৭-৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তোমার পূর্ববর্তী নবীদের উপর যেমন আল্লাহর অহী আসতো, অনুরূপভার তোমার উপরও এই কুরআন অহীর মাধ্যমে। অবতীর্ণ করা হয়েছে। এর ভাষা আরবী এবং এর বর্ণনা খুবই স্পষ্ট ও খোলাখুলি। যাতে তুমি মক্কাবাসী এবং ওর চতুর্দিকের জনগণকে সতর্ক করতে। পার। অর্থাৎ তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করতে পার আল্লাহর আযাব হতে।حَوْلَهَا দ্বারা প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের সমস্ত শহরকে ও জনপদকে বুঝানো হয়েছে। মক্কা শরীফকে ‘উম্মুল কুরা’ বলার কারণ এই যে, এটা সমস্ত শহর হতে ভাল ও উত্তম। এর বহু দলীল প্রমাণ রয়েছে যেগুলো নিজ নিজ জায়গায় বর্ণিত হবে। এখানে একটি দলীল বর্ণনা করা হচ্ছে যা সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্টও বটে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আদী হামরা যুহরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কার হাশূরাহ নামক বাজারে দাঁড়িয়েছিলেন এমতাবস্থায় তিনি তাঁকে বলতে শুনেনঃ “হে মক্কাভূমি! আল্লাহর কসম! তুমি আল্লাহর সবচেয়ে উত্তম ভূমি এবং আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ভূমি। আল্লাহর কসম! যদি তোমার উপর হতে আমাকে বের করে দেয়া না হতো তবে আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন)
মহান আল্লাহ বলেনঃ আর এই কুরআন আমি তোমার প্রতি এজন্যে অবতীর্ণ করেছি যে, যেন তুমি মানুষকে সতর্ক করতে পার কিয়ামত দিবস সম্পর্কে যাতে কোন সন্দেহ নেই। যেদিন কিছু লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং কিছু লোক জাহান্নামে যাবে। এটা এমন দিন হবে যে, জান্নাতীরা লাভবান হবে এবং জাহান্নামীরা হবে ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ یَوْمَ یَجْمَعُكُمْ لِیَوْمِ الْجَمْعِ ذٰلِكَ یَوْمُ التَّغَابُنِ অর্থাৎ “স্মরণ কর, যেদিন তিনি তোমাদেরকে সমবেত করবেন সমাবেশ দিবসে সেদিন হবে লাভ লোকসানের দিন।”(৬৪:৯) অন্য এক জায়গায় বলেনঃ
اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیَةً لِّمَنْ خَافَ عَذَابَ الْاٰخِرَةِ ذٰلِكَ یَوْمٌ مَّجْمُوْعٌ١ۙ لَّهُ النَّاسُ وَ ذٰلِكَ یَوْمٌ مَّشْهُوْدٌ ـ وَ مَا نُؤَخِّرُهٗۤ اِلَّا لِاَجَلٍ مَّعْدُوْدٍؕ ـ یَوْمَ یَاْتِ لَا تَكَلَّمُ نَفْسٌ اِلَّا بِاِذْنِهٖ١ۚ فَمِنْهُمْ شَقِیٌّ وَّ سَعِیْدٌ
অর্থাৎ “এতে নিশ্চয়ই ঐ ব্যক্তির জন্যে নিদর্শন রয়েছে যে আখিরাতের আযাবকে ভয় করে। ওটা হলো ঐ দিন যেই দিন সমস্ত মানুষকে একত্রিত করা হবে এবং (সবারই) উপস্থিতির দিন। আমি এটাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে বিলম্বিত করছি। ঐদিন কেউই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কথা বলতে পারবে না। তাদের মধ্যে কেউ হবে হতভাগ্য এবং কেউ হবে ভাগ্যবান।”(১১:১০৩-১০৫)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের নিকট আগমন করেন। ঐ সময় তার হাতে দু'টি কিতাব ছিল। তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “এ কিতাব দু’টি কি তা তোমরা জান কি?” আমরা উত্তরে বললামঃ আমাদের এটা জানা নেই। হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদেরকে এর খবর দিন। তখন তিনি তার ডান হাতের কিতাবটির দিকে ইঙ্গিত করে বলেনঃ “এটা রাব্বল আলামীন আল্লাহ তাআলার কিতাব। এতে জান্নাতীদের এবং তাদের পিতাদের ও গোত্রসমূহের নাম রয়েছে। শেষে হিসেব করে সর্বমোট করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আর কম বেশী হতে পারে না।” অতঃপর তিনি তার বাম হাতের কিতাবটির দিকে ইঙ্গিত করে বলেনঃ “এটা হলো জাহান্নামীদের নামের তালিকা বহি। এতেও তাদের নাম, তাদের পিতাদের নাম এবং তাদের গোত্রসমূহের নাম রয়েছে। শেষে হিসেব করে সর্বমোট করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং এর মধ্যে আর কম বেশী হবে না।” তখন তার সাহাবীগণ বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তাহলে আমাদের আমলের আর প্রয়োজন কি?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃ “ঠিকভাবে থাকো। মঙ্গল ও কল্যাণের কাছে কাছে থাকো। জান্নাতীদের পরিসমাপ্তি ভাল কাজের উপরই হবে, তারা যে কাজই করতে থাকুক না কেন। আর জাহান্নামীদের পরিসমাপ্তি মন্দ আমলের উপরই হবে, তারা যে কাজই করতে থাকুক না কেন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় হস্তদ্বয় মুষ্টিবদ্ধ করলেন এবং বললেনঃ “মহামহিমান্বিত আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের ফায়সালা শেষ করে ফেলেছেন। একদল যাবে জান্নাতে এবং একদল যাবে জাহান্নামে।” এর সাথে সাথেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় ডান ও বাম হাত দ্বারা ইশারা করেন যেন তিনি কোন জিনিস নিক্ষেপ করছেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা।
করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান গারীব বলেছেন)
ইমাম বাগাভীর (রঃ) তাফসীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে এবং তাতে কিছু বেশী আছে। তাতে আছে যে, একদল যাবে জান্নাতে এবং একদল যাবে জাহান্নামে। আর মহামহিমান্বিত আল্লাহর পক্ষ হতে আদল আর আদল বা ন্যায় আর ন্যায়ই থাকবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা'আলা যখন হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন এবং তার মধ্য হতে তাঁর সন্তানদেরকে বের করেন, আর তারা পিপড়ার মত হয়ে ময়দানে ছড়িয়ে পড়ে। তখন তাদেরকে তিনি স্বীয় দুই মুষ্টির মধ্যে নিয়ে নেন এবং বলেনঃ “এগুলোর একটি অংশ পুণ্যবান এবং অপর অংশ পাপী।” আবার তাদেরকে ছড়িয়ে দেন এবং পুনরায় একত্রিত করেন এবং আবার তিনি তাদেরকে মুষ্টির মধ্যে করে নেন। একটি অংশ জান্নাতী ও আর একটি অংশ জাহান্নামী। (এ রিওয়াইয়াতটি মাওকুফ হওয়াই সঠিক কথা। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)
হযরত আবু নাযরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আবু আবদিল্লাহ (রাঃ) নামক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর একজন সাহাবী রুগ্ন ছিলেন। সাহাবীগণ (রাঃ) তাঁকে দেখতে যান। তারা দেখেন যে, তিনি ক্রন্দন করছেন। তাঁরা তাঁকে বলেন, আপনি কাঁদছেন কেন? অথচ রাসূলুল্লাহ (সঃ) তো আপনাকে শুনিয়েছেনঃ “গোঁফ ছোট করে রাখবে যে পর্যন্ত না তুমি আমার সাথে মিলিত হবে। ঐ সাহাবী (রাঃ) উত্তরে বললেন, এটা ঠিকই বটে। কিন্তু আমাকে তো ঐ হাদীসটি কাঁদাচ্ছে যে, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা'আলা স্বীয় ডান মুষ্টির মধ্যে কিছু মাখলুক রাখেন এবং অনুরূপভাবে বাম মুষ্টির মধ্যেও কিছু মাখলুক রাখেন, অতঃপর বলেনঃ “এ লোকগুলো এর জন্যে অর্থাৎ জান্নাতের জন্যে এবং এ লোকগুলো এর জন্যে অর্থাৎ জাহান্নামের জন্যে। আর এতে আমি কোন পরোয়া করি না। সুতরাং আমার জানা নেই যে, আমি তার কোন মুষ্টির মধ্যে ছিলাম। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) তকদীর প্রমাণ করার আরো বহু হাদীস রয়েছে।
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ আল্লাহ ইচ্ছা করলে মানুষকে একই উম্মত করতে পারতেন, অর্থাৎ হয় সকলকেই হিদায়াত দান করতেন, না হয় সকলকেই পথভ্রষ্ট করতেন। কিন্তু আল্লাহ এদের মধ্যে পার্থক্য রেখে দিয়েছেন। কাউকেও তিনি হিদায়াতের উপর রেখেছেন এবং কাউকেও সুপথ হতে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার হিকমত বা নিপুণতা তিনিই জানেন। তিনি যাকে ইচ্ছা স্বীয় অনুগ্রহের অধিকারী করেন। আর যালিমদের কোন অভিভাবক নেই, নেই কোন সাহায্যকারী।
ইবনে হাজীরাহ (রঃ)-এর নিকট এ খবর পৌঁছেছে যে, হযরত মূসা (আঃ) আরয করেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনি আপনার মাখলুককে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাদের কতকগুলোকে নিয়ে যাবেন জান্নাতে এবং কতকগুলোকে নিয়ে যাবেন জাহান্নামে। যদি সবকেই জান্নাতে প্রবিষ্ট করতেন তবে কতই না ভাল হতো!” তখন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ “হে মূসা (আঃ)! তোমার জামাটি উঁচু কর।” তিনি তখন তাঁর জামাটি উচু করলেন। মহান আল্লাহ আবার বললেনঃ “আরো উঁচু করে ধর। হযরত মূসা (আঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহ! আমি আমার সারা দেহ হতে তো আমার জামাটি উঁচু করেছি, শুধু ঐ জায়গাটুকু বাকী রয়েছে যার উপর হতে সরানোর মধ্যে কোন কল্যাণ নেই।” তখন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “হে মূসা (আঃ)! এরূপভাবেই আমি আমার সমস্ত মাখলুককেই জান্নাতে প্রবিষ্ট করবো, শুধু তাদেরকে নয় যারা সম্পূর্ণরূপে কল্যাণ শূন্য হবে।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)