১৯-২২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা বলছেন যে, তিনি স্বীয় বান্দাদের প্রতি বড়ই দয়ালু। তিনি একজনকে অপরজনের মাধ্যমে রিযক পৌঁছিয়ে থাকেন। একজনও এমন নেই যাকে তিনি ভুলে যান। সৎ ও অসৎ সবাই তাঁর নিকট হতে আহার্য পেয়ে থাকে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَ مَا مِنْ دَآبَّةٍ فِی الْاَرْضِ اِلَّا عَلَى اللّٰهِ رِزْقُهَا وَ یَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَ مُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِیْ كِتٰبٍ مُّبِیْنٍ
অর্থাৎ “ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী সকলের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই; তিনি তাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী অবস্থিতি সম্পর্কে অবহিত; সুস্পষ্ট কিতাবে সব কিছুই আছে।”(১১:৬)
তিনি যার জন্যে ইচ্ছা করেন প্রশস্ত ও অপরিমিত জীবিকা নির্ধারণ করে থাকেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী। কেউই তাঁর উপর বিজয়ী হতে পারে না।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ যে কেউ আখিরাতের আমলের প্রতি মনোযোগী হয়, আমি স্বয়ং তাকে সাহায্য করি এবং তাকে শক্তি সামর্থ্য দান করি। তার পুণ্য আমি বৃদ্ধি করতে থাকি। কারো পুণ্য দশগুণ, কারো সাতশ’ গুণ এবং কারো আরো বেশী বৃদ্ধি করে দিই। মোটকথা, আখিরাতের চাহিদা যার অন্তরে থাকে, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে তাকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করা হয়। পক্ষান্তরে, যার সমুদয় চেষ্টা দুনিয়া লাভের জন্যে হয় এবং আখিরাতের প্রতি যে মোটেই মনোযোগ দেয় না, সে উভয় জগতেই ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। খুব সম্ভব যে, শত চেষ্টা সত্ত্বেও সে দুনিয়া লাভে বঞ্চিত হবে। মন্দ নিয়তের কারণে পরকাল তো পূর্বেই নষ্ট হয়ে গেছে, এখন দুনিয়াও সে লাভ করতে পারলো না। সুতরাং উভয় জগতকেই সে নষ্ট করে দিলো। আর যদি দুনিয়ার সুখ কিছু ভোগও করে তাতেই বা কি হলো? অন্য জায়গায় যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
مَنْ كَانَ یُرِیْدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهٗ فِیْهَا مَا نَشَآءُ لِمَنْ نُّرِیْدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهٗ جَهَنَّمَ یَصْلٰىهَا مَذْمُوْمًا مَّدْحُوْرًا ـ وَ مَنْ اَرَادَ الْاٰخِرَةَ وَ سَعٰى لَهَا سَعْیَهَا وَ هُوَ مُؤْمِنٌ فَاُولٰٓئِكَ كَانَ سَعْیُهُمْ مَّشْكُوْرًا ـ كُلًّا نُّمِدُّ هٰۤؤُلَآءِ وَ هٰۤؤُلَآءِ مِنْ عَطَـآءِ رَبِّكَ وَ مَا كَانَ عَطَـآءُ رَبِّكَ مَحْظُوْرًا ـ اُنْظُرْ كَیْفَ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلٰى بَعْضٍ وَ لَلْاٰخِرَةُ اَكْبَرُ دَرَجٰتٍ وَّ اَكْبَرُ تَفْضِیْلًا
অর্থাৎ “কেউ আশু সুখ-সম্ভোগ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছা এখানেই সত্বর দিয়ে থাকি; পরে তার জন্যে জাহান্নাম নির্ধারিত করি যেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও অনুগ্রহ হতে দূরীকৃত অবস্থায়। যারা মুমিন হয়ে পরলোক কামনা করে এবং ওর জন্যে যথাযথ চেষ্টা করে তাদেরই চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে। তোমার প্রতিপালক তাঁর দান দ্বারা এদেরকে আর ওদেরকে সাহায্য করেন এবং তোমার প্রতিপালকের দান অবারিত। লক্ষ্য কর, আমি কিভাবে তাদের একদলকে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম, আখিরাত তো নিশ্চয়ই মর্যাদায় মহত্তর ও গুণে শ্রেষ্ঠতর।”(১৭:১৮-২১)।
