১১৪-১১৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তারা যেন হালাল ও পবিত্র রিযিক আহার করে, তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে আর তিনি যে সকল জিনিস হারাম করেছেন ভক্ষণ করা থেকে বিরত থাকে।
(إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ)
এ সম্পর্কে আরো তিনবার আলোচনা হয়েছে। সূরা বাকারার ১৭৩ নং আয়াতে, সূরা মায়িদার ৩ নং আয়াতে এবং সূরা আন‘আমের ১৪৫ নং আয়াতে। এখানে চতুর্থবার উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে খুব সতর্ক করছেন যেন তারা এসব কর্ম ও আকীদার কাছে না যায়। বিশেষ করে
(وَمَآ أُهِلَّ لِغَيْرِ اللّٰهِ بِه)
তথা জবেহকালে আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের নামে জবেহ করা। এটি মারাত্মক শিরক। যা অনেক মুসলিম ব্যক্তিরা করে থাকে, কিন্তু তারা বুঝে এটা শিরক। যে পশু আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের নামে জবেহ করা হয় তার কয়েকটি অবস্থা হতে পারে ১. আল্লাহ তা‘আলার ছাড়া অন্যের নৈকট্য হাসিলের জন্য এবং জবেহ করার সময় সে ব্যক্তির নাম নেয়া। ২. আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের নৈকট্য লাভ করা উদ্দেশ্য কিন্তু জবেহ করে আল্লাহ তা‘আলার নাম নিয়ে। যেমন মাযার, কবর দরগাহ ইত্যাদিতে করা হয়। অনেকে মনে করে আল্লাহ তা‘আলার নামেই তো জবেহ করছি, সুতরাং পাপ বা শিরক হবে না। কিন্তু না, এটা প্রকাশ্য শিরক। আল্লাহ তা‘আলার নামে যেমন জবাই করতে হবে তেমনি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য জবাই করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ إِنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمٰتِيْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ)
“বল: ‘আমার সলাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ শুধুমাত্র জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে।’’ (সূরা আন‘আম ৬:১৬২)
এমনকি যে জায়াগায় শিরকী ও জাহিলী যুগের কোন কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে সে জায়গায় আল্লাহ তা‘আলার জন্য কোন ইবাদত ও পশু জবেহ করা যাবে না। কারণ এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলল: আমি বুওয়ানা নামক স্থানে উট জবাই করার মানত করেছি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: সেখানে জাহিলী যুগের কোন দেব-দেবী ছিল কি, যার পূজো করা হত? সাহাবী বললেন: না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন সেখানে তাদের কোন ঈদ-অনুষ্ঠান হয়ে থাকে কি? সাহাবী বললেন: না। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন: তুমি তোমার মানত পূর্ণ করতে পারো। (আবূ দাউদ হা: ৩৩১৫, সহীহ) সুতরাং বুঝা যাচ্ছে দেব দেবী সরিয়ে নেয়ার পরেও অথবা কোন স্থান থেকে জাহিলী যুগের আনন্দ অনুষ্ঠান উঠে যাওয়ার পরেও সেখানে ইবাদত করা ঠিক নয়। তাহলে ঐ সকল আস্তানায় ও মাযারে কিভাবে পশু জবেহ করা বৈধ হতে পারে, যা শিরক ও গাইরুল্লাহর ইবাদতের আড্ডাখানা?
(وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ...)
