আম্বিয়া আয়াত ৬
مَآ اٰمَنَتْ قَبْلَهُمْ مِّنْ قَرْيَةٍ اَهْلَكْنٰهَاۚ اَفَهُمْ يُؤْمِنُوْنَ ( الأنبياء: ٦ )
Maaa aaamanat qablahum min qaryatin ahlaknaahaa a-fahum yu'minoon (al-ʾAnbiyāʾ ২১:৬)
English Sahih:
Not a [single] city which We destroyed believed before them, so will they believe? (Al-Anbya [21] : 6)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
তাদের পূর্বে আমি যে সমস্ত জনপদ ধ্বংস করেছি তাদের একটিও ঈমান আনেনি, তাহলে এরা কি ঈমান আনবে? (আম্বিয়া [২১] : ৬)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
এদের পূর্বে যে সব জনপদ আমি ধ্বংস করেছি ওর অধিবাসীরা বিশ্বাস করত না; তবে এরা কি বিশ্বাস করবে? [১]
[১] অর্থাৎ, এর আগে আমি যত বসতি ধ্বংস করেছি তারা এমন ছিল না যে, তাদের ইচ্ছানুযায়ী মু'জিযা দেখানোর পর তারা ঈমান এনেছে; বরং তারা মু'জিযা দেখার পরও ঈমান আনেনি। যার কারণে ধ্বংসই ছিল তাদের পরিণতি। তাহলে কি মক্কাবাসীদের ইচ্ছানুসারে কোন মু'জিযা দেখানো হলে তারা কি ঈমান আনবে? কক্ষনো না; বরং তারা অবিশ্বাস ও বিরোধিতার পথেই অগ্রসর হতে থাকবে।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
এদের আগে যেসব জনপদ আমরা ধ্বংস করেছি সেখানকার অধিবাসীরা ঈমান আনেনি; তবে কি তারা ঈমান আনবে [১]?
[১] এ সংক্ষিপ্ত বাক্যে নিদর্শন দেখাবার দাবীর যে জবাব দেয়া হয়েছে তার মধ্যে তিনটি বিষয় রয়েছে। এক, পূর্ববতী রাসূলদেরকে যে ধরনের নিদর্শন দেয়া হয়েছিল তোমরা তেমনি ধরনের নিদর্শন দেয়া হয়েছিল তোমরা তেমনি ধরণের নিদর্শন চাচ্ছে? কিন্তু তোমরা ভুলে যাচ্ছো হঠকারী লোকেরা সেসব নিদর্শন দেখেও ঈমান আনেনি। দুই, তোমরা নিদর্শনের দাবী তো করছো কিন্তু একথা মনে রাখছো না যে, সুস্পষ্ট মু'জিযা স্বচক্ষে দেখে নেবার পরও যে জাতি ঈমান আনতে অস্বীকার করেছে তারা এরপর শুধু ধ্বংসই হয়ে গেছে। তিন, তোমাদের চাহিদামতো নিদর্শনাবলী না পাঠানো তো তোমাদের প্রতি আল্লাহর একটি বিরাট মেহেরবাণী। কারণ এ পর্যন্ত তোমরা আল্লাহর হুকুম শুধুমাত্র অস্বীকারই করে আসছো কিন্তু এ জন্য তোমাদের উপর আযাব পাঠানো হয়নি। এখন কি তোমরা নিদর্শন এ জন্য চাচ্ছো যে, যেসব জাতি নিদর্শন দেখার পরও ঈমান আনেনি এবং এ জন্য তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে তোমরাও তাদের মতো একই পরিণতির সম্মুখীন হতে চাও? তাদের পূর্বের লোকদের কাছে নিদর্শন পাঠানোর পরও তারা যখন ঈমান আনেনি তখন এরাও আসলে ঈমান আনবে না। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় যাদের বিরুদ্ধে আপনার রবের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গেছে, তারা ঈমান আনবে না। যদিও তাদের কাছে সবগুলো নিদর্শন আসে, যে পর্যন্ত না তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেখতে পাবে।” [সূরা ইউনুস; ৯৬-৯৭] এত কিছু বলা হলেও মূল কথা হচ্ছে, তারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এমন নিদর্শন দেখেছে যা পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের কাছে যে সমস্ত নিদর্শন ছিল তা থেকে অনেক বেশী স্পষ্ট, অকাট্য ও শক্তিশালী। [দেখুন, ইবন কাসীর]
3 Tafsir Bayaan Foundation
তাদের পূর্বে যে জনপদ ঈমান আনেনি তাদেরকে আমি ধ্বংস করেছি । তবে কি এরা ঈমান আনবে?
