৪-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
ইউসুফ (عليه السلام) তাঁর পিতা ইয়া‘কূব (عليه السلام)-কে বললেন, হে আমার পিতা! আমি স্বপ্নে দেখেছি এগারটি তারকা আমাকে সিজদা করছে এবং চন্দ্র, সূর্যও সিজদা করছে।
ইবনু আব্বাস ও কাতাদাহ বলেন: এগারটি নক্ষত্র দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউসুফ (عليه السلام) এর এগার ভাই এবং সূর্য ও চন্দ্র দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউসুফ (عليه السلام)-এর মাতা-পিতা। (কুরতুবী, তাফসীর সাদী, অত্র আয়াতের তাফসীর) বস্তুতঃ এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বাস্তবায়িত হয় যখন ইউসুফ (عليه السلام)-এর পিতা-মাতাসহ সব ভায়েরা মিসরে গিয়ে তাঁর সামনে সিজদাবনত হয়। যা অত্র সূরার ৯৯-১০০ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, স্বপ্ন ব্যাখ্যা করা জ্ঞানের অন্যতম একটি শাখা। ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়া‘কূব (عليه السلام) সকলে এ বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। ইউসুফ (عليه السلام) কেও আল্লাহ তা‘আলা স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার জ্ঞান দান করেছিলেন। যা ৬ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
ইউসুফ (عليه السلام)-এর স্বপ্নের কথা শুনে ইয়া‘কূব (عليه السلام) বুঝতে পারলেন যে, তাঁর এই পুত্র মহা সম্মানের অধিকারী হবে এবং নবুওয়াতের ধারা তাঁর কাছে পৌঁছবে। তাই তিনি ইউসুফ (عليه السلام) কে এই স্বপ্নের কথা তাঁর ভাইদের কাছে প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন। কারণ তাঁর ভাইয়েরা যখন এ স্বপ্নের কথা শুনবে তখন তারা এ মর্যাদার কথা বুঝতে পারবে। আর এ মর্যাদার কথা বুঝতে পেরে ইউসুফ (عليه السلام) এর কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে, যার ফলে তিনি এ স্বপ্ন প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন।
এ আয়াত প্রমাণ করে স্বপ্নের কথা সকলের কাছে বলা যাবে না, কেবল যাকে নিজের কল্যাণকামী বা একনিষ্ঠ মনে হবে তাদের কাছেই বলা উচিত। হাদীসে এসেছে: ভাল স্বপ্ন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে, যখন তোমাদের কেউ ভাল স্বপ্ন দেখবে তখন যেন তার প্রিয় ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো কাছে না বলে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, জ্ঞানী অথবা কল্যাণকামীর কাছে বলবে। আর যদি অপছন্দনীয় কিছু দেখে তাহলে তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় চাইবে, তিন বার থুথু ফেলবে। অন্য বর্ণনাতে পার্শ্ব পরিবর্তন করে বাম দিকে শয়নের কথা বলা হয়েছে। এবং তা কারো কাছে বর্ণনা করবে না, এতে তা সে ব্যক্তির ক্ষতি করবে না। (সহীহ বুখারী হা: ৭০৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ২২৬১)
ইউসুফ (عليه السلام) কে পিতা তাঁর ভাইদের ষড়যন্ত্রের কারণও বলে দিলেন যে, শয়তান যেহেতু মানুষের চিরশত্র“ সেহেতু সে মানুষকে ভ্রষ্ট ও হিংসা-বিদ্বেষে নিমজ্জিত করার সুযোগ খোঁজে। বলা বাহুল্য, এটা শয়তানের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ ছিল যে, ইউসুফ (عليه السلام) এর বিরুদ্ধে ভাইদের মনে হিংসা বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দেয়া। যেমন পরবর্তী জীবনে ইউসুফ (عليه السلام) তার ভাইদের চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন।
