ছোয়াদ আয়াত ১১
جُنْدٌ مَّا هُنَالِكَ مَهْزُوْمٌ مِّنَ الْاَحْزَابِ ( ص: ١١ )
Jundum maa hunaalika mahzoomum minal Ahzaab (Ṣād ৩৮:১১)
English Sahih:
[They are but] soldiers [who will be] defeated there among the companies [of disbelievers]. (Sad [38] : 11)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
(আরবের কাফিরদের) সম্মিলিত বাহিনীর এই দলটি এখানেই (অর্থাৎ এই মক্কা নগরীতেই একদিন) পরাজিত হবে। (ছোয়াদ [৩৮] : ১১)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
(ওরা বড় বড়) বাহিনীর নিকটে পরাজিত একটি (ছোট) সেনাদল। [১]
[১] جُنْدٌ শব্দটি ঊহ্য মুবতাদা (উদ্দেশ্য) هم এর খবর (বিধেয়) এবং ما তাকীদ স্বরূপ অসামান্য বা সামান্য বুঝাবার জন্য ব্যবহার হয়েছে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী (সাঃ)-কে সাহায্য এবং কাফেরদের পরাজয়ের প্রতিশ্রুতি। অর্থাৎ কাফেরদের এই দল বাতিলপন্থী দল, এই দল বড় হোক বা ছোট আদৌ তার পরোয়া করবে না এবং তাদেরকে ভয়ও করবে না। পরাজয়ই তাদের ভাগ্যে আছে। هُنَالِكَ দ্বারা দূর স্থানের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা বদরের যুদ্ধ ও মক্কা বিজয়ের দিনও হতে পারে, যেখানে কাফেররা শিক্ষামূলক পরাজয়ের শিকার হয়েছিল।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
এ বাহিনী সেখানে অবশ্যই পরাজিত হবে, পূর্ববতী দলসমূহের মত [১]।
[১] অর্থাৎ যেভাবে পূর্ববর্তী সময়ের লোকেরা তাদের নবীর উপর মিথ্যারোপ করার কারণে পরাজিত হয়েছে, তেমনি এ মিথ্যারোপকারী কাফের বাহিনীও পরাজিত হবে। এখন তাদেরকে কখন পরাজিত করা হয়েছে সে ব্যাপারে কারও কারও মত হচ্ছে, বদরের যুদ্ধে। [মুয়াসসার,কুরতুবী]
3 Tafsir Bayaan Foundation
এ বাহিনী তো সেখানে* পরাজিত হবে (পূর্ববর্তী) দলসমূহের মত।
* هناك দ্বারা মক্কার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। কারো কারো মতে বদর দিবসের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
4 Muhiuddin Khan
এক্ষেত্রে বহু বাহিনীর মধ্যে ওদেরও এক বাহিনী আছে, যা পরাজিত হবে।
5 Zohurul Hoque
এখানেই সম্মিলিত সৈন্যদলের এক বাহিনী পরাজিত হবে।
6 Mufti Taqi Usmani
(তাদের অবস্থা তো এই যে,) তারা যেন বিরোধী দলসমূহের একটি বাহিনী, যারা ওখানেই পরাস্ত হবে।
7 Mujibur Rahman
বহু দলের এই বাহিনীও সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পরাজিত হবে।
8 Tafsir Fathul Mazid
৪-১১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
শানে নুযূল :
ইবনু ‘আব্বাস বলেন : আবূ ত্বালিব যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন তখন তার নিকট আবূ জাহল-সহ কুরাইশদের একটি দল হাজির হল। তারা তাকে বলল : আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাদের মা‘বূদদেরকে গালি দেয়/অবজ্ঞা করে, সে অমুক অমুক কাজ করছে ও বলছে। আপনি তাঁকে ডেকে পাঠান এবং বলে দিন- সে যেন এরূপ না করে। তখন তিনি তাঁকে খবর দেন অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে