আল ক্বেয়ামাহ আয়াত ১৫
وَّلَوْ اَلْقٰى مَعَاذِيْرَهٗۗ ( القيامة: ١٥ )
Wa law alqaa ma'aazeerah (al-Q̈iyamah ৭৫:১৫)
English Sahih:
Even if he presents his excuses. (Al-Qiyamah [75] : 15)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
যদিও সে নানান অজুহাত পেশ করে। (আল ক্বেয়ামাহ [৭৫] : ১৫)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
যদিও সে নানা অজুহাতের অবতারণা করে। [১]
[১] অর্থাৎ লড়াই করুক, ঝগড়া করুক, আর যত অপব্যাখ্যা করবে করুক; এ রকম করে তার না কোন লাভ হবে, আর না সে নিজ বিবেককে সন্তুষ্ট করতে পারবে।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
যদিও সে নানা অজুহাতের অবতারণা করে।
3 Tafsir Bayaan Foundation
যদিও সে নানা অজুহাত পেশ করে থাকে।
4 Muhiuddin Khan
যদিও সে তার অজুহাত পেশ করতে চাইবে।
5 Zohurul Hoque
যদিও সে তার অজুহাত দেখায়।
6 Mufti Taqi Usmani
যদিও সে নানা অজুহাত পেশ করে!
7 Mujibur Rahman
যদিও সে নানা অজুহাতের অবতারণা করে।
8 Tafsir Fathul Mazid
নামকরণ
: القيامة কিয়ামত, যা অবশ্যই ঘটবে। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। প্রথম দুটি আয়াতে কিয়ামত সংক্রান্ত বচন ও মন সংক্রান্ত বিষয়ের মধ্য দিয়ে সূরাটির সূচনা হয়েছে, তারপর কিয়ামতের কিছু নিদর্শন বর্ণনা করা হয়েছে। অতঃপর কুরআন নাযিলের সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর করণীয় বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
১-১৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
لَآ أُقْسِمُ বাক্যতে لَآ অক্ষরটিকে কেউ অতিরিক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : যে জিনিসকে কেন্দ্র করে শপথ করা হয় (المقسم عليه) তা যদি নাবোধক হয় তাহলে গুরুত্ব বুঝোনোর জন্য শপথের (القسم) পূর্বে নাবোধক لَآ নিয়ে আসা হয়। (ইবনু কাসীর)
আল্লামা সাদী (রহঃ) বলেন : এখানে لا অক্ষরটি নাবোধকও নয় বা অতিরিক্তও না। বরং এখানে নিয়ে আসা হয়েছে সূচনা করা ও গুরুত্ব বুঝোনোর জন্য। (তাফসীর সা‘দী)
আবার কেউ কেউ বলেছেন, এ শপথের পূর্বে কাফিরদের কথার খন্ডন করা হয়েছে। তারা বলত যে, মরণের পর আর কোন জীবন নেই। لا দ্বারা বলা হল যে, তোমরা যেমন বলছ ব্যাপারটা তেমন নয়। এ ব্যাপারে আমি কিয়ামতের দিনের শপথ করে বলছি। কিয়ামতের দিনের শপথের উদ্দেশ্য হল তার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বুঝানো।
(النَّفْسِ اللَّوَّامَةِ)
‘তিরস্কারকারী আত্মা’ সূরা ইউসুফে আলোচনা করা হয়েছে যে, نفس (আত্মা) তিন প্রকার, তার মধ্যে এটি একটি। এ আত্মাকে لوامة বলা হয়
لكثرة تلو وترددها وعدم بثوتها علي حالة من أحوالها
বিভিন্ন রং ধারণ ও বেশি বেশি পরিবর্তন হওয়ার কারণে এবং একই অবস্থার ওপর বহাল না থাকার কারণে। প্রত্যেক আত্মাই নিজেকে তিরস্কার করবে, ভাল আত্মা নিজেকে তিরস্কার করে বলবে কেন আরো ভাল কাজ করিনি? আর খারাপ আত্মা নিজেকে খারাপ কাজ করার জন্য ভর্ৎসনা করবে। কিয়ামত ও নাফসে লাওওয়ামাহর শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামত অবধারিত হওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তবে সেটা কিছুটা ভিন্ন আংগিকে যথা :
(أَيَحْسَبُ الْإِنْسَانُ)
