৩২-৩৩ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মর্যাদার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে, কুরবানীর জন্তুও যার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলার আহকামের উপর আমল করার অর্থই হলো ওগুলিকে শ্রদ্ধা করা। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, নিদর্শনকারীকে শ্রদ্ধা করার অর্থ হলো কুরবানীর জন্তুগুলিকে মোটা তাজা ও সুন্দর করা। হযরত সাহল (রাঃ) বলেনঃ “মদীনায় আমরা কুরবানীর জন্তু গুলিকে লালন পালন করে মোটা তাজা করতাম। সমস্ত মুসলমানের মধ্যে এই প্রচলণই ছিল।” (এটা ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “দু'টো কালো বর্ণের জন্তুর রক্ত অপেক্ষা একটি সাদা বর্ণের জন্তুর রক্ত আল্লাহ তাআলার নিকট বেশী প্রিয় ও পছন্দনীয়।" (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম ইলু মাজাহ্ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাদা কালো মিশ্রিত রঙ এর বড় বড় শিং বিশিষ্ট দুটো ভেড়া কুরবানী করেন।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাদাকালো মিশ্রিত রঙ এর বড় শিং বিশিষ্ট একটি ভেড়া কুরবানী করেন যার মুখের উপর চোখের পার্শ্বে এবং পাগুলির উপর কালো দাগ ছিল। (এ হাদীসটি সুনান গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে সঠিক বলেছেন)
হযরত আবু রাফে (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) দু'টি খুব মোটা তাজা, চিক্কন, সাদা-কালো রঙ মিশ্রিত অণ্ডকোষ কর্তিত ভেড়া কুরবানী করেন।” (এ হাদীসটি সুনানে ইবনু মাজাহতে বর্ণিত আছে)
হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা যেন কুরবানীর জন্তু ক্রয় করার সময় চোখ ও কান ভাল করে দেখে নিই এবং সামনের দিক থেকে কান বিশিষ্ট, লম্বাভাবে ফাটা কান বিশিষ্ট ও ছিদ্র যুক্ত কান বিশিষ্ট জন্তু যেন কুরবানী না করি।" (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও আহলুস সুনান বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ)
এটাকে বিশুদ্ধ বলেছেন) অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) শিং ভাঙ্গা ও কান কাটা জন্তু কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন। এর ব্যাখ্যায় হযরত সাঈদ ইবনু মুসাইয়া (রঃ) বলেন যে, যদি অর্ধেক বা অর্ধেকের বেশী কান বা শিং না থাকে (তবে ঐ জন্তু কুরবানী করা চলবে না, এর কম হলে চলবে)।
কোন কোন ভাষাবিদ বলেন যে, কোন জানোয়ারের শিং যদি উপর থেকে ভাঙ্গা থাকে তবে আরবীতে ওটাকে قَصْما বলে। আর নীচে থেকে ভাঙ্গা থাকলে ওটাকে عَضب বলে হাদীসে عَضب শব্দ রয়েছে। আর কানের কিছু অংশ কাটা থাকলে ওটাকেও عَضب বলে। ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেন যে, এরূপ জাননায়ারের কুরবানী জায়েয হবে বটে, কিন্তু মাকরূহ হবে। ইমাম আহমাদ (রঃ) বলেন যে, এটার কুরবানী জায়েযই নয়। বাহ্যতঃ এই উক্তিটিই হাদীসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ইমাম মালিক (রঃ) বলেন যে, শিং হতে যদি রক্ত প্রবাহিত হয় তবে কুরবানী জায়েয হবে না, অন্যথায় জায়েয হবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
রাসূলুল্লাহর (সঃ) হাদীস রয়েছে যে, চার প্রকারের দোষযুক্ত জন্তু কুরবানীর জন্যে জায়েয নয়। ঐ কানা জন্তু যার চোখের টেরা ভাব প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। ঐ খোড়া পশু যার খোড়াত্ব প্রকাশ পেয়েছে। ঐ দুর্বল ও ক্ষীণ পশু যার মজ্জা নষ্ট হয়ে গেছে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও আহলুস সুনান হযরত বারা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে বিশুদ্ধ বলেছেন) এ গুলি এমনই দোষ যার ফলে পশুর গোশত কমে যায়। বকরী তো সাধারণতঃ চরেই খায়। কিন্তু অতি দুর্বলতার কারণে সে ঘাস পাতা পায় না। এ কারণেই এই হাদীসের মর্মানুযায়ী ইমাম শাফেয়ী (রঃ) প্রভৃতি মনীষীদের নিকট এই ধরনের পর কুরবানী জায়েয নয়। হাঁ, তবে যেই রুগ্ন পশুর রোগ ততো মারাত্মক নয়, বরং খুবই কম, এরূপ পশুর ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ীর (রঃ) দুটোই উক্তি রয়েছে।
হযরত উবা ইবনু আবদিস সালামী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিষেধ করেছেন সম্পূর্ণ শিং কাটা পশু হতে, শিং ভাঙ্গা পশু হতে, কানা জন্তু হতে সম্পূর্ণরূপে দুর্বল প্রাপ্ত হতে যা দুর্বলতার কারণে বা অতি বার্ধক্যের কারণে সদা পশু পালের পিছনে পড়ে থাকে এবং খোড়া জন্তু। হতে।