প্রবেশ করলেন। আবূ ত্বালিব ও ঐ বাহিনীর মাঝখানে একজন লোক বসার জায়গা ছিল। আবূ জাহল আশঙ্কা করল যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ জায়গায় আবূ ত্বালিব-এর পাশে যদি বসেন তাহলে তাঁর সাহচর্যের কারণে আবূ ত্বালিব-এর হৃদয় ইসলামের দিকে ঝুঁকে যাবে। তাই সে লাফ দিয়ে উঠে ঐ খালি জায়গায় বসে পড়ল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর চাচার কাছে বসার কোন জায়গা না পেয়ে দরজার একপাশে বসলেন। আবূ ত্বালিব তাঁকে বললেন : হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র! তোমার গোত্রের লোকেরা তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করছে যে, তুমি নাকি তাদের দেবতাদের ব্যাপারে কটুক্তি করছ এবং এরূপ এরূপ কথা বলছ? তারা তোমার বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ নিয়ে এসেছে। এর উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : হে আমার চাচা! আমি তো তাদের কাছ থেকে শুধু একটি কালিমার স্বীকৃতি চাচ্ছি, যদি তারা তা করে তাহলে সমগ্র আরব জাতি তাদেরকে অনুসরণ করবে এবং অনারবরা তাদেরকে জিযিয়া প্রদান করবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কী বলতে চাচ্ছেন তা তারা চিন্তিত মনে বুঝতে চেষ্টা করল এবং শেষে বলল : একটি মাত্র কালিমা! তোমার পিতার শপথ, একটি নয়, বরং আমরা দশটি কালিমা হলেও বলতে রাজী আছি। বলো, কী সে কালিমা? আবূ ত্বালিবও বললেন : হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র! সে কালিমাটি কী? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : তা হলো
لَا إِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ
“আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই” এ কথা শোনার সাথে সাথে তারা সবাই রাগে-ক্রোধে দাঁড়িয়ে গেল এবং তাদের পরিধেয় বস্ত্র মাটিতে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে এই বলে চলে গেল :
(أَجَعَلَ الْاٰلِهَةَ إلٰهًا وَّاحِدًا إِنَّ هٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ)
তখন ঐ আয়াতটিসহ
(بَلْ لَمَّا يَذُوقُوا عَذَابِ)
পর্যন্ত অবতীর্ণ হয়। (মুসনাদে আহমাদ : - ১/৩৬২, তিরমিযী হা. ৩২৩২, ইমাম তিরমিযী হাসান বলেছেন, আলবানী সনদ দুর্বল বলেছেন)
তারা আরো আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল এই ভেবে যে, একজন সাধারণ লোককে আল্লাহ তা‘আলা নাবী করে পাঠিয়েছেন তার সাথে সাথে সে আবার এতগুলো মা‘বূদকে এক মা‘বূদে পরিণত করেছে! এরূপ কথা আমরা ইতোপূর্বে কোন ধর্মে শুনতে পাইনি। নিঃসন্দেহে এটি একটি উদ্দেশ্য মূলক কথা যার দ্বারা সে আমাদেরকে আমাদের উপাস্য থেকে দূরে সরিয়ে তাঁর অনুসারী বানাতে এবং নিজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বাস্তবায়ন করতে চায়। এমনকি তারা এ টালবাহানাও দেখাল যে, আল্লাহ তা‘আলা যদি নাবী পাঠাতেন তাহলে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেয়ে আরো বড় বড় নেতৃবর্গ রয়েছে তাদের একজনকে নাবী হিসেবে প্রেরণ করতেন। এরূপ সাধারণ মানুষের নবুওয়াত মানতে পারব না। যেমন তারা বলত,
