৪২-৫৩ নং আয়াতের তাফসীর:
(وَقَالَ لِلَّذِیْ ظَنَّ اَنَّھ۫ نَاجٍ مِّنْھُمَا....)
ইউসুফ (عليه السلام) তাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করার পর দুজনের যে ব্যক্তি মুক্তি লাভ করবে অর্থাৎ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় বাদশাকে শরাব পান করানোর দায়িত্বে নিযুক্ত হবে তাকে বললেন: তোমার মালিকের নিকট (অর্থাৎ বাদশাহর কাছে) আমার বিষয়টি আলোচনা করবে যাতে তিনি জানতে পারেন যে, আমি অন্যায়ভাবে জেলে বন্দী হয়ে আছি। ফলে আমার মুক্তির ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সে যখন মুক্তি পেল তখন ইউসুফ (عليه السلام) এর ব্যাপারে বাদশার নিকট আলোচনা করতে ভুলে গেল, আর ভুলিয়ে দেয়াটা মূলতঃ শয়তানেরই কাজ ছিল। যার ফলে ইউসুফ (عليه السلام) কে কারারুদ্ধ অবস্থায় কয়েক বছর জেলখানায় অবস্থান করতে হয়েছে।
(بِضْعَ سِنِیْنَ) - আয়াতে بضع যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছেঅ। তা মূলত তিন থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাকে বুঝায়। যার ফলে ইউসুফ (عليه السلام) কত বছর কারারুদ্ধ ছিলেন তা সঠিকভাবে বলা যায় না। অধিকাংশ তাফসীরবিদগণ বলেছেন, সাত বছর জেলখানায় ছিলেন।
(وَقَالَ الْمَلِکُ اِنِّیْٓ اَرٰی سَبْعَ بَقَرٰتٍ سِمَانٍ..... وَاَنَّ اللہَ لَا یَھْدِیْ کَیْدَ الْخَا۬ئِنِیْنَ)
অত্র আয়াগুলোতে মিসরের বাদশার স্বপ্ন ও ইউসুফ (عليه السلام) কর্তৃক এর ব্যাখ্যা দান এবং কারাগার থেকে মুক্তির মাধ্যম সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
মিসরের বাদশা একটি স্বপ্ন দেখলেন এবং এটিই ছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ইউসুফ (عليه السلام) এর জেলখানা থেকে মুক্তির অসীলা। বাদশা তার সভাসদগণকে ডেকে বললেন: আমি স্বপ্নে দেখতে পেলাম সাতটি মোটা-তাজা গাভীকে সাতটি জীর্ণশীর্ণ (হালকা) গাভী খেয়ে ফেলছে এবং আরো দেখতে পেলাম সাতটি সবুজ শীষ আর অপর সাতটি শুষ্ক। বাদশা স্বপ্নের কথা বর্ণনা করার পর যারা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পারদর্শী এমন সব মুআব্বির, জ্যোতিষী ও গণকদের কাছে সঠিক ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। কিন্তু তারা সকলেই অপারগতা প্রকাশ করল এবং বাদশাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলল, এটা কোন ব্যাখ্যাযোগ্য স্বপ্ন নয়; বরং এটা (اَضْغَاثُ اَحْلَامٍ) বা কল্পনা প্রসূত মনের খেয়াল মাত্র। أَضْغَاثُ শব্দটি ضغث এর বহুবচন, অর্থ ঘাসের গোছা। أَحْلَامٍ শব্দটি حُلم এর বহুবচন যার অর্থ স্বপ্ন। অর্থাৎ এমন স্বপ্ন যার কোন অর্থ নেই, কল্পনাপ্রসূত মনের খেয়াল। কিন্তু বাদশা তাতে স্বস্তি পান পেলেন না। এমন সময় কারামুক্ত ইউসুফ (عليه السلام)-এর সেই সঙ্গী যাকে বলেছিলেন, তোমাদের একজন মুক্তি পেয়ে আবার বাদশার সরাব পান করানোর দায়িত্ব পাবে এবং এ কথাও বলেছিলেন, বাদশার কাছে আমার কথা বলিও সে এত