আল আ'রাফ আয়াত ৭২
فَاَنْجَيْنٰهُ وَالَّذِيْنَ مَعَهٗ بِرَحْمَةٍ مِّنَّا وَقَطَعْنَا دَابِرَ الَّذِيْنَ كَذَّبُوْا بِاٰيٰتِنَا وَمَا كَانُوْا مُؤْمِنِيْنَ ࣖ ( الأعراف: ٧٢ )
Fa anjainaahu wallazeena ma'ahoo birahmatim minnaa wa qata'naa daabiral lazeena kazzaboo bi Aayaatinaa wa maa kaanoo mu'mineen (al-ʾAʿrāf ৭:৭২)
English Sahih:
So We saved him and those with him by mercy from Us. And We eliminated those who denied Our signs, and they were not [at all] believers. (Al-A'raf [7] : 72)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
আমার করুণায় আমি তাকে ও তার সঙ্গী-সাথীদেরকে রক্ষা করলাম আর আমার নিদর্শনাবলীকে যারা অস্বীকার করেছিল এবং ঈমান আনেনি তাদের মূল উৎপাটন করলাম। (আল আ'রাফ [৭] : ৭২)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
অতঃপর তাকে ও তার সঙ্গীদেরকে আমার দয়াতে উদ্ধার করেছিলাম এবং আমার নিদর্শনসমূহকে যারা মিথ্যা মনে করেছিল এবং যারা অবিশ্বাসী ছিল তাদেরকে নির্মূল করেছিলাম। [১]
[১] এই জাতির উপর প্রবল ঝঞ্চাবায়ুর আযাব এসেছিল। তা সাত রাত এবং আট দিন পর্যন্ত লাগাতার অব্যাহত ছিল। আর এই ঝঞ্চাবায়ু প্রতিটি জিনিসকে ধূলিসাৎ করে ছেড়েছিল। যে আ'দ গোত্রের লোকেরা নিজেদের শক্তির উপর বড়ই অহংকার প্রদর্শন করত, তাদের লাশগুলো কাটা খেজুর গাছের কান্ডের ন্যায় মাটিতে পড়েছিল।
(সূরা হাক্কার ৬৯;৬-৮ নং, সূরা হূদের ১১;৫৩-৫৬ নং এবং সূরা আহক্বাফের ৪৬;২৪-২৫ নং আয়াতগুলো দ্রষ্টব্য।)
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
তারপর আমারা তাকে ও তার সাথীদেরকে আমাদের অনুগ্রহে উদ্ধার করেছিলাম; আর আমাদের আয়াতসমূহে যারা মিথ্যারোপ করেছিল এবং যারা মুমিন ছিল না তাদেরকে নির্মূল করেছিলাম [১]।
[১] এ অনুবাদটি এ হিসেবে যে, তাদের ধ্বংসের কারণ দু’টি। তারা মিথ্যারোপ করেছিল এবং ঈমান না এনে কুফরী করেছিল। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর] আয়াতের অর্থ এভাবেও করা যায় যে, যারা আমার আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করেছিল তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছি। আর তারা ঈমান গ্রহণকারী ছিল না, কারণ তারা আয়াতসমূহের উপর মিথ্যারোপ এবং সৎকাজ ছেড়ে দিয়েছিল। [মুয়াসসার]
3 Tafsir Bayaan Foundation
অতঃপর আমি তাকে ও তার সাথে যারা ছিল, তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে রহমত দ্বারা রক্ষা করেছি এবং তাদের মূল কেটে দিয়েছি, যারা আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করেছিল। আর তারা মুমিন ছিল না।
4 Muhiuddin Khan
অনন্তর আমি তাকে ও তার সঙ্গীদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে রক্ষা করলাম এবং যারা আমার আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করত তাদের মূল কেটে দিলাম। তারা মান্যকারী ছিল না।
5 Zohurul Hoque
কাজে কাজেই তাঁকে ও তাঁর সঙ্গে যারা ছিল তাদের আমরা উদ্ধার করেছিলাম আমাদের থেকে অনুগ্রহ বশতঃ, আর কেটে দিয়েছিলাম তাদের শিকড় যারা আমাদের নির্দেশসমূহ প্রত্যাখ্যান করেছিল ও যারা মুমিন ছিল না।
6 Mufti Taqi Usmani
সুতরাং আমি তাকে (হুদ আলাইহিস সালামকে) ও তার সঙ্গীদেরকে নিজ দয়ায় রক্ষা করলাম; আর যারা আমার নিদর্শনসমূহ প্রত্যাখ্যান করেছিল ও যারা মুমিন ছিল না, তাদেরকে নির্মূল করলাম।
7 Mujibur Rahman
অতঃপর আমি তাকে (হুদকে) এবং তার সঙ্গী-সাথীদেরকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করলাম, আর যারা আমার নিদর্শনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল এবং যারা ঈমানদার ছিলনা তাদের মূলোৎপাটন করে ছাড়লাম।
8 Tafsir Fathul Mazid
৬৫-৭২ নং আয়াতের তাফসীরঃ
