মারইয়াম আয়াত ৬
يَّرِثُنِيْ وَيَرِثُ مِنْ اٰلِ يَعْقُوْبَ وَاجْعَلْهُ رَبِّ رَضِيًّا ( مريم: ٦ )
Yarisunee wa yarisu min aali Ya'qoob, waj'alhu Rabbi radiyya (Maryam ১৯:৬)
English Sahih:
Who will inherit me and inherit from the family of Jacob. And make him, my Lord, pleasing [to You]." (Maryam [19] : 6)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
যে আমার উত্তরাধিকারী হবে আর উত্তরাধিকারী হবে ইয়া‘কুব পরিবারের; আর হে আমার প্রতিপালক! তাকে করুন আপনার সন্তুষ্টির পাত্র। (মারইয়াম [১৯] : ৬)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
যে উত্তরাধিকারী হবে আমার এবং উত্তরাধিকারী হবে ইয়াকূবের বংশের। আর হে আমার প্রতিপালক! তাকে তুমি সন্তোষভাজন কর।’
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
‘যে আমার উত্তরাধিকারিত্ত করবে [১] এবং উত্তরাধিকারিত্ত করবে ইয়া’কুবের বংশের [২] এবং হে আমার রব! তাকে করবেন সন্তোষভাজন।
[১] আলেমদের মতে, এখানে উত্তরাধিকারিত্বের অর্থ নবুওয়াত-রিসালত তথা ইলমের উত্তরাধিকার। আর্থিক উত্তরাধিকারিত্ব নয়। কেননা, প্রথমতঃ যাকারিয়্যার কাছে এমন কোন অর্থ সম্পদ ছিল বলেই প্রমাণ নেই, যে কারণে চিন্তিত হবেন যে, এর উত্তরাধিকারী কে হবে। একজন পয়গম্বরের পক্ষে এরূপ চিন্তা করাও অবান্তর। এছাড়া যাকারিয়্যা আলাইহিসসালাম নিজে কাঠ-মিস্ত্রি ছিলেন। নিজ হাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কাঠ-মিস্ত্রির কাজের মাধ্যমে এমন সম্পদ আহরণ করা সম্ভব হয় না। যার জন্য চিন্তা করতে হয়। দ্বিতীয়ত; সাহাবায়ে কেরামের ইজমা তথা ঐকমত্য সম্বলিত এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ "নিশ্চিতই আলেমগণ পয়গম্বরগণের ওয়ারিশ। পয়গম্বরগণ কোন দীনার ও দিরহাম রেখে যান না; বরং তারা ইলম ও জ্ঞান ছেড়ে যান। যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করে, সে বিরাট সম্পদ হাসিল করে।”- [আবু দাউদ; ৩৬৪১, ইবনে মাজাহ; ২২৩, তিরমিয়ী; ২৬৮২] তৃতীয়ত; স্বয়ং আলোচ্য আয়াতে এর
يَرِّثُنِىْ وَيَرِثُ مِنْ اٰلِ يَعْقُوْبَ
বাক্যের যোগ এরই প্রমাণ যে, এখানে আর্থিক উত্তরাধিকারিত্ব বোঝানো হয়নি। কেননা, যে পুত্রের জন্মলাভের জন্যে দো'আ করা হচ্ছে, তার পক্ষে ইয়াকুব আলাইহিসসালামের উত্তরাধিকার হওয়াই যুক্তিযুক্ত কিন্তু তাদের নিকটবতী আত্মীয়স্বজনরা যাদের উল্লেখ আয়াতে করা হয়েছে, তারা নিঃসন্দেহে আত্মীয়তায় ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম থেকে অধিক নিকটবতী। নিকটবতী আত্মীয় রেখে দূরবর্তীর উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করা উত্তরাধিকার আইনের পরিপন্থী। [ইবন কাসীর]
[২] অর্থাৎ আমি কেবলমাত্র নিজের উত্তরাধিকারী চাই না বরং ইয়াকুব বংশের যাবতীয় কল্যাণের উত্তরাধিকারী চাই। সে নবী হবে যেমন তার পিতৃপুরুষরা যেভাবে নবী হয়েছে। [ইবন কাসীর]