4 Muhiuddin Khan
তাদের পূর্বে যেসব জনপদ আমি ধবংস করে দিয়েছি, তারা বিশ্বাস স্থাপন করেনি; এখন এরা কি বিশ্বাস স্থাপন করবে?
5 Zohurul Hoque
ওদের আগে যেসব জনপদ বিশ্বাস করে নি তাদের আমরা ধ্বংস করেছি। এরা কি তবে বিশ্বাস করবে?
6 Mufti Taqi Usmani
অথচ তাদের পূর্বে আমি যত জনপদ ধ্বংস করেছি, তারা ঈমান আনেনি। তবে কি এরা ঈমান আনবে?
7 Mujibur Rahman
তাদের পূর্বে যে সব জনপদ আমি ধ্বংস করেছি ওর অধিবাসীরা ঈমান আনেনি; তাহলে কি তারা ঈমান আনবে?
8 Tafsir Fathul Mazid
সূরার নামকরণ:
الْأَنْبِيَاءِ আম্বিয়া শব্দটি নাবী শব্দের বহুবচন। এই সূরাতে একাধিক নাবী ও রাসূলের আলোচনা করা হয়েছে বিধায় একে সূরা আম্বিয়া নামে নামকরণ করা হয়েছে।
সূরাতে কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও মানুষ সে সম্পর্কে গাফেল, নাবীদের বৈশিষ্ট্য, পূর্ববর্তী কয়েকটি অবাধ্য জাতির ধ্বংস, একাধিক মা‘বূদ থাকলে কী সমস্যা হত এবং যে ফেরেশতাদেরকে অনেকে আল্লাহ তা‘আলার কন্যা মনে করে তারা মূলত তা নয় সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অতঃপর কয়েকজন নাবীর কাহিনী, তাদের আহ্বানে আল্লাহ তা‘আলার সাড়া দান, ইবরাহীম (عليه السلام)-এর পিতা ও জাতিকে তাওহীদের দাওয়াত, দাওয়াত পেয়ে তাদের অবস্থান এবং সবশেষে জাহান্নামী ও জান্নাতীদের সম্পর্কে আলোচনা নিয়ে আসা হয়েছে।
১-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
(اِقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ)
এখানে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সতর্ক করছেন যে, তাদের কৃতকর্মের হিসাব নেয়ার দিন তথা কিয়ামত নিকটবর্তী হয়ে গেছে। কারণ সময় যাচ্ছে কিয়ামত ঘনিয়ে আসছে, যতই সময় যাবে কিয়ামত ততই কাছে চলে আসবে। এভাবে একদিন কিয়ামত চলে আসবে আর প্রত্যেককে সেদিন ভাল-মন্দ সকল কর্মের হিসাব দিতে হবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: কিয়ামতের দিন আদম সন্তান পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দেয়া পর্যন্ত এক পাও আগাতে পারবে না (১) জীবন কোন পথে ব্যয় করেছে, (২) তোমার যৌবনকাল কোন পথে ব্যয় করেছে, (৩) সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে, (৪) এবং কোন পথে ব্যয় করেছে, (৫) জ্ঞানানুযায়ী কতটুকু আমল করেছে। (মুসনাদে আবী ইয়ালা হা: ৫২৭১) অথচ মানুষ এসব থেকে উদাসীন রয়েছে। তারা এর জন্য এমন কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করছে না; যা কিয়ামতের দিন উপকারে আসবে। বরং দিন দিন অন্যায় কাজের দিকে বেশি ধাবিত হচ্ছে। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছেন যাতে তারা মন্দ কার্যকলাপ ছেড়ে দিয়ে ভাল কাজের দিকে ধাবিত হয়। কেননা সেদিনের অবস্থা হবে খুবই ভয়াবহ। আল্লাহ তা‘আলা তা‘আলা বলেন:
(اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ - وَإِنْ يَّرَوْا اٰيَةً يُّعْرِضُوْا وَيَقُوْلُوْا سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ)
“কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে, চন্দ্র ফেটে গেছে, তারা কোন নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলেঃ এটা তো পূর্ব হতে চলে আসা বড় জাদু।” (সূরা ক্বামার ৫৪:১-২)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, তাদের কাছে যখন কোন নতুন উপদেশ আসে অর্থাৎ কুরআন যা প্রয়োজন মত অবতীর্ণ হয়। যদিও তা তাদেরই উপদেশের জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে কিন্তু তারা এমনভাবে তা শ্রবণ করে যেন তা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, উপহাস ও খেলা করছে, অর্থাৎ তা নিয়ে তারা কোন চিন্তাভাবনা করে না।
(لَاهِيَةً قُلُوْبُهُمْ)
অর্থাৎ তাদের অন্তর কুরআন থেকে গাফেল, দুনিয়ার বাতিল ও কু-প্রবৃত্তি নিয়ে ব্যস্ত।
মক্কার কুরাইশ কাফিররা গোপনে নিজেদের মাঝে শলাপরামর্শ করল কিভাবে মানুষদেরকে মুহাম্মাদ থেকে দূরে রাখা যায়, তারা চিন্তা করে বলল: মুহাম্মাদ তো তোমাদের মত একজন সাধারণ মানুষ, তার মধ্যে আর তোমাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সুতরাং সে যে কুরআন নিয়ে এসেছে তা একটি জাদু, তাহলে কিভাবে তার জাদুকে তোমরা মেনে নিয়ে তার অনুসরণ করবে? মক্কার কাফিররা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাদের মত একজন মানুষ বলে প্রত্যাখ্যান করল, নাবী হিসেবে মেনে নিল না। অথচ আল্লাহ তা‘আলা যত নাবী প্রেরণ করেছেন সকল নাবীই মানুষ ছিলেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَآ أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنَ الْمُرْسَلِيْنَ إِلَّآ إِنَّهُمْ لَيَأْكُلُوْنَ الطَّعَامَ وَيَمْشُوْنَ فِي الْأَسْوَاقِ)
“তোমার পূর্বে আমি যে সকল রাসূল প্রেরণ করেছি তারা সকলেই তো আহার করত ও হাটে-বাজারে চলাফেরা করত।” (সূরা ফুরক্বান ২৫:২০)
মানুষকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করার রহস্য হচ্ছে যদি আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ না করে কোন ফেরেশতা বা জিনকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করতেন তাহলে রিসালাতের পরিপূর্ণ উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হত না। মানুষের পক্ষে ফেরেশতা বা জিনদের কথা বোঝা সম্ভব হত না। মাটির মানুষ যে সকল সমস্যা অনুভব করবে তা নূরের তৈরি ফেরেশতা বা আগুনের তৈরি জিন অনুভব করতে পারবে না। একত্রে চলাফেরা করা কষ্টকর হত। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করেই আল্লাহ তা‘আলা মানুষকেই মানুষের নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। যদি পৃথিবীতে ফেরেশতা বসবাস করত তাহলে তিনি ফেরেশতাদেরকেই রাসূল হিসেবে প্রেরণ করতেন। যেহেতু পৃথিবীতে মানুষের বসবাস তাই তিনি মানুষকেই রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন।
(رَبِّيْ يَعْلَمُ الْقَوْل)
যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা আকাশ-জমিনে যত কথা হয় সকল কথা অবগত রয়েছেন সেহেতু হে কাফিররা! তোমরা আমার ব্যাপারে যা কিছু বলছ সব আল্লাহ তা‘আলা শুনছেন, সে হিসেবে তোমাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে। এ কথা বলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সতর্কসাবধান করছেন। অতএব মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যাপারে যেসব মিথ্যা বলছ সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে।
(أَضْغَاثُ أَحْلَامٍ)
