১২-২০ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা পাঁচটি বড় বড় সৃষ্টি মানুষের কল্যাণার্থে নিয়োজিত ও অনুগত করে দিয়েছেন সে কথা বলা হয়েছে। এ বড় বড় পাঁচটি সৃষ্টি হল রাত, দিন, সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র । এসব সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশেই চন্দ্র-সূর্য নির্দিষ্ট কক্ষপথে বিচরণ করছে, দিবা-রাত্রি আবর্তিত হচ্ছে, কোন সময় ছোট, কোন সময় বড় হচ্ছে, একটি অপরটিকে অতিক্রম করে চলছে না। এসবের মাঝে কোনরকম পার্থক্য সূচিত হয় না। নক্ষত্রমালা দ্বারা আকাশ সুসজ্জিত করেছেন এবং এর দ্বারা পথভোলা পথিক পথ খুঁজে পায়। এগুলো আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ শক্তি ও সার্বভৌমত্বের প্রমাণ বহন করে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِنَّ رَبَّکُمُ اللہُ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ فِیْ سِتَّةِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسْتَوٰی عَلَی الْعَرْشِﺤ یُغْشِی الَّیْلَ النَّھَارَ یَطْلُبُھ۫ حَثِیْثًاﺫ وَّالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُوْمَ مُسَخَّرٰتٍۭ بِاَمْرِھ۪ﺚ اَلَا لَھُ الْخَلْقُ وَالْاَمْرُﺚ تَبٰرَکَ اللہُ رَبُّ الْعٰلَمِیْنَﮅ)
“নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি ‘আরশে সমুন্নত হয়েছেন। তিনিই দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন যাতে তাদের একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে, আর সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি, যা তাঁরই আজ্ঞাধীন, জেনে রাখ যে, সৃষ্টি তাঁর, হুকুমও (চলবে) তাঁর। বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তিনি বরকতময়।” (সূরা আ‘রাফ ৭:৫৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَلَقَدْ زَيَّنَّا السَّمَا۬ءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيْحَ وَجَعَلْنٰهَا رُجُوْمًا لِّلشَّيٰطِيْنِ وَأَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابَ السَّعِيْر)
“আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা (তারকারাজী) দ্বারা আর ওগুলোকে শয়তানদেরকে প্রহার করার উপকরণ করেছি এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জাহান্নামের আযাব।” (সূরা মুলক ৬৭:৫)
এসব প্রত্যেকটি মাখলুক আল্লাহ তা‘আলার একত্বের ওপর প্রমাণ বহন করে যে, প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়। অতএব যারা এর বিপরীত মনে করবে অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্যকে প্রতিপালক হিসেবে বিশ্বাস করবে তারা মুশরিক আর তারাই হবে জাহান্নামী।
পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন যে, তিনি মানুষের উপকারার্থে পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরণের ও রঙের বস্তু সৃষ্টি করেছেন। খনিজ সম্পদ, গাছপালা, জড় পদার্থ ও জীবজন্তু এমন কি মানুষের মাঝেও ভিন্ন ভিন্ন রঙ সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: “তুমি কি লক্ষ্য করনি? আল্লাহ আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন। তারপর আমি তা দিয়ে নানা বর্ণের ফলমূল উৎপন্ন করি। আর পর্বতমালারও রয়েছে বিভিন্ন বর্ণের গিরিপথ সাদা, লাল ও ঘোর কাল। আর এভাবে মানুষ, প্রাণী ও চতুষ্পদ জন্তু বিভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকে। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপ্রতাপশালী, পরম ক্ষমাশীল।” (সূরা ফাতির ৩৫/২৭-২৮)
এ সমস্ত নিদর্শনগুলো এটাই প্রমাণ বহন করে যে, আল্লাহ তা‘আলা একক তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি ছাড়া আর কেউ ইবাদতের যোগ্য নয়। আর আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত বিভিন্ন প্রকার রঙের এসব জিনিস সৃষ্টি করার ক্ষমতা কারো নেই। সুতরাং সকলের উচিত তাঁরই ইবাদত করা।
পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, ঐ সমস্ত অধীনস্থ জিনিসগুলোর মত সমুদ্রকেও তিনি মানুষের অধীনস্থ করে দিয়েছেন, যাতে সমুদ্রে ভ্রমণ করা, শিকার করা, পরিধেয় অলঙ্কার বের করে আনা এবং এক স্থান থেকে অন্যস্থানে মালামাল স্থানান্তরিত করা সম্ভব হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَللّٰهُ الَّذِيْ سَخَّرَ لَكُمُ الْبَحْرَ لِتَجْرِيَ الْفُلْكُ فِيْهِ بِأَمْرِهٰ وَلِتَبْتَغُوْا مِنْ فَضْلِهٰ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ)
“আল্লাহ, তিনি সমুদ্রকে তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন, যাতে তাঁর আদেশে তাতে নৌযানসমূহ চলাচল করতে পারে এবং যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে পার ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও।” (সূরা জাসিয়া ৪৫:১২)
অত্র আয়াতে সমুদ্রকে মানুষের অনুগত করে দেয়ার মাধ্যমে চারটি নেয়ামত বর্ণনা করেছেন।
(১) طَرِيًّا অর্থ তাজা, অর্থাৎ মানুষ সমুদ্রে জাল ফেলে তাজা মাছ সংগ্রহ করে খেয়ে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنْ كُلٍّ تَأْكُلُوْنَ لَحْمًا طَرِيًّا)
“তোমরা প্রত্যেকটি থেকেই টাটকা গোশত খাও” (সূরা ফাতির ৩৫:১২)
(২) মানুষ সমুদ্র থেকে মূল্যবান পরিধেয় অলঙ্কার বের করে আনে। যেমন মণিমুক্তা, প্রবাল ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
يَخْرُجُ مِنْهُمَا اللُّؤْلُؤُ وَالْمَرْجَانُ
“উভয় সমুদ্র হতে বের করেন মুক্তা ও প্রবাল।” (সূরা রহমান ৫৫:২২)
(৩) সমুদ্রের পাহাড় সমান ঢেউ চিরে মানুষ তাতে ভ্রমণ করে, অথচ আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে তাতে ডুবিয়ে মারতে পারেন।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَخَلَقْنَا لَهُمْ مِّنْ مِّثْلِه۪ مَا يَرْكَبُوْنَ - وَإِنْ نَّشَأْ نُغْرِقْهُمْ فَلَا صَرِيْخَ لَهُمْ وَلَا هُمْ يُنْقَذُوْنَ)
“এবং তাদের জন্য আমি এর অনুরূপ যানবাহন সৃষ্টি করেছি যাতে তারা আরোহণ করে। আর আমি ইচ্ছা করলে তাদেরকে ডুবিয়ে দিতে পারি, তখন কেউ তাদের আর্তনাদে সাড়া দেবে না এবং তাদেরকে উদ্ধারও করা হবে না।” (সূরা ইয়াসিন ৩৬:৪২-৪৩)
(৪) মানুষ সমুদ্র পথে ব্যবসায়-বাণিজ্য করে আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ অন্বেষণ করে থাকে। হাজার হাজার টন মালামাল আমদানি ও রপ্তানি করে থাকে।
(وَتَرَي الْفُلْكَ فِيْهِ مَوَاخِرَ لِتَبْتَغُوْا مِنْ فَضْلِه۪ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ )
“তুমি দেখতে পাও ঢেউয়ের বুক চিরে জাহাজ চলাচল করে যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ তালাশ করতে পার এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।” (সূরা ফাতির ৩৫:১২)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে পাহাড় সৃষ্টির হিকমত ও উপকারিতা বর্ণনা করছেন। ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানে “ভাঁজ করার” বিষয়টি একটি সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত সত্য। ভাঁজ করা বিষয়টি পাহাড়-পর্বতের বিন্যাসের জন্য দায়ী। পৃথিবীর যে কঠিন পৃষ্ঠের ওপর আমরা বসবাস করি তা শক্ত খোসার ন্যায়, অথচ এর গভীরের স্তরগুলো উত্তপ্ত ও তরল। ফলে যে কোন প্রাণীর জন্য তা বসবাসের অনুপযোগী। এটাও জানা যায় যে, পাহাড়-পর্বতের স্থায়িত্ব ভাঁজ করার মত বিস্ময়কর ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। কারণ অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে পরিত্রাণের মাধ্যমে পাহাড়-পর্বতের ভিত্তি স্থাপন করাই ছিল এ ভাঁজগুলোর উদ্দেশ্য। সুতরাং পাহাড়গুলো স্থাপন করেছেন কীলক (পেরেক) স্বরূপ যাতে করে পৃথিবী নড়াচাড়া করতে না পারে। ক্ষণিকের ভূমিকম্প থেকে এর অনুভব করা যেতে পারে। ভূমিকম্প মুহূর্তের মধ্যে বিশাল বিশাল ঘরবাড়ি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় এবং শহর ও গ্রামকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا) - (وَّالْـجِبَالَ أَوْتَادًا