3 Tafsir Bayaan Foundation
‘যে আমার উত্তরাধিকারী হবে এবং ইয়াকূবের বংশের উত্তরাধিকারী হবে। হে আমার রব, আপনি তাকে পছন্দনীয় বানিয়ে দিন’।
4 Muhiuddin Khan
সে আমার স্থলাভিষিক্ত হবে ইয়াকুব বংশের এবং হে আমার পালনকর্তা, তাকে করুন সন্তোষজনক।
5 Zohurul Hoque
''যে আমাকে উত্তরাধিকার করবে এবং ইয়াকুবের বংশধরদের উত্তরাধিকার করবে, আর আমার প্রভু, তাকে সন্তোষভাজন বানিয়ো।’’
6 Mufti Taqi Usmani
যে আমারও উত্তরাধিকারী হবে এবং ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম)-এর উত্তরাধিকারও লাভ করবে এবং হে আমার প্রতিপালক! তাকে এমন বানান, যে (আপনার নিজেরও) সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত হবে।
7 Mujibur Rahman
যে আমার উত্তরাধিকারী হবে এবং উত্তরাধিকারীত্ব পাবে ইয়াকূবের বংশের এবং হে আমার রাব্ব! তাকে করুন সন্তোষভাজন।
8 Tafsir Fathul Mazid
নামকরণ:
এ সূরাতে ঈসা (عليه السلام)-এর মা মারইয়াম (عليه السلام) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে বিধায় উক্ত নামে সূরার নাম রাখা হয়েছে।
এ সূরাটি সূরা ফাতির নাযিল হওয়ার পর অবতীর্ণ হয়। যখন বদর যুদ্ধ সংঘটিত হল এবং যুদ্ধে কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ নিহত হল তখন কুরাইশরা বলল: তোমাদের বিদ্রোহীরা হাবশায় রয়েছে। হাবশার বাদশা নাজ্জাশীর কাছে কিছু হাদিয়া পাঠাও এবং তোমাদের মধ্য হতে দু’জন জ্ঞানবান লোক প্রেরণ কর, হতে পারে বাদশা তাদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেবেন। ফলে নিয়ে এসে তাদেরকে হত্যা করার মাধ্যমে বদরের যুদ্ধে তোমাদের যারা নিহত হয়েছে তাদের প্রতিশোধ নিতে পারবে। কুরাইশরা আমর বিন আস ও আব্দুল্লাহ বিন আবূ রবীয়াহকে প্রেরণ করল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরাইশদের এ প্রতিনিধি প্রেরণের সংবাদ শুনলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমর বিন উমাইয়া আয-যামরীকে প্রেরণ করলেন এবং সাথে একটি চিঠি দিলেন। তিনি চিঠি নিয়ে নাজ্জাসীর কাছে আগমন করলেন। বাদশা তা পড়ল, অতঃপর বাদশা তখন জাফর বিন আবূ তালেব ও মুহাজিরদেরকে ডাকলেন এবং যারা পণ্ডিত ছিল তাদেরকে একত্রিত করলেন, তারপর বাদশা জাফরকে কুরআনের কিছু তেলাওয়া করতে বললেন। তখন জাফর অত্র সূরা তেলাওয়াত করলেন। কুরআন শুনে বাদশা ও পণ্ডিতদের চোখের অশ্র“ ঝরতেছিল। তাদের ব্যাপারেই নাযিল হয়েছে “অবশ্যই মু’মিনদের প্রতি শত্র“তায় মানুষের মধ্যে ইয়াহূদী ও মুশরিকদেরকেই তুমি সর্বাধিক উগ্র দেখবে এবং যারা বলে ‘আমরা খ্রিস্টান’ মানুষের মধ্যে তাদেরকেই তুমি মু’মিনদের নিকটতর বন্ধুত্বে দেখবে; কারণ তাদের মধ্যে অনেক পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগী আছে, আর তারা অহঙ্কারও করে না।” (সূরা মায়িদাহ ৫:৮২)
১-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