অত্র আয়াতগুলোতে হূদ (আঃ) ও আদ জাতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে যাঁকে নূহ (আঃ)-এর পর প্রেরণ করা হয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর প্রধান ছয়টি জাতির মধ্যে নূহ (আঃ)-এর পরে আদ ছিল দ্বিতীয় জাতি। এরা খুবই দুর্ধর্ষ, শক্তিশালী, সুঠামদেহী ও বিরাট বপুস¤পন্ন ছিল। আদ ও সামূদ ছিল নূহ (আঃ)-এর পুত্র সামের বংশধর এবং নূহের পঞ্চম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। ইরামের পুত্র আদ-এর বংশধরগণ ‘আদ উলা বা প্রথম আদ’ এবং অপর পুত্রের সন্তান সামূদ-এর বংশধরগণ ‘আদ সানী বা দ্বিতীয় আদ’ বলে খ্যাত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) আ‘দ ও সামূদ উভয় গোত্রই ইরাম-এর দু’টি শাখা। সে-কারণে ইরাম নামটি আদ ও সামূদ উভয় গোত্রের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। তাই কুরআনে কোথাও ‘আদ উলা’ (সূরা নাজম ৫৩:৫০) এবং কোথাও ‘ইরাম’ (সূরা ফাজর ৮৯:৭) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আদ জাতির ১৩টি পরিবার বা গোত্র ছিল। আম্মান হতে শুরু করে হাজরামাউত ও ইয়ামান পর্যন্ত তাদের বসতি ছিল। (কুরতুবী, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি নাবী হিসেবে হূদ (আঃ)-কে প্রেরণ করলেন। তিনি স্বীয় জাতিকে শির্ক বর্জন করে সার্বিক জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে পূর্তিপূজা ত্যাগ করার এবং জুলুম ও অত্যাচার পরিহার করে ন্যায়-বিচারের পথে চলার উদাত্ত আহ্বান জানান। এমনকি তিনি এ-কথাও বলেন, ‘আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোন প্রতিদান চাই না, আমার পুরস্কার জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আছে।’ (সূরা শুআরা ২৬:১২৭) সূরা হূদের ৫০-৫১নং আয়াতেও এ কথা বলা হয়েছে। তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অপরাধের ক্ষমা চাইতে এবং তাওবা করতে বললেন। এ কাজ করলে ‘তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বারি বর্ষাবেন। তিনি তোমাদেরকে আরও শক্তি দিয়ে তোমাদের শক্তি বৃদ্ধি করবেন।’ (সূরা হূদ ১১:৫২) তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার যে সকল নেয়ামত রয়েছে সেকথাও স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তিনি তাদেরকে দান করেছেন চতুষ্পদ জন্তু ও সন্তান-সন্ততি, উদ্যান ও ঝর্ণাধারা। (সূরা শুআরা ২৬:১৩৩-১৩৪)
এসব কথা উল্লেখ করে তিনি যখনই তাওহীদ, তাওবা-ইস্তিগফার ও ন্যায়-নিষ্ঠার দাওয়াত দিতে শুরু করলেন তখনই লোকেরা তাকে নির্বোধ বলে আখ্যায়িত করতে লাগল। তারা বলল: ‘তুমি কি আমাদের নিকট এ উদ্দেশ্যে এসেছ যে, আমরা যেন এক ‘আল্লাহর ইবাদত করি এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণ যার ইবাদত করত তা বর্জন করি? তারা আরো বলতে লাগল, ‘হে হূদ! তুমি আমাদের নিকট কোন স্পষ্ট প্রমাণ আনয়ন করনি, তোমার কথায় আমরা আমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করব না এবং আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি না। ‘আমরা এটাই বলি: আমাদের উপাস্যদের মধ্যে কেউ তোমাকে অশুভ দৃষ্টি দ্বারা আবিষ্ট করেছে।” (সূরা হূদ ১১:৫৩-৫৪) তারা আরো বলল: তুমি কি আমাদের মা‘বূদদের থেকে আমাদেরকে ফিরিয়ে রাখার জন্য এসেছ? তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক তাহলে তুমি যে আযাবের ভয় দেখাচ্ছ তা নিয়ে এসো। (সূরা আহকাফ ৪৬:২৬) তারা বলেছিল: আমাদের প্রতিপালকের এরূপ ইচ্ছা হলে তিনি অবশ্যই ফেরেশতা অবতীর্ণ করতেন। অতএব, তুমি যেসব বিষয়সহ প্রেরিত হয়েছ, আমরা তা প্রত্যাখান করছি। (সূরা ফুসসিলাত ৪১: ১৪)
তিনি তাদের এসব কথার জবাবে বলেন:
(يٰقَوْمِ لَيْسَ بِيْ سَفَاهَةٌ وَّلٰكِنِّيْ رَسُوْلٌ مِّنْ رَّبِّ الْعٰلَمِيْنَ)
