ইয়াসীন আয়াত ৭০
لِّيُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيًّا وَّيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكٰفِرِيْنَ ( يس: ٧٠ )
Liyunzira man kaana haiyanw-wa yahiqqal qawlu 'alal-kaafireen (Yāʾ Sīn ৩৬:৭০)
English Sahih:
To warn whoever is alive and justify the word [i.e., decree] against the disbelievers. (Ya-Sin [36] : 70)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
যাতে সে (আত্মিকভাবে) জীবিতকে সতর্ক করতে পারে আর কাফিরদের বিরুদ্ধে অকাট্য দলীল হতে পারে। (ইয়াসীন [৩৬] : ৭০)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
যাতে সে জীবিত (জাগ্রতচিত্ত) ব্যক্তিদেরকে সতর্ক করতে পারে[১] এবং অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা সাব্যস্ত হয়। [২]
[১] অর্থাৎ, যার অন্তর শুদ্ধ ও সজাগ আছে সে সত্য গ্রহণ করে এবং বাতিল প্রত্যাখ্যান করে। لِيُنْذِرَ (সতর্ক করতে পারে) ক্রিয়ার কর্তা হল কুরআন।
[২] অর্থাৎ, যে ব্যক্তি অবিশ্বাস ও কুফরীর উপর অটল থাকবে, তার উপর আযাব সাব্যস্ত হবে।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
যাতে তা সতর্ক করতে পারে জীবিতকে এবং যাতে কাফিরদের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা সত্য হতে পারে।
3 Tafsir Bayaan Foundation
যাতে তা সতর্ক করতে পারে ঐ ব্যক্তিকে যে জীবিত এবং যাতে কাফিরদের বিরুদ্ধে অভিযোগবাণী প্রমাণিত হয়।
4 Muhiuddin Khan
যাতে তিনি সতর্ক করেন জীবিতকে এবং যাতে কাফেরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
5 Zohurul Hoque
যেন তিনি সাবধান করতে পারেন তাকে যে জীবন্ত রয়েছে, আর অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে রায় ন্যায়সঙ্গত হয়েছে।
6 Mufti Taqi Usmani
যাতে প্রত্যেক জীবিতজনকে সতর্ক করে দেয় এবং যাতে কাফেরদের বিরুদ্ধে প্রমাণ চূড়ান্ত হয়ে যায়।
7 Mujibur Rahman
যাতে সে সতর্ক করতে পারে জীবিতদেরকে এবং যাতে কাফিরদের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা সত্য হতে পারে।
8 Tafsir Fathul Mazid
৬৮-৭০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আমি তাদের মধ্য থেকে যাকে দীর্ঘ জীবন দান করি তার স্বাভাবিক গঠনের অবনতি ঘটাই। অর্থাৎ মানুষ শিশু অবস্থায় যেমন তার কোন জ্ঞান থাকে না অনুরূপ সে যখন জীবনের শেষ বেলায় বৃদ্ধ হয় তখন শিশুকালের মতই তারা জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। এ সম্পর্কে সূরা নাহ্ল-এর ৭০ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা ঐ সকল কাফির-মুশরিকদের কথার প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন যারা বলত, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন কবি। তাই আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আমি তাকে কাব্য শিখাইনি অর্থাৎ সে কবি নয় এবং কবিতা রচনা করা তার পক্ষে শোভনীয় নয়। শুধুমাত্র তাকে স্পষ্ট কুরআন দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে যেন তিনি জীবিত লোকদেরকে সতর্ক করতে পারেন। অর্থাৎ যাদের অন্তর সত্যাগ্রহী তাদেরকে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(وَأُوْحِيَ إِلَيَّ هٰذَا الْقُرْاٰنُ لِأُنْذِرَكُمْ بِه۪ وَمَنْ....)