(كٓهٰيٰعٓصٓ) –
(কাফ-হা-ইয়া-‘আঈন-স্ব-দ) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহ সম্পর্কে সূরা বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এর সঠিক ব্যাখ্যা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা যাকারিয়া (عليه السلام) (যিনি মারইয়াম (عليه السلام) এর খালু) ও যাকারিয়া (عليه السلام) এর ছেলে ইয়াহইয়া (عليه السلام) সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হচ্ছে।
যাকারিয়া ও ইয়াহইয়া (عليه السلام) হলেন সুলাইমান (عليه السلام) এর পরবর্তী দু’জন নাবী যারা পরস্পরে পিতা-পুত্র ছিলেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের অধিবাসী ছিলেন। যাকারিয়া (عليه السلام) এর পরেই ইয়াহইয়া (عليه السلام) নুবওয়াত পান এবং তিনি ঈসা (عليه السلام) এর আপন খালাত ভাই। বয়সে ঈসা (عليه السلام) থেকে তিনি বড়, সে হিসেবে তিনি ঈসা (عليه السلام) এর পূর্বে নবুওয়াত পেয়েছিলেন। যাকারিয়া ও ইয়াহইয়া (عليه السلام) সম্পর্কে সূরা আলি ইমরানের ৫টি আয়াতে, আন‘আমের ৮৫ নং আয়াতে ও সূরা আম্বিয়ার ৮৯-৯০ নং আয়াতের সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করা হয়েছে।
যাকারিয়া (عليه السلام) সম্পর্কে কুরআনে কেবল এতটুকু বর্ণনা এসেছে যে, তিনি মারইয়াম (عليه السلام)-এর লালন-পালনকারী ছিলেন। এ সম্পর্কে সূরা আলি ইমরানের ৩৫-৪১ নং আয়াতের উল্লেখ রয়েছে। মারইয়াম (عليه السلام) মসজিদের সংলগ্ন মেহরাবে থাকতেন। যাকারিয়া (عليه السلام) তাকে নিয়মিত দেখাশুনা করতেন।
সন্তান লাভের জন্য যাকারিয়া (عليه السلام)-এর দু‘আ:
মারইয়াম আলাইহাস সালাম-কে দেখাশুনা করতে গিয়ে যখনই মেহরাবে আসতেন তখনই সেখানে নতুন নতুন তাজা ফল-ফলাদি ও খাদ্য-খাবার দেখতে পেতেন। তিনি একদিন এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে মারইয়াম (عليه السلام) বললেন:
(ھُوَ مِنْ عِنْدِ اللہِﺚ اِنَّ اللہَ یَرْزُقُ مَنْ یَّشَا۬ئُ بِغَیْرِ حِسَابٍ)
“এসব আল্লাহর পক্ষ থেকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন অগণিত রিযিক দান করেন।” (সূরা আলি ইমরান ৩:৩৭)
সম্ভবত শিশু মারইয়ামের উপরোক্ত কথা থেকেই নিঃসন্তান বৃদ্ধ যাকারিয়ার মনের কোণে আশার সঞ্চার হয় এবং চিন্তা করেন যে, যিনি ফলের মৌসুম ছাড়াই মারইয়ামকে তাজা ফল সরবরাহ করতে পারেন তিনি অবশ্যই বৃদ্ধ দম্পতিকে সন্তান দিতে সক্ষম। তাই তিনি আশা নিয়ে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে প্রার্থনা করলেন।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(هُنَالِكَ دَعَا زَكَرِيَّا رَبَّه ج قَالَ رَبِّ هَبْ لِيْ مِنْ لَّدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً ج إِنَّكَ سَمِيْعُ الدُّعَا۬ءِ )
“সেখানেই যাকারিয়া তার রবকে ডেকে বললেন: হে আমার রব! আপনার পক্ষ থেকে আমাকে পবিত্র সন্তান দান করুন। আপনি তো দু‘আ শ্রবণকারী।” (সূরা আলি-ইমরান ৩:৩৮)
