৮০-৮৪ নং আয়াতের তাফসীরঃ
সালেহ (আঃ) ও তাঁর জাতির কথা আলোচনা করার পর আল্লাহ তা‘আলা লূত (আঃ) ও তাঁর জাতির আলোচনা নিয়ে এসেছেন। লূত (আঃ) ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ভাতিজা। চাচার সাথে তিনিও বাবেল শহর থেকে হিজরত করে বায়তুল মুকাদ্দাসের অদূরে কেন‘আনে চলে আসেন। আল্লাহ তা‘আলা লূত (আঃ)-কে নবুওয়াত দান করেন এবং কেন‘আন থেকে অল্প দূরে জর্ডান ও বায়তুল মুকদ্দাসের মধ্যবর্তী ‘সাদুম’ এলাকার অধিবাসীদের পথ প্রদশর্নের জন্য প্রেরণ করেন। এ এলাকায় স্বা’বাহ, সা’ওয়াহ, আমুরাহ, দূমা ও সাদুম নামে বড় বড় পাঁচটি শহর ছিল। কুরআন মাজীদে বিভিন্ন স্থানে এদের সমষ্টিকে ‘মু‘তাফেকাহ’ (সূরা নাজম৫৩:৫৩) বা ‘মু‘তাফেকাত’ (সূরা তাওবাহ ৯:৭০) শব্দে বর্ণনা করেছে। যার অর্থ জনপদ উল্টানো শহরগুলো। এ পাঁচটি শহরের মধ্যে সাদুম ছিল বড় এবং রাজধানী।
লূত (আঃ)-এর দাওয়াত:
লূত (আঃ)-এর জাতি আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ছেড়ে বহুত্ববাদের ইবাদত ও কুফরীতে লিপ্ত ছিল। পূর্বেকার ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ন্যায় তারাও চূড়ান্ত বিলাস-ব্যসনে গা ভাসিয়ে নানাবিধ দুষ্কর্ম চর্চা করত। রাহাজানি, নিজেদের মজলিসেই প্রকাশ্যে গর্হিত কাজ এমনকি পুংমৈথুন বা সমকামিতার মত নোংরামিতে তারা লিপ্ত ছিল, যা ইতোপূর্বে কোন জাতির মধ্যে দেখা যায়নি। জন্তু-জানোয়ারের চেয়ে নিকৃষ্ট ও হঠকারী এ জাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তা‘আলা লূত (আঃ)-কে প্রেরণ করেন। তিনি পূর্ববর্তী নাবীদের ন্যায় তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে বললেন:
(اِنِّیْ لَکُمْ رَسُوْلٌ اَمِیْنٌﯱ فَاتَّقُوا اللہَ وَاَطِیْعُوْنِﯲﺆوَمَآ اَسْئَلُکُمْ عَلَیْھِ مِنْ اَجْرٍﺆ اِنْ اَجْرِیَ اِلَّا عَلٰی رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ)
“আমি তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি তার জন্য তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না, আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকটই আছে।” (সূরা শু‘আরা ২৬:১৬২-১৬৪) অতঃপর তাদের বদ-অভ্যাসের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন:
(اَتَاْتُوْنَ الذُّکْرَانَ مِنَ الْعٰلَمِیْنَ)
“বিশ্বজগতের মধ্যে তো তোমরাই পুরুষের সাথে কুকর্ম কর।” (সূরা শু‘আরা ২৬:১৬৫)
এ কথাগুলোই অত্র সূরার ৮০-৮১ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
(مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ أَحَدٍ)
‘তোমদের পূর্বে বিশ্বে আর কেউই করেনি’ অর্থাৎ লূত (আঃ)-এর সম্প্রদায় সর্বপ্রথম لواطة বা সমকামিতায় লিপ্ত হয়। এদের পূর্বে কোন জাতিই পৃথিবীর বুকে এ কাজ করেনি। শুধু তাই নয়, তাদের মাঝে সুদর্শন কোন মেহমান আগমন করলেও তারা তাদের সাথে এ কুকর্ম করতে দ্বিধাবোধ করত না। যেমন লূত (আঃ)-এর বাড়িতে ফেরেশতারা সুদর্শন যুবকের রূপ ধারণ করে আগমন করলে মেহমান মনে করে তাদের সাথে কুকর্ম করার জন্য পিড়াপিড়ি শুরু করে। লূত (আঃ) তাদেরকে বললেন, আমার মেয়েরা আছে তাদেরকে বিবাহ করে তোমরা তোমাদের জৈবিক চাহিদা মেটাও। তারা বলল, ‘তুমি তো জান, তোমার কন্যাদেরকে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই; আমরা কী চাই তাও তো তুমি জান।’ (সূরা হূদ ১১:৭৮-৭৯) লূত (আঃ) তাদেরকে এহেন মন্দ কর্ম থেকে বারণ করলে জবাবে তারা বলল: ‘এদেরকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও, এরা এমন মানুষ যারা পবিত্র থাকতে চায়।” অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لَئِنْ لَّمْ تَنْتَھِ یٰلُوْطُ لَتَکُوْنَنَّ مِنَ الْمُخْرَجِیْنَ)
‘হে লূত! তুমি যদি বিরত না হও, তবে অবশ্যই তুমি নির্বাসিত হবে।’ (সূরা শুআরা ২৬:১৬৭) এভাবেই তারা লূত (আঃ)-এর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে শির্ক, কুফরী, আল্লাহ তা‘আলাদ্রোহী ও বেহায়াপনাপূর্ণ কাজে লিপ্ত থাকে।
গযবের বিবরণ:
লূত (আঃ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলে তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এবং লুত (আঃ)-এর স্ত্রীকে-সহ পাথর বৃষ্টি দ্বারা ধ্বংস করে দেন। কেননা লূত (আঃ)-এর স্ত্রী ঈমান আনেনি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَمَّا جَا۬ئَ اَمْرُنَا جَعَلْنَا عَالِیَھَا سَافِلَھَا وَاَمْطَرْنَا عَلَیْھَا حِجَارَةً مِّنْ سِجِّیْلٍﺃ مَّنْضُوْدٍ৫ لا مُّسَوَّمَةً عِنْدَ رَبِّکَﺚ وَمَا ھِیَ مِنَ الظّٰلِمِیْنَ بِبَعِیْدٍ)
“অতঃপর যখন আমার আদেশ আসল তখন আমি জনপদকে ওপর নিচ করে দিলাম এবং তাদের ওপর ক্রমাগত বর্ষণ করলাম প্রস্তর কঙ্কর, যা তোমার প্রতিপালকের নিকট চিহি“ত ছিল। এটা জালিমদের হতে দূরে নয়।” (সূরা হূদ ১১:৮২-৮৩)
লূত (আঃ)-এর অবাধ্য জাতির ওপর গযবের বিবরণ সূরা হূদের ৬৯-৮৩নং আয়াতের তাফসীরে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: আমার উম্মাতের ব্যাপারে বেশি আশংকা করি যে, তারা লূত (আঃ)-এর জাতির অপরাধে নিপতিত হবে। (তিরমিযী হা: ১৪৫৭, ইবনু মাযাহ হা: ২৫৬৩, হাসান)
যারা এরূপ কাজ করবে তাদের হত্যা করা হবে। এমনকি যদি পশুর সাথে এরূপ কাজ করে তাহলে তাকে ও পশুকে হত্যা করা হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি পশুর সাথে খারাপ কাজ করবে তাকে ও পশুকে হত্যা কর। (আবূ দাঊদ হা: ৪৪৬৫, তিরমিযী হা: ১৪৫৫, সহীহ)
সুতরাং এমন খারাপ কাজ থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে। এসব অপকর্ম করলে ধ্বংস অনিবার্য।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. লূত (আঃ)-এর জাতির অন্যান্য অপরাধের মধ্যে অন্যতম প্রধান অপরাধ ছিল সমকামিতা, যার কারণে পাথরের বৃষ্টির মত শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে।
২. কোন জাতি এমন কাজে লিপ্ত হলে তাদের ধ্বংস অনিবার্য।
৩. ঈমান না থাকলে বংশ বা আত্মীয়তা সম্পর্ক আল্লাহ তা‘আলা গযব থেকে রক্ষা করতে পারে না। যেমন লূত (আঃ)-এর স্ত্রী গযব থেকে রক্ষা পায়নি।
৪. কোন জাতির কাছে নাবী-রাসূল অথবা সংস্কারক পাঠিয়ে উপদেশ না দেয়া পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা শাস্তি দেন না।