মুশরিকরা কিছু কিছু হালাল জন্তুকে নিজেদের জন্য হারাম করে নিত এবং কিছু কিছু হারাম জন্তুকে হালাল করে নিত। যেমন বাহীরা, ওয়াসিলা, সায়েবা, হাম ইত্যাদি জন্তু থেকে দুধ দোহন, তাদের ওপর বোঝা বহনসহ অন্যান্য উপকার হারাম করে নিত এবং দেব-দেবীর নামে ছেড়ে দিত। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন: তোমরা নিজেরাই হালালকে হারাম করে এবং হারামকে হালাল করে আল্লাহ তা‘আলার ওপর মিথ্যারোপ করো না। এরূপ করেছিল ‘আমর বিন লুহাই’। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর লা‘নত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(قُلْ أَرَأَيْتُمْ مَّآ أَنْزَلَ اللّٰهُ لَكُمْ مِّنْ رِّزْقٍ فَجَعَلْتُمْ مِّنْهُ حَرَامًا وَّحَلٰلًا ط قُلْ آٰللّٰهُ أَذِنَ لَكُمْ أَمْ عَلَي اللّٰهِ تَفْتَرُوْنَ)
“বল: ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ তোমাদের যে রিযিক দিয়েছেন তোমরা তার কিছু হালাল ও কিছু হারাম করেছ? বল: ‘আল্লাহ কি তোমাদেরকে এ ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন, না তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করছ?’’ (সূরা ইউনুস ১০:৫৯)
এ সম্পর্কে সূরা মায়িদার ১০৩ নং এবং সূরা আনয়ামের ১৪০ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
لَا يُفْلِحُوْنَ অর্থাৎ যারা এভাবে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মিথ্যারোপ করে, আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেননি তা হারাম করে নেয়, আল্লাহ তা‘আলা যা বলেননি তা বলেছেন বলে উল্লেখ করে ইত্যাদি তারা কক্ষনো আখিরাতে সফলকাম হবে না। তারা দুনিয়াতে হয়তো কিছু দিন দুনিয়ার সামগ্রী উপভোগ করবে কিন্তু আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ إِنَّ الَّذِيْنَ يَفْتَرُوْنَ عَلَي اللّٰهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُوْنَ - مَتَاعٌ فِي الدُّنْيَا ثُمَّ إِلَيْنَا مَرْجِعُهُمْ ثُمَّ نُذِيْقُهُمُ الْعَذَابَ الشَّدِيْدَ بِمَا كَانُوْا يَكْفُرُوْنَ)
“বল: ‘যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে তারা সফলকাম হবে না।’ পৃথিবীতে তাদের জন্য আছে কিছু সুখ-সম্ভোগ; পরে আমারই নিকট তাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর কুফরীর কারণে তাদেরকে আমি কঠোর শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করাব।” (সূরা ইউনুস ১০:৬৯-৭০)
(حَرَّمْنَا مَا قَصَصْنَا عَلَيْكَ مِنْ قَبْلُ)
ইয়াহূদীদের ওপর যা হারাম করা হয়েছিল সে সম্পর্কে সূরা আন‘আমের ১৪৬ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
(ثُمَّ تَابُوْا مِنْۭ بَعْدِ ذٰلِكَ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে তাওবার উৎসাহ প্রদান করছেন। بجهالة বা অজ্ঞতাবশত। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবাগণ এ বিষয়ে একমত যে, প্রত্যেক অবাধ্য কাজ অজ্ঞতাবশত হয়। সে ইচ্ছায় করুক আর অনিচ্ছায় করুক।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: প্রত্যেক আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ব্যক্তি অজ্ঞ যখন সে অবাধ্যতা করে। (তিরমিযী: ৩৫৩৭, হাসান। তাফসীর ইবনে কাসীর, ২/২৬২) তবে সঠিক কথা হল: যদি গুনাহ স্বেচ্ছায় বারবার এবং বেপরোয়াভাবে না করে। (আয়সারুত তাফাসীর, ১/৩৭৬)
উপরোক্ত যে সকল বিধানাবলী জানতে পারলাম আমাদের উচিত তা মেনে চলা এবং খেয়াল রাখতে হবে আমার দ্বারা যেন শিরক না হয়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. হারাম জিনিস ভক্ষণ করা যাবে না।
২. হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল গণ্য করা যাবে না।
৩. একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করতে হবে।
৪. আল্লাহ তা‘আলার ওপর মিথ্যা আরোপ করা যাবে না।
৫. অন্যায় করার পর সঠিক তাওবা করলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দেন।