এমন স্বপ্ন যার কোন ব্যাখ্যা নেই। কেউ বলেছেন, মিথ্যা স্বপ্ন। অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে কুরআন পাঠ করে তা মিথ্যা বা আবোল-তাবোল স্বপ্ন। যখন তারা দেখল বিষয়টি এমন নয় তখন তারা বলল: সে এটা আবিষ্কার করেছে এবং নিজের পক্ষ থেকে উদ্ভাবন করেছে। এ কথা থেকেও ফিরত এসে বলল: না, সে একজন কবি। তাদের এ সকল দাবীর প্রতিবাদ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “এটা কোন কবির কথা নয়; তোমরা অল্পই বিশ্বাস কর, এটা কোন গণকের কথাও নয়, তোমরা অল্পই উপদেশ গ্রহণ কর। এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। যদি সে নিজে কোন কথা বানিয়ে আমার কথা বলে চালিয়ে দিত, তবে অবশ্যই আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম, এবং কেটে দিতাম তার হৃৎপিণ্ডের শিরা। অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ থাকত না, যে আমার থেকে তাকে রক্ষা করতে পারে।” (সূরা হাক্কাহ ৬৯:৪১-৪৭)
তারা এ দাবী করত, যদি মুহাম্মাদ সত্যবাদী হয় তাহলে তাদের নিকট পূর্ববর্তীদের মত নিদর্শন নিয়ে আসুক। যেমন সালেহ (عليه السلام) উটনী নিয়ে এসেছিলেন, মূসা (عليه السلام) লাঠি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথা অনুপাতে নিদর্শন অবতীর্ণ করেননি। কারণ আল্লাহ তা‘আলা জানেন যে, তারা নিদর্শন দেখে ঈমান আনবে না। তাই আল্লাহ তা‘আলা বলছেন: ইতোপূর্বে যত জনপদ ধ্বংস করেছি তাদের কেউ ঈমান আনেনি, অতএব এরা কি ঈমান আনবে? কক্ষনো না, এরা পূর্ববর্তীদের অনুগামী।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَاَقْسَمُوْا بِاللہِ جَھْدَ اَیْمَانِھِمْ لَئِنْ جَا۬ءَتْھُمْ اٰیَةٌ لَّیُؤْمِنُنَّ بِھَاﺚ قُلْ اِنَّمَا الْاٰیٰتُ عِنْدَ اللہِ وَمَا یُشْعِرُکُمْﺫ اَنَّھَآ اِذَا جَا۬ءَتْ لَا یُؤْمِنُوْنَ)
“তারা আল্লাহর নামে কঠিন শপথ করে বলে, তাদের নিকট যদি কোন নিদর্শন আসত তবে অবশ্যই তারা তাতে ঈমান আনত। বল: ‘নিদর্শন তো (আসে একমাত্র) আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাদের নিকট নিদর্শন আসলেও তারা যে ঈমান আনবে না এটা কিভাবে তোমাদের বোধগম্য করান যাবে?” (সূরা আন‘আম ৬:১০৯)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামত অতি নিকটবর্তী, তাই কিয়ামতের কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মন্দ আমল ছেড়ে দিয়ে সৎ আমল করতে হবে।
২. কুরআন মনোযোগ সহকারে শুনতে হবে, কৌতুকচ্ছলে নয়।
৩. যুগে যুগে মানুষের মধ্য হতে মানুষকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করার হেকমত জানলাম।
৪. কুরআন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাব, কোন অলীক কাহিনী নয়।
৫. পূর্ববর্তী যাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছে সবাই আল্লাহ তা‘আলার সাথে নাফরমানী করেছে।
9 Fozlur Rahman
এদের আগে যেসব জনপদ আমি ধ্বংস করেছি তার অধিবাসীরা ঈমান আনেনি। অতএব, এরা কি ঈমান আনবে?
10 Mokhtasar Bangla
৬. এ প্রস্তাবকারীদের পূর্বে যে জনপদই নিদর্শন নাযিলের প্রস্তাব করেছে এবং তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী তা দেয়া হয়েছে তখন তারা ঈমান আনেনি। বরং তারা তা অস্বীকার করলে আমি তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছি। তাহলে এরা কি ঈমান আনবে?!
