২২-২৩ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, যখন তিনি বান্দাদের ফায়সালার কাজ শেষ করবেন এবং মুমিনরা জান্নাতে ও কাফিররা জাহান্নামে চলে যাবে, ঐ সময় অভিশপ্ত ইবলীস জাহান্নামের উপর দাঁড়িয়ে জাহান্নামীদেরকে সম্বোধন করে বলবেঃ “আল্লাহ তাআলা তোমাদের সাথে যে ওয়াদা অঙ্গীকার করেছিলেন তা ছিল সম্পূর্ণরূপে সত্য। রাসূলদের অনুসরণ ও আনুগত্যই ছিল মুক্তি ও শান্তির পথ। আর আমার ওয়াদা তো ছিল প্রতারণা মাত্র। আমার কথা ছিল দলীল-প্রমাণহীন। তোমাদের উপর আমার কোন জোর যবরদস্তি ও আধিপত্য তো ছিল না। তোমরা অযথা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিলে। আমি তোমাদেরকে যে হুকুম করেছিলাম তা তোমরা মেনে নিয়েছিলে। রাসূলদের সত্য প্রতিশ্রুতি, তাদের দলীল ও যুক্তিপূর্ণ কথা তোমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলে। তাঁদের তোমরা বিরোধিতা করেছিলে, আমার কথামত চলেছিলে। এর পরিণাম তোমরা আজ স্বচক্ষে দেখতে পেলে। এটা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। সুতরাং আজ তোমরা আমাকে তিরস্কার করো না, বরং নিজেদেরকেই দোষারোপ করো। পাপ তোমরা নিজেরাই করেছিল। দলীল-প্রমাণগুলি তোমরা ত্যাগ। করেছিলে। আমার কথাই তোমরা মেনে চলেছিলে। আজকে আমি তোমাদের কোনই কাজে আসবো না। না আজ আমি তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা করতে পারবো, না তোমাদের কোন উপকার করতে পারবো। আমি তোমাদের শিরকের কারণে তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করছি। আমি আজ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছি যে, আমি আল্লাহর শরীক নই। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَ مَنْ اَضَلُّ مِمَّنْ یَّدْعُوْا مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ مَنْ لَّا یَسْتَجِیْبُ لَهٗۤ اِلٰى یَوْمِ الْقِیٰمَةِ وَ هُمْ عَنْ دُعَآىٕهِمْ غٰفِلُوْنَ অর্থাৎ “ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক যালিম আর কে আছে, যে আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে আহবান করে, যারা কিয়ামতের দিন তাদের আহবানে সাড়া দিতে পারবে না? বরং তারা তাদের আহবান হতে উদাসীন ও অমনোযোগী থাকবে। কিয়ামতের দিন তারা তাদের শত্রু হয়ে যাবে এবং তাদের ইবাদতকে অস্বীকার করবে।” (৪৬:৫) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ كَلَّاسَیَكْفُرُوْنَ بِعِبَادَتِهِمْ وَ یَكُوْنُوْنَ عَلَیْهِمْ ضِدًّا অর্থাৎ “নিশ্চয় তারা তাদের ইবাদতকে অস্বীকার করবে এবং তাদের শত্রু হয়ে যাবে, তারা অত্যাচারী লোক কেন না তারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, বাতিলের অনুসারী হয়েছে এইরূপ অত্যাচারীদের জন্যে বেদনাদায়ক শাস্তি রয়েছে।” (১৯:৮২)।
অতএব, এটা প্রকাশ্য কথা যে, জাহান্নামীদের সাথে ইবলীসের এই কথাবার্তা হবে জাহান্নামে প্রবেশের পর, যাতে তাদের আফসোস ও দুঃখ খুব বেশী হয়। কিন্তু হযরত উকবা ইবনু আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদেরকে আল্লাহ তাআলা একত্রিত করবেন এবং তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দিবেন তখন একটা সাধারণ ভয় ও সন্ত্রাসের সৃষ্টি হবে।” মু'মিনগণ বলবেঃ “আমাদের ফায়সালা হতে যাচ্ছে, এখন আমাদের সুপারিশের জন্যে দাঁড়াবে কে?” অতঃপর তারা হযরত আদম (আঃ), হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত ঈসার (আঃ) কাছে যাবে। হযরত ঈসা (আঃ) বলবেনঃ “তোমরা নবী উম্মীর (সঃ) কাছে গমন কর।” তখন আল্লাহ তাআলা আমাকে। দাঁড়িয়ে যাওয়ার অনুমতি দিবেন। তৎক্ষণাৎ আমার মজলিস হতে পবিত্র এবং উত্তম সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়বে, যার মত উত্তম সুগন্ধি ইতিপূর্বে কেউ কখনো শুকেনি। সুতরাং আমি তখন বিশ্ব প্রতিপালকের কাছে আগমন করবো, আমার মাথার চুল থেকে নিয়ে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলী পর্যন্ত সারাদেহ আলোকোজ্জ্বল হয়ে যাবে। অতঃপর আমি সুপারিশ করবো এবং মহা কল্যাণময় আল্লাহ আমার সুপারিশ কবুল করবেন। এটা দেখে কাফিররা পরস্পর বলাবলি করবেঃ “চলো, আমরাও কাউকে আমাদের সুপারিশকারী বানিয়ে নিয়ে তাকে