দিন ভুলে গিয়েছিল, তখন ইউসুফ (عليه السلام) এর কথা তার স্মরণ হল। সে বাদশার কাছে ইউসুফ (عليه السلام) এর কথা উল্লেখ করল এবং এ কথাও বলল, জেলে থাকাকালে আমি ও আমার সঙ্গী (যাকে শূলিবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে) স্বপ্ন দেখেছিলাম। তিনি আমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেছিলেন যা বাস্তবায়িত হয়েছে। উক্ত খাদেম কারাগারে যাবার অনুমতি তলব করলে বাদশা ইউসুফের কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য উক্ত খাদেমকে কারাগারে পাঠালেন। উক্ত খাদেম স্বপ্নের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউসুফ (عليه السلام) তাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানিয়ে দিলেন। তিনি বললেন: ‘সাতটি মোটা-তাজা গাভী’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল সাত বছর ভাল ফসল হবে, আর ‘সাতটি শীর্ণকায় গাভী’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল সাত বছর দুর্ভিক্ষ হবে। অনুরূপ ‘সাতটি সবুজ শীষ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল সাত বছর ভাল ফসল হবে, এমনকি ফসলে মাঠ সবুজ শ্যামলে পরিণত হবে। আর অপর ‘সাতটি শুষ্ক শীষ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল কোন ফসল উৎপন্ন হবে না। এ ব্যাখ্যা দেয়ার সাথে সাথে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে তাও বলে দিলেন। তিনি বললেন: ধারাবাহিকভাবে সাত বছর ভালভাবে চাষাবাদ করবে এবং যে শস্য উৎপন্ন হবে তা কেটে যতটুকু খাওয়ার তা বাদে সব শীষসহ জমা করে রাখবে যাতে শস্য ভালভাবে সংরক্ষিত থাকে, নষ্ট না হয়। অতঃপর এ সাতটি ভাল বছরের পর সাতটি কঠিন দুর্ভিক্ষের বছর আসবে, তখন এ জমাকৃত খাদ্য কাজে লাগবে, ফসল না হলেও এগুলো খেয়ে দুর্ভিক্ষের সাত বছর অতিক্রম করতে পারবে।
(مِّمَّا تُحْصِنُوْنَ)
অর্থাৎ শস্যবীজ যা পুনরায় চাষ করার জন্য সংরক্ষণ করে রাখা হয়। এ শস্যবীজ ব্যতীত দুর্ভিক্ষের সাত বছর জমাকৃত সব খাদ্য শেষ হয়ে যাবে।
(ثُمَّ يَأْتِيْ مِنْم بَعْدِ ذٰلِكَ)
অর্থাৎ এ দুর্ভিক্ষের সাত বছর অতীত হয়ে যাওয়ার পর প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে, ফলে প্রচুর ফসল উৎপন্ন হবে এবং তোমরা আঙুর থেকে রস বের করবে, যায়তুন থেকে তেল বের করবে এবং চতুষ্পদ জন্তু থেকে দুধ দোয়াবে। বাদশা এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে বুঝতে পারলেন এটাই সঠিক ব্যাখ্যা। তাই তিনি কর্মচারীদেরকে বললেন: তাঁকে (ইউসুফকে) নিয়ে এসো। আগত দূত ইউসুফ (عليه السلام)-কে বলল, বাদশা আপনাকে ডেকেছেন। ইউসুফ (عليه السلام) বললেন, তোমার রব তথা বাদশার কাছে ফিরে যাও এবং জিজ্ঞেস কর, যে মহিলারা তাদের হাত কেটে ফেলেছিল তাদের বিষয়টি কী? ইউসুফ (عليه السلام) ধৈর্যের পরিচয় দিলেন এবং আত্মমর্যাদাবোধের দিকে লক্ষ্য করলেন। যেখানে বাদশা মুক্তি দিয়ে তার কাছে যেতে বলেছেন সেখানে তিনি বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ নিতে পারতেন, কিন্তু তিনি চাচ্ছিলেন তাকে যে অপবাদ দেয়া হয়েছে তা থেকে সকলের সামনে পবিত্রতা প্রমাণিত হোক।
