আল বাকারা আয়াত ১৭৯
وَلَكُمْ فِى الْقِصَاصِ حَيٰوةٌ يّٰٓاُولِى الْاَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ ( البقرة: ١٧٩ )
Wa lakum fil qisaasi hayaatuny yaaa ulil albaabi la 'allakum tattaqoon (al-Baq̈arah ২:১৭৯)
English Sahih:
And there is for you in legal retribution [saving of] life, O you [people] of understanding, that you may become righteous. (Al-Baqarah [2] : 179)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন নিহিত রয়েছে, যাতে হে জ্ঞানী সমাজ! (হত্যানুষ্ঠান হতে) তোমরা নিবৃত্ত থাক। (আল বাকারা [২] : ১৭৯)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
হে বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ! তোমাদের জন্য ক্বিস্বাসে (প্রতিশোধ গ্রহণের বিধানে) জীবন রয়েছে, যাতে তোমরা সাবধান হতে পার।[১]
[১] যখন হত্যাকারীর এই ভয় হবে যে, আমাকেও ক্বিস্বাসে হত্যা করা হবে, তখন সে কাউকে হত্যা করতে সাহস পাবে না। যে সমাজে ক্বিস্বাসের আইন বলবৎ থাকে, সে সমাজে এ (ক্বিস্বাসে হত্যা হওয়ার) ভয় সমাজকে হত্যা ও খুনোখুনি থেকে সুরক্ষিত রাখে এবং এরই ফলে সমাজে নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর এর (বাস্তব) দৃশ্য আজও সৌদী আরবে লক্ষ্য করা যেতে পারে, যেখানে -আলহামদু লিল্লাহ- ইসলামী দন্ড-বিধির কার্যকারিতার বরকতসমূহ বিদ্যমান রয়েছে। যদি অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলিও ইসলামী দন্ড-বিধি কার্যকরী করে জনসাধারণের জন্য শান্তিময় জীবন-যাপনের সুব্যবস্থা করতে পারত, তাহলে কতই না ভাল হত!
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
আর হে বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্নগণ ! কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে জীবন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।
3 Tafsir Bayaan Foundation
আর হে বিবেকসম্পন্নগণ, কিসাসে রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে।
4 Muhiuddin Khan
হে বুদ্ধিমানগণ! কেসাসের মধ্যে তোমাদের জন্যে জীবন রয়েছে, যাতে তোমরা সাবধান হতে পার।
5 Zohurul Hoque
আর তোমাদের জন্য প্রতিশোধের বিধানে রয়েছে জীবন, হে জ্ঞানবান ব্যক্তিগণ! যাতে তোমরা ধর্মপরায়ণতা অবলন্বন করো।
6 Mufti Taqi Usmani
এবং হে বুদ্ধিমানেরা! কিসাসের ভেতর তোমাদের জন্য রয়েছে জীবন (রক্ষার ব্যবস্থা)। আশা করা যায় তোমরা (এর বিরুদ্ধাচরণ) পরিহার করবে।
7 Mujibur Rahman
হে জ্ঞানবান লোকেরা! কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে, যেন তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।
8 Tafsir Fathul Mazid
১৭৮ ও ১৭৯ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় আরবের দু’টি গোত্রকে কেন্দ্র করে। যার একটিকে অপেক্ষাকৃত বেশি মর্যাদাবান ও সম্মানি মনে করা হত। যার কারণে সম্মানের দাবিদার গোত্রের কোন কৃতদাস হত্যা করলে অপর গোত্রের স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করত, কোন মহিলাকে হত্যা করলে তার পরিবর্তে পুরুষকে হত্যা করত।
