১৪-১৮ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা নিজের অরো অনুগ্রহ ও মেহেরবাণীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেনঃ “হে মানবমণ্ডলী! সমুদ্রের উপরেও তিনি তোমাদেরকে আধিপত্য দান করেছেন। নিজের গভীরতা ও তরঙ্গমালা সত্ত্বেও ওটা তোমাদের অনুগত। তোমাদের নৌকাগুলি তাতে চলাচল করে। অনুরূপভাবে তোমরা ওর মধ্য হতে মৎস্য বের করে ওর তাজা গোশত ভক্ষণ করে থাকো। মাছ (হজ্জের ইহরামহীন অবস্থায় এবং ইহরামের অবস্থায় জীবিত হোক বা মৃত। হোক সব সময় হালাল। মহান আল্লাহ এই সমুদ্রের মধ্যে তোমাদের জন্যে জওহর ও মনিমুক্তা সৃষ্টি করেছেন, যেগুলি তোমরা অতি সহজে বের করতঃ অলংকারের কাজে ব্যবহার করে থাকে। এই সমুদ্রে নৌকাগুলি বাতাস সরিয়ে এবং পানি ফেড়ে বুকের ভরে চলে থাকে।
সর্বপ্রথম হযরত নুহ (আঃ) নৌকায় আরোহণ করেন। তাকেই আল্লাহ তাআ’লী নৌকা তৈরীর কাজ শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই মানুষ নৌকা তৈরী করে আসছে এবং আরোহণ করে তারা বড় বড় সফর করতে রয়েছে। এপারের জিনিস ওপারে এবং ওপারের জিনিস এপারে নিয়ে যাওয়া-আসা করছে। ঐ কথাই এখানে বলা হচ্ছেঃ ‘তা এই জন্যে যে, যেন তোমরা তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং তোমরা যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আল্লাহ তাআলা পশ্চিমা সমুদ্রকে বলেনঃ “আমার বান্দাদেরকে আমি তোমার মধ্যে আরোহণ করাতে চাই। সুতরাং তুমি তাদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করবে?” উত্তরে সে বলেঃ “আমি তাদেরকে ডুবিয়ে দেবো।” তখন আল্লাহ তাআলা তাকে বলেনঃ “তোমার তীব্রতা তোমার কিনারা বা ধারের উপরই থাক। আমি তাদেরকে আমার হাতে নিয়ে চলবো। তোমাকে আমি প্রলংকার ও শিকার হতে বঞ্চিত করে দিলাম। অতঃপর তিনি পূর্বা সমুদ্রকে অনুরূপ কথাই বললেন। সে বললোঃ “আমি তাদেরকে স্বীয় হাতে উঠিয়ে নিবো এবং মা যে ভাবে নিজের সন্তানের খোঁজ খবর নিয়ে থাকে সেই ভাবে আমিও তাদের খোঁজ খবর নিতে থাকবে।” তার এ কথা শুনে মহান আল্লাহ তাদের অলংকারও দিলেন এবং শিকারও দিলেন। (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বাযযার (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। এর রিওয়াইয়াতকারী শুধু আবদুর রহমান ইবনু আবদিল্লাহ। তবে হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতেও এ হাদীসটি মারূফ রূপে বর্ণিত হয়েছে)
এরপর যমীনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এটাকে থামিয়ে রাখা এবং হেলাদোলা হতে রক্ষা করার জন্যে এর উপর মযবুত ও ওজনসই পাহাড় স্থাপন করা হয়েছে। যাতে এর নড়াচড়া করার কারণে এর উপর অবস্থানকারীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে না পড়ে। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেনঃ وَالْجِبَالَ اَرْسٰهَا অর্থাৎ “তিনি পর্বতসমূহকে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করেছেন।”
হযরত হাসান (রঃ) বলেন, আল্লাহ তাআলা যখন যমীন সৃষ্টি করেন তখন তা হেলা-দোলা করছিল। শেষ পর্যন্ত ফেরেশতারা বলতে শুরু করেন, এর উপর তো কেউ অবস্থান করতে পারবে না। সকালেই তাঁরা দেখতে পান যে, এতে পাহাড়কে গেড়ে দেয়া হয়েছে এবং ওর হেলা-দোলাও বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং পাহাড়কে কোন জিনিস দ্বারা বানানো হয়েছে সেটাও ফেরেস্তাগণ অবগত হন। কায়েস ইবনু উবাদাহ (রাঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে। হযরত আলী (রাঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে। হযরত আলী (রাঃ) বলেন যে, যমীন বলেঃ “হে আল্লাহ! আপনি আমার উপর বণী আদমকে বসবাস করার অধিকার। দিচ্ছেনঃ যারা আমার পিঠের উপর গুনাহ করবে এবং অশ্লীলতা ছড়াবে।” একথা বলে সে কাঁপতে শুরু করে। তখন আল্লাহ পাক ওর উপর পর্বতসমূহ মযবুত ভাবে প্রোথিত করেন যেগুলি তোমরা দেখতে পাচ্ছ এবং কতকগুলিকে দেখতেও পাচ্ছ না।”