এটা শপথের জবাব। এখানে ইনসান বা মানুষ বলতে কাফির ও নাস্তিকদেরকে বুঝোনো হয়েছে যারা আখিরাতকে অস্বীকার করে থাকে। যারা বলে, আমরা মারা গেলে পচে গলে যাব, কোন অস্তিত্ব থাকবে না। আবার কি আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একত্রিত করা সম্ভব? জবাবে আল্লাহ বলছেন : بلي হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলা এতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, বরং আঙ্গুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত যথাযথভাবে সুবিন্যস্ত করতে সক্ষম। এখানে বিশেষ করে আঙ্গুলের অগ্রভাগের কথা উল্লেখ করার কারণ হল : একজন মানুষের আঙ্গুলের অগ্রভাগের ছাপের সাথে অন্য মানুষের আঙ্গুলের ছাপের মিল নেই। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের এ সূক্ষ্ম পার্থক্যটুকুসহ নিয়ে আসতে সক্ষম।
এ আয়াতকে কেন্দ্র করে আবিস্কার করা হল (ফিঙ্গার প্রিন্ট) যা ব্যক্তিগত কাজে অপরাধীকে সনাক্তকরণে ব্যবহার করা হয়।
(لِيَفْجُرَ أَمَامَه۫) الفجور
-বলা হয় স্বেচ্ছায় মিথ্যা কথা বলাকে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : মানুষ বলে যে, খারাপ কাজ করতে থাকব, অতঃপর কিয়ামতের পূর্বে তাওবা করে নেব। (ইবনু কাসীর) তারপর আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের অবস্থা বর্ণনা করছেন।
(بَرِقَ الْبَصَرُ)
অর্থাৎ কিয়ামতের আতংকে চক্ষু খুলে স্থির হয়ে যাবে আর পলক পড়বে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَا تَحْسَبَنَّ اللّٰهَ غَافِلًا عَمَّا يَعْمَلُ الظّٰلِمُوْنَ إِنَّمَا يُؤَخِّرُهُمْ لِيَوْمٍ تَشْخَصُ فِيْهِ الْأَبْصَارُ)
“তুমি কখনও মনে কর না যে, জালিমরা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ গাফিল, নিশ্চয়ই তিনি তাদেরকে সেদিন পর্যন্ত অবকাশ দেন যেদিন চক্ষুসমূহ বিস্ফোরিত হবে।” (সূরা ইবরাহীম ১৪ : ৪২)
(خَسَفَ الْقَمَرُ)
অর্থাৎ চাঁদের আলো থাকবে না।
(وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ)
‘যখন সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে’ আজ পর্যন্ত চাঁদ ও সূর্য একত্রিত হয়নি। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা চাঁদকে আলোহীন আর সূর্যকে গুটিয়ে নিয়ে উভয়কে একত্রিত করবেন।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ وَإِذَا النُّجُوْمُ انْكَدَرَت)
“সূর্যকে যখন গুটিয়ে আলোহীন করা হবে, নক্ষত্ররাজি যখন খসে পড়বে।” (সূরা তাকভীর ৮১ : ১-২)
কিয়ামতের এ ভয়াবহ অবস্থা দেখে কাফিররা পলায়ন করার চেষ্টা করবে কিন্তু পলায়নের জায়গা কোথায়? পালানোর কোন জায়গা থাকবে না।
وزر অর্থ : এমন পাহাড় বা দুর্গকে বলা হয় যেখানে আশ্রয় গ্রহণ করা যায়। অর্থাৎ সেদিন কোন আশ্রয়স্থল থাকবেনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
( مَا لَكُمْ مِّنْ مَّلْجَإٍ يَّوْمَئِذٍ وَّمَا لَكُمْ مِّنْ نَّكِيْرٍ)
“যেদিন তোমাদের কোন আশ্রয়স্থল থাকবে না এবং তোমাদের জন্য তা প্রতিরোধকারী কেউ থাকবে না।” (সূরা শুয়ারা ৪২ : ৪৭)
(يُنَبَّؤُا الْإِنْسَانُ. . . )
“সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে, যা সে অগ্রে পাঠিয়েছে ও পশ্চাতে রেখে গেছে।” যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
(وَوَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِرًا ط وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا)
“তারা তাদের কৃতকর্ম সম্মুখে উপস্থিত পাবে; তোমার প্রতিপালক কারোর প্রতি জুলুম করেন না।” (সূরা কাহাফ ১৮ : ৪৭)
(بَصِيرَةٌ . . . . . وَّلَوْ أَلْقٰي مَعَاذِيرَه)
অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ তার কৃতকর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত যদিও সে নানা রকমের বাহানা বা অজুহাত পেশ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اِقْرَأْ كِتٰبَكَ ط كَفٰي بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيْبًا)
‘তুমি তোমার কিতাব পাঠ কর, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসেব-নিকাশের জন্য যথেষ্ট।’ (সূরা ইসরা ১৭ : ১৪)
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : যদিও মানুষ তাদের কৃত পাপ কাজ অস্বীকার করার জন্য বিতর্ক করবে কিন্তু সে ভাল করেই অবগত যে, এগুলো আমার দ্বারা কৃত অপরাধ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(ثُمَّ لَمْ تَكُنْ فِتْنَتُهُمْ إِلَّآ أَنْ قَالُوْا وَاللّٰهِ رَبِّنَا مَا كُنَّا مُشْرِكِيْنَ)
“অতঃপর (যখন তাদের শরীকদের সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তখন) তাদের এটা ছাড়া বলার অন্য কোন অজুহাত থাকবে না-‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহর শপথ! আমরা তো মুশরিকই ছিলাম না।” (সূরা আনআম ৬ : ২৩)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. نفس اللوامة
এর পরিচয় ও তিরস্কার করার কারণ জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে পুক্সক্ষানুপুক্সক্ষভাবে পুনরুত্থিত করতে সক্ষম।
৩. কিয়ামতের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানলাম।
৪. সেদিন মানুষ কৃত অপরাধ অস্বীকার করতে চাইবে, পলায়ন করতে চাইবে কিন্তু কোন পথ পাবে না।
9 Fozlur Rahman
যদিও সে তার (খারাপ কাজ ঢাকার জন্য) অজুহাত পেশ করতে চাইবে।
10 Mokhtasar Bangla
১৫. যদিও সে নিজের প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে এ বলে কৈফিয়ত উপস্থিত করে যে, সে কোন পাপ করে নি তবুও তা তার কোন উপকারে আসবে না।
11 Tafsir Ibn Kathir
১-১৫ নং আয়াতের তাফসীর
এটা কয়েকবার বর্ণনা করা হয়েছে যে, যে জিনিসের উপর শপথ করা হয় ওটা যদি প্রত্যাখ্যান করার জিনিস হয় তবে ওর পূর্বে لَا এ কালেমাটি নেতিবাচকের গুরুত্বের জন্যে আনয়ন করা বৈধ। এখানে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার উপর এবং অজ্ঞ লোকদের এর প্রত্যাখ্যানের উপর যে, কিয়ামত হবে না, শপথ করা হচ্ছে। মহান আল্লাহ তাই বলছেনঃ আমি শপথ করছি কিয়ামত দিবসের এবং আরো শপথ করছি তিরস্কারকারী আত্মার।
হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, কিয়ামতের কসম, এবং তিরস্কারকারী আত্মার কসম নয়। হযরত কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, দুটোরই কসম! হযরত হাসান (রঃ) ও হযরত আ’রাজ (রঃ)-এর কিরআতে لَا اُقْسِمُ بِيَوْمِ الْقِيَامَةِ রয়েছে। এর দ্বারাও হযরত হাসান (রঃ)-এর উক্তি প্রাধান্য পাচ্ছে। কেননা, তাঁর মতে প্রথমটির শপথ এবং দ্বিতীয়টির শপথ নয়। কিন্তু সঠিক উক্তি এই যে, আল্লাহ পাক দুটোরই শপথ করেছেন। যেমন হযরত কাতাদাহ (রঃ) বলেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের হতেও এটাই বর্ণিত আছে।
কিয়ামতের দিন সম্পর্কে সবাই অবহিত। نَفْس لَوَّامَة -এর তাফসীরে হযরত হাসান বসরী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এর দ্বারা মুমিনের নফস উদ্দেশ্য এটা সব সময় নিজেই নিজেকে তিরস্কার করতে থাকে যে, এটা কেন করলে? কেন এটা খেলে? কেন এই ধারণা মনে এলো? হ্যাঁ, তবে ফাসিকের নফস সদা উদাসীন থাকে। তার কি দায় পড়েছে যে, সে নিজের নফসকে তিরস্কার করবে?