এরূপ হতাহতের ঘটনা দু’টি মুসলিম গোত্রে ঘটে গেল যা জাহেলী যুগ থেকে চালু ছিল। তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট অভিযোগ জানালো। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়ে জাহিলী প্রথা বাতিল করে দেয়। (আয়সারুত তাফাসীর, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১২৯)
জাহিলী যুগ যেখানে ছিল না কোন সুষ্ঠু আইন-কানুন, ছিল না কোন মানবতা। ছিল শুধু অন্যায় অবিচার, তাদের বিধান ছিল ‘জোর যার মুল্লুক তার’। তাদের এক প্রকার জুলুম ছিল এ রকম যে, যদি সবল ও সম্মানিত গোত্রের কোন পুরুষ লোক হত্যা করা হত, তাহলে কেবল হত্যাকারীকেই তারা হত্যা করত না, কখনো কখনো পুরো পরিবার ধ্বংশ করে দিত। মহিলার পরিবর্তে পুরুষকে, কৃতদাসের পরিবর্তে স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করত।
আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম সমাজকে এহেন অবস্থা থেকে মুক্ত করে ন্যায় ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ার বিধান দিলেন ‘কিসাস’-এর মাধ্যমে। হত্যাকারী পুরুষ, মহিলা, স্বাধীন ও ক্রীতদাস যেই হোক, নিহত ব্যক্তির কিসাসস্বরূপ তাকে হত্যা করা হবে। তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
الْمُسْلِمُونَ تَتَكَافَأُ دِمَاؤُهُمْ
মুসলিমরা রক্তে সবাই সমান। (আবূ দাঊদ হা: ২৭৫১, মুসনাদ আহমাদ হা: ৬৭১৭, হাদীসটি সহীহ)।
আয়াতের সরল অনুবাদে বলা হয়েছে- স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস ও নারীর বদলে নারী হত্যা করা হবে। এমতাবস্থায় যদি স্বাধীন ব্যক্তি ক্রীতদাসকে হত্যা করে বা পুরুষ মহিলাকে হত্যা করে তাহলে কি ক্রীতদাসের বদলে স্বাধীন ব্যক্তিকে আর মহিলার পরিবর্তে পুরুষকে হত্যা করা হবে না? উত্তর আয়াতটির এ শব্দগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবে সাজানোর কারণ হল- অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট। অর্থাৎ জাহিলী যুগের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যেমন কৃতদাসের পরিবর্তে স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করত বা মহিলার পরিবর্তে পুরুষকে হত্যা করত এমন করা যাবে না। বরং কিসাসে হত্যাকারীকেই হত্যা করা হবে। তাতে সে পুরুষ হোক অথবা মহিলা হোক, সবল হোক আর দুর্বল হোক, উঁচু বংশের হোক আর নীচু বংশের হোক। এটাই হলো মুসলিমরা রক্তে সবাই সমান।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَکَتَبْنَا عَلَیْھِمْ فِیْھَآ اَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِﺫ وَالْعَیْنَ بِالْعَیْنِ وَالْاَنْفَ بِالْاَنْفِ وَالْاُذُنَ بِالْاُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّﺫ وَالْجُرُوْحَ قِصَاصٌ)
“আমি তাদের জন্য তাতে ফরয করে দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং জখমের বদলে অনুরূপ জখম।”(সূরা মায়িদা ৫:৪৫)
