৫৯-৬০ নং আয়াতের তাফসীর:
ইবনে আব্বাস (রাঃ), মুজাহিদ (রঃ), যহ্হাক (রঃ), কাতাদা (রঃ), আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) প্রমুখ মনীষীগণ বলেন যে, মুশরিকরা কতকগুলো জন্তুকে ‘বাহায়ের ‘সাওয়ায়েব' এবং ‘আসায়েল’ নামে নামকরণ করে কোনটাকে নিজেদের উপর হালাল এবং কোনটাকে হারাম করে নিতো, এখানে এটাকেই খণ্ডন করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ “জমি হতে যা উৎপন্ন হয় এবং যেসব পশুর জন্ম হয়, তা থেকে তারা একটা অংশ আল্লাহর জন্যে নির্ধারণ করে।”
আবুল আহওয়াস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি হচ্ছেন আউফ ইবনে মালিক ইবনে নালা, তিনি তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট গমন করি। ঐ সময় আকৃতি ও পোশাক পরিচ্ছদের দিক দিয়ে আমার অবস্থা ভাল ছিল না। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমার কি কোন ধন-সম্পদ নেই?” আমি উত্তরে বললামঃ হ্যা আছে। তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেনঃ “কি মাল আছে?” আমি জবাব দিলামঃ সর্বপ্রকারের মাল রয়েছে। যেমন, উট, দাসদাসী, ঘোড়া এবং বকরী। তখন তিনি বলেনঃ “যখন তিনি তোমাকে মালধন দান করেছেন, তখন তিনি তার নিদর্শন তোমার উপর দেখতে চান।" অতঃপর তিনি বললেনঃ “তোমাদের উস্ত্রীর বাচ্চা হয়। ওর সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভাল ও নিখুঁত হয়। কিন্তু তোমরাই ক্ষুর উঠিয়ে নিয়ে ওর কান কেটে দিয়ে থাকো। আর এটাকে বলে থাকো ‘বাহায়ের'? তোমরা ওর চামড়া চিরে দাও এবং ওকে বলে থাকো সরম। তোমরা এগুলো নিজেদের উপরও হারাম করে নাও এবং পরিবারবর্গের জন্যেও। এটা সত্য নয় কি?” আমি বললামঃ হ্যাঁ, সত্য। এরপর তিনি বললেনঃ “জেনে রেখো যে, আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে যা কিছু দান করেছেন, তা সর্বসময়ের জন্যে হালাল। কখনও তা হারাম হতে পারে না। আল্লাহর হাত তোমাদের হাত অপেক্ষা অনেক বেশী শক্তিশালী। আল্লাহর চাকু তোমাদের চাকু অপেক্ষা বহুগুণে তীক্ষ্ণ।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আল্লাহ তাআলা ঐ লোকদের প্রতি নিজের কঠিন অসন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করছেন, যারা তাঁর হালালকে নিজেদের উপর হারাম করে নেয় এবং তাঁর হারামকে নিজেদের জন্যে হালাল বানিয়ে নেয়। আর এটা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত মত ও প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করেই করে থাকে, যার কোন দলীল নেই।
এরপর আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে কিয়ামত দিবসের শাস্তি হতে ভয় প্রদর্শন করছেন। তিনি বলছেন, যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে, কিয়ামতের দিন আমি তাদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করবো এ সম্পর্কে তাদের ধারণা কি?
اِنَّ اللّٰهَ لَذُوْ فَضْلٍ عَلَى النَّاسِ অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ লোকদের উপর বড়ই অনুগ্রহশীল। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এটা ছেড়ে দেয়ার মধ্যে যেন দুনিয়াতেই তাদেরকে শাস্তি দিয়ে চিকিৎসা করা উদ্দেশ্য। আমি বলি- এটাও উদ্দেশ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা লোকদের উপর বড়ই অনুগ্রহশীল। কেননা, তিনি দুনিয়ায় তাদের জন্যে এমন বহু জিনিস হালাল করেছেন, যেগুলো পেয়ে তারা আনন্দিত হয় এবং তাদের জন্যে সেগুলো উপকারী। পক্ষান্তরে তিনি মানুষের জন্যে এমন জিনিস হারাম করেছেন, যেগুলো তাদের জন্যে সরাসরি ক্ষতিকর ছিল। এটা হয় দ্বীনের দিক দিয়েই হাক, না হয় দুনিয়ার দিক দিয়েই হাক। কিন্তু অধিকাংশ লোকই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। অর্থাৎ তারা আল্লাহর দেয়া নিয়ামতগুলো নিজেদের উপর হারাম করে