‘হে আমার সম্প্রদায়! আমি নির্বোধ নই, বরং আমি জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হতে রাসূল।’ (সূরা আ‘রাফ ৭:৬৭) তিনি তাদের জবাবে আরো বলেন: ‘আমি নির্ভর করি আমার ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর ওপর; এমন কোন জীবজন্তু নেই, যে তাঁর পূর্ণ আয়ত্বাধীন নয়; নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক আছেন সরল পথে। ‘এরপরেও যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও (তবে জেনে রেখ) আমি তোমাদের নিকট যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, অবশ্যই তা তোমাদের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছি; এবং আমার প্রতিপালক তোমাদের পরিবর্তে কোন সম্প্রদায়কে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন এবং তোমরা তাঁর কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক সমস্ত কিছুর রক্ষণাবেক্ষণকারী।’ (সূরা হূদ ১১: ৫৬-৫৭)
(رَجُلٍ مِّنْکُمْ)
‘তোমাদের মধ্য হতে একজন ব্যক্তি’ অর্থাৎ তোমাদের মধ্য হতে একজনকে আল্লাহ তা‘আলা বাছাই করে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন- এতে তোমরা আশ্চর্যবোধ করছ। মূলতঃ এটা আশ্চর্যের কথা নয় বরং প্রত্যেক জাতির সম্প্রদায় থেকে একজনকে বাছাই করে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল হিসেবে মনোনিত করেন।
(مِنْۭ بَعْدِ قَوْمِ نُوْحٍ)
‘নূহের সম্প্রদায়ের পরে’ অর্থাৎ নূহ (আঃ)-এর অবাধ্য জাতিকে মহা প্লাবনে ধ্বংসের পর তোমরা জমিনে বাস করছ, সেকথা বেশি দূরে নয়।
(وَّزَادَكُمْ فِي الْخَلْقِ بَسْطَةً)
‘এবং তোমাদের দৈহিক গঠনে অধিকতর হৃষ্টপুষ্ট-বলিষ্ঠ করেছেন।’ অর্থাৎ শক্তি, সামর্থ্যে ও দৈহিক গঠনে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। অতএব আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতগুলো স্মরণ কর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(الَّتِيْ لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِي الْبِلَادِ)
“যাদের সমান শক্তি ও বলবীর্যে সারা বিশ্বের শহরসমূহে কোন লোক সৃষ্টি করা হয়নি” (সূরা ফাজর ৮৯:৮)
(فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا)
‘আমাদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছ তা নিয়ে এসো’ এরূপ মক্কার কুরাইশরাও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর কাছে দাওয়াতের উত্তরে বলেছিল:
(اللّٰهُمَّ إِنْ كَانَ هٰذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَ السَّمَا۬ءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ)
“স্মরণ কর, যখন তারা বলছিল- ‘হে আল্লাহ! এটা যদি তোমার পক্ষ হতে সত্য হয়, তবে আমাদের ওপর আকাশ হতে প্রস্তর বর্ষণ কর কিংবা আমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দাও।” (সূরা আনফাল ৮:৩২)
رجس এর প্রকৃত অর্থ নাপাকী, এখানে অর্থ হল শাস্তি।
যখন নিজেদের ধনৈশ্বর্যের মোহে এবং দুনিয়াবী শক্তির অহংকারে মত্ত হয়ে তারা নাবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল, বাপ-দাদার দোহায় দিয়ে দেব-দেবীর উপাসনায় মগ্ন রইল এবং অহংকার করে বলল: ‘আমাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী কে আছে?’ (সূরা ফুসসিলাত ৪১:১৫) তখন আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি অবধারিত হয়ে গেল।
(وَقَطَعْنَا دَابِرَ الَّذِيْنَ كَذَّبُوْا بِاٰيٰتِنَا)
‘আর আমার নিদর্শনকে যারা অস্বীকার করেছিল এবং যারা মু’মিন ছিল না তাদেরকে নির্মূল করেছি।’ অর্থাৎ এ জাতির ওপর প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝা দ্বারা শাস্তি দেয়া হয়েছিল। যা সাত রাত ও সাত দিন ধারাবাহিকভাবে বয়ে চলছিল। ফলে তাদের লাশগুলো কাটা খেজুর গাছের কাণ্ডের মত মাটিতে পড়ে ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاَرْسَلْنَا عَلَیْھِمْ رِیْحًا صَرْصَرًا فِیْٓ اَیَّامٍ نَّحِسَاتٍ لِّنُذِیْقَھُمْ عَذَابَ الْخِزْیِ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَاﺚ وَلَعَذَابُ الْاٰخِرَةِ اَخْزٰی وَھُمْ لَا یُنْصَرُوْنَ)