11 Tafsir Ibn Kathir
সহীহ বুখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, সূরায়ে বানী ইসরাঈল, সূরায়ে কাহফ, সূরায়ে মারইয়াম, সূরায়ে তা-হা এবং সূরায়ে আম্বিয়া হলো প্রথম মনোনীত সূরাসমূহ এবং এগুলোই تلَاوى।
১-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
মহামহিমান্বিত আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করছেন যে, কিয়ামত নিকটবর্তী হয়ে গেছে, অথচ মানুষ তা থেকে সম্পূর্ণ উদাসীন রয়েছে। তারা ওর জন্যে এমন কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করছে না যা সেই দিন তাদের উপকারে আসবে। বরং তারা সম্পূর্ণরূপে দুনিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। দুনিয়ায় তারা এমনভাবে লিপ্ত হয়ে পড়েছে যে, ভুলেও একবার কিয়ামতকে স্মরণ করে না। অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ اَتٰۤى اَمْرُ اللّٰهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوْهُ অর্থাৎ “আল্লাহর আদেশ আসবেই; সুতরাং তোমরা ওকে ত্বরান্বিত করতে চেয়ো না।” (১৬:১) আর এক জায়গায় বলেনঃ اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَ انْشَقَّ الْقَمَرُ ـ وَ اِنْ یَّرَوْا اٰیَةً یُّعْرِضُوْا অর্থাৎ “কিয়ামত আসন্ন, চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। তারা কোন নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (৫৪:১-২) কবি আবু নুওয়াসের এই অর্থেরই নিম্নরূপ একটি কবিতাংশ রয়েছেঃ اَلنَّاسُ فِىْ غَفْلَاتِهِمْ ـ وَرُحَى الْمَنِيَّةِ تُطْحَنُ অর্থাৎ “মানুষ তাদের উদাসিনতায় ডুবে আছে, অথচ মৃত্যুর যাতা ঘুরতে রয়েছে। তখন তাকে প্রশ্ন করা হয়ঃ “কি থেকে এটা নেয়া হয়েছে? " উত্তরে সে বলেঃ আল্লাহ তাআলার اِقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِىْ غَفْلَةٍ مُّعْرِضُوْنَ এই উক্তি হতে।”
বর্ণিত আছে যে, হযরত আমির ইবনু রাবীআহ (রাঃ) বড়িীতে একটি লোক অতিথিরূপে আগমন করে। হযরত আমির (রাঃ) তার খুব খাতিরসম্মান করে তাকে বাড়ীতে রাখেন এবং তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সঃ) সাথেও আলোচনা করেন। একদা এ অতিথি হযরত আমিরকে (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে অমুক উপত্যকা দান করেছেন। আমি চাই যে, ঐ উত্তম ভূ-খণ্ডের কিছু অংশ আপনার নামে করে দিই, যাতে আপনার অবস্থা স্বচ্ছল হয়।” উত্তরে হযরত আমির (রাঃ) বলেনঃ “ভাই, আমার এর কোন প্রয়োজন নেই। আজ এমন একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে যা দুনিয়াকে আমার কাছে তিক্ত করে তুলেছে।” অতঃপর তিনি اِقْتَرَبَ لِلنَّاسِ এই আয়াতটিই পাঠ করেন।
এরপর আল্লাহ তাআলা কুরায়েশ এবং তাদের মত অন্যান্য কাফিরদের সম্পর্কে বলেনঃ যখনই তাদের নিকট তাদের প্রতিপালকের কোন নতুন উপদেশ আসে তখন তারা তা শ্রবণ করে কৌতুকচ্ছলে। তারা আল্লাহর কালাম ও তাঁর ওয়াহীর দিকে কানই দেয় না। তারা এক কানে শুনে এবং অন্য কান দিয়ে উড়িয়ে দেয়। তাদের অন্তর হাসি-তামাশায় লিপ্ত থাকে।
