৩৬-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:
ইরশাদ হচ্ছেঃ এই কাফিররা কতটুকু ক্ষমতা রাখে? এদের পূর্বে এদের চেয়ে বেশী শক্তিশালী এবং সংখ্যায় অধিক লোকদের এই অপরাধের কারণেই আল্লাহ তা'আলা ধ্বংস করে দিয়েছেন, যারা শহরে বহু কিছু স্মৃতিসৌধ ছেড়ে গেছে। ভূ-পৃষ্ঠে তারা বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। তারা দীর্ঘ সফর করতো। আল্লাহর শাস্তি দেখে তা হতে বাঁচার পথ তারা অনুসন্ধান করতে থাকে। কিন্তু তাদের ঐ চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। আল্লাহর পাকড়াও হতে কে বাঁচতে পারে? প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ কাফিরদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ তোমরা মনে রেখো যে, যখন আমার শাস্তি এসে যাবে তখন ভূষির মত উড়ে যাবে। প্রত্যেক জ্ঞানী ও বিবেকবান ব্যক্তির জন্যে এতে যথেষ্ট উপদেশ ও শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। যে নিবিষ্ট চিত্তে এটা শ্রবণ করে তার জন্যেও এতে শিক্ষা ও উপদেশ আছে।
অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এগুলোর অন্তর্বর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছি ছয় দিনে এবং এতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়িনি। এতেও এটা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা'আলা মৃত্যুর পর পুনর্জীবন দান করতে পূর্ণরূপে ক্ষমতাবান। কেননা, এতো বড় মাখলুককে যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন তাঁর পক্ষে মৃতকে পুনর্জীবিত করা মোটেই কঠিন নয়।
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ অভিশপ্ত ইয়াহূদীরা বলতো যে, আল্লাহ তা'আলা ছয় দিনে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম গ্রহণ করেন। আর ঐ দিনটি ছিল শনিবার। ঐ দিনের নামটিই তারা يَوْمُ السَّبْتِ রেখে তবে ছেড়েছিল। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা তাদের এই বাজে ধারণাটি খণ্ডন করতে গিয়ে বলেন যে, তিনি ক্লান্তই হননি, কাজেই বিশ্রাম কিসের? যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ
اَوَ لَمْ یَرَوْا اَنَّ اللّٰهَ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ وَ لَمْ یَعْیَ بِخَلْقِهِنَّ بِقٰدِرٍ عَلٰۤى اَنْ یُّحْیَِۧ الْمَوْتٰى بَلٰۤى اِنَّهٗ عَلٰى كُلِّ شَیْءٍ قَدِیْرٌ
অর্থাৎ “তারা কি অনুধাবন করে না যে, আল্লাহ, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং এসবের সৃষ্টিতে কোন ক্লান্তি বোধ করেননি, তিনি মৃতের জীবনদান করতেও সক্ষম? বস্তুতঃ তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (৪৬:৩৩)
আর যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর এক আয়াতে বলেনঃ
لَخَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ اَكْبَرُ مِنْ خَلْقِ النَّاسِ
অর্থাৎ “অবশ্যই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করা মানব সৃষ্টি করা অপেক্ষা বহুগুণে বড় (কঠিন)।” (৪০:৫৭) আল্লাহ তা'আলা আরো বলেনঃ
ءَاَنْتُمْ اَشَدُّ خَلْقًا اَمِ السَّمَآءُ بَنٰىهَاٙ
অর্থাৎ “তোমাদেরকেই কি সৃষ্টি করা কঠিন, না আকাশ, যা তিনি বানিয়েছেন?” (৭৯:২৭)
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! অতএব তারা তোমাকে যা বলে তাতে তুমি মনঃক্ষুন্ন হয়ো না বরং ধৈর্যধারণ কর, তাদেরকে অবকাশ দাও, তাদেরকে ছেড়ে দাও এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে এবং রাত্রে তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।
মিরাজের পূর্বে ফজরের ও আসরের নামায ফরয ছিল এবং রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর এবং তার উম্মতের উপর এক বছর পর্যন্ত তাহাজ্জুদের নামায ওয়াজিব থাকে। তারপর তাঁর উম্মতের উপর হতে এর বাধ্যবাধকতা রহিত হয়ে যায়। অতঃপর মিরাজের রাত্রে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হয়, যেগুলোর মধ্যে। ফজর ও আসরের নাম যেমন ছিল তেমনই থাকে। সুতরাং সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে এ কথার দ্বারা ফজর ও আসরের নামাযকে বুঝানো হয়েছে।