আমাদের জন্যে সুপারিশ করতে বলি। আর এ কাজের জন্যে আমাদের কাছে ইবলীস ছাড়া আর কে আছে? সে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল। সুতরাং চল, আমরা তার কাছেই যাই এবং আর করি।” অতঃপর তারা ইবলীসের কাছে। গিয়ে বলবেঃ “মুমিনরা সুপারিশকারী পেয়ে গেছে, তুমি আমাদের জন্যে সুপারিশকারী হয়ে যাও। কারণ, তুমিই তো আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলে।” একথা শুনে ঐ অভিশপ্ত শয়তান দাঁড়িয়ে যাবে। তার মজলিস হতে এমন দুর্গন্ধ বের হবে যে, ইতিপূর্বে কারো নাকে এমন জঘন্য দুর্গন্ধ কখনো পৌঁছে নাই।” (এ হাদীসটি ইবনু আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) তারপর সে যা বলবে তাতো উপরে বর্ণিত হলো।
মুহাম্মদ ইবনু কা'ব কারাযী (রঃ) বলেন, জাহান্নামীরা যখন বলবেঃ سَوَآءٌ عَلَیْنَاۤ اَجَزِعْنَاۤ اَمْ صَبَرْنَا مَا لَنَا مِنْ مَّحِیْصٍ অর্থাৎ “এখন আমাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটুক বা আমরা ধৈর্যশীল হয়ে যাই একই কথা; আমাদের কোন নিষ্কৃতি নেই।” (১৪:২১) ঐ সময় ইবলীস তাদেরকে উপরোক্ত কথা বলবে। যখন তারা ইবলীসদের উপরোক্ত বক্তব্য শুনবে তখন তারা নিজেদের জীবনের উপরও ক্রোধান্বিত হয়ে যাবে। তখন তাদেরকে ডাক দিয়ে বলা হবেঃ “তোমরা আজ নিজেদের জীবনের উপর যেমন রাগান্বিত হয়েছে, এর চেয়ে অনেক বেশী রাগান্বিত হয়েছিলেন আল্লাহ তাআলা ঐ সময়, যে সময় তোমাদেরকে ঈমানের দিকে ডাক দেয়া হয়েছিল, আর তোমরা সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলে” ।
হযরত আমির শাবী (রঃ) বলেন, (কিয়ামতের দিন) সমস্ত মানুষের সামনে দু’জন বক্তা বক্তৃতা দেয়ার জন্যে দাঁড়াবে। হযরত ঈসা ইবনু মারইয়ামকে (আঃ) বলবেনঃ তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলেঃ “তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আমাকে ও আমার জননীকে মা’রূদ রূপে গ্রহণ করো? এই আয়াত থেকে নিয়ে قَالَ اللّٰهُ هٰذَا یَوْمُ یَنْفَعُ الصّٰدِقِیْنَ صِدْقُهُمْ (আল্লাহ বলবেনঃ “এই সেই দিন যেদিন সত্যবাদীগণ তাদের সত্যতার জন্যে উপকৃত হবে)। (৫:১১৯) এই আয়াত পর্যন্ত এই বর্ণনাই রয়েছে। আর অভিশপ্ত ইবলীস দাঁড়িয়ে বলবেঃ “আমার তো তোমাদের উপর কোন আধিপত্য ছিল না, আমি শুধু তোমাদেরকে আহবান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়েছিলে (শেষ পর্যন্ত)।”
দুষ্ট ও পাপী লোকদের পরিণাম ও তাদের দুঃখ-বেদনা এবং ইবলীসের উত্তরের বর্ণনা দেওয়ার পর আল্লাহ তাআলা এখন সৎ ও পূণ্যবান লোকদের পরিণামের বর্ণনা দিচ্ছেন। মমিন ও সৎকর্মশীল লোকেরা জান্নাতে প্রবেশ করবে। তথায় তারা যথেচ্ছা গমনাগমন করবে, চলবে, ফিরবে এবং পানাহার করবে। চিরদিনের জন্যে তারা সেখানে অবস্থান করবে। সেখানে না তারা। চিন্তিত ও দুঃখিত হবে, না তাদের মন খারাপ হবে, না অস্বস্তি বোধ করবে, না মারা যাবে, না বহিষ্কৃত হবে, না নিয়ামত কমে যাবে। সেখানে তাদের অভিবাদন হবে ‘সালাম’ আর ‘সালাম’। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ حَتّٰۤى اِذَا جَآءُوْهَا وَ فُتِحَتْ اَبْوَابُهَا وَ قَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلٰمٌ عَلَیْكُمْ অর্থাৎ “যখন তারা জান্নাতের নিকট উপস্থিত হবে ও ওর দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবেঃ তোমাদের প্রতি সালাম।” (৩৯:৭৩) অন্য জায়গায় রয়েছেঃ “প্রত্যেক দরজা দিয়ে ফেরেস্তারা তাদের কাছে প্রবেশ করবে এবং বলবেঃ “তোমাদের প্রতি সালাম।” আর এক আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেনঃ وَ یُلَقَّوْنَ فِیْهَا تَحِیَّةً وَّ سَلٰمًا অর্থাৎ “তাদেরকে সেথায় অভ্যর্থনা করা হবে অভিবাদন ও সালাম সহকারে।” (২৫:৭৫)
আল্লাহ তাআলা আর এক স্থানে বলেছেনঃ دَعْوٰىهُمْ فِیْهَا سُبْحٰنَكَ اللّٰهُمَّ وَ تَحِیَّتُهُمْ فِیْهَا سَلٰمٌۚ-وَ اٰخِرُ دَعْوٰىهُمْ اَنِ الْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ অর্থাৎ “সেথায় তাদের ধ্বনি হবেঃ হে আল্লাহ! তুমি মহান! তুমি পবিত্র! এবং সেথায় তাদের অভিবাদন হবে, ‘সালাম এবং তাদের শেষ ধ্বনি হবেঃ প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর প্রাপ্য।” (১০:১০)