সহীহ বুখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “আহলে কিতাবদের কিতাবের কথা কিজ্ঞেস করা তোমাদের কি প্রয়োজন। তারা তো আল্লাহর কিতাবে বহু কিছু রদ-বদল করে দিয়েছে, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে ফেলেছে। তোমাদের কাছে তো নতুনভাবে অবতারিত আল্লাহর কিতাব বিদ্যমান রয়েছে। এতে কোন প্রকার পরিবর্তন ঘটে নাই। এলাকগুলি নিজেদের অন্তরকে এর ক্রিয়া থেকে শূন্য রাখতে চাচ্ছে। তারা অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করছে এবং বলছেঃ “আমাদেরই মত একজন মানুষের তো আমরা অধীনতা স্বীকার করতে পারি না। তোমরা কেমন লোক যে, দেখে শুনে যদুিকে মেনে নি? এটা অসম্ভব যে, আল্লাহ তাআলা আমাদের মতই মানুষকে রিসালাত ও ওয়াহী দ্বারা বিশিষ্ট করবেন। সুতরাং এটা বিস্ময়কর ব্যাপার যে, লোক বুঝে সুঝেও তার যাদুর মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। তাদের একথার জবাবে আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (সাঃ) বলেনঃ তুমি বলঃ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমস্ত কথাই আমার প্রতিপালক অবগত আছেন। তাঁর কাছে কোন কিছুই গোপন নেই। তিনি এই পাক কালাম কুরআন কারীম অবতীর্ণ করেছেন। এতে পূর্ব ও পরের সমস্ত খবর বিদ্যমান রয়েছে। এটা একথাই প্রমাণ করে যে, এটা অবতীর্ণকারী হলেন আলেমুল গায়েব। তিনি তোমাদের সব কথাই শ্রবণ করেন এবং তিনি তোমাদের সমস্ত অবস্থা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। সুতরাং তোমাদের তাঁকে ভয় করা উচিত।
এরপর কাফিরদের ঔদ্ধত্যপনা ও হঠকারিতার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তারা বলে এ সব অলীক কল্পনা হয় সে উদ্ভাবন করেছে, না হয় সে একজন কবি। এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তারা নিজেরাই এ ব্যাপারে হয়রান পেরেশান রয়েছে। কোন এক কথার উপর তারা স্থির থাকতে পারছে না। তাই, তারা আল্লাহর কালামকে কখনো যাদু বলছে এবং কখনো কবিতা বলছে এবং কখনো আবার বিক্ষিপ্ত ও উদ্ভট কথা বলছে। কখনো আবার তারা একথাও বলছে যে, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ওগুলি নিজেই বানিয়ে নিয়েছেন। মোট কথা, তাদের মুখে যা আসছে তাই তারা বলছে। কখনো তারা বলছেঃ যদি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সত্য নবী হন তবে হ্যরত সালেহের (আঃ) মত কোন উস্ত্রী আমাদের নিকট আনয়ন করুন, বা হযরত মূসার (আঃ) মত কোন মু'জিযা প্রদর্শন করুন অথবা হযরত ঈসার (আঃ) মত কোন মুজিযা প্রকাশ করুন না কেন? অবশ্যই আল্লাহ তাআলা এ সবের উপরপূর্ণ ক্ষমতাবান। কিন্তু যদি এগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং পরেও তারা ঈমান আনয়ন না করে তবে আল্লাহ তাআলার নীতি অনুযায়ী তারা তার শাস্তির কোপানলে পড়ে যাবে এবং তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। তাদের পূর্ববর্তী লোকেরাও একথাই বলেছিল এবং ঈমান আনয়ন করে নাই। ফলে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। অনুরূপভাবে এরাও মুজিযা দেখতে চাচ্ছে, কিন্তু তা প্রকাশিত হয়ে পড়লে তারা ঈমান আনবে না। সুতরাং পূর্ববর্তী লোকদের মত তারাও ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ اِنَّ الَّذِیْنَ حَقَّتْ عَلَیْهِمْ كَلِمَتُ رَبِّكَ لَا یُؤْمِنُوْنَ ـ وَ لَوْ جَآءَتْهُمْ كُلُّ اٰیَةٍ حَتّٰى یَرَوُا الْعَذَابَ الْاَلِیْمَ অর্থাৎ “নিশ্চয় যাদের উপর তোমার প্রতিপালকের কথা বাস্তবায়িত হয়েছে তারা ঈমান আনয়ন করবেনা, যদিও তাদের কাছে সমস্ত নিদর্শন এসে যায়, যে পর্যন্ত না তারা যন্ত্রণাদায়ক শস্তি অবলোকন করে। (১০:৯৬-৯৭)