হযরত জারীর ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমরা (একদা) নবী (সঃ)-এর নিকট বসেছিলাম। তিনি চৌদ্দ তারিখের চাঁদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং বলেনঃ “তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের সামনে হাযির করা হবে এবং তাকে তোমরা এমনিভাবে দেখতে পাবে যেমনভাবে এই চাঁদকে দেখছো। সুতরাং তোমরা পারলে অবশ্যই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বের নামাযকে কখনো ছাড়বে না।” অতঃপর তিনি وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ ـ ـ ـ -এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম বুখারী (রঃ) এবং ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে আরো বলেনঃ ‘রাত্রেও তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।' যেমন অন্য আয়াতে বলেনঃ
وَ مِنَ الَّیْلِ فَتَهَجَّدْ بِهٖ نَافِلَةً لَّكَ عَسٰۤى اَنْ یَّبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُوْدًا
অর্থাৎ “এবং রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করবে, এটা তোমার এক অতিরিক্ত বর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে।” (১৭:৭৯)
اَدْبَارَ السُّجُوْدِ দ্বারা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতে নামাযের পরে তাসবীহ পাঠকে বুঝানো হয়েছে।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, দরিদ্র মুহাজিরগণ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ধনী লোকেরা তো উচ্চ মর্যাদা ও চিরস্থায়ী নিয়ামত লাভ করে ফেলেছেন!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “কিরূপে?” তারা জবাবে বললেনঃ আমাদের মত তারাও নামায পড়েন ও রোযা রাখেন। কিন্তু তারা দান-খয়রাত করেন যা আমরা করতে পারি না এবং তাঁরা গোলাম আযাদ করেন, আমরা তা করতে সমর্থ হই না।” তিনি তখন তাদেরকে বললেনঃ “এসো, আমি তোমাদেরকে এমন আমলের কথা বলে দিই যা তোমরা করলে তোমরাই সর্বাপেক্ষা অগ্রগামী হয়ে যাবে, তোমাদের উপর কেউই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারবে না। কিন্তু তারাই পারবে যারা তোমাদের মত আমল করবে। তোমরা প্রত্যেক নামাযের পরে সুবহানাল্লাহ', 'আলহামদুলিল্লাহ’ এবং আল্লাহু আকবার' তেত্রিশবার করে পাঠ করবে।” (কিছু দিন পর) তারা আবার আসলেন এবং বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের ধনী ভ্রাতাগণও আমাদের এ আমলের মত আমল করতে শুরু করেছেন!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করে থাকেন।”
দ্বিতীয় উক্তি এই যে, এর দ্বারা মাগরিবের পরে দুই রাকআত নামাযকে বুঝানো হয়েছে। হযরত উমার (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), হযরত হাসান ইবনে আলী (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এবং হযরত আবু উমামাও (রাঃ) এ কথাই বলেন। হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত শা’বী (রঃ), হযরত নাখঈ (রঃ) এবং হযরত কাতাদা (রঃ)-এরও এটাই উক্তি।
হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রত্যেক ফরয নামাযের পরে দুই রাকআত নামায পড়তেন, শুধু ফজর ও আসরের পরে পড়তেন না । (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) আব্দুর রহমান (রঃ) প্রত্যেক নামাযের পরে’ একথা বলেছেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একটি রাত্রি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট অতিবাহিত করি। তিনি ফজরের ফরয নামাযের পূর্বে দুই রাকআত নামায হালকাভাবে আদায় করেন। তারপর তিনি (ফরয) নামাযের জন্যে বাড়ী হতে বের হন এবং আমাকে বলেনঃ “হে ইবনে আব্বাস (রাঃ)! ফজরের পূর্বে দুই রাকআত নামায হলো اَدْبَارَ النُّجُوْم এবং মাগরিবের পরে দুই রাকআত নামায হলো اَدْبَارَ السُّجُوْدِ।” এটা ঐ রাত্রির ঘটনা, যে রাত্রিতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) তাহাজ্জুদের তেরো রাকআত নামায রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে আদায় করেছিলেন এবং ঐটি ছিল তার খালা হযরত মায়মূনা (রাঃ)-এর পালার রাত্রি। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে গারীব বলেছেন। হ্যাঁ, তবে তাহাজ্জুদের মূল হাদীস তো সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও রয়েছে। সম্ভবতঃ পরবতী কথাটি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর নিজের কথাই হবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)