২৫-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:
(وَالَّذِیْنَ یَنْقُضُوْنَ عَھْدَ اللہِ...)
পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে মু’মিনদের অন্যতম একটি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা যাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন তারা তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে। এখানে বিপরীত দোষের অধিকারী ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তাদেরকে যে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নিদের্শ দেয়া হয়েছে তা তারা বজায় রাখে না। এবং তারা জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বেড়ায়। অথচ তারা নিজেদের ব্যাপারে মনে করে যে, তারা ভাল কাজ করছে। মূলত তারা হল মুনাফিক, আর এদের সম্পর্কে সূরা বাক্বারার প্রথম দিকে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এরা অভিশপ্ত সম্প্রদায়, আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে বঞ্চিত। ফলে তাদের জন্য আখিরাতে রয়েছে নিকৃষ্ট আবাসস্থল। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। সেখান থেকে নিষ্কৃতি লাভ করবে না।
(اَللہُ یَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ یَّشَا۬ئُ وَیَقْدِرُ....)
অত্র আয়াতে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা রিযিক বৃদ্ধি করে দেন আবার যাকে ইচ্ছা সঙ্কীর্ণ করে দেন। পূর্বের আয়াতে বলা হয়েছে; যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করে না তথা তাঁর প্রতি ঈমান ও সৎআমলের অঙ্গীকার পূরণ না করে কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্টতম স্থান জাহান্নাম। প্রশ্ন হতে পারে, দুনিয়াতে তো কাফের মুশরিকরাই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে রয়েছে, তাদের পার্থিব রিযিকের অভাব নেই। তাহলে কি তারাই আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়পাত্র? প্রকৃত ব্যাপার তা নয়, এরূপ চিন্তা-চেতনাকে খণ্ডনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, পার্থিব উপায় উপকরণ একমাত্র আমার হাতে। আমি যাকে ইচ্ছা যত পরিমাণ রিযিক দিয়ে থাকি। দুনিয়াতে কাউকে সম্পদের প্রাচুর্য দান করা বা ক্ষমতা ও সুখ-শান্তি দান করা এটা প্রমাণ করে না আমি তাদেরকে ভালবাসি। বরং তাদেরকে দুনিয়ার সুখ-সাচ্ছন্দ্য দান করার পিছনে হিকমত রয়েছে। তা হল (১) দুনিয়ার এসব সুখ-সাচ্ছন্দ ক্ষণস্থায়ী, তাই তাদের জন্য দুনিয়ার আরাম-আয়েশ দিয়েই শেষ, আখিরাতে তাদের জন্য জাহান্নাম ছাড়া কিছুই থাকবে না।
(২) দুনিয়ার এসব সুখ-সাচ্ছন্দ্য দ্বারা তাদেরকে অপরাধের অবকাশ দেয়া হয়, আখিরাতে তাদেরকে জাহান্নামে অপমানের সাথে প্রবেশ করানো হবে।
(৩) দুনিয়াটা মু’মিনদের জন্য পরীক্ষাগার, এখানে তারা আরাম আয়েশ ও সুখ-সাচ্ছন্দে বাস করবে, এটা আগমনের উদ্দেশ্য নয়। বরং তারা সকল আরাম আয়েশ ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য বর্জন করে এমনকি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি হাসিল করতঃ জান্নাতে স্থান করে নিবে।
(৪) আল্লাহ তা‘আলা সকলকে যদি সমান পরিমাণ রিযিক দিতেন তাহলে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি হত। কেউ কাউকে পরোয়া করতো না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَوْ بَسَطَ اللّٰهُ الرِّزْقَ لِعِبَادِه۪ لَبَغَوْا فِي الْأَرْضِ وَلٰكِنْ يُّنَزِّلُ بِقَدَرٍ مَّا يَشَا۬ءُ ط إِنَّه۫ بِعِبَادِه۪ خَبِيْرٌۭبَصِيْرٌ)
“আল্লাহ তাঁর (সকল) বান্দাদের রুযী বাড়িয়ে দিলে তারা পৃথিবীতে অবশ্যই সীমালঙ্ঘন করত; কিন্তু তিনি তাঁর ইচ্ছামত পরিমাণেই দিয়ে থাকেন। তিনি তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক জানেন ও দেখেন।” (সূরা শুরা ৪২:২৭)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যার জন্য যতটুকু পরিমাণ রিযিক উপযুক্ত মনে করেন তাকে ততটুকুই রিযিক দিয়ে থাকেন।
কিন্তু যারা কাফের তারা পার্থিব জীবন ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য নিয়েই সন্তুষ্ট। তারা আখিরাতের কথা চিন্তাই করে না। অথচ এ দুনিয়া অতি নগণ্য, যা আখিরাতের তুলনায় কিছুই না।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيْلٌ ج وَالْاٰخِرَةُ خَيْرٌ لِّمَنِ اتَّقٰي قف وَلَا تُظْلَمُوْنَ فَتِيْلًا)
“বল: ‘পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে মুত্তাকী তার জন্য আখিরাতই উত্তম। তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও জুলুম করা হবে না।’’ (সূরা নিসা ৪:৭৭) এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা ছোট কানবিশিষ্ট একটি মৃত ছাগলের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন। যখন তারা এ ছাগলটিকে ফেলে দিল তখন তিনি বললেন: আল্লাহ তা‘আলার কসম এই বকরীর বাচ্চার মালিকের কাছে তার যতটুকু মূল্য রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার কাছে দুনিয়ার মূল্য তার চেয়েও নগণ্য। (সহীহ মুসলিম হা: ২২৭৪)
অনুরূপ অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, “আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া এরূপ সমুদ্রের পানির তুলনায় আঙ্গুলের পানি যেরূপ।” (সহীহ মুসলিম হা: ২১৯৩)
অতএব, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, আর আখিরাতের জীবন চিরস্থায়ী। সুতরাং আখিরাত ছেড়ে দিয়ে দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত হওয়াটা বোকামী ব্যতীত আর কিছুই নয়। এই সমস্ত আয়াত ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণীত হয় যে, যারা দুনিয়া ছেড়ে দিয়ে বৈরাগী হয়ে যায় তারা ভ্রান্ত। কারণ ইসলামে তা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ব্যাপারে বলেন: ইসলামের মধ্যে কোন বৈরাগ্যবাদ নেই। (আবূ দাঊদ) অর্থাৎ যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করবে তাদেরকে এই বৈরাগ্যবাদ পরিত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় তারা মুসলিম বা ইসলাম থেকে বাহির হয়ে যাবে। তারা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উম্মত হিসেবে আখিরাতে নাজাত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা মু’মিনের কাজ নয়।
২. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, ক্ষুণত্ন করা যাবে না।
৩. দুনিয়া ছেড়ে আখিরাত এবং আখিরাত ছেড়ে দুনিয়া নিয়ে পড়ে থাকা যাবে না। বরং উভয়টাই চাইতে হবে, তবে সর্বক্ষেত্রে আখিরাতকে প্রাধান্য দিতে হবে।
৪. ইসলামে কোন বৈরাগ্যবাদ নেই। বৈরাগ্যবাদ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাতের খেলাফ।