নিচ্ছে এবং নফসের উপর সংকীর্ণতা আনয়ন করছে। এটা এইরূপে যে, নিজেদের পক্ষ থেকে কোন জিনিস হালাল করছে এবং কোন জিনিস হারাম করছে। মুশরিকরা এটাকে নিজেদের মধ্যে বহুল পরিমাণে প্রকাশ করেছে এবং একরূপ পন্থাই বানিয়ে নিয়েছে। যদিও আহলে কিতাবের মধ্যে এটা ছিল না, কিন্তু এখন তারাও এই বিদআত চালু করে দিয়েছে। মূসা ইবনে সাবাহ হতে, اِنَّ اللّٰهَ لَذُوْ فَضْلٍ عَلَى النَّاسِ -এই উক্তির ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে, কিয়ামতের দিন তিন প্রকারের আল্লাহওয়ালা লোককে পেশ করা হবে। আল্লাহ তা'আলা তাদের মধ্যে প্রথম প্রকারের লোককে জিজ্ঞেস করবেনঃ “হে আমার বান্দা! কি উদ্দেশ্যে তুমি ভাল কাজ করেছিলে?" উত্তরে সে বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনি জান্নাত তৈরী করেছেন এবং তার মধ্যে বাগান, ফলমূল, বৃক্ষলতা, নদ-নদী, হুর ও প্রাসাদ এবং অনুগত বান্দাদের জন্যে সর্বপ্রকারের নিয়ামত সরবরাহ করে রেখেছেন। ঐগুলো লাভ করার আশাতেই আমি রাত্রি জেগে জেগে আপনার ইবাদত করেছি ও সারা দিন রোযা রেখেছি।” তখন আল্লাহ তা'আলা বলবেনঃ “তুমি যখন জান্নাত লাভের আশাতেই এসব আমল করেছো, তখন যাও, জান্নাতই তোমার ঠিকানা। কিন্তু এটা তোমার আমলের বিনিময়ে নয়। আমি তোমাকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দিলাম। এটা আমার অনুগ্রহ। আর তোমাকে আমি জান্নাতে প্রবিষ্ট করছি আর এটাও আমার অনুগ্রহ।” তখন সে এবং তার সঙ্গীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারপর দ্বিতীয় প্রকারের লোককে হাযির করা হবে। তাকে আল্লাহ তা'আলা জিজ্ঞেস করবেনঃ “হে আমার বান্দা! তুমি কেন ভাল কাজ করেছিলে?” উত্তরে সে বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনি জাহান্নাম তৈরী করেছেন এবং তার মধ্যে রেখেছেন জিঞ্জির, লু-হাওয়া ও গরম পানি। নাফরমান বান্দাদের জন্যে সেখানে সর্বপ্রকারের শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন। আমি এই জাহান্নাম হতে রক্ষা পাওয়ার আশাতেই রাত্রি জেগে জেগে ইবাদত করেছি এবং সারা দিন রোযা রেখেছি।” তখন আল্লাহ তা'আলা বলবেনঃ “তুমি যখন জাহান্নামের ভয়ে ভাল কাজ করেছে, তখন আমি তোমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলাম। তারপর এটা অতিরিক্ত অনুগ্রহ যে, তোমাকে আমি জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়ার পর জান্নাতও দান করলাম।” সুতরাং সে এবং তার সাথীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে। অতঃপর তৃতীয় প্রকারের লোককে পেশ করা হবে। তাকেও আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেনঃ “হে আমার বান্দা! তুমি কেন ভাল কাজ করেছিলে।” সে উত্তরে বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমি শুধু আপনার প্রতি প্রেম ও মহব্বতের কারণে আপনার ইবাদত করেছি। আমি রাত জেগে জেগে ইবাদত করেছি এবং ক্ষুধা ও পিপাসা সহ্য করে সারা দিন রোযা রেখেছি একমাত্র আপনার সাথে সাক্ষাৎ লাভের আশায় এবং আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।” তখন মহান আল্লাহ তাকে বলবেনঃ “তুমি যখন আমার মহব্বতে ও আমার সাথে সাক্ষাৎ লাভের উদ্দেশ্যে এরূপ করেছে, তখন আমি তোমার সামনে আমার ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ করছি। তুমি এখন আমাকে মন ভরে দেখে নাও এবং চক্ষু জুড়িয়ে নাও। তুমি সর্বাপেক্ষা বড় সম্পদ লাভ করলে।” এরপর তিনি তাকে বলবেনঃ “আমি আমার অনুগ্রহের বদৌলতে তোমাকে জাহান্নাম থেকেও মুক্তি দিচ্ছি এবং জান্নাতেও প্রবিষ্ট করছি। আমার ফিরিশতামণ্ডলী তোমার পাশে হাযির থাকবে এবং আমি স্বয়ং তোমার উপর আমার শান্তি বর্ষণ করতে থাকবো।” সুতরাং সে ও তার সঙ্গীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে। (ইবনে আবি হাতিমই (রঃ) এই আয়াতের তাফসীরে এটা বর্ণনা করেছেন)