এটাও আল্লাহ তাআলার দয়া ও মেহেরবাণী যে, তিনি চতুর্দিকে নদ-নদী ও প্রস্রবণ প্রবাহিত রেখেছেন। কোনটি তেজ, কোনটি মন্দা, কোনটি দীর্ঘ এবং কোনটি খাটো। কখনো পানি কমে যায় এবং কখনো বেশী হয় এবং কখনো সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে যায়। পাহাড়-পর্বতে, বনে-জঙ্গলে, মরূ প্রান্তরে এবং পাথরে বরাবরই এই প্রস্রবণগুলি প্রবাহিত রয়েছে এবং এক স্থান হতে অন্যস্থানে চলে যাচ্ছে। এ সবই হচ্ছে মহান আল্লাহর ফযল ও করম, করুণা ও দয়া। না আছে তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ এবং না আছে কোন প্রতিপালক। তিনি ছাড়া অন্য কেউই ইবাদতের যোগ্য নয়। তিনিই প্রতিপালক এবং তিনিই মাবুদ। তিনিই রাস্তা বানিয়ে দিয়েছেন স্থলে ও জলে, পাহাড়ে ও জঙ্গলে, লোকালয়ে এবং বিজনে। তাঁর দয়া ও অনুগ্রহে সর্বত্রই রাস্তা বিদ্যমান রয়েছে, যাতে এদিক থেকে ওদিকে লোক যাতায়াত করতে পারে। কোন পথ প্রশস্ত, কোনটা সংকীর্ণ এবং কোনটা সহজ, কোনটা কঠিন। তিনি আরো নিদর্শন রেখেছেন। যেমন পাহাড়, টিলা ইত্যাদি, যেগুলির মাধ্যমে পথচারী মসাফির পথ জানতে বা-চিনতে পারে। তারা পথ ভুলে যাওয়ার পর সোজা সঠিক পথ পেয়ে যায়। নক্ষত্ররাজি পথ প্রদর্শকরূপে রয়েছে। রাত্রির অন্ধকারে ওগুলির মাধ্যমেই রাস্তা ও দিক নির্ণয় করা যায়।
ইমাম মালিক (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, نُجُوْم দ্বারা পাহাড়কে বুঝানো হয়েছে।
এরপর মহান আল্লাহ নিজের বড়ত্বের শ্রেষ্ঠত্বের, বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ “ইবাদতের যোগ্য তিনি ছাড়া আর কেউই নেই। আল্লাহ ছাড়া লোকেরা যাদের ইবাদত করছে তারা একেবারে শক্তিহীন। কোন কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা তাদের নেই। পক্ষান্তরে সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন আল্লাহ।”
এটা স্পষ্ট কথা যে, সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি করতে অক্ষম কখনো সমান হতে পারে না। সুতরাং উভয়ের ইবাদত করা বড়ই যুলুমের কাজ। এতোটা বেহুশ হওয়া মানুষের জন্যে মোটেই শোভনীয় নয়।
অতপরঃ আল্লাহ তাআলা স্বীয় নিয়ামতের প্রাচুর্য ও আধিক্যের বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি বলেনঃ “আমি তোমাদেরকে এতো বেশী নিয়ামত দান করেছি। যে, তোমরা সেগুলি গণে শেষ করতে পার না। আমি তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে থাকি। যদি আমি আমার সমস্ত নিয়ামতের পুরোপুরি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দাবী করতাম তবে তোমাদের দ্বারা তা পূরণ করা মোটেই সম্ভব ছিল না যদি আমি এই নিয়ামতরাশির বিনিময়ে তোমাদের সকলকে শাস্তি প্রদান করি তবুও তা আমার পক্ষে যুলুম হবে না। কিন্তু তোমাদের অপরাধ ও পাপসমূহ ক্ষমা করে থাকি। তোমাদের দোষ-ত্রুটি আমি দেখেও দেখি না। পাপ হতে তাওবা, আনুগত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন এবং আমার সন্তুষ্টির কামনার পর কোন গুনাহ হয়ে গেলে আমি তা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখে থাকি। আমি অত্যন্ত দয়ালু। তাওবার পর আমি শাস্তি প্রদান করি না।