(وَقَالُوْا لَوْلَا نُزِّلَ هٰذَا الْقُرْاٰنُ عَلٰي رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيْمٍ)
“এবং তারা বলে : এই কুরআন কেন অবতীর্ণ করা হল না দুই জনপদের কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির ওপর?” (সূরা যুখরুফ ৪৩ : ৩১)
অবশেষে তাদের এ সকল মিথ্যা টালবাহানা তাদেরকে ঈমান আনা থেকে বিরত রাখল ও তারা শিরকের ওপর দৃঢ়তার সাথে স্থির রইল এবং সাধারণ লোকদেরকে দেব-দেবীর পূজা করার নির্দেশ প্রদান করল।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা এ সকল কাফিরদেরকে লক্ষ করে বলেন : তাদের নিকট কি আল্লাহ তা‘আলার রহমতের ধন-ভাণ্ডার রয়েছে, অথবা আকাশসমূহ ও জমিনের কর্তৃক্ত রয়েছে? মূলত এগুলোর কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার, তাই তিনি তাঁর ইচ্ছা মতো যাকে খুশি নবুওয়াত দান করতে পারেন। এগুলোর ওপর যদি মানুষের কর্তৃত্ব থাকত তাহলে তারা কাউকে কোন কিছুই দিত না বরং উপেক্ষা করে চলত। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(قُلْ لَّوْ أَنْتُمْ تَمْلِكُوْنَ خَزَا۬ئِنَ رَحْمَةِ رَبِّيْٓ إِذًا لَّأَمْسَكْتُمْ خَشْيَةَ الْإِنْفَاقِ ط وَكَانَ الْإِنْسَانُ قَتُوْرًا)
“বল : ‘যদি তোমরা আমার প্রতিপালকের দয়ার ভাণ্ডারের অধিকারী হতে, তবুও ‘ব্যয় হয়ে যাবে’ এ আশঙ্কায় তোমরা তা ধরে রাখতে; মানুষ তো অতিশয় কৃপণ।’ (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭ : ১০০)
অতএব সকল নেয়ামত, রহমত ও ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি যাকে ইচ্ছা তাঁর অনুগ্রহ দান করে থাকেন। তাই একজন অসহায় দরিদ্র ব্যক্তি যদি দীনের সঠিক জ্ঞান রাখে তাহলে তার সত্যের দাওয়াত বর্জন করার কোন সুযোগ নেই।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন জাদুকর, কবি ছিলেন না এবং মিথ্যাবাদীও নন বরং তিনি ছিলেন সত্যসহ প্রেরিত একজন নাবী ও রাসূল।
২. দীনের কাজ করতে গিয়ে যদি কোন দুঃখ-কষ্ট আসে তাহলে বিচলিত না হয়ে বরং ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
৩. আকাশসমূহ ও জমিনের যাবতীয় রাজত্ব আল্লাহ তা‘আলার। তাঁর বিরুদ্ধে কোন বাহিনীই জয়ী হতে পারবে না।
৪. আল্লাহ তা‘আলাই হচ্ছেন একমাত্র মা‘বূদ। তিনি ব্যতীত আর সত্য কোন মা‘বূদ নেই।
9 Fozlur Rahman
সে ক্ষেত্রে (তাদের) যে বাহিনীই হোক, তা (অতীতের) বড় বড় দলের মত পরাজিত হবে।
10 Mokhtasar Bangla
১১. মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে অস্বীকারকারী এসব লোকজন হলো পরাজিত বাহিনী। যেমন তাদের পূর্বে অতিবাহিত নবীদেরকে অস্বীকারকারী বাহিনীর অবস্থা ছিলো।
11 Tafsir Ibn Kathir
৪-১১ নং আয়াতের তাফসীর:
