اِذْ جَعَلَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فِيْ قُلُوْبِهِمُ الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ فَاَنْزَلَ اللّٰهُ سَكِيْنَتَهٗ عَلٰى رَسُوْلِهٖ وَعَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ وَاَلْزَمَهُمْ كَلِمَةَ التَّقْوٰى وَكَانُوْٓا اَحَقَّ بِهَا وَاَهْلَهَا ۗوَكَانَ اللّٰهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمًا ࣖ ( الفتح: ٢٦ )
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
কাফিররা যখন তাদের অন্তরে জিদ ও হঠকারিতা জাগিয়ে তুলল- অজ্ঞতার যুগের জিদ ও হঠকারিতা- তখন আল্লাহ তাঁর রসূল ও মু’মিনদের উপর স্বীয় প্রশান্তি অবতীর্ণ করলেন আর তাদের জন্য তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ-বাণী অপরিহার্য (রূপে পালনীয়) ক’রে দিলেন; আর তারাই ছিল এর সবচেয়ে বেশি হকদার ও যোগ্য অধিকারী। আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারী।
English Sahih:
When those who disbelieved had put into their hearts chauvinism – the chauvinism of the time of ignorance. But Allah sent down His tranquility upon His Messenger and upon the believers and imposed upon them the word of righteousness, and they were more deserving of it and worthy of it. And ever is Allah, of all things, Knowing.
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
যখন[১] অবিশ্বাসীরা তাদের অন্তরে গোত্রীয় অহমিকা -- অজ্ঞতা যুগের অহমিকা পোষণ করেছিল, তখন আল্লাহ তাঁর রসূল ও বিশ্বাসীদের উপর স্বীয় প্রশান্তি বর্ষণ করলেন;[২] আর তাদেরকে তাকওয়ার বাক্যে সৃদৃঢ় করলেন[৩] এবং তারাই ছিল এর অধিকতর যোগ্য ও উপযুক্ত। আর আল্লাহ সমস্ত বিষয়ে সম্যক জ্ঞান রাখেন।
[১] إذ (যখন) অব্যয়টির কাল বিশেষণ হয় لَعَذَّبْنَا ক্রিয়ার। অথবা وَاذْكُرُوْا ক্রিয়া ঊহ্য আছে। অর্থাৎ, সেই সময়কে স্মরণ করো, যখন অবিশ্বাসীরা ----।
[২] কাফেরদের এই জাহেলী যুগের গোত্রীয় অহমিকা (আভিজাত্যের গর্ব)এর অর্থ হল, মক্কাবাসীদের মুসলিমদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া। তারা বলল যে, এরা আমাদের ছেলে ও বাপদেরকে হত্যা করেছে। লাত-উয্যার শপথ! আমরা এদেরকে কখনই এখানে প্রবেশ করতে দেব না। অর্থাৎ, তারা এটাকে মান-সম্মানের ব্যাপার মনে করে নিল। আর এটাকেই 'অজ্ঞতাযুগের অহমিকা' বলা হয়েছে। কারণ, কা'বা শরীফে ইবাদতের জন্য আগমনকারীদেরকে রোধ করার অধিকার কারো নেই। মক্কার কুরাইশদের শত্রুতামূলক এই আচরণের উত্তরে আশঙ্কা ছিল যে, মুসলিমদের আবেগ-উদ্যমের মধ্যেও উত্তেজনা এসে যেত এবং তাঁরাও এটাকে তাঁদের সম্মানের ব্যাপার মনে করে মক্কায় প্রবেশ করার জন্য জেদ ধরতেন। ফলে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে পড়ত। আর এই যুদ্ধ মুসলিমদের ক্ষেত্রে বড়ই বিপজ্জনক ছিল। (যেমন, পূর্বে এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।) এই জন্য মহান আল্লাহ মুসলিমদের অন্তরে প্রশান্তি অবতীর্ণ করে দিলেন। অর্থাৎ, তাঁদেরকে ধৈর্য-সহ্য তথা উত্তেজনা সংবরণ করার তওফীক দান করলেন। সুতরাং তাঁরা নবী করীম (সাঃ)-এর নির্দেশ অনুযায়ী হুদাইবিয়াতে থেমে গেলেন এবং আবেগপ্রবণ হয়ে মক্কা যাওয়ার প্রচেষ্টা করলেন না। কেউ কেউ বলেন, মূর্খতাযুগের এই অহমিকা থেকে বুঝানো হয়েছে তাদের সেই আচরণকে, যা সন্ধি ও চুক্তির সময় তারা