কিন্তু তখনকার ঈমান আনয়ন বৃথা। প্রকৃত ব্যাপার এটাই যে, তার ঈমান অনবেই না। তাদের চোখের সামনে তো রাসলল্লাহর (সঃ) অসংখ্য মজিয়া বিদ্যমান ছিল। এমন কি তার মু'জিযাগুলি ছিল অন্যান্য নবীদের মু'জিযা গুলি অপেক্ষা বেশী প্রকাশমান।
হযরত উবাদা ইবনু সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “একদা আমরা মসজিদে অবস্থান করছিলাম। হযরত আবু বকর (রাঃ) কুরআন পাঠ করছিলেন। এমন সময় আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সাল মুনাফিক আগমন করে এবং নিজের গদী বিছিয়ে এবং বালিশে হেলান দিয়ে আঁকজমকের সাথে বসে পড়ে। সে খুব বাকপটুও ছিল। হযরত আবু বকরকে (রাঃ) সে বললোঃ “হে আবু বকর (রাঃ)! হযরত মুহাম্মদকে (সঃ) বলুন যে, তিনি যেন আমাদের কাছে কোন নিদর্শন আনয়ন করেন যেমন তাঁর পূর্ববর্তী নবীরা (আঃ) নিদর্শন সমূহ আনয়ন করেছিলেন। যেমন হযরত মুসা (আঃ) ফলক আনয়ন করেছিলেন, হযরত সালেহ (আঃ) এনেছিলেন উষ্ট্ৰী, হযরত দাউদ (আঃ) আনয়ন করেছিলেন যবুর এবং হযরত ঈসা (আঃ) আনয়ন করেছিলেন ইঞ্জীল ও আসমানী খাদ্য পূর্ণ খাঞ্চা।” তার একথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) কাঁদতে শুরু করেন। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আগমন করেন। তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) অন্যান্য সাহাবীদেরকে বলেনঃ “রাসূলুল্লাহর (সঃ) সম্মানার্থে দাড়িয়ে যান এবং এই মুনাফিকের ফরিয়াদ তাঁর কাছে পৌছিয়ে দাও।" তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “ আমার জন্যে দাঁড়ানো চলবে না। দাঁড়াতে হবে শুধুমাত্র মহামহিমান্বিত আল্লাহর জন্যে। আমরা তখন বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! এই মুনাফিকের কারণে আমরা বড়ই কষ্ট পাচ্ছি।” তখন তিনি বললেনঃ “এখনই অমাির কাছে হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করেছিলেন এবং আমাকে বললেনঃ “আপনি বাইরে গিয়ে জনগণের সামনে আল্লাহর ঐ নিয়ামত রাজির বর্ণনা দিন যা তিনি আপনাকে দান করেছেন এবং ঐ মর্যাদার কথা প্রকাশ করুন যা তিনি আপনাকে দিয়েছেন।” অতঃপর তিনি আমাকে সুসংবাদ দিলেন যে, আমাকে সারা দুনিয়ার জন্যে রাসূলরূপে প্রেরণ করা হয়েছে। আমাকে নিদর্শন দেয়া হয়েছে যে, আমি যেন জ্বিনদের কাছেও আল্লাহর পয়গাম পৌঁছিয়ে দিই। মহান আল্লাহ আমাকে তার পবিত্র কিতাব (কুরআন) দান করেছেন, অথচ আমি সম্পূর্ণরূপে নিরক্ষর। তিনি আমার পূর্বেও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। ফেরেশতাদের মাধ্যমে তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন। আমার সামনে তিনি ভক্তি প্রযুক্ত ভয় রেখে দিয়েছেন। আমাকে হাওজে কাউসার দান করা হয়েছে যা কিয়ামতের দিন সমস্ত হাওজ অপেক্ষা বড় হবে। আমার সাথে তিনি মাকামে মাহমুদের ওয়াদা করেছেন যখন সমস্ত লোক উদ্বিগ্ন অবস্থায় মাথা নীচু করে থাকবে। তিনি আমাকে ঐ প্রথম দলভূক্ত করেছেন যারা লোকদের মধ্য হতে বের হবে। আমার শাফাআতের ফলে আমার উম্মতের মধ্য হতে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে চলে যাবে। আমাকে বিজয় ও রাজ্য দান করা হয়েছে। আমাকে সুখময় জান্নাতের ঐ সুউচ্চ কক্ষ দান করা হবে যার মত উচ্চ মঞ্জিল আর কারো হবে না। আমার উপর শুধুমাত্র ঐ ফেরেশতারা থাকবেন যারা আল্লাহর আরশ উঠিয়ে নিয়ে থাকবেন। আমার জন্যে ও আমার উম্মতের জন্যে গনীমতের মাল (যুদ্ধলব্ধমাল) হালাল করা হয়েছে, অথচ আমার পূর্বে কারো জন্যে এটা হালাল ছিল না। "