“অতঃপর আমি তাদেরকে পার্থিব জীবনে অপমানজনক শাস্তি আস্বাদন করাবার জন্য তাদের বিরুদ্ধে অশুভ দিনে প্রেরণ করেছিলাম প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়। পরকালের শাস্তি তো অধিকতর লাঞ্ছনাদায়ক এবং তাদের সাহায্যও করা হবে না।” (সূরা ফুসসিলাত ৪১:১৬৬ নং আয়াত) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاَمَّا عَادٌ فَاُھْلِکُوْا بِرِیْحٍ صَرْصَرٍ عَاتِیَةٍﭕ سَخَّرَھَا عَلَیْھِمْ سَبْعَ لَیَالٍ وَّثَمٰنِیَةَ اَیَّامٍﺫ حُسُوْمًاﺫ فَتَرَی الْقَوْمَ فِیْھَا صَرْعٰیﺫ کَاَنَّھُمْ اَعْجَازُ نَخْلٍ خَاوِیَةٍﭖفَھَلْ تَرٰی لَھُمْ مِّنْۭ بَاقِیَةٍ)
“আর আদ সম্প্রদায়, তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় দ্বারা। যা তিনি তাদের ওপর প্রবাহিত করেছিলেন বিরামহীনভাবে সাত রাত ও আট দিন, তুমি (উপস্থিত থাকলে) সেই সম্প্রদায়কে দেখতে খেজুর কান্ডের ন্যায় সেখানে ছিন্ন ভিন্নভাবে পড়ে আছে। তুমি কি তাদের কাউকেও অবশিষ্ট দেখতে পাও?” (সূরা হাক্কাহ ৬৯:৬-৮) এদের সম্পর্কে সূরা আহকাফের ২১-২৬, শুআরার ১২৩-১৪০, ক্বামারের ১৮-২২ ও সূরা হাক্কাহর ৪-৮ নং আয়াতের আলোচনা করা হয়েছে।
সুতরাং এ আদ জাতি থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, এরা শক্তি-সামর্থে ও দৈহিক গঠনে পৃথিবীতে অতুলনীয় ছিল। কিন্তু তাদের নাবী যখন তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে আসলেন আর তারা তা প্রত্যাখ্যান করল, নাবীকে পাগল বলতে লাগল এবং সকল মা‘বূদকে বর্জন করে এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা অসম্ভব মনে করল তখন তাদের দৈহিক শক্তি তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার আযাব থেকে রেহাই দিতে পারেনি ।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. শির্ক, অন্যায়-অবিচার ও অহংকার প্রদর্শন করাই হল আল্লাহ তা‘আলার গযবের প্রধান কারণ।
২. যুগে যুগে যারাই নাবীদের আনিত বিধান প্রত্যাখ্যান করেছে তারাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, আদ সম্প্রদায় তাদের অন্যতম।
৩. আল্লাহ তা‘আলা প্রেরিত গযব বিভিন্ন ধরনের হতে পারে; তা মোকাবেলা করার কেউ নেই। অনেকে আল্লাহ তা‘আলার শাস্তিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে যার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকেই উপেক্ষা করা হয় যা ঈমানের পরিপন্থী।
৪. সকল ইবাদত পাওয়ার একমাত্র হকদার আল্লাহ তা‘আলা। সুতরাং সকল বাতিল মা‘বূদ বর্জন করে এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করলে দুনিয়াতে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে আর পরকালেও নাজাত পাওয়া যাবে।
৫. বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে সত্য প্রত্যাখ্যান করা পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির আলামত।
৬. ইসলামী রীতি-নীতি ও অনুশাসন মেনে চলে সৎ আমল করলে দুনিয়ার সম্পদ ও সুখ-শান্তি বৃদ্ধি পাবে।
9 Fozlur Rahman
অতঃপর আমি তাকে ও তার সঙ্গীদেরকে আমার বিশেষ অনুগ্রহে রক্ষা করেছিলাম এবং যারা আমার আয়াতসমূহ অমান্য করেছিল তাদের শিকড় কেটে দিয়েছিলাম। তারা বিশ্বাসী ছিল না।
10 Mokhtasar Bangla
৭২. অতঃপর আমি হূদ (আলাইহিস-সালাম) ও তাঁর মু’মিন সাথীদেরকে আমার দয়ায় নিরাপদে রেখেছি। আর যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছে এবং তারা ঈমান না এনে মিথ্যারোপকারী সেজে নিজেরাই শাস্তির উপযুক্ত হয়েছে তাদেরকে আমি ধ্বংসের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে মূলোৎপাটন করেছি।
11 Tafsir Ibn Kathir
৭০-৭২ নং আয়াতের তাফসীর:
কাফিরগণ হযরত হূদ (আঃ)-এর সাথে কিরূপ অবাধ্যতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছিল তারই বর্ণনা আল্লাহ পাক এখানে দিচ্ছেন। তারা তাকে বলেছিল-“হে হূদ (আঃ)! আমাদের পূর্বপুরুষরা যাদের ইবাদত-বন্দেগী করতো তাদেরকে ছেড়ে আমরা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করি এজন্যেই কি তুমি আমাদের কাছে এসেছো? আচ্ছা, তুমি যদি তোমার কথায় সত্যবাদী হও তবে যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছ তা আনয়ন কর।” যেমন কাফির কুরাইশরা বলছে- “তুমি আমাদেরকে শাস্তির যে ভয় দেখাচ্ছ তা যদি সত্য হয় তাহলে আকাশ থেকে পাথর বর্ষিয়ে নাও এবং আমাদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করেই ফেলো।” মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রঃ) বলেন যে, হযরত হূদ (আঃ)-এর কওম মূর্তিসমূহের পূজা করতো। একটি মূর্তির নাম ছিল সামাদ, একটির নাম ছিল ‘সামুদ' এবং একটির নাম ছিল ‘হাবা’! এজন্যেই হূদ (আঃ) তাদেরকে বলেছিলেন, তোমাদের একথা বলার কারণেই তোমাদের উপর আল্লাহর গযব ওয়াজিব হয়ে গেছে। বলা হয়েছে যে, رِجْسٌ শব্দটি رِجْزٌ -এরই প্রতিশব্দ । হ্রদ (আঃ) বলেনঃ “তোমরা কি আমার সাথে এমনসব মূর্তির ব্যাপার নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হচ্ছে যেগুলোর নাম তোমরা নিজেরা রেখেছে বা তোমাদের পূর্বপুরুষরা রেখেছে। এসব মূর্তি তো তোমাদের কোন লাভও করতে পারে না এবং কোন ক্ষতিও করতে পারে না। আল্লাহ তোমাদেরকে এগুলোর ইবাদত করার কোন সনদও দেননি এবং তোমাদের কাছে এর কোন দলীল প্রমাণও নেই। যদি কথা এটাই হয় তবে ঠিক আছে, তোমরা শাস্তির জন্যে অপেক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি। এটা রাসূলের পক্ষ থেকে তাঁর কওমের প্রতি কঠিন হুমকি ও ভয় প্রদর্শন। সুতরাং এর পরই ইরশাদ হচ্ছে- আমি হদ (আঃ)-কে এবং তার অনুসারী সঙ্গী সাথীদেরকে তো বাঁচিয়ে নিলাম, কিন্তু যারা তার উপর ঈমান আনেনি এবং আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছিল আমি তাদের মূলোৎপাটন করলাম।
আদ জাতির ধ্বংসের ঘটনা কুরআন মাজীদের অন্য জায়গায় এরূপ বর্ণিত আছে- “তাদের উপর আমি এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিবায়ু প্রেরণ করলাম এবং যাদের উপর দিয়ে ওটা বয়ে গেল তাদের সবকেই তচনচ্ করে দিলো।” যেমন অন্য একটি আয়াতে আছে- “আর আ’দ সম্প্রদায়কে এক প্রচণ্ড ঝঞাবায়ু দ্বারা বিধ্বস্ত করা হয়েছে। যে বায়ুকে আল্লাহ সাত রাত্রি ও আট দিবস পর্যন্ত তাদের উপর একাধারে চাপিয়ে রেখেছিলেন, অতএব, তুমি ঐ সম্প্রদায়কে ওতে এমনভাবে ভূপতিত দেখতে পেতে, যেন তারা উৎপাটিত খেজুর বৃক্ষের কাণ্ডসমূহ। সুতরাং তাদের কাউকেও কি তুমি অবশিষ্ট দেখতে পাও?” তাদের ঔদ্ধত্যের কারণে তাদের উপর এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিবার্তা প্রেরণ করে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। ঐ বায়ু তাদেরকে আকাশে নিয়ে উড়তেছিল এবং পরে মাথার ভরে যমীনে নিক্ষেপ করে দিচ্ছিলো। ফলে তাদের মাথাগুলো ভেঙ্গে দেহ থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিলো। এজন্যেই আল্লাহ পাক বলেছেন যে, তারা সেই খেজুর গাছের কাণ্ডের মত হয়ে গিয়েছিল যেগুলো সম্পূর্ণরূপে ডাল-পাতা শূন্য ছিল। ঐ লোকগুলো ইয়ামানে আম্মান ও হারামাউতের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতো। তাছাড়া তারা সারা দুনিয়ায় দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা শক্তির দাপটে জনগণের উপর অত্যাচার চালাতো। তারা মূর্তিপূজা করতো। তাই আল্লাহ তা'আলা তাদের কাছে হূদ (আঃ)-কে পাঠালেন। তিনি তাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশীয় ছিলেন। তিনি তাদেরকে উপদেশ দিতেন যে, তারা যেন আল্লাহকে এক বলে স্বীকার করে নেয় এবং তার সাথে কাউকে শরীক না করে। আর তারা যেন লোকদের উপর অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু তারা তা অস্বীকার করে এবং তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতঃ বলে- “আমাদের অপেক্ষা বড় শক্তিশালী আর কে আছে?” অন্যান্য লোকেরাও তাদের অনুসরণ করে। হ্রদ (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনয়নকারী