সুতরাং এই সমুদয় দোষযুক্ত পশুর কুরবানী জায়েয নয়। তবে যদি কুরবানীর জন্যে নিখুঁত জন্তু নির্ধারণ করে দেয়ার পর ঘটনাক্রমে ওর মধ্যে কোন দোষ এসে পড়ে, যেমন খোড়া ইত্যাদি হয়ে যায় তা হলে ইমাম শাফেয়ীর (রঃ) মতে এর কুরবানী নিঃসন্দেহে জায়েয। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) এর বিপরীত মত পোষণ করেন। ইমাম শাফিয়ীর (রঃ) দলীল হলো নিম্নের হাদীসটিঃ
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) বলেনঃ “আমি কুরবানীর জন্যে একটি ভেড়া ক্রয় করি। ওর উপর একটি নেকড়ে বাঘ আক্রমণ করে এবং ওর একটি রান ভেঙ্গে দেয়। আমি ঘটনাটি রাসূলুল্লাহর (সঃ) নিকট বর্ণনা করি। তিনি বলেনঃ “তুমি ওটাকেই কুরবানী করতে পার।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
সুতরাং ক্রয় করার সময় জন্তু মোটা তাজা ও নিখুঁত হতে হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) নির্দেশ দিয়েছেনঃ “তোমরা (কুরবানীর পশু কিনবার সময়) ওর চোখ, কান দেখে নাও।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উমার ফারূক (রাঃ) একটি অত্যন্ত সুন্দর উষ্ট্রকে কুরবানীর জন্যে নির্দিষ্ট করেন। জনগণ ওর মূল্যায়ণ করে তিন শ' স্বর্ণমুদ্রা। তখন তিনি রাসূলুল্লাহকে (সঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি কুরবানীর নামে একটি উট রেখেছি। লোকেরা ওর মূল্যায়ণ করছে। তিনশ’ স্বর্ণ মুদ্রা। আমি কি ওটা বিক্রী করে ওর মূল্যের বিনিময়ে কয়েকটি কুরবানীর জন্তু ক্রয় করতে পারি ? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “না, বরং তুমি ওটাই কুরবানী কর।” (এটাও মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, কুরবানীর উট شَعَائِرَ اللهِ এর অন্তর্ভুক্ত। মুহাম্মদ ইবনু আবি মূসা (রঃ) বলেন যে, আরাফার মাঠে অবস্থান করা, মুযদালাফায় গমন করা, জুমরাকে কংকর মারা, মাথা মুণ্ডন করা এবং কুরবানীর উট, এ সব গুলি شَعَائِرَ اللهِ এর মধ্যে গণ্য। হযরত ইবনু উমার (রাঃ) বলেন যে, এসব অপেক্ষা অগ্রগণ্য হলো মক্কা শরীফ।
মহান আল্লাহ বলেনঃ এ সমস্ত আনআমে তোমাদের জন্যে নানাবিধ উপকার রয়েছে। যেমন এগুলির পশমে তোমাদের জন্যে উপকরি রয়েছে। তোমরা এগুলির উপর সওয়ার হয়ে থাকে। এগুলির চামড়া তোমরা কাজে লাগিয়ে থাকে। এটা একটা নির্দিষ্ট কালের জন্যে। অর্থাৎ যতদিন পর্যন্ত এই জন্তু গুলিকে তোমরা আল্লাহর নামে না রেখে দাও ততদিন পর্যন্ত তোমরা ওগুলির দুধ পান কর এবং বাচ্চা লাভ কর। যখন কুরবানীর জন্যে এগুলিকে নির্দিষ্ট করে দেবে তখন এগুলি আল্লাহর জিনিস হয়ে যাবে। অন্যান্য বুযুর্গ ব্যক্তিবর্গ বলেন যে, প্রয়োজনবোধে এই সময়েও এগুলির উপর আরোহণ করা চলবে। যেমন হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি লোককে তার কুরবানীর জন্তু হাঁকিয়ে নিয়ে যেতে দেখে তাকে বলেনঃ “এর উপর সওয়ার হয়ে যাও।" লোকটি তখন বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি একে কুরবানী করার নিয়ত করেছি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার বলেনঃ “হায় আফসোস! তুমি এর উপর সওয়ার হচ্ছে না কেন? (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রয়োজন হলে তোমরা উত্তম পন্থায় (কুরবানীর জন্তুর উপর) সওয়ার হয়ে যাও।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
একটি লোকের কুরবানীর উস্ত্রী বাচ্চা প্রসব করে। তখন হযরত আলী • (রাঃ) লোকটিকে বলেনঃ “বাচ্চাটিকে পেট ভরে দুধপান করাও। যদি এ বাচ্চা বেঁচে থাকে তবে তো ভালই। তুমি একে নিজের কাজে লাগাও। কুরবানীর দিন আসলে এ উষ্ট্রীকে ও এর বাচ্চাকে আল্লাহর নামে যবাহ করে দেবে।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ অতঃপর এগুলির কুরবানীর স্থান প্রাচীন গৃহের নিকট। যেমন এক জায়গায় আছেঃ هَدْيًا بَالِغَ الْكَعْبَةِ এবং অন্য এক স্থানে রয়েছে وَالْهَدْىَ مَعْكُوْفًا اَنْ يَّبْلُغَ مَحِلَّهٗ
اَلْبَيْتِ الْعَتِيْقِএর অর্থ ইতিপূর্বেই বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যে।
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, বায়তুল্লাহর তাওয়াফকারী ইহরাম হতে হালাল হয়ে যায়। দলীল হিসেবে তিনি ثُمَّ مَحِلَّهَا اِلَى الْبَيْتِ الْعَتِيْقِ এটাই পাঠ করেন।