এ কথাটিই অত্র সূরার তৃতীয় আয়াত থেকে ব্যক্ত করা হয়েছে।
যাকারিয়া (عليه السلام) আল্লাহ তা‘আলাকে গোপনে আহ্বান করলেন। কেননা গোপনে আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকা আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন। এতে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতা থাকে এবং সে ইবাদত কবূলের অধিক আশা করা যায়। সুতরাং উচ্চঃস্বরে হৈ-হুল্লোড় করে সমস্বরে আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকা বা তাঁর যিকির করা উত্তম পন্থা নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
( اُدْعُوْا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَّخُفْيَةً ط إِنَّه لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِيْنَ)
“তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাক, তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” (সূরা আ‘রাফ ৭:৫৫)
যাকারিয়া (عليه السلام) প্রার্থনা শুরু করলেন এ কথা বলে, তিনি কখনো আল্লাহ তা‘আলার কাছে কোন কিছু প্রার্থনা করে ব্যর্থ হননি। তাই তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে একটি সন্তান প্রার্থনা করেন, যে তাঁর পরে তাঁর নবুওয়াতের উত্তরাধিকারী হবে। যদিও তিনি বার্ধক্যে উপনীত হয়ে গেছেন। তাঁর মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে এবং তাঁর স্ত্রী বন্ধ্যা। তারপরও তিনি সন্তান কামনা করেছেন। কারণ তিনি জানেন আল্লাহ তা‘আলা চাইলে এ অবস্থাতেও সন্তান দিতে পারেন। তিনি এ জন্য প্রার্থনা করলেন, কারণ তাঁর স্বজাতির মধ্যে আর কেউ নেই যে, তাঁর মৃত্যুর পর মানুষকে ওয়ায-নসীহত করবে। তাই তিনি একটি সন্তান প্রার্থনা করলেন, যে তাঁর এবং ইয়াকুব (عليه السلام)-এর নবুওয়াতের উত্তরাধিকারী হবে এবং লোকদেরকে ওয়ায-নসীহত শুনাবে। মূলত পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলার বাণী প্রচার করার জন্যই তিনি এ প্রার্থনা করেছেন।
আয়াতে উল্লিখিত উত্তরাধিকারী হওয়া বলতে সম্পদের উত্তরাধিকার বুঝানো হয়নি বরং নবুওয়াতের উত্তরাধিকার বুঝানো হয়েছে। কারণ নাবীরা সম্পদের উত্তরাধিকার বানিয়ে যান না, তারা ইলম তথা নবুওয়াতের উত্তরাধিকার বানিয়ে যান। (আবূ দাঊদ হা: ৩৬৪৩)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা মানুষের কথা শ্রবণ করেন। যদিও তা গোপনে হয়।
২. আল্লাহ তা‘আলা চাইলে মানুষকে বৃদ্ধাবস্থায়ও সন্তান দান করতে পারেন এবং বন্ধ্যা স্ত্রী থেকেও। তাই সন্তান চাওয়ার জন্য কোন মাযারে বা বাবার কাছে যেতে হবে না, যাকারিয়া (عليه السلام) যেমন দৃঢ়বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহ তা‘আলার কাছে চেয়েছিলেন তেমনিভাবে চাইতে হবে।
৩. আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাওয়ার অন্যতম একটি আদব হল প্রথমে তাঁর প্রশংসা করা এবং তাঁর কাছে বিনয়ী হওয়া তারপর চাওয়া।