(فَمَنْ عُفِیَ لَھ۫) ক্ষমা করে দেয়া দু’ভাবে হতে পারে:
১. বিনিময় ছাড়া আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ক্ষমা করা।
২. কিসাসের পরিবর্তে রক্তপণ গ্রহণ করা।
দ্বিতীয় পদ্ধতি অবলম্বন করলে ভালভাবে আদায় করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
(أَخِيْهِ) “তার ভাই” অর্থাৎ হত্যাকারী কাফির হবে না। কারণ এখানে ভাই দ্বারা উদ্দেশ্য হলো দীনি ভাই। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, এ অপরাধ করলে একজন মুসলিম কাফির হতে পারে না, যদি সে ঐ অপরাধ করা বৈধ মনে না করে।
(ذٰلِكَ تَخْفِيْفٌ مِّنْ رَّبِّكُم)
অর্থাৎ কিসাস না আদায় করে দিয়াত গ্রহণ করা অথবা সম্পূর্ণ ক্ষমা করে দেয়ার বিধান আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তোমাদর প্রতি শাস্তি হ্রাস ও বিশেষ অনুগ্রহ। ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্র্ণিত, তিনি বলেন: বানী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের মধ্যে কিসাস প্রথা চালু ছিল, কিন্তু দিয়াত তাদের মধ্যে চালু ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মাতের জন্য এ আয়াত অবতীর্ণ করে তাদের উপর বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। আর তা হলোঃ হত্যার ক্ষেত্রে কিসাস বা খুনের বদলে খুন তোমাদের জন্য ফরয করা হয়েছে। স্বাধীন মানুষের বদলে স্বাধীন মানুষ, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস এবং স্ত্রীলোকের বদলে স্ত্রীলোকের কিসাস নেয়া হবে। হ্যাঁ, কোন হত্যাকারীর সঙ্গে তার কোন (মুসলিম) ভাই নম্রতা দেখাতে চাইলে উল্লিখিত আয়াতে ক্ষমা এর অর্থ ইচ্ছাকৃত হত্যার ক্ষেত্রে দিয়াত গ্রহণ করে কিসাস ক্ষমা করে দেয়া।
(فَاتِّبَاعٌۭ بِالْمَعْرُوْفِ وَأَدَآءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ)
অর্থাৎ এ ব্যাপারে যথাযথ বিধি মেনে চলবে এবং নিষ্ঠার সাথে দিয়াত আদায় করে দেবে। তোমাদের পূর্বের লোকেদের ওপর আরোপিত কিসাস হতে তোমাদের প্রতি দিয়াত ব্যবস্থা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তোমাদের প্রতি শাস্তি হ্রাস ও বিশেষ অনুগ্রহ। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৯৮)
তবে কিসাস আদায় করা, দিয়াত গ্রহণ করা অথবা সম্পূর্ণ ক্ষমা করে দেয়া নিহত পরিবারের ইখতিয়ারাধীন, তাদেরকে কোনটাতে বাধ্য করা যাবেনা। এতে হত্যাকারী সন্তুষ্ট থাকুক আর নাই থাকুক।
মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: কোন ব্যক্তির (অধীনস্থ) কাউকে হত্যা করা হয়ে থাকলে তার দু’টি অবকাশ রয়েছে: এক. সে ইচ্ছা করলে দিয়াত গ্রহণ করতে পারবে। দুই. ইচ্ছা করলে কিসাস আদায় করতে পারবে। (সহীহ বুখারী হা: ১১২, ২৪৩৪, সহীহ মুসলিম হা: ১৩৫৫)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে: তাকে ক্ষমা করেও দিতে পারবে এ অধিকার রয়েছে। (ইরওয়া হা: ২২২০)