এটাও বর্ণিত আছে যে, আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত মাখলূক কিয়ামতের দিন নিজেই নিজেকে তিরস্কার করবে। সৎকর্মশীল নফস সৎকর্মের স্বল্পতার জন্যে এবং অসৎকর্মশীল নফস অসৎকর্মের আবির্ভাবের কারণে নিজে নিজেকে ভৎসনা করবে। এ কথাও বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা নিন্দনীয় নফসকে বুঝানো হয়েছে, যা অবাধ্য নফস। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা ঐ নফস উদ্দেশ্য যা ছুটে যাওয়া জিনিসের উপর লজ্জিত হয় এবং তজ্জন্যে নিজেকে ভৎসনা করে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এ উক্তিগুলো ভাবার্থের দিক দিয়ে প্রায় একই ভাবার্থ এই যে, এটা ঐ নফস যা পুণ্যের স্বল্পতার জন্যে এবং দুষ্কার্য হয়ে যাওয়ার জন্যে নিজেই নিজেকে তিরস্কার করে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ মানুষ কি মনে করে যে, আমি তার অস্থিসমূহ একত্রিত করতে পারবো না? এটা তো তাদের বড়ই ভুল ধারণা। আমি ওগুলোকে বিভিন্ন জায়গা হতে একত্রিত করে পুনরায় দাঁড় করিয়ে দিবো এবং ওকে পূর্ণভাবে গঠিত করবো।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ আমি ওকে উট বা ঘোড়ার পায়ের পাতার মত বা খুরের মত বানিয়ে দিতে সক্ষম। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, ভাবার্থ হচ্ছেঃ দুনিয়াতেও ইচ্ছা করলে আমি তাকে এরূপ করে দিতে পারতাম। শব্দ দ্বারা তো বাহ্যতঃ এটাই জানা যাচ্ছে যে, قَادِرِيْنَ শব্দটি نَجْمَعُ হতে حَال হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ কি ধারণা করে যে, আমি তার অস্থিগুলো একত্রিত করবো না? হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্বরই আমি ওগুলো একত্রিত করবো। আমি তার অঙ্গুলীর অগ্রভাগ পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম। আমি ইচ্ছা করলে সে পূর্বে যা ছিল তার চেয়েও কিছু বেশী করে দিয়ে তাকে পুনরুত্থিত করতে পারবো। ইবনে কুতাইবাহ (রঃ) ও যাজ্জাজ (রঃ)-এর উক্তির অর্থ এটাই।
মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ মানুষ তার সামনে পাপকর্মে লিপ্ত হতে চায়। অর্থাৎ পদে পদে সে এগিয়ে চলেছে। বুকে আশা বেঁধে রয়েছে এবং বলছেঃ পাপকর্ম করে তো যাই, পরে তাওবা করে নিবো। তারা কিয়ামত দিবসকে, যা তাদের সামনে রয়েছে, অস্বীকার করছে। যেন সে তার মাথার উপর সওয়ার হয়ে আগে বেড়ে চলেছে। সদা-সর্বদা তাকে এ অবস্থাতেই পাওয়া যাচ্ছে যে, সে পদে পদে নিজেকে আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তবে যার উপর আল্লাহ পাক দয়া করেন সেটা স্বতন্ত্র কথা।
