১৭-১৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা বলেন, যারা আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করে তারা আল্লাহর মসজিদগুলো আবাদ করার যোগ্যই নয়। তারা তো মুশরিক! আল্লাহর ঘরের সাথে তাদের কি সম্পর্ক? مَسَاجِد শব্দটিকে مَسْجِد ও পড়া হয়েছে। এর দ্বারা মসজিদুল হারামকে বুঝানো হয়েছে, যা দুনিয়ার মসজিদসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মর্যাদার অধিকারী। এটা প্রথম দিন থেকে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্যেই নির্মিত হয়েছে। আল্লাহর খলীল ইবরাহীম (আঃ) এ ঘরের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। এ লোকগুলো নিজেদের অবস্থার দ্বারা ও কথার দ্বারা নিজেদের কুফরীর স্বীকারোক্তিকারী। যেমন সুদ্দী (রঃ) বলেন, তুমি যদি খ্রীষ্টানকে জিজ্ঞেস কর – “তোমার ধর্ম কি?” সে অবশ্যই উত্তরে বলবেঃ “আমি খ্রীষ্টান ধর্মের লোক।” ইয়াহূদীকে তার ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে বলবেঃ “আমি ইয়াহুদী ধর্মাবলম্বী।” সাবীকে জিজ্ঞেস করলে সেও বলবেঃ “আমি সাবী।” এই মুশরিকরাও বলবে, “আমরা মুশরিক।” আল্লাহ পাক বলেনঃ তাদের সমস্ত আমল বিফল হয়ে গেল। কারণ তারা আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করেছে। চিরদিনের জন্যে তারা জাহান্নামী হয়ে গেল। তারা অন্যদেরকে মসজিদুল হারাম থেকে বাধা প্রদান করে থাকে। তারা নিজেদেরকে আল্লাহর বন্ধু বললেও প্রকৃতপক্ষে তারা তা নয়। আল্লাহর বন্ধু তো ওরাই যারা তাকে ভয় করে চলে। কিন্তু অধিকাংশ লোকই এটা বুঝে না ও জানে না। হ্যাঁ, আল্লাহর ঘরের আবাদ হবে মুমিনদের দ্বারা। সুতরাং যাদের দ্বারা আল্লাহর ঘর আবাদ হয়, কুরআন কারীম হচ্ছে তাদের ঈমানের সাক্ষী।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন তোমরা কোন লোককে দেখতে পাও যে, সে মসজিদে যেতে আসতে অভ্যস্ত হয়েছে তখন তোমরা তার ঈমানের সাক্ষ্য প্রদান কর।” অতঃপর তিনি اِنَّمَا یَعْمُرُ مَسٰجِدَ اللّٰهِ مَنْ اٰمَنَ بِاللّٰهِ -এই আয়াতটি পাঠ করেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইবনে মিরদুওয়াই (রঃ) এবং ইমাম হাকিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মসজিদসমূহের আবাদকারীরাই হলো আল্লাহওয়ালা।” আনাস (রাঃ) হতে মারফু’রূপে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তা'আলা মসজিদমুখীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে গোটা কওমের উপর থেকেই আযাব সরিয়ে নেন।” আনাস (রাঃ) হতেই মারফু’রূপে আরো একটি হাদীস বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “আমার সম্মান ও মর্যাদার কসম! আমি পৃথিবীবাসীর উপর শাস্তি প্রেরণের ইচ্ছা করি, কিন্তু যখন আমার ঘরসমূহের আবাদকারীদের প্রতি, আমারই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পরস্পর প্রেম বিনিময়কারীদের প্রতি এবং প্রাতঃকালে ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করি তখন ঐ আযাব তাদের উপর থেকে সরিয়ে থাকি।” (ইবনে আসাকের (রঃ) বলেন যে, এ হাদীসটি গারীব বা দুর্বল)
মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “শয়তান হচ্ছে মানুষের জন্যে নেকড়ে বাঘ স্বরূপ। যেমন বকরীর (শুক্র) নেকড়ে বাঘ দূরে পৃথক ও বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থানকারী বকরীকে ধরে নেয় (তদ্রুপ তোমরা দল ছাড়া হয়ে থাকলে তোমাদেরকেও শয়তান পথভ্রষ্ট করবে)। সুতরাং তোমরা মতভেদ সৃষ্টি করা থেকে বেঁচে থাক এবং নিজেদের জন্যে জামাআত, সর্বসাধারণ ও মসজিদসমূহ আঁকড়ে ধরাকে অপরিহার্য করে নও।
আমর ইবনে মায়মূন আওদী (রঃ) বলেন, আমি মুহাম্মাদ (সঃ)-এর সাহাবীগণকে বলতে শুনেছি- “ভূ-পৃষ্ঠের মসজিদগুলো আল্লাহর ঘর। যারা এখানে আসবে, আল্লাহর হক হচ্ছে তাদেরকে মর্যাদা দেয়া।” ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি সালাতের আযান শোনার পর মসজিদে এসে জামাআতের সাথে সালাত আদায় করে না, তার সালাত হয় না। সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর নাফরমানী করলো। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “আল্লাহর মসজিদগুলো আবাদ করা তাদেরই কাজ, যারা আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামতের দিনের প্রতি ঈমান আনয়ন করে। (এটা ইবনে মিরদুওয়াই তাখরীজ করেছেন) এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, তারা সালাত প্রতিষ্ঠিত করে। শারীরিক ইবাদত সালাতের তারা পাবন্দ হয়ে থাকে এবং আর্থিক ইবাদত যাকাতও তারা আদায় করে। তাদের কল্যাণ তাদের নিজেদের জন্যেও হয় এবং সাধারণ মাখলুকের জন্যেও হয়। তাদের অন্তর আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও ভয় করে না। এরাই হচ্ছে সুপথপ্রাপ্ত লোক এবং এরাই হচ্ছে একত্ববাদী ও ঈমানদার। কুরআন ও হাদীসের আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, যারা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পাবন্দ, শুধুমাত্র আল্লাহকেই যারা ভয় করে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের যারা ইবাদত করে না তারাই সুপথগামী এবং সফলকাম। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতে কুরআন কারীমের মধ্যে যেখানেই عَسٰى শব্দ এসেছে সেখানেই তা নিশ্চিত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, ‘আশা’ অর্থে নয়।
যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ عَسٰۤى اَنْ یَّبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُوْدًا এখানে অর্থ হবে- “হে নবী (সঃ)! এটা নিশ্চিত কথা যে, আল্লাহ তোমাকে মাকামে মাহমূদে পৌছিয়ে দিবেন।” (১৭:৭৯) এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রঃ) বলেন যে, আল্লাহর কালামে عَسٰى শব্দটি সত্য ও নিশ্চয়তার জন্যে এসে থাকে।