আর একজন ব্যক্তিকে হত্যার কারণে আক্রোশমূলক একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করা যাবে না। তবে একাধিক ব্যক্তি একজনকে হত্যা করার কাজে সম্পৃক্ত থাকলে তাদের সবাইকে হত্যা করা যাবে। (ইমাম বুখারী সহীহ বুখারীর দিয়াত অধ্যায়ে সনদবিহীন বর্ণনা করেছেন: উমার (রাঃ) একজন সানআ ব্যক্তিকে হত্যা করার কারণে সাতজনকে হত্যা করেছেন)। অনুরূপ পিতা সন্তানকে হত্যা করলে সন্তানের বদলে পিতাকে হত্যা করা যাবেনা। কারণ পিতা মূল আর সন্তান হল শাখা। (তিরমিযী হা: ১৪০০, ইবনু মাযাহ হা: ২৬৪৬, সহীহ) আবার কোন কাফিরকে মুসলিম হত্যা করলে তার বদলে মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না। (সহীহ বুখারী হা: ১১১)
(ذٰلِكَ تَخْفِيْفٌ مِّنْ رَّبِّكُم)
‘এটা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে হালকা বিধান’অর্থাৎ কিসাস না আদায় করে দিয়াত গ্রহণ করা অথবা সম্পূর্ণ ক্ষমা করে দেয়ার বিধান আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তোমাদের প্রতি শাস্তি হ্রাস ও বিশেষ অনুগ্রহ। ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্র্ণিত, তিনি বলেন: বানী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের মধ্যে কিসাস প্রথা চালু ছিল, কিন্তু দিয়াত তাদের মধ্যে চালু ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মাতের জন্য এ আয়াত অবতীর্ণ করেনঃ হত্যার ক্ষেত্রে কিসাস বা খুনের বদলে খুন তোমাদের জন্য ফরয করা হয়েছে। স্বাধীন মানুষের বদলে স্বাধীন মানুষ, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস এবং স্ত্রীলোকের বদলে স্ত্রীলোকের কিসাস নেয়া হবে। হ্যাঁ, কোন হত্যাকারীর সঙ্গে তার কোন (মুসলিম) ভাই নম্রতা দেখাতে চাইলে উল্লিখিত আয়াতে ক্ষমা এর অর্থ ইচ্ছাকৃত হত্যার ক্ষেত্রে দিয়াত গ্রহণ করে কিসাস ক্ষমা করে দেয়া।
দিয়াত বা রক্তপণ গ্রহণ করার পর অথবা ক্ষমা করার পরও যদি কেউ হত্যাকারীকে হত্যা করে তাহলে তা সীমালংঘন হবে। তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, এ কিসাসে তোমাদের জীবন রয়েছে। অর্থাৎ যখন হত্যাকারীর এ ভয় থাকবে যে, হত্যা করলে তাকেও হত্যা করা হবে তখন সে অবশ্যই হত্যা করা থেকে বিরত থাকবে। তাই যে সমাজে কিসাস বলবত থাকবে, সে সমাজ হত্যা, খুন-খারাবী ও অন্যায় থেকে মুক্ত থাকবে। ফলে সমাজে আসবে শান্তি ও নিরাপত্তা। এটাই হল কিসাসের মাঝে জীবন এর ব্যাখ্যা।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সমাজে কুরআন-সুন্নাহ প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যায় অবিচার, হত্যার ছড়াছড়ি ও অশ্লীলতা বেহায়াপনা থেকে মুক্ত থাকবে।
২. ইসলাম নারী-পুরুষ, স্বাধীন ও ক্রীতদাস, ধনী-গরীব সকলের জীবনের সমান মূল্যায়ণ করেছে।
৩. শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ার একমাত্র জীবন ব্যবস্থা ইসলাম।
9 Fozlur Rahman
হে বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা! কেসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন (বাঁচানোর ব্যবস্থা) নিহিত আছে, যাতে (এই বিধানের কল্যাণে) তোমরা রক্ষা পেতে পার।