ইউসুফ (عليه السلام) এর স্বপ্নের মর্মার্থ বুঝতে পেরে ইয়া‘কূব (عليه السلام) আরো বললেন, তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়া‘কূবকে যেভাবে নবুওয়াতের জন্য মনোনীত করেছেন, স্বপ্ন ব্যাখ্যার জ্ঞান দান করেছেন এবং নেয়ামত দিয়েছেন সেভাবেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে নবুওয়াতের জন্য মনোনীত করবেন, স্বপ্ন ব্যাখ্যার জ্ঞান দান করবেন এবং নেয়ামতকে পূর্ণ করবেন। মূলতঃ অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফ (عليه السلام) কে তিনটি নেয়ামতের সুসংবাদ দিয়েছেন (১) আল্লাহ তা‘আলা তাকে নাবী হিসেবে মনোনীত করবেন, (২) স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার জ্ঞান দান করবেন, (৩) তার প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করবেন। ফলে ইউসুফ (عليه السلام) স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পারদর্শী ছিলেন, যেমন মিসরের বাদশার স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলেন যা অত্র সূরার ৪১ ও ৪৭-৪৯ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আর এখানে যে নেয়ামতের কথা বলা হয়েছে তা দ্বারা দুটি উদ্দেশ্য হতে পারে (১) নবুওয়াত যা ইউসুফ (عليه السلام)-কে প্রদান করা হয়েছিল; যেমন আয়াতের পরের অংশ প্রমাণ করছে যে, ‘যেভাবে তিনি এটা পূর্বে পূর্ণ করেছিলেন তোমার পিতৃ-পুরুষ ইব্রাহীম ও ইস্হাকের প্রতি’ তাদের প্রতি যে নেয়ামত পরিপূর্ণ করে দেয়া হয়েছিল তা হল নবুওয়াত। (২) সেই নেয়ামতসমূহ যা ইউসুফ (عليه السلام)-কে মিসরে প্রদান করা হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলাই এ ব্যাপারে ভাল জানেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. পিতা সন্তানদের লালন-পালন করবেন, সন্তানদের মধ্য হতে যার মাঝে জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বুঝার যোগ্যতা অনুভব করবেন তার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করবেন।
২. সত্য স্বপ্ন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে। ইউসুফ (عليه السلام) সত্য স্বপ্ন দেখেছেন, ফলে তাঁর পিতা স্বপ্নের কথা ভাইদের কাছে বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন। ভাল স্বপ্ন প্রিয় মানুষের কাছে প্রকাশ করা যাবে, তবে মন্দ স্বপ্ন প্রকাশ করা ঠিক নয়।
৩. আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফ (عليه السلام)-কে স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন।
৪. কল্যাণার্থে নেয়ামত প্রকাশ না করে গোপন রাখা বৈধ। এজন্য ইউসুফ (عليه السلام) এর পিতা স্বপ্নের কথা কাউকে বলতে নিষেধ করেছেন। অথচ এখানে স্বপ্ন একটি নেয়ামত ছিল।
৫. শয়তান সহোদর ভাইদের মাঝেও প্রবেশ করে তাদের অন্তরে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে পারে, ফলে ভাইরা পরস্পরের প্রতি দয়াদ্র হওয়া সত্ত্বেও শত্র“তে পরিণত হয়।
৬. কেউ কারো কাছে স্বপ্নের কথা বললে উত্তম দিকনির্দেশনা দেয়া উচিত।
৭. পিতা সব সন্তানদের প্রতি ন্যায়-নীতি অবলম্বন করবেন, যদিও কোন সন্তানকে অধিক পরিমাণ গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে তা পিতা প্রকাশ করবেন না। কারণ ভাইদের মাঝে বিদ্বেষের কারণ হতে পারে।
৮. একটি উত্তম পরিবার থেকে উত্তম সন্তানের আশা করা যায়। যেমন পিতা ইয়া‘কূব তেমনি সন্তান ইউসুফ (عليه السلام)।