৪৮-৫২ নং আয়াতের তাফসীর:
কাফির-মুশরিকদের হঠকারিতার অন্যতম একটি দিক হল তারা কিয়ামতকে অসম্ভব মনে করে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলে; তুমি আমাদেরকে যে কিয়ামতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছো তা কখন হবে? মূলত তারা এ কথার দ্বারা রাসূলের সাথে ঠাট্টা করত এবং কিয়ামত দিবসকে বিশ্বাস করত না। কিন্তু তারা যে উদ্দেশ্যে তা দ্রুত কামনা করছে তা হাসিল হবে না এবং তা তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাদের উচিত ছিল কিয়ামত দিবসকে ভয় করা এবং তার প্রতি ঈমান আনা। যেমন মু’মিনরা করে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يَسْتَعْجِلُ بِهَا الَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ بِهَا ج وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مُشْفِقُوْنَ مِنْهَا لا وَيَعْلَمُوْنَ أَنَّهَا الْحَقُّ)
“যারা এর প্রতি বিশ্বাস করে না তারাই এটার (কিয়ামত) জন্য তড়িঘড়ি করে। আর যারা বিশ্বাসী তারা একে ভয় করে এবং জানে যে, এটা সত্য।” (সূরা শুরা ৪২:১৮)
মুশরিকরা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে দ্রুত শাস্তি নিয়ে আসার জন্য যেভাবে আবেদন করত তারই উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা বলে দিচ্ছেন, হে নাবী! তুমি বলে দাও অন্য কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ করা তো দূরের কথা আমি তো নিজেরই কোন উপকার বা ক্ষতির মালিক নই; এমনকি শাস্তিকে আগ-পিছ করার ক্ষমতাও রাখি না। তবে হ্যাঁ, এসব ক্ষমতা আল্লাহ তা‘আলার হাতে এবং তিনি নিজের ইচ্ছামত কাউকে কল্যাণ বা অকল্যাণ দান করার ফায়সালা করেন বা শাস্তিকে যেকোন সময় নিয়ে আসতে পারেন।
সুতরাং উপরোক্ত বক্তব্য থেকে বুঝা যাচ্ছে, যেখানে নাবী-রাসূলগণ কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ করার মালিক নন সেখানে সাধারণ মানুষ বা তথাকথিত ভণ্ড বাবা, পীর, গাউস কুতুবরা মানুষের দুঃখ-কষ্ট কিভাবে দূর করতে পারবে? অথবা যার সন্তান হয় না তার সন্তান দিতে পারবে? তাহলে এ কথা যে ভ্রান্ত তা-কি এ আয়াতগুলো প্রমাণ করে না? সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, যারা এরূপ দাবী করে তারা মিথ্যা বলে। এ সমস্ত লোকদের কাছে তো কিছু চাওয়া যাবেই না এমনকি রাসূলের কাছেও যদি এমন জিনিস চাওয়া হয় তাহলেও তা শির্ক হবে যা সম্পূর্ণরূপে হারাম।
তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা সকল উম্মাতের জন্য একটি সময় নির্ধারিত রেখেছেন। সেই নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু যখন সেই নির্ধারিত সময় এসে যায় তখন এক মুর্হূতও আগ-পিছ হয় না। যেমন
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَا تَسْبِقُ مِنْ أُمَّةٍ أَجَلَهَا وَمَا يَسْتَأْخِرُوْنَ)
“কোন জাতি তার নির্দিষ্ট সময়কে অতিক্রম করতে পারে না, বিলম্বিতও করতে পারে না।” (সূরা হিজর ১৫:৫)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(إِنَّ أَجَلَ اللّٰهِ إِذَا جَا۬ءَ لَا يُؤَخَّرُ ﻣ لَوْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সময় উপস্থিত হলে তা বিলম্বিত হয় না, যদি তোমরা এটা জানতে!” (সূরা নূহ ৭১:৪)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের এই তাড়াহুড়া দেখে বলছেন, যদি দিবাভাগে বা রাত্রিকালে কোন এক সময় হঠাৎ শাস্তি এসেই পড়ে তখন কি করবে? কাজেই তাড়াতাড়ি করছ কেন?