10 Mokhtasar Bangla
১৭৯. আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য কিসাসের তথা অপরাধের সমপরিমাণ শাস্তির যে বিধান দিয়েছেন তাতে তোমাদের সত্যিকারের জীবন লুকিয়ে আছে। তাতে রয়েছে তোমাদের রক্তের হিফাযত ও পারস্পরিক অত্যাচারের প্রতিরোধ। তবে এটি বুঝবে ওই বুদ্ধিমানরা যারা আল্লাহর শরীয়ত মানা ও তা আমল করার মাধ্যমে তাঁকে ভয় করে।
11 Tafsir Ibn Kathir
১৭৮-১৭৯ নং আয়াতের তাফসীর
অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা বলেন-হে মুসলিমগণ! প্রতিশোধ গ্রহণের সময় ন্যায় পন্থা অবলম্বন করবে। স্বাধীন ব্যক্তির পরিবর্তে স্বাধীন ব্যক্তি, দাসের পরিবর্তে দাস এবং নারীর পরিবর্তে নারীকে হত্যা করবে। এই ব্যাপারে সীমালংঘন করবে না। যেমন সীমা লংঘন করেছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা। তারা আল্লাহর নির্দেশ পরিবর্তন করে ফেলেছিল। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ এই যে, অজ্ঞতার যুগে বান্ নাযীর ও বনু কুরাইযা নামক ইয়াহূদীদের দু'টি সম্প্রদায়ের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে বান্ নাযীর জয় যুক্ত হয়। অতঃপর তাদের মধ্যে এই প্রথা চালু হয় যে, যখন বান্ নাযীরের কোন লোক বানূ কুরাইযার কোন লোককে হত্যা করতো তখন প্রতিশোধ রূপে বানূ নাযীরের ঐ লোকটিকে হত্যা করা হতো না। বরং রক্তপণ হিসেবে তার নিকট হতে এক ওয়াসাক (প্রায় চার মণ) খেজুর আদায় করা হতো। আর যখন বান্ কুরাইযার কোন লোক বা নাযীরের কোন লোককে হত্যা করতো তখন প্রতিশোধ রূপে তাকেও হত্যা করা হতো এবং রক্তপণ গ্রহণ করা হলে দ্বিগুণ অর্থাৎ দুই ওয়াসাক খেজুর গ্রহণ করা হতো। সুতরাং মহান আল্লাহ অজ্ঞতা যুগের এই জঘন্য প্রথাকে উঠিয়ে দিয়ে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠিত করার নির্দেশ দেন।
ইমাম আবু হাতিমের (রঃ) বর্ণনায় এই আয়াতের শান-ই-নুযুল এই বর্ণনা করা হয়েছে যে, আরবের দুটি গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। ইসলাম গ্রহণের পর তারা পরস্পরে প্রতিশোধ গ্রহণের দাবীদার হয় এবং বলেঃ আমাদের দাসের পরিবর্তে তাদের স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করা হোক এবং আমাদের নারীর পরিবর্তে তাদের পুরুষকে হত্যা করা হোক। তাদের এই দাবী খণ্ডনে এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। এই হুকুমটিও মানসূখ। কুরআন মাজীদ ঘোষণা করেঃ اَلنَّفْسُ بِالنَّفْسِ অর্থাৎ প্রাণের পরিবর্তে প্রাণ। সুতরাং প্রত্যেক হত্যাকারীকে নিহত ব্যক্তির পরিবর্তে হত্যা করা হবে। স্বাধীন দাসকে হত্যা করুক বা এর বিপরীত, পুরুষ নারীকে হত্যা করুক বা এর বিপরীত। সর্বাবস্থায় এই বিধানই চালু থাকবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এরা পুরুষকে নারীর পরিবর্তে হত্যা করতো না। এই কারণেই اَلنَّفْسُ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنُ بَالْعَيْنِ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। সুতরাং স্বাধীন লোক সবাই