৬৫-৬৬ নং আয়াতের তাফসীরঃ
এ আয়াতে মু’মিনদেরকে আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদ করার প্রতি প্রেরণা দেয়ার ব্যাপারে নাবী (সাঃ) কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআন ও সহীহ হাদীসে জিহাদের প্রেরণামূলক অনেক বর্ণনা রয়েছে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنَّ اللہَ اشْتَرٰی مِنَ الْمُؤْمِنِیْنَ اَنْفُسَھُمْ وَاَمْوَالَھُمْ بِاَنَّ لَھُمُ الْجَنَّةَﺚ یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللہِ فَیَقْتُلُوْنَ وَیُقْتَلُوْنَﺤ وَعْدًا عَلَیْھِ حَقًّا فِی التَّوْرٰٿةِ وَالْاِنْجِیْلِ وَالْقُرْاٰنِﺚ وَمَنْ اَوْفٰی بِعَھْدِھ۪ مِنَ اللہِ فَاسْتَبْشِرُوْا بِبَیْعِکُمُ الَّذِیْ بَایَعْتُمْ بِھ۪ﺚ وَذٰلِکَ ھُوَ الْفَوْزُ الْعَظِیْمُ)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের নিকট হতে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে স্বসস্ত্র যুদ্ধ করে, হত্যা করে ও নিহত হয়। তাওরাত, ইন্জীল ও কুরআনে এ সম্পর্কে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্র“তি রয়েছে। নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর কে আছে? তোমরা যে সওদা করেছ সে সওদার জন্য আনন্দিত হও আর এটাই মহাসাফল্য।”(সূরা তাওবাহ ৯:১১১)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় একমাত্র জিহাদ করার উদ্দেশ্যে বের হবে, আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিশ্বাস রেখে এবং রাসূলগণকে সত্য বলে জানবে সে আল্লাহ তা‘আলার যিম্মায়, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন অথবা যে বাড়ি থেকে বের হয়েছে প্রতিদান ও গনীমতসহ সেখানে ফিরিয়ে আনবেন। তারপর বলেন: সে সত্তার শপথ করে বলছি যার হাতে আমার প্রাণ! যদি মুসলিমদের কষ্ট না হত তাহলে আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় যত জিহাদ হয় তার একটি হতেও পিছপা হতাম না। কিন্তু আমি এমন কোন বাহন পাই না যা মুসলিমদের দেব এবং তাদের কাছেও এমন কোন বাহন নেই যে তারা আমার অনুসরণ করবে। আমাকে ছেড়ে তারা সন্তুষ্ট মনে বসেও থাকতে পারবে না। যার হাতে মুহাম্মাদের আত্মা রয়েছে তাঁর শপথ! আমার ইচ্ছা হয় আমি আল্লাহ তা‘আলার পথে জিহাদ করে শহীদ হই, আবার জিহাদ করি আবার শহীদ হই, আবার জিহাদ করি আবার শহীদ হই। (সহীহ মুসলিম হা: ১৮৭৬, ইবনু মাযাহ হা: ২৭৫২)
পক্ষান্তরে যারা দুনিয়ার ধন-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদির মায়া ছেড়ে জিহাদে যেতে পারে না, তাদের তিরস্কার করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ اِنْ کَانَ اٰبَا۬ؤُکُمْ وَاَبْنَا۬ؤُکُمْ وَاِخْوَانُکُمْ وَاَزْوَاجُکُمْ وَعَشِیْرَتُکُمْ وَاَمْوَالُ اۨقْتَرَفْتُمُوْھَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ کَسَادَھَا وَمَسٰکِنُ تَرْضَوْنَھَآ اَحَبَّ اِلَیْکُمْ مِّنَ اللہِ وَرَسُوْلِھ۪ وَجِھَادٍ فِیْ سَبِیْلِھ۪ فَتَرَبَّصُوْا حَتّٰی یَاْتِیَ اللہُ بِاَمْرِھ۪ﺚ وَاللہُ لَا یَھْدِی الْقَوْمَ الْفٰسِقِیْنَ)