যদি শাস্তি এসেই পড়ে তখন কি ঈমান আনবে? তখন আর ঈমান আনয়নের সময় থাকবে না। যখন তাদের কাছে শাস্তি এসে যাবে তখন তাদেরকে বলা হবে যে শাস্তির ব্যাপারে তাড়াহুড়া করছিলে তা আস্বাদন কর। শাস্তি এসে গেলে তারা বলে, আমরা ঈমান আনলাম। যেমন
ফির‘আউন সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(حثج اِذَآ اَدْرَکَھُ الْغَرَقُﺫ قَالَ اٰمَنْتُ اَنَّھ۫ لَآ اِلٰھَ اِلَّا الَّذِیْٓ اٰمَنَتْ بِھ۪ بَنُوْٓا اِسْرَا۬ءِیْلَ وَاَنَا مِنَ الْمُسْلِمِیْنَﮩاٰ۬لْئٰنَ وَقَدْ عَصَیْتَ قَبْلُ وَکُنْتَ مِنَ الْمُفْسِدِیْنَﮪ)
“পরিশেষে যখন সে ডুবতে শুরু করল তখন বলল: ‘আমি ঈমান এনেছি যে, তিনি ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই যাঁর প্রতি ঈমান এনেছে বানী ইসরাঈল এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ ‘এখন! ইতোপূর্বে তো তুমি অমান্য করেছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।” (সূরা ইউনুস ১০:৯০-৯১) কিন্তু তাদের ঈমান তখন আর কোন কাজে আসবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَمَّا رَاَوْا بَاْسَنَا قَالُوْٓا اٰمَنَّا بِاللہِ وَحْدَھ۫ وَکَفَرْنَا بِمَا کُنَّا بِھ۪ مُشْرِکِیْنَﮣ فَلَمْ یَکُ یَنْفَعُھُمْ اِیْمَانُھُمْ لَمَّا رَاَوْا بَاْسَنَاﺚ سُنَّةَ اللہِ الَّتِیْ قَدْ خَلَتْ فِیْ عِبَادِھ۪ﺆ وَخَسِرَ ھُنَالِکَ الْکٰفِرُوْنَﮤﺟ)
“অতঃপর যখন তারা আমার শাস্তি প্রত্যক্ষ করল তখন বললোঃ আমরা এক আল্লাহতেই ঈমান আনলাম এবং আমরা তাঁর সাথে যাদেরকে শরীক করতাম তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলাম। তারা যখন আমার শাস্তি প্রত্যক্ষ করল তখন তাদের ঈমান তাদের কোন উপকারে আসল না। আল্লাহর এই বিধান পূর্ব হতেই তাঁর বান্দাদের মধ্যে চলে আসছে এবং সে ক্ষেত্রে কাফিররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” (সূরা মু’মিন ৪০:৮৪-৮৫)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ السَّيِّاٰتِ ج حَتّٰي إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّيْ تُبْتُ الْئٰنَ)
“আর তাদের জন্য কোন তাওবাহ কবূল করা হয় না যারা পাপ কাজ করতেই থাকে এমনকি তাদের নিকট যখন মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন সে বলে আমি এখন তাওবাহ করছি।” (সূরা নিসা ৪:১৮)
সুতরাং যারা ঈমান আনবে তাদের উচিত শাস্তি প্রকাশ পাবার পূর্বেই ঈমান নিয়ে আসা। শাস্তি শুরু হয়ে গেলে ঈমান দ্বারা আর কোন ফায়দা লাভ করা যাবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামত একদিন অবশ্যই সংঘটিত হবে।
২. আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি এসে গেলে কেউ তা ঠেকাতে পারবে না।
৩. আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কারো কাছে কোন কিছু চাওয়া যাবে না।
৪. প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের একটি নির্ধারিত সময় রয়েছে, এই সময়ের পূর্বে কেউ মৃত্যুবরণ করবে না।
৫. শাস্তির ব্যাপারে তাড়াহুড়া করা ঠিক নয়।
৭. শাস্তি প্রকাশ পাবার পূর্বেই ঈমান আনতে হবে।