রাসূলুল্লাহ বলেছেন: যদি আমি অতদিন কারাগারে থাকতাম যতদিন ইউসুফ (عليه السلام) ছিলেন, তাহলে বাদশার দূত প্রথমবার আসার সাথে সাথে আমি তার প্রস্তাব গ্রহণ করতাম। এ কথা বলার পর তিনি ৫০ নং আয়াতটি তেলাওয়াত করেন। (তিরমিযী হা: ৩১১৬, সহীহ)
কারাগার থেকে পাঠানো ইউসুফ (عليه السلام) এর দাবী অনুযায়ী মহিলাদের কাছে বাদশা ঘটনার তদন্ত করলেন। বাদশা সেসব মহিলাকে দরবারে ডাকলেন, তারা প্রকৃত ঘটনা খুলে বলল এবং ইউসুফ (عليه السلام) যে নির্দোষ এ কথা স্বীকার করল। তখন আযীযের স্ত্রী যুলাইখাও স্বীকার করল যে, এখন সত্য সুস্পষ্ট হয়ে গেছে, আমিই তাকে অপকর্ম করার জন্য আহ্বান করেছিলাম, সে নিজেকে সংযত রেখেছে, সে নির্দোষ, সে সত্যবাদী। পরিশেষে ইউসুফ (عليه السلام) সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে জেলখানা থেকে বেরিয়ে এলেন। আর তিনি বাদশার সামনে মহিলাদের এ স্বীকারোক্তির ব্যবস্থা এ জন্য করেছিলেন যাতে যুলাইখার স্বামী জেনে নেয়, তার অনুপস্থিতিতে তিনি কোন খেয়ানত করেননি। বরং তিনি তার আমানত রক্ষা করেছেন।
(وَمَآ أُبَرِّئُ نَفْسِيْ)
‘আমি নিজেকে নির্দোষ মনে করি না’ এটা ইউসুফ (عليه السلام) এর কথাও হতে পারে, তাহলে এটা তাঁর পক্ষ থেকে আত্মবিনয়ের বহিঃপ্রকাশ হবে। কেননা এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি অপবাদ থেকে পবিত্র। পক্ষান্তরে যুলাইখার কথাও হতে পারে, তবে এটাই সম্ভাবনা বেশি, কারণ সে নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। যার ফলেই সে বলছে, আমি নিজেকে নির্দোষ মনে করি না, কারণ মানুষের অন্তর খারাপ কাজ প্রবণ। তবে আল্লাহ তা‘আলা যাকে রহম করেন সে ব্যতীত।
সুতরাং এমন আত্মা যা খারাপ কাজের প্রতি ঝুঁকে পড়ে তা থেকে আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় চাইতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা শত প্রতিকূল পরিবেশেও আল্লাহ তা‘আলার আদেশ নিষেধ মেনে চলেন তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেন।
২. ধৈর্য ধারণ করার ফযীলত সম্পর্কে জানা গেল। সুতরাং কোন বিষয়ে তাড়াহুড়া করা উচিত নয়।
৩. মানুষের মন সর্বদা খারাপ কাজের দিকেই ধাবিত হয়। তবে যার প্রতি আল্লাহ তা‘আলা রহম করেন সে ব্যতীত।
৪. খারাপ কাজ প্রবণ অন্তর থেকে আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় চাইতে হবে।
৫. উক্ত আয়াত অর্থনীতি ও সম্পদ সংরক্ষণের মূলনীতি।
৬. উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা বিপদ মুক্তির চেয়ে আপতিত অপবাদ মুক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
৭. এখানে তাদের জন্য বড় শিক্ষা নিহিত রয়েছে যারা অপরের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে নারীদের চক্রান্ত থেকে সাবধান থাকবেন।