সমান। প্রাণের বদলে প্রাণ নেয়া হবে। হত্যাকারী পুরুষই হোক বা স্ত্রী হোক। অনুরূপভাবে নিহত লোকটি পুরুষই হোক বা স্ত্রীই হোক। যখনই কোন স্বাধীন ব্যক্তি কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করবে তখন তার পরিবর্তে তাকেও হত্যা করা হবে। এরূপভাবে এই নির্দেশ দাস ও দাসীর মধ্যেও চালু থাকবে। যে কেউই প্রাণ নাশের ইচ্ছায় অন্যকে হত্যা করবে, প্রতিশোধ রূপে তাকেও হত্যা করা হবে। হত্যা ছাড়া জখম বা কোন অঙ্গ হানিরও এই নির্দেশই। হযরত ইমাম মালিক (রঃ) এই আয়াতটিকে اَلنَّفْسُ بِالنَّفْسِ এই আয়াত দ্বারা মানসূখ বলেছেন।
জিজ্ঞাস্যঃ
ইমাম আবু হানীফা (রঃ), ইমাম সাওরী (রঃ), ইমাম আবু লায়লা (রঃ) এবং ইমাম আবু দাউদ (রঃ)-এর মাযহাব এই যে, কোন আযাদ ব্যক্তি যদি কোন গোলামকে হত্যা করে তবে তার পরিবর্তে তাকেও হত্যা করা হবে। হযরত আলী (রাঃ), হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত সাঈদ বিন যুবাইর (রঃ), হযরত ইবরাহীম নখঈ (রঃ) হযরত হাকাম (রাঃ)-এরও এই মাযহাব। হযরত ইমাম বুখারী (রঃ), হযরত আলী বিন মাদীনী (রঃ), হযরত ইবরাহীম নাখঈ (রঃ)- এরও একটি বর্ণনা অনুসারে হযরত সাওরী (রঃ)-এরও মাযহাব এটাই যে, যদি কোন মনিব তার গোলামকে হত্যা করে তবে তার পরিবর্তে মনিবকেও হত্যা করা হবে। এর দলীল রূপে তারা এই হাদীসটি পেশ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি তার গোলামকে হত্যা করবে আমরাও তাকে হত্যা করবো, যে তার গোলামের নাক কেটে নেবে আমরাও তার নাক কেটে নেবো এবং যে তার অণ্ডকোষ কেটে নেবে তারও এই প্রতিশোধ নেয়া হবে। কিন্তু জমহুরের মাযহাব এই মনীষীদের উল্টো। তাঁদের মতে। দাসের পরিবর্তে স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে না। কেননা, দাস এক প্রকারের মাল। সে ভুল বশতঃ নিহত হলে রক্তপণ দিতে হয় না, শুধুমাত্র তার মূল্য আদায় করতে হয়। অনুরূপভাবে তার হাত, পা ইত্যাদির ক্ষতি হলে প্রতিশোধের নির্দেশ নেই। কাফিরের পরিবর্তে মুসলমানকে হত্যা করা হবে কিনা এ ব্যাপারে জমহুর উলামার মাযহাব তো এই যে, তাকে হত্যা করা হবে।। সহীহ বুখারী শরীফের এই হাদীসটি এর দলীল لَايُقْتَلُ مُسْلِمٌ لِكَافِرٍ অর্থাৎ ‘কাফিরের পরিবর্তে মুসলমানকে হত্যা করা হবে না। এই হাদীসের উল্টো না কোন সহীহ হাদীস আছে, না এমন কোন ব্যাখ্যা হতে পারে যা এর উল্টো হয়। তথাপি শুধু ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর মাযহাব এই যে, কাফিরের পরিবর্তে মুসলমানকে হত্যা করা হবে।
জিজ্ঞাস্যঃ
হযরত হাসান বসরী (রঃ) এবং হযরত আত্তার (রঃ)-এর উক্তি রয়েছে যে, পুরুষকে নারীর পরিবর্তে হত্যা করা হবে না। এর দলীল রূপে তাঁরা উপরোক্ত আয়াতটি পেশ করে থাকেন। কিন্তু ‘জমহুর-ই-উলামা-ই-ইসলাম এর বিপরীত মত পোষণ করেন। কেননা, সূরা-ই-মায়েদার এই আয়াতটি সাধারণ, যার মধ্যে اَلنَّفْسُ بِالنَّفْسِ বিদ্যমান রয়েছে। তাছাড়া হাদীস শরীফের মধ্যেও রয়েছে اَلْمُسْلِمُوْنَ تَتَكَافَا دِمَاءُهُمْ অর্থাৎ মুসলমানদের রক্ত পরস্পর সমান। হযরত লায়েস (রঃ)-এর মাযহাব এই যে, স্বামী যদি তার স্ত্রীকে মেরে ফেলে তবে তার পরিবর্তে তাকে (স্বামীকে হত্যা করা হবে না)