৪. আলেমগণ নাবীদের উত্তরাধিকারী, আর সে উত্তরাধিকার হল নবুওয়াতী জ্ঞানের, সম্পদের নয়।
9 Fozlur Rahman
যে আমার উত্তরাধিকারিত্ব করবে ও ইয়াকূব-পরিবারের উত্তরাধিকারিত্ব করবে। আর হে প্রভু! তুমি তাকে (তোমার) সন্তোষভাজন করো।”
10 Mokhtasar Bangla
৬. যে আমার ও ইয়াকুব (আলাইহিস-সালাম) এর নবুওয়াতের উত্তরাধিকার পাবে। হে আমার প্রতিপালক! আপনি তাকে ধর্ম, চরিত্র ও জ্ঞানে একজন সন্তোষজনক ব্যক্তি বানিয়ে দিন।
11 Tafsir Ibn Kathir
এই সূরার প্রারম্ভিক আয়াতগুলি হযরত জাফর ইবুন আবি তালিব (রাঃ) আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশী ও তার সভাসদ বর্গের সামনে পাঠ করেছিলেন। (এটা ‘মুসনাদে আহমাদ ও 'সীরাতে মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক’ গ্রন্থে উল্লিখিত আছে)
১-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
এই সূরার প্রারম্ভে যে পাঁচটি অক্ষর রয়েছে এ গুলিকে ‘হুরূফে মুকাত্তাআহ’ বলা হয়। সূরায়ে বাকারার তাফসীরের প্রারম্ভে আমরা এগুলি বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছি। আল্লাহ তাআলার বান্দা ও নবী যাকারিয়ার (আঃ) প্রতি তাঁর যে দয়া ও অনুগ্রহ নাযিল হয় তারই বর্ণনা এখানে দেয়া হচ্ছে। زَكَرِيَّا শব্দটি এক কিরআতে زَكَرِيَّاء রয়েছে। زَكَرِيَّا শব্দটির مَد ও قَصَر উভয় কিরআতই মশহুর বা প্রসিদ্ধ। তিনি বাণী ইসরাঈলের এক অতি খ্যাতি সম্পন্ন নবী ছিলেন। সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, তিনি ছুতার ছিলেন এবং এ কাজ করেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি স্বীয় প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করতেন। কিন্তু তাঁর এই প্রার্থনা ছিল লোকদের কাছে স্বাভাবিক এবং তাদের মনে খেয়াল জাগতে পারে যে, বুড়ো বয়সে তাঁর সন্তান লাভের চাহিদা হয়েছে, তাই তিনি নিভৃতে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতেন। তাঁর নিভৃতে ও নির্জনে প্রার্থনা করার আর একটি কারণ এই যে, নির্জনে ও নিভৃতে প্রার্থনা আল্লাহ তাআলার নিকট খুবই প্রিয়। এ প্রার্থনা তাড়াতাড়ি কবুল হয়ে থাকে। খোদাভীরু অন্তরকে আল্লাহ তাআলা খুব ভালরূপই জানেন। ধীরে ধীরে ও চুপি চুপি কথা বললেও তিনি পূর্ণরূপে শুনতে পান। পূর্ব যুগীয় কোন কোন গুরুজন বলেছেন যে, তিনি রাত্রে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতেন যখন তার পরিবার পরিজন ও সঙ্গী সাথীরা ঘুমিয়ে থাকতেন। অতঃপর তিনি চুপি চুপি বলতেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! হে আমার পালন কর্তা!' তখন মহান আল্লাহ বলেনঃ لَبَّيْكَ لَبَّيْـك لَبَّيْـكَ অর্থাৎ আমি তোমার সামনে হাজির আছি, তোমার সামনে আমি বিদ্যমান রয়েছি, তোমার সম্মুখে আমি উপস্থিত রয়েছি। হযরত যাকারিয়া (আঃ) প্রার্থনায় বলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমার অস্থি দুর্বল হয়ে গেছে এবং আমার মাথার চুল পেকে সাদা হয়েছে। এর দ্বারা তিনি দুর্বলতা ও বার্ধক্যকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ হে আমার প্রতিপালক! আমার বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিন সমস্ত শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। ভিতরের ও বাইরের দুর্বলতা আমাকে পরিবেষ্টন করে ফেলেছে।
তিনি আরো বলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনার কাছে প্রার্থনা করে আমি তো কখনো ব্যর্থ মনোরথ হই নাই এবং আপনার দরবার হতে কখনো শূন্য হস্তে ফিরে যাই নাই। বরং যখনই যা কিছু চেয়েছি তাই আপনি আমাকে দান করেছেন।"
কাসাঈ (রঃ) مَوَالِىَ শব্দটিকে مَوَالِىْ পড়েছেন অর্থাৎ ى অক্ষরে সাকিন বা জযম দিয়ে পড়েছেন। এর দ্বারা عصبه কে বুঝানো হয়েছে। (ফারায়েযের পরিভাষায় আল্লাহর কিতাবে যাদের অংশ নির্ধারিত রয়েছে ঐ সব ওয়ারিসকে আসহাবে ফুরূষ বলা হয়। এই অসহাবে ফুরূযকে অংশ দেয়ার পর অবশিষ্ট অংশ যে ওয়ারিছরা পেয়ে থাকে তাদেরকে আসাবা বলা হয়)
বর্ণিত আছে যে, হযরত উছমনি (রাঃ) خِفْتُ কে خَفَّتْ পড়েছেন। অর্থাৎ আমার পরে আমার নিজস্ব লোক খুবই কম থাকবে। প্রথম কিরআতে অর্থ হবে “আমার সন্তানাদি নেই বলে আমার আত্মীয় স্বজন যারা রয়েছে তাদের ব্যাপারে আমি আশংকা করছি যে, না জানি আমার পরে তারা আমার মীরাছের সাথে অন্যায় আচরণ করবে। সুতরাং হে আল্লাহ! আপনি আমাকে সন্তান দান করুন, যে আমার পরে আমার নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করবে।"
এটা মনে করা কখনো উচিত নয় যে, হযরত যাকারিয়ার (আঃ) মাল-ধন এদিক ওদিক হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। কেননা, নবীগণ (আঃ) এর থেকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। তাঁরা যে এই উদ্দেশ্যে সন্তান লাভের প্রার্থনা জানাবেন যে, সন্তান না থাকলে তার মীরাছ বা উত্তরাধিকার দূরের আত্মীয়দের মধ্যে চলে যাবে, এটা হতে তাদের মর্যাদা বহু উর্ধ্বে। দ্বিতীয়তঃ এটাও প্রকাশমান যে, হযরত যাকারিয়া (আঃ) সারাজীবন ধরে ছুতারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন, এমতাবস্থায় তাঁর কাছে কি এমন সম্পদ থাকতে পারে যার জন্য তিনি এতো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বেন যে, ঐ সম্পদ তার হাত ছাড়া হয়ে যাবে? নবীগণ তো এমনিতেই সারা দুনিয়া হতে, অধিক মাল হতে বহু দূরে সরে থাকেন। দুনিয়ার প্রতি তাদের তো কোন আকর্ষণই থাকে না। তৃতীয় কারণ এটাও যে, কয়েকটি সনদে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হাদীস রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমরা নবীদের দল ওয়ারিছ বানাই না। আমরা যা কিছু ছেড়ে যাই সবই সাদকারূপে পরিগণিত হয়।" জামে তিরমিযীতেও সহীহ সনদে এ হাদীস রয়েছে। সুতরাং এটা প্রমাণিত হলো যে, হযরত যাকারিয়া যে আল্লাহ তাআলার নিকট পুত্রের জন্যে প্রার্থনা করেছিলেন যে, তিনি তার ওয়ারিছ হবেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য নবুওয়াতের