“আমি কি জমিনকে বিছানাস্বরূপ করিনি? এবং পাহাড়সমূহকে পেরেকস্বরূপ?” (সূরা নাবা ৭৮:৬-৭)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(خَلَقَ السَّمٰوٰتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا وَأَلْقٰي فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيْدَ بِكُمْ)
“তিনি আসমান সৃষ্টি করেছেন স্তম্ভ ব্যতিরেকে, তোমরা তা দেখছ। তিনি পৃথিবীতে সুউচ্চ পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, যাতে পৃথিবী তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে।” (সূরা লুকমান ৩১:১০)
আর আল্লাহ তা‘আলা এতে নদী ও চলার পথ তৈরী করে দিয়েছেন যাতে করে মানুষেরা সহজেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَجَعَلْنَا فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيْدَبِهِمْ وَجَعَلْنَا فِيْهَا فِجَاجًا سُبُلًا لَّعَلَّهُمْ يَهْتَدُوْنَ)
“এবং আমি পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছি সুদৃঢ় পর্বত, যাতে পৃথিবী তাদেরকে নিয়ে এদিক-ওদিক ঢলে না যায় এবং আমি তাতে করে দিয়েছি প্রশস্ত পথ, যাতে তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারে” (সূরা আম্বিয়া ২১:৩১)
আর রাস্তা খুঁজে বের করার নিদর্শন স্বরূপ তিনি আকাশে সৃষ্টি করেছেন নক্ষত্ররাজী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَهُوَ الَّذِيْ جَعَلَ لَكُمُ النُّجُوْمَ لِتَهْتَدُوْا بِهَا فِيْ ظُلُمٰتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ)
“তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্র সৃষ্টি করেছেন যেন তার দ্বারা স্থলের ও সমুদ্রের অন্ধকারে তোমরা পথ পাও।” (সূরা আনয়াম ৬:৯৭)
এই সব মানুষের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ। এখানে এ সমস্ত অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে তাওহীদের গুরুত্ব বুঝানো হচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলাই সকল কিছুর স্রষ্টা। আর তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে ছেড়ে যাদের ইবাদত করছ তারা কিছুই সৃষ্টি করেনি; বরং তারাও আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্ট। অতএব স্রষ্টা ও সৃষ্ট বস্তু কখনো এক হতে পারে না। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে যাদেরকে মা‘বূদ হিসেবে আহ্বান করা হয় তারা কোন কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না, বরং তারা আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি।
এই সমস্ত নেয়ামত ছাড়া আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে আরো অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন। যা মানুষ গণনা করে শেষ করতে পারবে না। তবুও তারা ঈমান আনে না। বস্তুত তারাই মূর্খ বা নির্বোধ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنْ تَعُدُّوْا نِعْمَتَ اللّٰهِ لَا تُحْصُوْهَا ط إِنَّ الْإِنْسَانَ لَظَلُوْمٌ كَفَّارٌ )
“তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। মানুষ অবশ্যই অতি মাত্রায় জালিম, অকৃতজ্ঞ।” (সূরা ইবরাহীম ১৪:৩৪)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. চন্দ্র-সূর্য, দিবা-রাত্রি সকল কিছুকে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের অনুগত করে দিয়েছেন।
২. পর্বত পৃথিবীতে স্থাপন করা হয়েছে যাতে করে পৃথিবী নড়াচড়া না করে।
৩. নক্ষত্র সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষকে পথ দেখানোর জন্য।
৪. সমুদ্রে মণি-মুক্তা রয়েছে।
৫. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত গণনা করে শেষ করা যাবে না।