জিজ্ঞাস্যঃ
চার ইমাম এবং জমহুর-ই উম্মতের মাযহাব এই যে, কয়েকজন মিলে একজন মুসলমানকে হত্যা করলে তার পরিবর্তে তাদের সকলকেই হত্যা করা হবে। হযরত উমার ফারূক (রাঃ)-এর যুগে সাতজন মিলে একটি লোককে হত্যা করে। তিনি সাতজনকেই হত্যা করে দেন এবং বলেন—যদি সুন' পলীর। সমস্ত লোক এই হত্যায় অংশগ্রহণ করতো তবে আমি প্রতিশোধ রূপে সকলকেই হত্যা করতাম। কোন সাহাবীই তাঁর যুগে তাঁর এই ঘোষণার উল্টো করেননি। সূতরাং এই কথার উপর যেন ইজমা হয়ে গেছে। কিন্তু ইমাম আহমাদ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে-তিনি বলেন যে, একজনের পরিবর্তে একটি দলকে হত্যা করা হবে না, বরং একজনের পরিবর্তে একজনকেই হত্যা করা হবে। হযরত মুআয (রাঃ), হযরত ইবনে যুবাইর (রাঃ), আবদুল মালিক বিন মারওয়ান, যুহরী (রঃ), ইবনে সীরীন (রঃ) এবং হাবীব বিন আবি সাবিত (রঃ) হতেও এই উক্তিটি বর্ণিত আছে। ইবনুল মুনযির (রঃ) বলেন যে, এটাই সর্বাপেক্ষা সঠিক মত। একজন নিহত ব্যক্তির পরিবর্তে একটি দলকে হত্যা করার কোন দলীল নেই। হযরত ইবনে যুবাইর (রাঃ) হতে সাব্যস্ত আছে যে, তিনি এই মাসআলাটি স্বীকার করতেন না। সুতরাং সাহাবীদের (রাঃ) মধ্যে যখন মতবিরোধ দেখা দিয়েছে তখন এই মাসআলাটি বিবেচ্য বিষয় হয়ে পড়েছে। অতঃপর বলা হয়েছে যে, নিহত ব্যক্তির কোন উত্তরাধিকারী যদি হত্যাকারীর কোন অংশ ক্ষমা করে দেয় তবে সেটা অন্য কথা। অর্থাৎ সে হয়তো হত্যার পরিবর্তে রক্তপণ স্বীকার করে কিংবা হয়তো তার অংশের রক্তপণ ছেড়ে দেয় এবং স্পষ্টভাবে ক্ষমা করে দেয়। যদি সে রক্তপণের উপর সম্মত হয়ে। যায় তবে সে যেন হত্যাকারীর উপর জোর জবরদস্তি না করে, বরং যেন ন্যায়সঙ্গতভাবে তা আদায় করে। হত্যাকারীরও কর্তব্য এই যে, সে যেন তা সদ্ভাবে পরিশোধ করে, টালবাহানা যেন না করে।
জিজ্ঞাস্যঃ
ইমাম মালিক (রঃ) এর প্রসিদ্ধ মাযহাব, ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এবং তার ছাত্রদের মাযহাব, ইমাম শাফিঈ (রঃ) এর মাযহাব এবং একটি বর্ণনা অনুসারে ইমাম আহমাদ (রঃ)-এর মাযহাব এই যে, নিহত ব্যক্তির অভিভাবকদের ‘কিসাস ছেড়ে দিয়ে রক্তপণের উপর সম্মত হওয়া ঐ সময় জায়েয যখন স্বয়ং হত্যাকারীও তাতে সম্মত হয়। কিন্তু অন্যান্য মনীষীগণ বলেন যে, এতে হত্যাকারীর সম্মতির শর্ত নেই।
জিজ্ঞাস্যঃ
পূর্ববর্তী একটি দল বলেন যে, নারীরা যদি কিসাসকে ক্ষমা করে দিয়ে রক্তপণের উপর সম্মত হয়ে যায় তবে তার কোন মূল্য নেই। হযরত হাসান বসরী (রঃ), হযরত কাতাদাহ (রঃ), হযরত যুহরী (রঃ), হযরত ইবনে শিবরামাহ (রঃ), হযরত লায়েস (রঃ) এবং হযরত আওযায়ী (রঃ)-এর এটাই মাযহাব। কিন্তু অবশিষ্ট উলামা-ই-দ্বীন তাদের বিরোধী। এঁরা বলেন যে, যদি কোন নারীও রক্তপণের উপর সম্মত হয়ে যায় তবে কিসাস উঠে যাবে। অতঃপর বলা হচ্ছে যে, ইচ্ছাপূর্বক হত্যায় রক্তপণ গ্রহণ, এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে লঘু বিধান ও করুণা। পূর্ববর্তী উম্মতদের এই সুযোগ ছিল না। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, বানী ইসরাঈলের উপর ‘কিসাস’ (হত্যার পরিবর্তে হত্যা) ফরয ছিল। কিসাস’ ক্ষমা করে রক্তপণ গ্রহণের অনুমতি তাদের জন্যে ছিল না। কিন্তু উম্মতে মুহাম্মদীর (সঃ) উপর আল্লাহ তা'আলার এটাও বড় অনুগ্রহ যে, রক্তপণ গ্রহণও তাদের জন্যে বৈধ করা হয়েছে। তাহলে এখানে তিনটি জিনিস হচ্ছে। (১) কিসাস’, (২) রক্তপণ, (৩) ক্ষমা। পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্যে শুধুমাত্র ‘কিসাস’ ও ‘ক্ষমা ছিল, কিন্তু দিয়্যাতের বিধান ছিল কেউ কেউ বলেন যে, তাওরাতধারীদের জন্যে শুধু কিসাস ও ক্ষমার বিধান ছিল এবং ইঞ্জীলধারীদের জন্যে শুধু ক্ষমাই ছিল। তারপরে বলা হচ্ছে যে, যে ব্যক্তি রক্তপণ গ্রহণ বা মেনে নেয়ার পরেও বাড়াবাড়ি করে, তার জন্যে কঠিন বেদনাদায়ক শাস্তি রয়েছে। যেমন দিয়্যাত' গ্রহণ করার পরে আবার হত্যার জন্যে খড়গ হস্ত হয়ে গেল ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, কোন লোকের যদি কেউ নিহত বা আহত হয় তবে তার তিনটির যে কোন একটি গ্রহণের স্বাধীনতা। রয়েছে। (১) সে প্রতিশোধ গ্রহণ করুক, (২) বা ক্ষমা করে দিক, (৩) অথবা রক্তপণ গ্রহণ করুক। আর যদি সে আরও কিছু করার ইচ্ছে করে তবে তাকে বাধা প্রদান কর। এই তিনটির মধ্যে একটি করার পরেও যে বাড়াবাড়ি করবে সে চিরদিনের জন্যে জাহান্নামী হয়ে যাবে (আহমাদ)'। অন্য একটি হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন- 'যে ব্যক্তি রক্তপণ গ্রহণ করলে, অতঃপর হত্যাকারীকে হত্যা করে দিলো, এখন আমি তার নিকট হতে রক্তপণও নেবো না; বরং তাকে হত্যা করে দেবো।' অতঃপর ইরশাদ হচ্ছে-হে জ্ঞানীরা! তোমরা জেনে রেখো যে, কিসাসের মধ্যে মানব গোষ্ঠীর অমরত্ব রয়েছে। এর মধ্যে বড় দুরদর্শিতা রয়েছে। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে যে, একজনের পরিবর্তে অপরজন নিহত হচ্ছে, সুতরাং দু’জন মারা যাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যদি অন্তর্দষ্টি দিয়ে দেখা যায় তবে জানা যাবে যে, এটা জীবনেরই কারণ। হত্যা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির স্বয়ং এই ধারণা হবে যে, সে যাকে হত্যা করতে যাচ্ছে তাকে হত্যা করা উচিত হবে না। নতুবা তাকেও নিহত হতে হবে। এই ভেবে সে হত্যার কাজ হতে বিরত থাকবে। তাহলে দু’ব্যক্তি মৃত্যু হতে বেঁচে যাচ্ছে। পূর্বের গ্রন্থসমূহের মধ্যেও তো আল্লাহ তা'আলা এই কথাটি বর্ণনা করেছিলেন যে, اَلْقَتْلُ اَنْفَى الْقَتْلِ অর্থাৎ হত্যা হত্যাকে বাধা দেয়, কিন্তু কুরআন পাকের মধ্যে অত্যন্ত বাকপটুতা ও ভাষালঙ্কারের সাথে এই বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। অতঃপর বলা হচ্ছেঃ এটা তোমাদের বেঁচে থাকার কারণ। প্রথমতঃ তোমরা আল্লাহ পাকের অবাধ্যতা থেকে রক্ষা পাবে। দ্বিতীয়তঃ না কেউ কাউকে হত্যা করবে, না সে নিহত হবে। সুতরাং পৃথিবীর বুকে সর্বত্র নিরাপত্তা ও শান্তি বিরাজ করবে।تَقْوٰى হচ্ছে প্রত্যেক পুণ্যের কাজ করা এবং প্রত্যেক পাপের কাজ ছেড়ে দেয়ার নাম।