ওয়ারিছ, মাল-ধনের ওয়ারিছ নয়। এ জন্যে তিনি বলেছিলেনঃ “সে আমার ওয়ারিছ হবে ও আলে ইয়াকুবের (আঃ) ওয়ারিছ হবে।"যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ وَوَرِثَ سُلَيْمٰنُ دَاوٗدَ অর্থাৎ “সুলাইমান (আঃ) দাউদের (আঃ) ওয়ারিছ হলেন। (২৭:১৬) অর্থাৎ নবুওয়াতের ওয়ারিছ হলেন, ধন-মালের ওয়ারিছ নয়। অন্যথায় মালে তো অন্য ছেলেরাও ওয়ারিছ হয়। কাজেই মালে বিশেষত্ব বুঝায় না। চতুর্থ কারণ এটাও যে, ছেলে ওয়ারিছ হওয়া তো সাধারণ কথা। এটা সবারই মধ্যে এবং সমস্ত মাযহাবে আছে। সুতরাং এটার কোন প্রয়োজন ছিল না যে, হযরত যাকারিয়া (রাঃ) নিজের প্রার্থনার এই কারণ বর্ণনা করবেন। এর দ্বারা এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ঐ উত্তরাধিকার একটা বিশেষ উত্তরাধিকার ছিল এবং সেটাও হলো নবুওয়াতের উত্তরাধিকার। যেমন হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “আমরা যা ছেড়ে যাই তা সাকারূপে পরিগণিত।" মুজাহিদ (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ইলমের উত্তরাধিকার। হযরত যাকারিয়া (আঃ) হযরত ইয়াকূবের (আঃ) সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আবু সালেহ (রঃ) বলেন যে, উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ তিনিও তার বড়দের মত নবী হবেন। হাসান (রঃ) বলেন যে, নুবওয়াত ও ইলমের ওয়ারিছ হবেন। সুদ্দীর (রঃ) উক্তি এই যে, হযরত যাকারিয়ার (আঃ) উদ্দেশ্য ছিলঃ আমার ঐ সন্তান আমার ও আলে ইয়াকূবের (আঃ) ওয়ারিছ হবে।
মুসনাদে আবদির রাষ্যকে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা হযরত যাকারিয়ার (আঃ) উপর দয়া করুন! তার মালের ওয়ারিছের কি প্রয়োজন ছিল? আল্লাহ লুতের (আঃ) উপর রহম করুন! তিনি সুদৃঢ় দুর্গের আকাংখা করে ছিলেন। তাফসীরে ইবনু জারীরে রয়েছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা আমার ভাই যাকারিয়ার (আঃ) উপর রহম করুন! তিনি প্রার্থনা করেছিলেনঃ "হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আপনার নিকট হতে একজন ওয়ালী দান করুন, যে আমার ও আলে ইয়াকুবের ওয়ারিছ হবে।" (কিন্তু এই সব হাদীসই মুরসাল। সাহাবী (রাঃ) নবী (সঃ) হতে বর্ণনা করেন নাই, তাবেয়ী বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এগুলো বিশুদ্ধ হাদীস সমূহের সমকক্ষতা লাভ করতে রাখে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন) তিনি আরো বলেনঃ “হে আল্লাহ! তাকে পছন্দনীয় গোলাম বানিয়ে দিন এবং এমন দ্বীনদার ও দিয়ানতদার বানিয়ে দিন যে, যেন আপনার মুহাব্বাত ছাড়াও সমস্ত সৃষ্টজীব তাকে মুহাব্বাত করে। সবাই যেন তার ধর্ম ও চরিত্রকে পছন্দনীয় ও প্রেম প্রীতির দৃষ্টিতে দেখে।”