মুমিন পুরুষ এবং মুমিনা নারীদের জন্যে আল্লাহ তাআলা যে কল্যাণ ও চিরস্থায়ী নিয়ামতরাজি প্রস্তুত রেখেছেন, এখানে তিনি তারই বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি তাদের জন্যে এমন জান্নাতসমূহ তৈরী করে রেখেছেন যেগুলোর নিম্নদেশে নির্মল পানির প্রস্রবণ বইতে থাকে। সেখানে রয়েছে সুউচ্চ, সুন্দর, ঝকঝকে এবং সাজসজ্জাপূর্ণ প্রাসাদসমূহ! যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “দু’টি জান্নাত শুধু সোনার তৈরী, ও দু'টির পাত্র এবং ও দুটির মধ্যে যা কিছু রয়েছে সবই সোনার তৈরী। আর দুটি জান্নাত রয়েছে রূপার তৈরী, ও দু’টির পাত্র এবং অন্য যা কিছু রয়েছে সবই রূপার তৈরী । তারা (জান্নাতবাসীরা) তাদের প্রতিপালকের দিকে এমন অবস্থায় তাকাবে যে, তাঁর চেহারার ঔজ্জ্বল্যময় চাদর ছাড়া অন্য কোন পর্দা থাকবে না। এটা আদন নামক জান্নাতের মধ্যে হবে।” অন্য হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, মুমিনদের জন্যে জান্নাতে একটি তাবু থাকবে যা একটি মাত্র মুক্তা দ্বারা নির্মিত হবে। ওর দৈর্ঘ্য হবে ষাট মাইল। সেখানে মুমিনদের স্ত্রীরা থাকবে যাদের কাছে তারা যাতায়াত করবে, কিন্তু তারা একে অপরকে দেখতে পাবে না।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর উপর ঈমান এনেছে, সালাত কায়েম করেছে ও রমযানের রোযা রেখেছে, আল্লাহ তা'আলার উপর এ হক রয়েছে যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করাবেন, সে হিজরত করে থাকুক বা বাড়ীতে বসেই থাকুক।”
লোকেরা জিজ্ঞেস করলোঃ “আমরা অন্যদেরকেও এ হাদীস শুনিয়ে দিবো কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “জান্নাতে একটি শ্রেণী রয়েছে, যেগুলোকে আল্লাহ তার পথে জিহাদকারীদের জন্যে বানিয়েছেন। প্রতি দু’শ্রেণীর মাঝে এতোটা দূরত্ব রয়েছে যতটা দূরত্ব রয়েছে আসমান ও যমীনের মাঝে। সুতরাং যখনই তোমরা আল্লাহর কাছে জান্নাতের জন্যে প্রার্থনা করবে তখন জান্নাতুল ফিরদাউসের জন্যে প্রার্থনা করবে। ওটা সবচেয়ে উঁচু ও সর্বাপেক্ষা উত্তম জান্নাত। জান্নাতসমূহের সমস্ত নহর ওখান থেকেই বের হয়। ওর উপরেই রহমানের (আল্লাহর) আরশ রয়েছে।”
সাহল ইবনে সাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতবাসীরা জান্নাতী প্রাসাদগুলোকে ঐরূপ দেখবে যেরূপ তোমরা আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো দেখে থাকো।” প্রকাশ থাকে যে, জান্নাতে একটি সুউচ্চ স্থান রয়েছে, যাকে ‘ওয়াসীলা' বলা হয়, যা আরশের নিকটবর্তী স্থানে রয়েছে। ওটাই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জান্নাতের বাসস্থান। যেমন আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন তোমরা আমার উপর দুরূদ পাঠ করবে তখন আল্লাহর কাছে আমার জন্যে ‘ওয়াসীলা’ চাইবে।” জিজ্ঞেস করা হলোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ‘ওয়াসীলা' কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “ওটা হচ্ছে জান্নাতের একটি উচ্চতম শ্রেণী (প্রকোষ্ঠ), যা একটি মাত্র লোক লাভ করবে। আমি প্রবল আশা রাখি যে, ঐ লোকটি আমিই।” আমর ইবনুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “যখন তুমি মুআযযিনের আযান শুনবে তখন যে শব্দগুলো সে উচ্চারণ করে তুমিও সেগুলো উচ্চারণ করবে। অতঃপর তোমরা আমার প্রতি দুরূদ পাঠ করবে। যে ব্যক্তি আমার উপর দুরূপ পাঠ করে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি দশটি রহমত নাযিল করেন। অতঃপর আমার জন্যে ওয়াসীলা চীও। এটা জান্নাতের এমন একটি মনযিল যা আল্লাহ তা'আলার সমস্ত সৃষ্টির মধ্য হতে একটি মাত্র লোক লাভ করবে। আমি আশা রাখি যে, ওটা আমাকেই দান করা হবে। যে ব্যক্তি আমার জন্যে এ ওয়াসীলা চাবে তার জন্যে কিয়ামতের দিন। আমার শাফাআত বৈধ হবে। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) আবূ হুরাইরা (রঃ) হতে তাখরীজ
করেছেন)
ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা আমার জন্যে ওয়াসীলা যাঞা কর। যে কেউ আমার জন্যে ওয়াসীলা যা করবে, কিয়ামতের দিন আমি তার সাক্ষী ও সুপারিশকারী হবো।”
আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের কাছে জান্নাতের বর্ণনা দিন! ওর ভিত্তি কোন জিনিসের হবে? তিনি উত্তরে বললেনঃ “ওর ভিত্তি হবে স্বর্ণ ও রৌপ্যের ইটের। ওর গারা হবে খাঁটি মিশক। ওর কংকর হবে মুক্তা ও ইয়াকূত। ওর মাটি হবে জাফরান। সেখানে যে যাবে সে ঐ সুখ সম্ভোগের মধ্যে থাকবে যা কখনও শেষ হবে না। সেখানে সে চিরস্থায়ী জীবন লাভ করবে, যার পরে মৃত্যুর কোন ভয় নেই। না তার কাপড় খারাপ হবে, না যৌবনে কোন ভাটা পড়বে।” আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা বলেনঃ “জান্নাতে এমন প্রকোষ্ঠ বা কক্ষ রয়েছে যার ভিতরের অংশ বাহির থেকে দেখা যাবে এবং বাইরের অংশ ভিতর থেকে দেখা যাবে।” একথা শুনে একজন বেদুইন উঠে জিজ্ঞেস করেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এ প্রকোষ্ঠ কার জন্যে?" রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “যে ভাল কথা বলে, খানা খেতে দেয়, রোযা রাখে এবং রাত্রে লোকদের দ্রিা অবস্থায় (তাহাজ্জুদের) সালাত আদায় করে।”
উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “জান্নাতের আকাক্ষী এবং ওর জন্যে পরিশ্রমকারী কেউ আছে কি? জান্নাতকে সীমাবদ্ধকারী ওর চতুপার্শ্বে কোন প্রাচীর নেই। কা'বার প্রতিপালকের (আল্লাহর) শপথ! ওটা তো উজ্জ্বল নূর, সুগন্ধময় ফুলের বাগান, সুউচ্চ ও চাকচিক্যময় প্রাসাদ, তরঙ্গযুক্ত প্রবহমান নদী, পরিপুষ্ট ও পাকা পাকা ফলের গুচ্ছ, সুন্দর দেহ বিশিষ্টা ও পবিত্র চরিত্রের অধিকারিণী হুর, মূল্যবান রঙ্গীন রেশমী পোশাক, চিরস্থায়ী স্থান, শান্তি নিকেতন, ফল মূল, সবুজ শ্যামল পরিবেশ, প্রশস্ততা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, নিয়ামত, রহমত এবং সুউচ্চ ও সুদৃশ্য প্রাসাদ।” এ কথা শুনে জনগণ বলে উঠলেনঃ “হ্যা, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা এই জান্নাতের আকাঙ্ক্ষী ও এর জন্যে পরিশ্রমকারী।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদেরকে বললেনঃ “ইনশাআল্লাহ বল। লোকেরা তখন ইনশাআল্লাহ বললেন। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন)
আল্লাহর সন্তুষ্টি হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় (নিয়ামত)- অর্থাৎ তাদের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি যা তাদের সমুদয় ভোগ্য বস্তু অপেক্ষা বড় ও মর্যাদাপূর্ণ। মুসনাদে আহমাদে আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহা মহিমান্বিত আল্লাহ জান্নাত বাসীদেরকে ডাক দিয়ে বলবেনঃ “হে জান্নাতবাসীরা!” তখন তারা (সমস্বরে) বলে উঠবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার দরবারে হাযির আছি। আপনার হাতেই কল্যাণ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তখন বলবেনঃ “তোমরা সন্তুষ্ট হয়েছো কি?” তারা উত্তরে বলবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! কেন আমরা সন্তুষ্ট হবো না? অথচ আপনি আমাদেরকে এমন জিনিসই দান করেছেন যা আপনার সৃষ্টির মধ্যে আর কাউকেই দান করেননি।” আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞেস করবেনঃ “এর চেয়ে উত্তম জিনিস কি আমি তোমাদেরকে দান করবো না?” তারা জবাব দেবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! এর চেয়ে উত্তম জিনিস আর কি আছে?” আল্লাহ তা'আলা বলবেনঃ “হ্যা, হ্যা আছে, জেনে রেখো যে, আমি তোমাদের উপর আমার সন্তুষ্টি নাযিল করলাম । আজকের পর আমি তোমাদের উপর কখনো অসন্তুষ্ট হব না।”
জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, জান্নাতবাসীরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন মহিমান্বিত আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেনঃ “তোমরা আর কিছু চাও কি? চাইলে আমি অতিরিক্ত আরো দেবো।" তারা উত্তরে বলবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদেরকে যা দিয়েছেন এর চেয়ে উত্তম আর কি হতে পারে?” আল্লাহ তা'আলা তখন বলবেনঃ “ওটা হচ্ছে আমার সন্তুষ্টি, যা সবচেয়ে বড় (নিয়ামত)।” ইমাম হাফিজ যিয়া মাকদিসি (রঃ) জান্নাতের বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ বর্ণনায় একটি নির্ভরযোগ্য কিতাব লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেনঃ “এ হাদীসটি আমার নিকট সহীহ এর শর্তের উপর রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।