মুশরিকরা যে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর রিসালাতের উপর নির্বুদ্ধিতামূলক বিস্ময় প্রকাশ করেছিল এখানে আল্লাহ তা'আলা তারই খবর দিচ্ছেন। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ اَكَانَ لِلنَّاسِ عَجَبًا اَنْ اَوْحَیْنَاۤ اِلٰى رَجُلٍ مِّنْهُمْ اَنْ اَنْذِرِ النَّاسَ وَ بَشِّرِ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَنَّ لَهُمْ قَدَمَ صِدْقٍ عِنْدَ رَبِّهِمْ قَالَ الْكٰفِرُوْنَ اِنَّ هٰذَا لَسٰحِرٌ مُّبِیْنٌ অর্থাৎ “এটা কি লোকদের জন্যে বিস্ময়ের ব্যাপার হয়েছে যে, আমি তাদের মধ্য হতে একটি লোকের উপর এই অহী করেছি যে, তুমি লোকদেরকে ভয় প্রদর্শন করবে এবং মুমিনদেরকে এই সুসংবাদ দিবে যে, তাদের জন্যে তাদের প্রতিপালকের নিকট উত্তম প্রস্তুতি রয়েছে? আর কাফিররা তো বলতে শুরু করেছে যে, এটা স্পষ্ট যাদুকর।” (১০:২) এখানে রয়েছেঃ “তারা বিস্ময়বোধ করছে যে, তাদের নিকট তাদের মধ্য হতে একজন সতর্ককারী আসলো এবং কাফিররা বলে উঠলোঃ এতো এক যাদুকর, মিথ্যাবাদী।” রাসূল (সঃ)-এর রিসালাতের উপর বিস্ময়ের সাথে সাথে আল্লাহর একত্বের উপরও তারা বিস্ময়বোধ করেছে এবং বলতে শুরু করেছেঃ “দেখো, এ লোকটি এতোগুলো মা’রূদের পরিবর্তে বলছে যে, আল্লাহ একমাত্র মা’রূদ এবং তার কোন প্রকারের কোন শরীকই নেই।” ঐ নির্বোধদের তাদের বড়দের দেখাদেখি যে শিরক ও কুফরীর অভ্যাস ছিল, তার বিপরীত শব্দ শুনে তাদের অন্তরে আঘাত লাগে। তারা তাওহীদকে একটি অদ্ভুত ও অজানা বিষয় মনে করে বসে। তাদের বড় ও প্রধানরা গর্বভরে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাদের অধীনস্থদের সামনে ঘোষণা করে ? “তোমরা তোমাদের প্রাচীন মাযহাবের উপর অটল থাকো। এ ব্যক্তির কথা শুনো না। তোমরা তোমাদের মা’রূদগুলোর ইবাদত করতে থাকো। এ লোকটি তো শুধু নিজের মতলব ও স্বার্থের কথা বলছে। এর মাধ্যমে সে তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করতে চায়। তোমরা তার অধীনস্থ হয়ে থাকো এটাই তার বাসনা।”
এ আয়াতগুলোর শানে নুযূল এই যে, একবার কুরায়েশদের সম্ভ্রান্ত ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা একত্রিত হয়। তাদের মধ্যে আবু জেহেল ইবনে হিশাম, আ’স ইবনে ওয়ায়েল, আসওয়াদ ইবনুল মুত্তালিব, আসওয়াদ ইবনে আবদে ইয়াগ্স প্রমুখও ছিল। তারা সবাই একথার উপর একমত হয় যে, তারা আবূ তালিবের কাছে গিয়ে একটা ফায়সালা করিয়ে নিবে। তিনি ইনসাফের সাথে একটা যিম্মাদারী তাদের উপর দিবেন এবং একটা যিম্মাদারী স্বীয় ভ্রাতুস্পুত্রের (মুহাম্মাদ সঃ-এর) উপর দিবেন। কেননা, তিনি এখন বয়সের শেষ সীমায় পৌঁছে | গেছেন। তিনি এখন ভোরের প্রদীপের ন্যায় হয়েছেন। অর্থাৎ তার জীবন প্রদীপ নির্বাপিত প্রায়। যদি তিনি মারা যান এবং তার পরে তারা মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর কোন বিপদ চাপিয়ে দেয় তবে আরবরা তাদেরকে ভৎসনা করবে যে, আবূ তালিবের মৃত্যুর পর তাদের সাহস বেড়ে গেছে। তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রের কোন ক্ষতি করার সাহস তাদের হয়নি। অতঃপর তারা আবু তালিবের বাড়ীর উদ্দেশ্যে গমন করলো। লোক পাঠিয়ে আবু তালিবের বাড়ীতে প্রবেশের অনুমিত চাইলো। অনুমতি পেয়ে তারা সবাই তার বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করলো এবং তাকে বললোঃ “দেখুন জনাব, আপনার ভ্রাতুস্পুত্রের জ্বালাতন এখন আমাদের