“এবং এ কুরআন আমার নিকট প্রেরিত হয়েছে যেন তোমাদেরকে এবং যার নিকট তা পৌঁছবে তাদেরকে এর দ্বারা আমি সতর্ক করি।” (সূরা আন‘আম ৬ : ১৯)
আর যারা এ সতর্কবাণী শুনার পরও সতর্ক হয় না বরং অবাধ্য থেকেই যায় তাদের জন্যই জাহান্নামের শাস্তি বাস্তবায়িত হবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(وَمَنْ يَّكْفُرْ بِه۪ مِنَ الْأَحْزَابِ فَالنَّارُ مَوْعِدُه۫)
“অন্যান্য দলের যারা একে অস্বীকার করে, অগ্নিই তাদের প্রতিশ্র“ত স্থান।” (সূরা হূদ ১১ : ১৭)
অতএব যারা আল্লাহ তা‘আলার বিধানের অবাধ্য হবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কুরআন মূলত জীবিতদের জন্যই নাযিল হয়েছে, অতএব মৃতদের পাশে কুরআন পাঠে তাদের কোনই উপকার হবে না।
২. সূরা ইয়াসীনের ফযীলত রয়েছে বলে তা মৃতদের পাশে পাঠ করা হয় যা সঠিক নয়।
9 Fozlur Rahman
যাতে সে জীবিত (অন্তরবিশিষ্ট ঈমানদার) ব্যক্তিকে সতর্ক করতে পারে এবং (মৃত অন্তরবিশিষ্ট) কাফেরদের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা সঠিক প্রমাণিত হয়।
10 Mokhtasar Bangla
৭০. যাতে করে তিনি জীবন্ত অন্তর ও আলোকিত দৃষ্টি শক্তির অধিকারী ব্যক্তিকে সতর্ক করতে সক্ষম হন। কেননা, শুধু এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষই কেবল তা দ্বারা উপকৃত হতে পারে। আর যাতে করে কাফিরদের জন্য শাস্তি অবধারিত হয়। কেননা, তাদের উপর প্রমাণ সাব্যস্ত হয়েছে তা অবতীর্ণ হওয়া ও তার আহŸান পৌঁছার মাধ্যমে। ফলে তাদের পক্ষ থেকে আপত্তি উত্থাপন করার কোন অবকাশ অবশিষ্ট নেই।
11 Tafsir Ibn Kathir
৬৮-৭০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা ইবনে আদম সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন যে, যেমন যেমন তাদের যৌবনে ভাটা পড়তে থাকে তেমন তেমন তাদের বার্ধক্য দর্বলতা ও শক্তিহীনতা এসে পড়ে। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ
اَللّٰهُ الَّذِیْ خَلَقَكُمْ مِّنْ ضُعْفٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنْۢ بَعْدِ ضُعْفٍ قُوَّةً ثُمَّ جَعَلَ مِنْۢ بَعْدِ قُوَّةٍ ضُعْفًا وَّ شَیْبَةًؕ-یَخْلُقُ مَا یَشَآءُ وَ هُوَ الْعَلِیْمُ الْقَدِیْرُ
অর্থাৎ “আল্লাহ, তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেন দুর্বল রূপে, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি, শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি। করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।”(৩০:৫৪) অন্য একটি আয়াতে রয়েছেঃ
وَ مِنْكُمْ مَّنْ یُّرَدُّ اِلٰۤى اَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَیْلَا یَعْلَمَ مِنْۢ بَعْدِ عِلْمٍ شَیْــئًـا
অথাৎ “তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে যাকে খুব বেশী বয়সের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয় (সে অতি বার্ধক্যে পদার্পণ করে), যাতে সে জ্ঞানবান হওয়ার পরে জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে।”(২২:৫) সুতরাং আয়াতের ভাবার্থ এই যে, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী ও স্থানান্তরের জায়গা। এ দুনিয়া চিরস্থায়ী নয়। তবুও কি এ লোকগুলো এ জ্ঞান রাখে না যে, তারা নিজেদের শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্যের উপর চিন্তা-ভাবনা করে এবং হৃদয়ঙ্গম করে যে, এই দুনিয়ার পরে আখিরাত আসবে এবং এই জীবনের পরে আবার নবজীবন লাভ করবে?