এই আয়াতের তাফসীরে পূর্ব যুগীয় অধিকাংশ মনীষীর উক্তি এটাই যে, সে পাপকার্যে তাড়াতাড়ি করছে এবং তাওবা করতে বিলম্ব করছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, অর্থ হলোঃ সে হিসাবের দিনকে অস্বীকার করছে। ইবনে যায়েদেরও (রঃ) এটাই উক্তি। এটাই বেশী প্রকাশমান ভাবার্থও বটে। কেননা, এরপরেই রয়েছেঃ সে প্রশ্ন করেঃ কখন কিয়ামত দিবস আসবে? তার এ প্রশ্নটি অস্বীকৃতিসূচক। তার বিশ্বাস তো এটাই যে, কিয়ামত সংঘটিত হওয়া অসম্ভব। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ وَ یَقُوْلُوْنَ مَتٰى هٰذَا الْوَعْدُ اِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ ـ قُلْ لَّكُمْ مِّیْعَادُ یَوْمٍ لَّا تَسْتَاْخِرُوْنَ عَنْهُ سَاعَةً وَّ لَا تَسْتَقْدِمُوْنَ
অর্থাৎ “তারা বলে- যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে বলঃ কিয়ামত কখন হবে? তুমি তাদেরকে বলে দাও – ওর জন্যে একটি নির্ধারিত সময় রয়েছে যা হতে তোমরা এক ঘন্টা আগেও বাড়তে পার না এবং পিছনেও সরতে পার না।” (৩৪:২৯-৩০)
এখানেও মহান আল্লাহ বলেনঃ যখন চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ لَا یَرْتَدُّ اِلَیْهِمْ طَرْفُهُمْ অর্থাৎ “নিজেদের প্রতি তাদের দৃষ্টি ফিরবে।" (১৪:৪৩) তারা ভয়ে ও সন্ত্রাসে চক্ষু ফেড়ে ফেড়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকবে। بَرِقَ শব্দটি অন্য পঠনে بَرَقَ রয়েছে। দুটোর অর্থ প্রায় একই।
আল্লাহ পাকের উক্তিঃ চন্দ্র হয়ে পড়বে জ্যোতিহীন। আর সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে। অর্থাৎ দুটোকেই জ্যোতিহীন করে জড়িয়ে নেয়া হবে। ইবনে যায়েদ (রঃ) এ আয়াতের তাফসীরে নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেছেনঃ
اِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ ـ وَ اِذَا النُّجُوْمُ انْكَدَرَتْ
অর্থাৎ “সূর্য যখন নিষ্প্রভ হবে এবং যখন নক্ষত্ররাজি খসে পড়বে।” (৮১:১-২) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কিরআতে وَجَمَعَ بَيْنَ الشَّمْسِ وَالْقَمَرِ রয়েছে।
মানুষ এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে বলবেঃ আজ পালাবার স্থান কোথায়? তখন আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে জবাব দেয়া হবেঃ না, কোন আশ্রয়স্থল নেই। এই দিন ঠাঁই হবে তোমার প্রতিপালকেরই নিকট। এ আয়াতটি নিম্নের আয়াতটির মতইঃ
مَا لَكُمْ مِّنْ مَّلْجَاٍ یَّوْمَئِذٍ وَّ مَا لَكُمْ مِّنْ نَّكِیْرٍ
অর্থাৎ “আজ না আছে তোমাদের জন্যে কোন আশ্রয়স্থল এবং না আছে এমন জায়গা যেখানে গিয়ে তোমরা অচেনা ও অপরিচিত হয়ে যাবে।” (৪২:৪৭)।
ঘোষিত হচ্ছেঃ সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে সে কী অগ্রে পাঠিয়েছে ও কী পশ্চাতে রেখে গেছে। যেমন মহান আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ
وَوَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِرًا وَّلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ اَحَدًا
অর্থাৎ তারা তাদের কৃতকর্ম সম্মুখে উপস্থিত পাবে। তোমার প্রতিপালক কারো প্রতি যুলুম করেন না।”
মহান আল্লাহ এখানে বলেনঃ বস্তুতঃ মানুষ নিজের সম্বন্ধে সম্যক অবগত, যদিও সে নানা অজুহাতের অবতারণা করে। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ
اِقْرَاْ كِتٰبَكَ كَفٰى بِنَفْسِكَ الْیَوْمَ عَلَیْكَ حَسِیْبًا
অর্থাৎ “তুমি তোমার কিতাব (আমলনামা) পাঠ কর, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব নিকাশের জন্যে যথেষ্ট।” (১৭:১৪) তার চক্ষু-কৰ্ণ, হাত, পা এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। বড়ই আফসোসের বিষয় যে, সে অন্যদের দোষ-ত্রুটি দেখতে রয়েছে, আর নিজের দোষ-ত্রুটি সম্বন্ধে রয়েছে সম্পূর্ণ উদাসীন! বলা হয় যে, তাওরাতে লিখিত রয়েছেঃ “হে আদম সন্তান! তুমি তোমার ভাই এর চোখের খড়-কুটা দেখতে পাচ্ছ, অথচ তোমার নিজের চোখের তীরটিও দেখতে পাচ্ছ না?”
কিয়ামতের দিন মানুষ বাজে বাহানা, মিথ্যা প্রমাণ এবং নিরর্থক ওর পেশ করবে, কিন্তু তার একটি ওযরও গৃহীত হবে না।
وَلَوْ اَلْقٰى مَعَاذِيْرَةٌ-এর আর একটি ভাবার্থ বর্ণনা করা হয়েছে। তা হলোঃ যদিও সে পর্দা ফেলে দেয়। ইয়ামনবাসী পর্দাকে عِذَار বলে থাকে। কিন্তু উপরের অর্থটিই সঠিকতর। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
ثُمَّ لَمْ تَكُنْ فِتْنَتُهُمْ اِلَّاۤ اَنْ قَالُوْا وَ اللّٰهِ رَبِّنَا مَا كُنَّا مُشْرِكِیْنَ
অর্থাৎ “কোন জ্ঞান সম্মত ওযর পেশ করতে না পেরে তার নিজেদের শিরককে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে বলবেঃ আল্লাহর কসম, আমরা মুশরিকই ছিলাম না।" (৬:২৩) আল্লাহ পাক আর এক জায়গায় বলেনঃ
یَوْمَ یَبْعَثُهُمُ اللّٰهُ جَمِیْعًا فَیَحْلِفُوْنَ لَهٗ كَمَا یَحْلِفُوْنَ لَكُمْ وَ یَحْسَبُوْنَ اَنَّهُمْ عَلٰى شَیْءٍ اَلَاۤ اِنَّهُمْ هُمُ الْكٰذِبُوْنَ
অর্থাৎ “যেদিন আল্লাহ তাদের সকলকে পুনরুত্থিত করবেন তখন তারা তাঁর সামনে শপথ করে করে নিজেদেরকে সত্যবাদী বানাতে চাইবে, যেমন আজ দুনিয়ায় তোমাদের সামনে মিথ্যা কসম খাচ্ছে, তারা নিজেদেরকে কিছু একটা মনে করছে, কিন্তু আল্লাহ নিশ্চিতরূপে জানেন যে, তারা মিথ্যাবাদী।" মোটকথা, কিয়ামতের দিন তাদের ওযর-আপত্তি তাদের কোনই উপকারে আসবে না। যেমন আল্লাহ তা'আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ
لَا یَنْفَعُ الظّٰلِمِیْنَ مَعْذِرَتُهُمْ
অর্থাৎ “সীমালংঘনকারীদের ওযর-আপত্তি তাদের কোন কাজে আসবে না।” (৪০:৫২) তারা তো শিরকের সাথে সাথে নিজেদের সমস্ত দুষ্কর্মকেই অস্বীকার করে ফেলবে, কিন্তু সবই বৃথা হবে। তাদের ঐ অস্বীকৃতি তাদের কোনই উপকারে আসবে না।