নিকট অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আপনি ইনসাফের সাথে আমাদের ও তার মধ্যে ফায়সালা করে দিন। আমরা আপনার নিকট ইনসাফ কামনা করছি। সে যেন আমাদের মা’বৃদদেরকে মন্দ না বলে। তাহলে তাকে আমরা কিছুই বলবো না। সে যার ইচ্ছা তারই ইবাদত করুক। আমাদের কিছুই বলার নেই। কিন্তু শর্ত হলো যে, সে আমাদের উপাস্যদেরকে খারাপ বলতে পারবে না।” আবু তালিব তখন তোক পাঠিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে ডেকে আনালেন। তিনি আসলে আবু তালিব তাকে বললেনঃ “হে আমার প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্র! দেখতেই তো পাচ্ছ যে, তোমার কওমের সম্মানিত ও নেতৃস্থানীয় লোকগুলো একত্রিত হয়েছেন এবং তাঁরা তোমার নিকট শুধু এটুকুই কামনা করেন যে, তুমি তাদের উপাস্যদেরকে খারাপ বলবে না। আর দ্বীনের ব্যাপারে তারা তোমাকে স্বাধীনতা দিচ্ছেন। তুমি যে দ্বীনের উপর রয়েছে ওর উপরই থাকো। এতে তাদের কোন আপত্তি নেই।” উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেনঃ “প্রিয় চাচাজান! আমি কি তাদেরকে বড় কল্যাণের দিকে ডাকবো না?” আবু তালিব বললেনঃ “তা কি?” তিনি জবাব দিলেনঃ “তারা শুধু একটি কালেমা পাঠ করবে। শুধু এটা পাঠ করার কারণে সারা আরব তাদের বশীভূত হয়ে যাবে।” অভিশপ্ত আবু জেহেল বললোঃ “বল, ঐ কালেমাটি কি? একটি কেন, আমরা দশটি কালেমা পড়তে প্রস্তুত আছি।” তিনি বললেনঃ “কালেমাটি হলো لَااِلٰهَ اِلَّااللهُ লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই।” তার একথা শোনা মাত্রই সেখানে শশারগোল শুরু হয়ে গেল। আৰূ জেহেল বললোঃ “এটা ছাড়া যা চাইবে আমরা তা দিতে প্রস্তুত আছি।” তিনি বললেনঃ “তোমরা যদি আমার হাতে সূর্যও এনে দাও তবুও আমি এই কালেমা ছাড়া তোমাদের কাছে আর কিছুই চাইবো না।” তাঁর এ কথা শুনে তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো এবং উঠে গিয়ে বললোঃ “অবশ্যই আমরা তোমার ঐ মাবুদকে গালি দিবো যে তোমাকে এর নির্দেশ দিয়েছে।” অতঃপর তারা বিদায় হয়ে গেল এবং তাদের নেতা তাদেরকে বললোঃ “যাও, তোমরা তোমাদের দ্বীনের উপর এবং তোমাদের মাবুদগুলোর ইবাদতের উপর স্থির ও অটল থাকো। জানাই যাচ্ছে যে, এ ব্যক্তির উদ্দেশ্যই আলাদা। সে তোমাদের মধ্যে বড় ও প্রধান হয়ে থাকতে চায়।” (এটা সুদ্দী (রঃ), ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এবং ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করছেন)
একটি রিওয়াইয়াতে এটাও আছে যে, ঐ কুরায়েশ প্রধানদের চলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় চাচাকে বলেনঃ “আপনিই এই কালেমাটি পাঠ করুন!” উত্তরে তার চাচা আবূ তালিব বলেনঃ “না, বরং আমি আমার পূর্বপুরুষদের দ্বীনের উপরই থাকতে চাই।” তখন اِنَّكَ لَا تَهْدِیْ مَنْ اَحْبَبْتَ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! তুমি যাকে ভালবাস তাকে তুমি হিদায়াতের উপর আনতে পার না।" (২৮:৫৬)
আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, ঐ সময় আবু তালিব রুগ্ন ছিলেন এবং এই রোগেই তিনি মারাও গিয়েছিলেন। যে সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর নিকট উপস্থিত হন ঐ সময় তাঁর পার্শ্বে একজন লোক বসার মত জায়গা ফাঁকা ছিল। বাকী সব জায়গা-ই লোকে পরিপূর্ণ ছিল। দূরাচার আবু জেহেল মনে করলো যে, যদি মুহাম্মাদ (সঃ) তার চাচার পার্শ্বে বসতে পারেন তবে তার উপর তিনি প্রভাব বিস্তার করে ফেলবেন এবং আবু তালিব তার উপর হয়তো আকৃষ্ট হয়ে পড়বেন। তাই সে ঐ ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসে গেল। ফলে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে দরবার পার্শ্বেই বসতে হলো। তিনি একটি কালেমা পাঠ করতে বললে সবাই উত্তর দিলোঃ “একটি কেন, আমরা দশটি কালেমা পড়তে প্রস্তুত আছি। বল, কালেমাটি কি?" যখন তারা কালেমায়ে তাওহীদ তার মুখে শুনলো তখন ক্রোধে ফেটে পড়লো এবং কাপড় ঝেড়ে উঠে গেল। বিদায়ের সময় তাদের নেতা তাদেরকে বললোঃ “দেখো, এ লোকটি বহু মা’দের পরিবর্তে এক মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে। এটা তো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার!” তখন بَلْ لَمَّا يَذُوْقُوْا عَذَابَ পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। (এটা ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা . করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান বলেছেন)
তারা বললোঃ “আমরা তো অন্য ধর্মাদর্শে এরূপ কথা শুনিনি। এটা এক মনগড়া উক্তি মাত্র। সম্পূর্ণ ভুল ও মিথ্যা কথা এটা। কতই না বিস্ময়কর কথা এটা যে, আল্লাহকে দেখাই গেল না, আর তিনি এ ব্যক্তির উপর কুরআন নাযিল করে দিলেন!” যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ
لَوْ لَا نُزِّلَ هٰذَا الْقُرْاٰنُ عَلٰى رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْیَتَیْنِ عَظِیْمٍ
অর্থাৎ “কেন এ কুরআন এই দুই শহরের মধ্যকার কোন একজন বড় লোকের উপর অবতীর্ণ করা হয়নি?” (৪৩:৩১) তাদের এ কথার জবাবে আল্লাহ পাক বলেনঃ “তারা কি আল্লাহর রহমত বন্টনকারী? এরা তো এমনই মুখাপেক্ষী যে, স্বয়ং তাদেরও জীবিকা ও মান-মর্যাদা আমিই বন্টন করে থাকি।” মোটকথা, এই প্রতিবাদও তাদের বোকামি ও নির্বুদ্ধিতারই পরিচায়ক ছিল।
প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ প্রকৃতপক্ষে তারা তো আমার কুরআনে সন্দিহান। তারা এখানে আমার শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করেনি। কাল কিয়ামতের দিন যখন তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তখন তারা তাদের ঔদ্ধত্যপনা ও হঠকারিতার শাস্তি আস্বাদন করবে।
এরপর আল্লাহ তা'আলা স্বীয় ক্ষমতা প্রকাশ করছেন যে, তিনি যা চান তাই করেন। তিনি যাকে যা কিছু দেয়ার ইচ্ছা করেন তা-ই দিয়ে থাকেন। সম্মান দান ও লাঞ্ছিতকরণ তাঁরই হাতে। হিদায়াত দান ও বিভ্রান্তকরণ তাঁর পক্ষ থেকেই। হয়ে থাকে। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্য হতে যার উপর ইচ্ছা করেন অহী অবতীর্ণ করে থাকেন। তিনি যার অন্তরে চান মোহর মেরে দেন। মানুষের অধিকারে কিছুই নেই। তারা সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাহীন, নিরুপায় ও বাধ্য। এ জন্যেই তো মহান আল্লাহ বলেনঃ “তাদের কাছে কি আছে অনুগ্রহের ভাণ্ডার, তোমার প্রতিপালকের, যিনি পরাক্রমশালী, মহান দাতা?” অর্থাৎ নেই। মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ
اَمْ لَهُمْ نَصِیْبٌ مِّنَ الْمُلْكِ فَاِذًا لَّا یُؤْتُوْنَ النَّاسَ نَقِیْرًا ـ اَمْ یَحْسُدُوْنَ النَّاسَ عَلٰى مَاۤ اٰتٰىهُمُ اللّٰهُ مِنْ فَضْلِهٖ فَقَدْ اٰتَیْنَاۤ اٰلَ اِبْرٰهِیْمَ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ وَ اٰتَیْنٰهُمْ مُّلْكًا عَظِیْمًا ـ فَمِنْهُمْ مَّنْ اٰمَنَ بِهٖ وَ مِنْهُمْ مَّنْ صَدَّ عَنْهُ وَ كَفٰى بِجَهَنَّمَ سَعِیْرًا
অর্থাৎ “তবে কি রাজশক্তিতে তাদের কোন অংশ আছে? সে ক্ষেত্রেও তো তারা কাউকেও এক কপর্দকও দিবে না। অথবা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন সে জন্যে কি তারা তাদের ঈর্ষা করে? ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরকেও তো আমি কিতাব ও হিকমত প্রদান করেছিলাম এবং তাদেরকে বিশাল রাজ্য দান করেছিলাম। অতঃপর তাদের কতক তাতে বিশ্বাস করেছিল এবং কতক তা হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। দগ্ধ করার জন্যে জাহান্নামই যথেষ্ট।”(৪:৫৩-৫৫) আর এক জায়গায় বলেনঃ
قُلْ لَّوْ اَنْتُمْ تَمْلِكُوْنَ خَزَآئِنَ رَحْمَةِ رَبِّیْۤ اِذًا لَّاَمْسَكْتُمْ خَشْیَةَ الْاِنْفَاقِ وَ كَانَ الْاِنْسَانُ قَتُوْرًا
অর্থাৎ “বলঃ যদি তোমরা আমার প্রতিপালকের দয়ার ভাণ্ডারের অধিকারী হতে, তবুও ব্যয় হয়ে যাবে এই আশংকায় তোমরা ওটা ধরে রাখতে। মানুষ তো অতিশয় কৃপণ।” (১৭:১০০)
হযরত সালেহ (আঃ)-কেও তাঁর কওম বলেছিলঃ
ءَاُلْقِیَ الذِّكْرُ عَلَیْهِ مِنْۢ بَیْنِنَا بَلْ هُوَ كَذَّابٌ اَشِرٌ ـ سَیَعْلَمُوْنَ غَدًا مَّنِ الْكَذَّابُ الْاَشِرُ
অর্থাৎ “আমাদের মধ্যে কি তারই প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে? না, সে তো একজন মিথ্যাবাদী, দাম্ভিক। আগামীকাল তারা জানবে, কে মিথ্যাবাদী, দাম্ভিক।” (৫৪:২৫-২৬)।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “তাদের কি সার্বভৌমত্ব আছে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যস্থিত সবকিছুর উপর? থাকলে তারা সিঁড়ি বেয়ে আরোহণ করুক। বহু দলের এই বাহিনীও সেক্ষেত্রে অবশ্যই পরাজিত হবে। যেমন ইতিপূর্বে সত্য হতে বিমুখ বড় বড় দল ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছিল। অন্য আয়াতে রয়েছেঃ
اَمْ یَقُوْلُوْنَ نَحْنُ جَمِیْعٌ مُّنْتَصِرٌ
অর্থাৎ “তারা কি বলেঃ আমরা এক সংঘবদ্ধ অপরাজেয় দল?"(৫৪:৪৪) এর পরে রয়েছেঃ
سَیُهْزَمُ الْجَمْعُ وَ یُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ
অর্থাৎ “এই দল তো শীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে।” (৫৪:৪৫) এর পরে ঘোষিত হয়েছেঃ
بَلِ السَّاعَةُ مَوْعِدُهُمْ وَ السَّاعَةُ اَدْهٰى وَ اَمَرُّ
অর্থাৎ “অধিকন্তু কিয়ামত তাদের শাস্তির নির্ধারিত কাল এবং কিয়ামত হবে কঠিনতর ও তিক্ততর।”(৫৪:৪৬)