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি রাসূল (সঃ)-কে কাব্য রচনা করতে শিখাইনি এবং কাব্য রচনা তাঁর পক্ষে শোভনীয়ও নয়। কবিতার প্রতি তাঁর ভালবাসা নেই এবং কোন আকর্ষণও নেই। এর প্রমাণ তার জীবনেই প্রকাশমান যে, তিনি কোন কবিতা পাঠ করলে তা সঠিকভাবে শেষ করতে পারতেন না এবং তাঁর পুরোপুরিভাবে তা মুখস্থ থাকতো না। হযরত শা'বী (রঃ) বলেন যে, আবদুল মুত্তালিবের বংশের প্রত্যেক নর ও নারী কবিতা বলতে পারতো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ) এটা হতে বহু দূরে ছিলেন।” (এটা ইবনে আসাকির (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিম্ন লিখিত কবিতাংশটিঃ كَفٰى بِالْاِسْلَامِ وَالشَّيْبِ لِلْمَرْءِ نَاهِيًا এইরূপে পড়েন। তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেন:“হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কবিতাংশটি এরূপ নয়, বরং নিম্নরূপ হবেঃ كَفٰى الشَّيْبُ وَالْاِسْلَامُ لِلْمَرْءِ نَاهِيًا অতঃপর হযরত আবু বকর (রাঃ) অথবা হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল। যেহেতু আল্লাহ তা'আলা আপনার ব্যাপারে বলেছেনঃ
وَ مَا عَلَّمْنٰهُ الشِّعْرَ وَ مَا یَنْۢبَغِیْ لَهٗ
অর্থাৎ “আমি তাকে কাব্য রচনা করতে শিখাইনি এবং এটা তার পক্ষে শোভনীয় নয়।” (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
ইমাম বায়হাকী (রঃ) স্বীয় দালায়েল’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আব্বাস ইবনে মিরদাস সালমী (রাঃ)-কে বলেনঃ “তুমিই তো
اَتَجْعَلُ نُهْبِىْ ونُهْبَ الْعَبِيْدِ ـ بَيْنَ الْاَقْرَعِ وَعُيَيْنَةُ
এ কবিতাংশটি বলেছো?” উত্তরে হযরত আব্বাস ইবনে মিরদাস (রাঃ) বলেনঃ “এটা بَيْنَ عُيَيْنَة وَالْاَقْرَع-এইরূপ হবে।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “সবই সমান।” অর্থাৎ অর্থের দিক দিয়ে দুটো একই। তার উপর আল্লাহর দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
সুহায়লী (রঃ) আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর এভাবে নাম আগে পাছে করার এক বিস্ময়কর কারণ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) আকরাকে পূর্বে এবং উইয়াইনাকে পরে এ জন্যেই উল্লেখ করেছেন যে, উইয়াইনা হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর খিলাফের যুগে মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আকরা ইসলামের উপর অটল ছিলেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
উমুভী (রঃ) তাঁর 'মাগাযী’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, বদরের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বদর যুদ্ধে নিহত কাফিরদের মাঝে চক্কর দিতে দিতে মুখে উচ্চারণ করছিলেনঃ نُغْلِقُ هَامَّا তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) কবিতার পংক্তিটি পূর্ণ করতে গিয়ে বলেনঃ
مِنْ رِّجَالِ اَعِزَّةٍ عَلَيْنَا ـ وَهُمْ كَانُوْا اَعَقَّ وَاَظْلَمَا
এটা কোন একজন আরবীয় কবির কবিতাংশ। এটা দিওয়ানে হামাসার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে।
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কখনো কখনো কবি তুরফার নিম্নের পংক্তিটি পাঠ করতেনঃ
يَاْتِيْكَ بِالْاَخْبَارِ مَنْ لَّمْ تُزَوِّدِ
অর্থাৎ “এমন ব্যক্তি তোমার নিকট সংবাদ বহন করবে যাকে তুমি ভ্রমণ সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করনি।” এর প্রথম মিসরাটি হলোঃ
سَتُبْدِىْ لَكَ الْاَيَّامُ مَا كُنْتَ جَاهِلًا
অর্থাৎ “যামানা অতি শীঘ্র অজ্ঞাত বিষয় তোমার নিকট প্রকাশ করে দিবে।”
হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয় ? “রাসূলুল্লাহ (সঃ) কবিতা বলতেন কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ তাঁর কবিতার প্রতি সবচেয়ে বেশী ঘৃণা ছিল। হ্যা, তবে তিনি কখনো কখনো বানু কায়েসের কবিতা পাঠ করতেন। কিন্তু তাতেও তিনি ভুল করে বসতেন। আগে পিছে হয়ে যেতো। হযরত আবু বকর (রাঃ) তখন বলতেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এরূপ হবে না বরং এইরূপ হবে।
তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলতেনঃ “আমি কবিও নই এবং কবিতা রচনা করা আমার জন্যে শোভনীয়ও নয়।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে এটাও বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কবিতা পড়তেন কি-না এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেনঃ না, তবে কবি তুরফার নিম্নের কবিতাংশটি তিনি পড়তেনঃ
سَتُبْدِىْ لَكَ الْاَيَّامُ مَا كُنْتَ جَاهَلًا ـ وَيَاْتِيْكَ بِالْاَخْبَارِ مَنْ لَّمْ تُزَوِّدِ
কিন্তু তিনি مَنْ لَّمْ تُزَوَّدْ بَالْاَخْبَارِ এইরূপ পড়েন। তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “এটা এই রূপ নয়।” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি কবি নই এবং কবিতা রচনা আমার জন্যে শোভনীয়ও নয়।”
সহীহ হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) খন্দক খননের সময় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ)-এর কবিতা পাঠ করেছিলেন। তবে এটা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, তিনি এ কবিতা সাহাবীদের (রাঃ) সাথে পাঠ করেছিলেন। কবিতাটি নিম্নরূপঃ
لَاهَمَّ لَوْلَا اَنْتَ مَا اهْتَدَيْنَا ـ وَلَا تَصَدَّقْنَا وَلَا صَلَّيْنَا
فَاَنْزِلْنَ سَكِيْنَةً عَلَيْنَا ـ وَثَبِّتِ الْاَقْدَامَ اِنْ لَّاقَيْنَا
اِنَّ الْاُوْلٰى قَدْ بَغَوْا عَليْنَا ـ اِذَا اَرَادُوْا فِتْنَةً اَبَيْنَا
রাসূলুল্লাহ (সঃ) اَبَيْنَا শব্দটি খুব টান দিয়ে উচ্চ স্বরে পড়তেন।
কবিতাটির আনুবাদঃ “কোন চিন্তা নেই, যদি আপনি না থাকতেন তবে আমরা সুপথ প্রাপ্ত হতাম না। আর সাদকাও করতাম না এবং নামাযও পড়তাম না। সুতরাং (হে আল্লাহ!) আমাদের উপর শান্তি নাযিল করুন এবং যদি আমরা শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সম্মুখীন হই তবে আমাদের পাগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে অটল ও স্থির রাখুন! এ লোকগুলোই আমাদের উপর হঠকারিতা করেছে, তবে যখন তারা ফিত্নার ইচ্ছা করে তখন আমরা তা অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করি। অনুরূপভাবে এটাও প্রমাণিত আছে যে, হুনায়েনের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) পাঠ করেছিলেনঃ
اَنَا النَّبِيُّ لَا كَذِبَ ـ اَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ
অর্থাৎ “আমি নবী, এটা মিথ্যা নয় এবং আমি আবদুল মুত্তালিবের সন্তান (সন্তানের সন্তান বা বংশধর)।”
এ ব্যাপারে এটা স্মরণ রাখা দরকার যে, ঘটনাক্রমে এমন একটা কথা তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে যা কবিতার ওজনে মিলে গেছে। কিন্তু ইচ্ছা করে তিনি কবিতা বলেননি।
হযরত জুনদুব ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে একটি গুহায় ছিলাম এমতাবস্থায় তাঁর একটি অঙ্গুলী যখমী হয়। তখন তিনি বলেনঃ
هَلْ اَنْتِ اِلَّا اِصْبَعٌ دَمِيْتِ ـ وَفِىْ سَبِيْلِ اللّٰهِ مَا لَقِيْتَ
অর্থাঃ “তুমি একটি অঙ্গুলী মাত্র এবং তুমি আল্লাহর পথে রক্তাক্ত হয়েছে।” এটাও ঘটনাক্রমে হয়েছে, ইচ্ছাপূর্বক নয়। অনুরূপভাবে الا اللمم-এর তাফসীরে একটি হাদীস আসছে, তাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছিলেনঃ
اِنْ تَغْفِرِ اللّٰهُمَّ تَغْفِرْ جَمَّا ـ وَاَيُّ عَبْدٍ لَّكَ مَا اَلَمًا