লোকের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। যখন আ’দ সম্প্রদায় এরূপ অবাধ্যতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে শুরু করে, আর বিনা প্রয়োজনে বড় বড় অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ করে, তখন হযরত হূদ (আঃ) তাদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ “তোমরা সব জায়গায় বিনা প্রয়োজনে ঘরবাড়ী নির্মাণ করছে এবং ওগুলোকে এতো মজবুত করে তৈরী করছো যে, মনে হচ্ছে তোমরা এখানে চিরকাল থাকবে! যখন তোমরা কারো উপর ক্ষমতা প্রাপ্ত হচ্ছে তখন তার সাথে অত্যন্ত কঠোরতাপূর্ণ ব্যবহার করছো! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার কথা মেনে চল।” তারা তখন তাকে বললোঃ “হে হূদ (আঃ)! তুমি প্রমাণবিহীন কথা বলছো। তোমার কথায় আমরা আমাদের মা’বৃদদেরকে ছেড়ে দিতে পারি না এবং তোমার উপর ঈমানও আনব না। আমাদের তো ধারণা হচ্ছে যে, তোমার উপর আমাদের কোন মা'বুদের গযব পতিত হয়েছে, ফলে তুমি পাগল হয়ে গেছো।” হুদ (আঃ) তাদেরকে বললেনঃ “আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি এবং তোমরাও সাক্ষী থাক যে, আমি তোমাদের শিকযুক্ত চিন্তা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। এখন তোমরা সবাই মিলে আমার সাথে যা কিছু ছল-চাতুরী করতে চাও কর এবং আমাকে অবকাশ দিয়ো না। আমি আল্লাহর উপরই ভরসা করছি। তিনি আমার প্রভু এবং তোমাদেরও প্রভু। আমার প্রতিপালক যা কিছু বলেন ঠিকই বলেন।”
ঐ লোকগুলো যখন কুফরীর উপর অটল থাকলো তখন আল্লাহ তা'আলা তিন বছর পর্যন্ত তাদের উপর বৃষ্টি বন্ধ রাখলেন। তারা তখন কঠিন বিপদে পতিত হলো। যখন তারা কোন কঠিন বিপদের সম্মুখীন হতো তখন সেই বিপদ থেকে মুক্তি লাভের জন্যে আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা জানাতো। ঐ সময় তারা কাউকে বায়তুল্লাহ শরীফে পাঠিয়ে দিতো। ঐ যুগে তাদের গোত্রের আমলীক নামে পরিচিত কতকগুলো লোক মক্কায় বসবাস করছিল। তারা ছিল আমালীক ইবনে লাও ইবনে সাম ইবনে নূহ (আঃ)-এর বংশধর। মুআবিয়া ইবনে বকর নামক একটি পোর্ক ছিল তাদের নেতা। তার মা ছিল আ’দ সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তার নাম ছিল জুলহিয়া । সে ছিল খাবীরীর কন্যা। যা হাক, আ’দ সম্প্রদায় সত্তরজন লোকের এক প্রতিনিধি দলকে হারাম শরীফের দিকে পাঠিয়ে দিলো, যেন তারা কা’বাতুল্লাহয় গিয়ে পানি বর্ষণের জন্যে প্রার্থনা করে। ঐ লোকগুলো মক্কার বাইরে তাদের গোত্রীয় লোক মুআবিয়ার নিকট অবস্থান করে। এক মাস পর্যন্ত তারা তার কাছেই অবস্থান করতে থাকে। তারা সেখানে মদ্যপান করতে এবং মুআবিয়ার দু’জন গায়িকা দাসীর গান শুনতো। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে তাদের অবস্থান মুআবিয়ার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অতিথিদেরকে বিদায় হয়ে যাওয়ার কথা বলতে সে লজ্জাবোধ করছিল। অবশেষে সে কতকগুলো ছন্দ রচনা করলো এবং ওগুলো তাদের সামনে গায়িকাদেরকে গাইতে বললো। ছন্দগুলোর অনুবাদ নিম্নরূপঃ
“হে কায়েল! তোমার উপর আফসোস! যাও, প্রার্থনা কর। হয়তো আল্লাহ বৃষ্টি বর্ষণের জন্যে মেঘ পাঠাবেন। ফলে আ’দ সম্প্রদায়ের ভূমি অদ্র ও সতেজ হয়ে উঠবে। কেননা, আ’দ সম্প্রদায়ের অবস্থা তো এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তারা ভালভাবে কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। পিপাসায় এখন তাদের ওষ্ঠাগত প্রাণ। বুড়ো ও যুবক কারো জীবনের আশা নেই। তাদের মহিলাদেরও অবস্থা ভাল নয়। ক্ষুধা ও পিপাসায় এখন তাদের চলৎশক্তি রহিত। বন্য জঙুগুলো অতি সহজেই তাদের বস্তিতে ঢুকে পড়েছে। কেননা, আ’দ সম্প্রদায় সম্পর্কে তাদের এখন কোন ভয় নেই যে, তারা ওদেরকে তীর মেরে হত্যা করবে। কারণ, এখন তাদের তীর চালাবার শক্তিও নেই। সুতরাং জেনে রেখো যে, তাদের এখন দিবস ও রজনী শেষ হয়েই গেছে। কোন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দল তোমাদের ন্যায় এতো নিষ্ঠুর হতে পারে না। তোমাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হাক!” একথা শুনে ঐ প্রতিনিধি দলের লোকদের চৈতন্য ফিরলো। তারা কাবা ঘরে গিয়ে কওমের জন্যে প্রার্থনা করতে শুরু করলো। ঐ প্রতিনিধি দলের নেতার নাম ছিল কায়েল। আল্লাহর হুকুমে তিন খণ্ড মেঘ প্রকাশিত হলো। এক খণ্ড সাদা, এক খণ্ড কালো এবং এক খণ্ড লাল। আকাশ থেকে একটা শব্দ শোনা গেল- “নিজের কওমের জন্যে এই তিন খণ্ড মেঘের যে কোন একখণ্ড পছন্দ করে নাও।”