“বল: ‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের পতœী, তোমাদের স্বগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত’ আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।”(সূরা তাওবাহ ৯:২৪)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের সুসংবাদ দিচ্ছেন যে, তোমাদের মধ্যে যদি দৃঢ়তার সাথে বিশজন যুদ্ধ করে তাহলে কাফিরদের দু’শত জন সৈন্যের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারবে। আর একশত জন হলে তাদের এক হাজার জনের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারবে।
(الْاٰنَ خَفَّفَ اللّٰهُ عَنْكُمْ)
‘আল্লাহ এখন তোমাদের ভার লাঘব করলেন।’অর্থাৎ পূর্বের বিধান মু’মিনদের ওপর কঠিন ছিল। তার মানে হল একশত জন মুসলিম বাহিনী থাকলে এক হাজার কাফিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আবশ্যক। এখন আল্লাহ তা‘আলা হালকা করে দিলেন যে, একশত জন ধৈর্যের সাথে জিহাদ করলে দুইশত জনের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারবে। অর্থাৎ প্রতি একজন মুসলিম দু’জন কাফিরের সমান। মূলত আয়াতের এ অংশটুকু জিহাদের প্রতি প্রেরণা দিচ্ছে।
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাঃ) খন্দকের দিকে বের হলেন, হিম শীতল সকালে আনসার ও মুহাজিররা পরিখা খনন করছেন, আর তাদের এ কাজ করার জন্য তাদের কোন কর্মচারী ছিল না। যখন তিনি তাদের দেখতে পেলেন যে, তারা কষ্ট এবং ক্ষুধায় আক্রান্ত, তখন বললেন:
اللّٰهُمَّ إِنَّ العَيْشَ عَيْشُ الآخِرَةِ، فَاغْفِرْ لِلْأَنْصَارِ وَالمُهَاجِرَةِ
হে আল্লাহ! সুখের জীবন তো আখিরাতের জীবন। তুমি আনসার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করে দাও। এর উত্তরে তারা বললেন:
نَحْنُ الَّذِينَ بَايَعُوا مُحَمَّدَا ... عَلَي الجِهَادِ مَا بَقِينَا أَبَدَا
আমরা সেই ব্যক্তি যারা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর হাতে জিহাদের বাইয়াত গ্রহণ করেছি, যতদিন আমরা জীবিত আছি। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৩৪, সহীহ মুসলিম হা: ১৮০৫)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(مِّائَةٌ صَابِرَةٌ یَّغْلِبُوْا مِائَتَیْنِ)
‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে একশত জন ধৈর্যশীল থাকলে (কাফিরদের) দু’শত জনের ওপর বিজয়ী হবে।’ যখন অবতীর্ণ হল। তখন দশজন কাফিরের বিপরীত একজন মুসলিম থাকলেও পলায়ন না করা ফরয করে দেয়া হল। সুফইয়ান ইবনু উয়াইনাহ (রাঃ) আবার বর্ণনা করেন, দু’শ জন কাফিরের বিপক্ষে বিশজন মুসলিম থাকলেও পলায়ন করা যাবে না। তারপর এ আয়াতটি নাযিল হল- ‘আল্লাহ তা‘আলা এখন তোমাদের বোঝা হালকা করে দিয়েছেন এবং তিনি জানেন যে, তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা আছে। সুতরাং যদি তোমাদের মধ্যে একশ’জন দৃঢ়পদ লোক থাকে তবে তারা দু’শজনের ওপর জয়লাভ করবে আর তোমাদের মধ্যে একহাজার থাকলে তারা দু’জাহারের ওপর জয়লাভ করবে। আর আল্লাহ তা‘আলা আছেন দৃঢ়পদ লোকেদের সঙ্গে।......হাদীসের শেষ পর্যন্ত। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৫২, ৪৬৫৩)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আলিমদের উচিত নাবী (সাঃ)-এর ওয়ারিশ হিসেবে মু’মিনদেরকে সঠিক পন্থায় জিহাদের প্রতি অনুপ্রেরণা দেয়া এবং নিজেরাও শরীক হওয়া।
২. স্থান, কাল ও পাত্রভেদে মু’মিনদের জিহাদের অংশগ্রহণ করা আবশ্যক।
৩. যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়পদে অটল থাকা আবশ্যক।
৪. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।