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করেন তবে তো আমাদের পাপরাশিই ক্ষমা করবেন, অন্যথায় আপনার কোন বান্দাই তো ছোট ছোট পাপ ও পদস্থলন হতে মুক্ত ও পবিত্র নয়। সুতরাং এ সবগুলো এ আয়াতের বিপরীত নয়। কেননা, আল্লাহ তা'আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা কবিতা শিক্ষা নয়। বরং এটা তো শুধু এক উপদেশ এবং সুস্পষ্ট কুরআন। এর কাছে বাতিল আসতে পারে না। কুরআন কারীমের এই পবিত্র ছন্দ কবিতা হতে বহু দূরে রয়েছেন এবং এটা হতে সম্পূর্ণ রূপে পবিত্র। এমনিভাবে এ কুরআন গণক এবং যাদুকরের কথা হতেও পুরোপুরিভাবে পবিত্র। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর স্বভাব ও প্রকৃতি এসব হতে ছিল সম্পূর্ণ নিষ্কলংক।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে তিনি বলতে শুনেছেনঃ “আমাকে যা দেয়া হয়েছে তার কাছে আমি বিষের প্রতিষেধক পান করা, তাবীয লটকানো এবং কবিতা রচনাকরণকে মোটেই গ্রাহ্য করি না (কুরআন কারীমের কাছে এগুলো একেবারে মূল্যহীন ও তুচ্ছ)।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, কবিতার প্রতি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রকৃতিগতভাবে ঘৃণা ছিল। দুআয় তিনি ব্যাপক অর্থবোধক কালেমা পছন্দ করতেন এবং এ ছাড়া অন্যগুলো ছেড়ে দিতেন। (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের কারো পেট পূজে পরিপূর্ণ হওয়া তার জন্যে কবিতায় তার পেট পূর্ণ হওয়া অপেক্ষা উত্তম।” (ইমাম আবু দাউদ (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন:“যে ব্যক্তি ইশার নামাযের পর কবিতার একটি ছন্দ রচনা করে তার ঐ রাত্রির নামায ককূল হয় না।”
তবে এখানে এটা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, কবিতার শ্রেণী বিভাগ রয়েছে। মুশরিকদের নিন্দে করে কবিতা রচনা করা শরীয়ত সম্মত। হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (রাঃ), হযরত কা'ব ইবনে মালিক (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) প্রমুখ বড় বড় মর্যাদাবান সাহাবীগণ মুশরিকদের নিন্দা করে কবিতা রচনা করেছেন। কতকগুলো কবিতা হয় উপদেশ, আদব ও হিকমতে পরিপূর্ণ, যেমন অজ্ঞতার যুগের কবিদের কবিতার মধ্যে পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, উমাইয়া ইবনে সালাতের কবিতার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মন্তব্য করেনঃ “তার কবিতাগুলো তো ঈমান এনেছে। কিন্তু তার অন্তর কাফিরই রয়ে গেছে।”
একজন সাহাবী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে উমাইয়ার একশটি কবিতা শুনিয়ে দেন। প্রত্যেকটি কবিতার পরেই তিনি বলেনঃ “আরো বলো।"
সুনানে আবি দাউদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কতকগুলো বর্ণনা যাদুর মত কাজ করে আর কতকগুলো কবিতা হয় হিকমতে পরিপূর্ণ।”
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি রাসূল (সঃ)-কে কাব্য রচনা করতে শিখাইনি এবং এটা তার পক্ষে শোভনীয় নয়। এটা তো শুধু এক উপদেশ এবং সুস্পষ্ট কুরআন। যে ব্যক্তি এ সম্পর্কে সামান্য পরিমাণও চিন্তা করবে তার কাছেই এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। এটা এ জন্যেই যে, যেন তিনি দুনিয়ায় জীবিতাবস্থায় বিদ্যমান লোকদেরকে সতর্ক করতে পারেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ
لِاُنْذِرَكُمْ بِهٖ وَ مَنْۢ بَلَغَ
অর্থাৎ “যেন আমি এর দ্বারা তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে এটা পৌঁছবে তাদেরকে সতর্ক করতে পারি।" (৬:১৯) মহামহিমান্বিত আল্লাহ আরো বলেনঃ
وَ مَنْ یَّكْفُرْ بِهٖ مِنَ الْاَحْزَابِ فَالنَّارُ مَوْعِدُهٗ
অর্থাৎ “দলসমূহের মধ্যে যারাই এটাকে মানবে না তারাই জাহান্নামের যোগ্য।”(১১:১৭) এই কুরআন এবং নবী (সঃ)-এর ফরমান তাদের জন্যে ক্রিয়াশীল ও ফলদায়ক হবে যাদের অন্তর জীবিত এবং ভিতর পরিষ্কার। যাদের জ্ঞান ও অন্তদৃষ্টি রয়েছে। আর শাস্তির কথা তো কাফিরদের উপর বাস্তবায়িত হয়েছে। অতএব, কুরআন কারীম মুমিনদের জন্যে রহমত স্বরূপ এবং কাফিরদের উপর হুজ্জত স্বরূপ।