কায়েল বললোঃ “আমি কালো মেঘখণ্ডই পছন্দ করলাম। কালো মেঘ থেকেই অধিক বৃষ্টি বর্ষিত হয়ে থাকে।” পুনরায় শব্দ আসলো-“তুমি তো ভষ্ম ও মাটিকে পছন্দ করলে। আ’দ সম্প্রদায়ের কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। এ মেঘ তো পিতাকে ছাড়বে না এবং পুত্রকেও ছাড়বে না, বরং সবকে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু আ’দ সম্প্রদায়ের বানী আযিয়া গোত্র নিরাপত্তা লাভ করবে।” আ’দ সম্প্রদায়ের এ গোত্রটি মক্কায় অবস্থান করছিল। তারা শাস্তির কিছুই টের পায়নি। আ’দ সম্প্রদায়ের সবাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যারা রক্ষা পেয়েছিল তারা ছিল এই বানী আযিয়া গোত্রেরই লোক। এর বংশ ও সন্তানদের মধ্য থেকে ঐ কওম অবশিষ্ট থাকে যাদেরকে আ’দে সানী’ বা দ্বিতীয় আ’দ বলা হয়। কথিত আছে যে, আল্লাহ তা'আলা একটা কলো মেঘখণ্ড পাঠিয়েছিলেন যাকে কায়েল পছন্দ করেছিল এবং এটাই ঐ সম্প্রদায়ের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল। ঐ মেঘখণ্ডটি মুগীস নামক একটি উপত্যকা হতে উঠেছিল। জনগণ ওটা দেখে খুব খুশী হয় এবং বলে- “এটা তো বর্ষণকারী মেঘ।” আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “প্রবল ঝটিকা এই মেঘ বয়ে নিয়ে আসে। এরই মধ্যে ছিল যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি, যা সব কিছুকেই ধ্বংস করে দেয়। এই মেঘের মধ্যে একটি জিনিস সর্বপ্রথম যে দেখেছিল, সে ছিল একটি মহিলা। তার নাম ছিল মুমীদ। সে মেঘের মধ্যে যা দেখেছিল তা দেখে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। জ্ঞান ফিরলে সে বলেঃ “এই মেঘের মধ্যে আগুনের শিখা ছিল। কতকগুলো লোককে দেখা যাচ্ছিল যারা ঐ শিখাগুলো টেনে আনছিল।” সাতরাত ও আটদিন পর্যন্ত ঐ মেঘ হতে পানি বর্ষিতে থাকে। আ’দ সম্প্রদায়ের এমন লোক অবশিষ্ট ছিল না যে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিল। হূদ (আঃ) এবং তাঁর সঙ্গী মুমিনগণ এখান থেকে সরে গিয়েছিলেন এবং একটি শস্যক্ষেত্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা সম্পূর্ণ নিরাপদে ছিলেন। ঠাণ্ডা বায়ু তাদের দেহ স্পর্শ করছিল এবং তাদের আত্মাকে সতেজ ও পরিতৃপ্ত রাখছিল । কিন্তু আ’দ সম্প্রদায়ের প্রতি ঐ মেঘ ঝটিকা পাথর বর্ষণ করছিল। তাদের মাথাগুলো ভেঙ্গে গিয়েছিল। এ ঘটনার বর্ণনা খুবই দীর্ঘ এবং এর রচনাভঙ্গীও বেশ বিস্ময়কর। এর থেকে কয়েকটি ফলাফলও বের হয় । আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “আমার আযাব যখন এসে পৌঁছেই গেল তখন আমি হূদ (আঃ)-কে এবং তার সঙ্গীয় মুমিনদেরকে বাঁচিয়ে নিলাম। যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে তারা নিরাপদে থাকলো।”
হারিসুল বিকরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ আমি আ’লা ইবনে হারামীর অভিযোগ নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট যাচ্ছিলাম। আমি কওমের পার্শ্ব দিয়ে গমন করছিলাম। এমতাবস্থায় বানী তামীম গোত্রের একটি মহিলা যে তার গোত্র থেকে ছুটে গিয়ে একা পড়ে গিয়েছিল, আমাকে বললো- “হে আল্লাহর বান্দা! আমাকে আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর কাছে নিয়ে চলুন। তাঁর আমার প্রয়োজন রয়েছে। আমি তখন তাকে আমার উটের উপর বসিয়ে নিয়ে মদীনায় পৌঁছলাম। মসজিদ লোকে পরিপূর্ণ ছিল এবং একটি কালো পতাকা উত্তোলিত ছিল। হযরত বিলাল (রাঃ) স্বীয় তরবারী লটকিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম- এ লোকগুলোর জমায়েত হওয়ার কারণ কি? উত্তর হলোঃ “আমর ইবনুল আস (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী প্রেরণ করা হচ্ছে।” আমি বসে পড়লাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় কক্ষে প্রবেশ করলেন। আমি তার কাছে হাযির হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলাম। আমাকে অনুমতি দেয়া হলো। আমি তার কাছে হাযির হয়ে সালাম করলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- “তোমার ও তাদের মধ্যে মননামালিন্য আছে কি?” আমি উত্তরে বললামঃ হ্যাঁ, তাদের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ রয়েছে। এখন আমি আপনার নিকট আসছিলাম, এমতাবস্থায় পথে বানী তামীম গোত্রের এক বুড়ীর সাথে আমার সাক্ষাত হয়। সে তার গোত্র থেকে ছাড়া পড়ে গিয়েছিল। সে আমাকে বলে- “আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর কাছে আমার প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন। সে দরজাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (আঃ) তাকে ডেকে নিলেন।
সে এসে পড়লে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার ও বানী তামীমের মধ্যে আড়াল করে দিন। একথা শুনে বানী তামীম গোত্রের ঐ বুড়ীটি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো এবং বললোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তাহলে এই নিরাশ্রয়া কোথায় আশ্রয় নেবে? আমি তখন বললাম, আমার এই দৃষ্টান্ত তো হচ্ছে “বকরী নিজেই নিজের মৃত্যুকে টেনে আনলো” -এই প্রবাদ বাক্যের মতই। আমি এই বুড়ীকে নিজের সোয়ারীর উপর চড়িয়ে আনলাম, আমি কি জানতাম যে, সেই আমার শত্রুরূপে সাব্যস্ত হবে! আমি আ’দ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দলের মত হয়ে যাই এর থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট আশ্রয় চাচ্ছি। আমার একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আ’দ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের ঘটনাটি কি?” অথচ তিনি এটা আমার চেয়ে অনেক বেশী জানতেন। কিন্তু তিনি এটা আমার নিকট থেকে শুনতে আগ্রহী ছিলেন। সুতরাং আমি বলতে লাগলাম, আ’দ সম্প্রদায় দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়েছিল। তাই তারা একটা প্রতিনিধি দল মক্কায় প্রেরণ করে। তাদের নেতা ছিল কায়েল নামক একটি লোক। তারা মক্কায় গিয়ে মুআবিয়া ইবনে বকরের নিকট অবস্থান করে। সেখানে তারা দীর্ঘ এক মাস ধরে বাস করে এবং মদ্যপানরত.থাকে। তাছাড়া তারা জারাদাতান নাম্নী" দু'টি দাসীর গান শুনতে থাকে। অতঃপর তাদের নেতা কায়েল মুহরার পাহাড়ের দিকে গমন করে এবং প্রার্থনা জানিয়ে বলে- “হে আল্লাহ! আপনি জানেন যে আমরা কোন রোগীর রোগ মুক্তির দুআ’র জন্যে আসিনি বা কোন বন্দীর মুক্তিপণের জন্যে প্রার্থনা করছি না। বরং আমাদের প্রার্থনা এই যে, আপনি আ’দ সম্প্রদায়ের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করুন।” তখন আল্লাহর হুকুমে তিনখণ্ড মেঘ প্রকাশিত হলো (মেঘখণ্ডগুলো ছিল সাদা, কালো ও লাল)। দৈববাণী হলো- “যে কোন একখণ্ড মেঘ গ্রহণ কর।” সে কালো মেঘ খণ্ডটি পছন্দ করল। পুনরায় শব্দ আসলো-“তুমি তো মাটি পাবে। আ’দ সম্প্রদায়ের একটি প্রাণীও রক্ষা পাবে না বরং সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে।” অতঃপর আল্লাহ তা'আলা একটা প্রবল ঝটিকা প্রেরণ করেন। সেই বায়ু ছিল বায়ু ভাণ্ডারের মধ্যে যেন আমার আংটির বৃত্তের সমপরিমাণ। তাতে সমস্ত আ’দ সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে গেল। এখন আরবের লোকেরা কোন প্রতিনিধি দল পাঠালে প্রবাদ বাক্য হিসেবে বলে থাকেঃ আদ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দলের মতো হয়ো না। (এটা ইমাম তরমিযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) ও ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন)