসন করেছে, কিন্তু যখনই তারা জামা‘আত ভঙ্গ করে দলাদলি সৃষ্টি করল তখনই তাদের ওপর নেমে আসল লাঞ্ছনা ও অপমান।
কোন ভেড়ার পাল থেকে একটি ভেড়া আলাদা হয়ে গেলে যেমন নেকড়ে সহজেই তাকে আক্রমন করতে পারে ঠিক জামা‘আত থেকে আলাদা হয়ে গেলে অবস্থা তাই-ই হবে। ইসলামের মূল ভিত্তিই হল ঐক্য, একথাটি বুঝতে পেরেছিল ইংরেজরা, তারা বুঝতে পেরেছিল সাত সাগর তের নদী পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষ শাসন করা সম্ভব নয়। তাই তারা নীতি গ্রহণ করল মুসলিমরা এক থাকলে তাদের ওপর শাসন কায়েম করা যাবে না, সুতরাং এদেরকে শাসন করতে হলে প্রয়োজন (ডিভাইডেড এন্ড রোল) অর্থাৎ ‘বিভাজন কর এবং শাসন কর’ নীতি। আজও আমরা সে বিভাজনে পড়ে রইলাম। সুতরাং মুসলিমদের উচিত হবে তাদের সে পুরোনো গৌরবগাঁথা ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সকলে এক হয়ে ইসলামের জন্য কাজ করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সকল নাবীদের দীনের মূলনীতি ছিল একই- এক আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদত করতে হবে এবং দলবদ্ধভাবে জীবন-যাপন করতে হবে, পৃথক হওয়া যাবে না।
২. সত্যের দা‘ওয়াত মুশরিকদের নিকট বড়ই রাগের একটি বিষয়।
৩. মানুষের ব্যাপারে পূর্ব থেকেই সিদ্ধান্ত করে রাখা হয়েছে।
৪. সকল মুসলিমকে জামা‘আত বদ্ধ হয়ে আমীরের নেতৃত্বে জীবন-যাপন করা আবশ্যক।