হযরত উবাই ইবনে কাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এই উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব, উচ্চতা, সাহায্য এবং রাজত্বের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি পরকালের কাজ করবে দুনিয়া (লাভের) জন্য, পরকালে সে কিছুই লাভ করবে না।” (এ হাদীসটি হ্যরত সাওরী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ এই মুশরিকরা তো আল্লাহর দ্বীনের অনুসরণ করে না, বরং তারা জ্বিন, শয়তান ও মানবদেরকে নিজেদের পূজনীয় হিসেবে মেনে নিয়েছে। ওরা যে আহকাম এদেরকে বাতলিয়ে দেয় এগুলোর সমষ্টিকেই এরা দ্বীন মনে করে। ওরা যেগুলোকে হারাম বা হালাল বলে, এরা সেগুলোকেই হারাম বা হালাল মনে করে থাকে। তাদের ইবাদতের পন্থা এদেরই আবিষ্কৃত। মোটকথা, এই জ্বিন ও মানুষ যেটাকে শরীয়ত বলেছে সেটাকেই এই মুশরিকরা শরীয়ত বলে মেনে নিয়েছে। যেমন অজ্ঞতার যুগে তারা কতকগুলো জন্তুকে নিজেরাই হারাম করে নিয়েছিল। যেমন কোন কোন জন্তুর কান কেটে নিয়ে তারা ওটাকে তাদের বাতিল দেবতাদের নামে ছেড়ে দিতো। দাগ দিয়ে তারা ষাঁড় ছেড়ে দিতো এবং মাদীর বাচ্চাকে গর্ভাবস্থাতেই ঐ দেবতাদের নামে রেখে দিতো। যে উষ্ট্রীর তারা দশটি বাচ্চা লাভ করতো ওটাকেও তাদের নামে ছেড়ে দিতো। অতঃপর ওগুলোকে সম্মানিত মনে করে নিজেদের উপর হারাম করে নিতো। আর কতকগুলো জিনিসকে নিজেরাই হালাল করে নিতো। যেমন মৃত, রক্ত, জুয়া ইত্যাদি। সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি আমর ইবনে লুহাই ইবনে কামআহকে দেখি যে, সে নিজের নাড়িভূড়ি জাহান্নামের মধ্যে টানতে রয়েছে।” সে ঐ ব্যক্তি যে সর্বপ্রথম গায়রুল্লাহর নামে জন্তু ছেড়ে দেয়ার প্রথা চালু করেছিল। সে ছিল খুযাআ’র বাদশাহদের একজন। সেই সর্বপ্রথম এসব কাজের সূচনা করেছিল। সেই কুরায়েশদেরকে প্রতিমা পূজায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। আল্লাহ তা'আলা তার প্রতি অভিসম্পাত নাযিল করুন!
প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ ফায়সালার ঘোষণা না থাকলে এদের বিষয়ে তো সিদ্ধান্ত হয়েই যেতো। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যদি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে থাকতেন যে, তিনি পাপীদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ দিবেন, তবে তৎক্ষণাৎ তাদের প্রতি তার শাস্তি আপতিত হতো। নিশ্চয়ই এই যালিমদেরকে কিয়ামতের দিন কঠিন বেদনাদায়ক শাস্তি ভোগ করতে হবে।
প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ তুমি এই যালিমদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্যে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবে। আর এটাই তাদের উপর আপতিত হবে। সেদিন এমন কেউ থাকবে না যে তাদেরকে এই শাস্তি হতে রক্ষা করতে পারে। সেদিন তারা তাদের কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করবেই। পক্ষান্তরে, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তারা থাকবে জান্নাতের মনোরম স্থানে। তারা সেথায় চরম সুখে অবস্থান করবে। সেখানে তাদের মোটেই কোন দুঃখ কষ্ট হবে না। তারা যা কিছু চাইবে তাই তাদের প্রতিপালকের নিকট পাবে। তারা এমন সুখ ভোগ করবে যা কল্পনাও করা যায় না।
হযরত আবু তায়বাহ (রঃ) বলেন যে, জান্নাতীদের মাথার উপর মেঘমালা আনয়ন করা হবে এবং তাদেরকে বলা হবেঃ “তোমরা এই মেঘমালা হতে কি বর্ষণ কামনা কর?” তারা তখন যে জিনিসের বর্ষণ কামনা করবে তা-ই তাদের উপর বর্ষিত হবে। এমনকি তারা বলবেঃ “আমাদের উপর সমবয়স্কা উদভিন্ন যৌবনা তরুণী বর্ষিত হোক।” তখন তাদের উপর তা-ই বর্ষিত হবে। এজন্যেই মহান আল্লাহ বলেনঃ এটাই তো মহা অনুগ্রহ। পূর্ণ সফলতা এটাই।