অবলম্বন করেছিল। তাদের এই আরচণ এবং সন্ধি উভয়টাই বাহ্যতঃ মুসলিমদের জন্য অসহ্যকর ছিল। কিন্তু পরিণতির দিক দিয়ে যেহেতু এতে ইসলাম ও মুসলিমদের কল্যাণ ছিল, তাই অতীব অপছন্দনীয় ও কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে তা মেনে নেওয়ার সুমতি দান করলেন। এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ হল এ রকম, যখন রসূল (সাঃ) মক্কার কুরাইশদের প্রেরিত প্রতিনিধিদের এই কথা মেনে নিলেন যে, এ বছর মুসলিমরা উমরার জন্য মক্কায় যাবেন না এবং এখান থেকেই প্রত্যাবর্তন করবেন, তখন তিনি আলী (রাঃ)-কে সন্ধিপত্র লেখার নির্দেশ দিলেন। তিনি (আলী (রাঃ)) রসূল (সাঃ)-এর নির্দেশে 'বিসমিল্লাহির রাহমা-নির রাহীম' লিখলেন। তখন তারা প্রতিবাদ করে বলল যে, 'রাহমান' ও 'রাহীম'কে আমরা জানি না। আমরা যে শব্দ ব্যবহার করি -- অর্থাৎ, 'বিসমিকাল্লা-হুম্মা' (হে আল্লাহ! তোমার নাম নিয়ে) তাই দিয়ে শুরু করেন। তাই নবী (সাঃ) ঐভাবেই লিখালেন। তারপর তিনি লিখালেন, "এটা সেই চুক্তিপত্র যাতে আল্লাহর রসূল মুহাম্মাদ মক্কাবাসীদের সাথে সন্ধি করছেন।" তখন কুরাইশদের প্রতিনিধিগণ বলল যে, ঝগড়ার মূল কারণই তো আপনার 'রিসালাত' তথা রসূল হওয়া। যদি আমরা আপনাকে আল্লাহর রসূল বলে মেনেই নিতাম, তাহলে এর পর ঝগড়াই-বা আর কি রয়ে যেত? অতঃপর আপনার সাথে যুদ্ধ করার এবং আল্লাহর ঘর থেকে আপনাকে বাধা দেওয়ার প্রয়োজনই কি? অতএব, আপনি এখানে 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ'র পরিবর্তে 'মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ' লিখুন। সুতরাং তিনি আলী (রাঃ)-কে এ রকমই লিখার নির্দেশ দিলেন। (এটা মুসলিমদের জন্য বড়ই লাঞ্ছনাকর ও উত্তেজনামূলক পরিস্থিতি ছিল। যদি আল্লাহ তাঁদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ না করতেন, তবে তাঁরা তা কখনই সহ্য করতে পারতেন না।) আলী (রাঃ) তাঁর নিজ হাত দিয়ে 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' মিটিয়ে দিতে অস্বীকার করলেন। তখন নবী করীম (সাঃ) বললেন, (আমাকে দেখিয়ে দাও) এ শব্দটি কোথায়? দেখিয়ে দিলে তিনি নিজের হাতে তা মিটিয়ে দিলেন এবং নিজে (মু'জিযাস্বরূপ) সেই স্থানে 'মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ' লিখলেন। এর পর এই চুক্তিপত্রে তিনটি জিনিস লেখা হয়। (ক) মক্কাবাসীদের মধ্যে যে ইসলাম গ্রহণ করে নবী (সাঃ)-এর কাছে আসবে, তাকে (মক্কায়) ফিরিয়ে দেওয়া হবে। (খ) আর কোন মুসলিম মক্কাবাসীদের সাথে মিলিত হলে, (মক্কাবাসীরা) তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে না। (গ) মুসলিমগণ আগামী বছর মক্কায় আসবে এবং এখানে তিন দিন অবস্থান করতে পারবে। আর তাদের সাথে কোন অস্ত্র থাকবে না। (বুখারী, মুসলিমঃ জিহাদ অধ্যায়) এর সাথে দু'টি কথা আরো লেখা হয়, (ক) এ বছর যুদ্ধ স্থগিত থাকবে। (খ) গোত্রগুলোর মধ্যে যে চায় মুসলিমদের সাথে এবং যে চায় কুরাইশদের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে।
[৩] 'তাকওয়ার বাক্য' বলে তাওহীদ ও রিসালাতের বাক্য 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' বুঝানো হয়েছে। যেটাকে হুদাইবিয়ার দিন মুশরিকরা অস্বীকার করেছিল। (ইবনে কাসীর) অথবা সেই ধৈর্য ও সহনশীলতা যা তাঁরা হুদাইবিয়ার দিন প্রদর্শন করেছিলেন। কিংবা সেই অঙ্গীকার পূরণ ও তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা, যা ছিল আল্লাহভীরুতার ফল। (ফাতহুল ক্বাদীর)