আল বাকারা আয়াত ২
ذٰلِكَ الْكِتٰبُ لَا رَيْبَ ۛ فِيْهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَۙ ( البقرة: ٢ )
Zaalikal Kitaabu laa raiba feeh; udal lilmuttaqeen (al-Baq̈arah ২:২)
English Sahih:
This is the Book about which there is no doubt, a guidance for those conscious of Allah . (Al-Baqarah [2] : 2)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
এটা ঐ (মহান) কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য পথ নির্দেশ। (আল বাকারা [২] : ২)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
এ গ্রন্থ; (কুরআন) এতে কোন সন্দেহ নেই, [১] সাবধানীদের জন্য এ (গ্রন্থ) পথ-নির্দেশক।[২]
[১] এ কিতাবের অবতরণ যে আল্লাহর নিকট থেকে এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। যেমন অন্য আয়াতে এসেছে, "এ কিতাবের অবতরণ বিশ্বপালনকর্তার নিকট থেকে এতে কোন সন্দেহ নেই।" (সূরা সাজদা ৩২;২) কোন কোন আলেমগণ বলেছেন, বাক্যটি ঘোষণামূলক হলেও তার অর্থ নিষেধমূলক। অর্থাৎ, لاَ تَرتَابُوا فِيهِ (এতে সন্দেহ করো না)। এ ছাড়াও এতে যেসব ঘটনাবলী উল্লেখ করা হয়েছে তার সত্যতা সম্পর্কে, যেসব বিধি-বিধান ও মসলা-মাসায়েল বর্ণিত হয়েছে সে সবের উপর মানবতার কল্যাণ ও মুক্তি যে নির্ভরশীল সে ব্যাপারে এবং যেসব আক্বীদা (তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত) সংক্রান্ত বিষয় আলোচিত হয়েছে তার সত্য হওয়ার ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ নেই।
[২] এই ঐশী গ্রন্থ আসলে তো সমস্ত মানুষের হিদায়াত এবং পথ প্রদর্শনের জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু এই নির্ঝরের পানি দ্বারা কেবল তারাই সিক্ত হবে, যারা 'আবে হায়াত' (সঞ্জীবনী পানি)-এর সন্ধানী এবং আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হবে। আর যাদের অন্তরে মৃত্যুর পর আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করার অনুভূতি এবং চিন্তা নেই, যাদের মধ্যে সুপথ সন্ধানের অথবা ভ্রষ্টতা থেকে বাঁচার কোনই উৎসাহ ও আগ্রহ নেই, তারা সুপথ কোথা থেকে এবং কেনই বা পাবে? (সকাল তো তাদের জন্য, যারা ঘুম ছেড়ে চোখের পাতা মেলে জেগে ওঠে।)
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
এটা [১] সে কিতাব; যাতে কোন সন্দেহ নেই [২] মুত্তাকীদের জন্য [৩] হেদায়েত,
[১] এখানে (ذلك) শব্দের অর্থ - ঐটা, সাধারণতঃ কোন দূরবতী বস্তুকে ইশারা করার জন্য
ব্যবহৃত হয়। এখানে (ذلك) দ্বারা কি উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে এ ব্যাপারে আলেমগণ থেকে কয়েকটি মত বর্ণিত হয়েছেঃ
১) (ذلك) শব্দের অর্থ তাওরাত ও ইঞ্জিল বুঝানো হয়েছে, তখন তার অর্থ হবেঃ হে মুহাম্মাদ! (রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঐ কিতাব যা আমি তাওরাত ও ইঞ্জিলে উল্লেখ করেছিলাম, তা-ই আপনার উপর নাযিল করেছি। অথবা, হে ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায়! তোমাদেরকে যে কিতাবের ওয়াদা আমি তোমাদের কিতাবে করেছি সেটা এই কিতাব যা আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নাযিল করেছি।
২) এখানে (ذلك) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, এ আয়াতসমূহের পূর্বে মক্কা ও মদীনায় নাযিল কুরআনের অন্যান্য সূরা ও আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করা। আর যেহেতু সেগুলো আগেই গত হয়েছে, সেহেতু (ذلك) দ্বারা সম্বোধন শুদ্ধ হয়েছে।
৩) কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এখানে কিতাব বলতে ঐ কিতাবকে বুঝিয়েছেন, যা আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর কাছে রেখে দিয়েছেন। যা লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত।
৪) এখানে কিতাব দ্বারা ঐ কিতাব উদ্দেশ্য, যাতে আল্লাহ্ তা'আলা বান্দার ভাল-মন্দ, রিয্ক, আয়ু ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।
৫) এখানে ঐ কিতাব বুঝানো হয়েছে যা তিনি নিজে লিখে রেখেছেন তাঁর কাছে আরশের উপর, যেখানে লেখা আছে, “আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রাধান্য পাবে”। [বুখারী; ৭৫৫৩, মুসলিম; ২৭৫১]
৬) (الم) দ্বারা যদি পবিত্র কুরআন বুঝানো হয়ে থাকে, অর্থাৎ (الم) কুরআনের নাম হয়ে থাকে, তাহলে (ذلك الكتاب) দ্বারা (الم) বুঝানো হয়েছে।
৭) এখানে (ذلك) দ্বারা (هذا ) বুঝানো হয়েছে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] অর্থাৎ এই কিতাব যার আলোচনা হচ্ছে, বা সামনে আসছে। সুতরাং এর দ্বারা কুরআনকেই বুঝানো হয়েছে। আর এ শেষোক্ত মতই সবচেয়ে বেশী বিশুদ্ধ। সুতরাং (الكتاب) দ্বারা কুরআন মাজীদকে বোঝানো হয়েছে।
[২] এ আয়াতে উল্লেখিত (ريب) শব্দের অর্থ এমন সন্দেহ যা অস্বস্তিকর। এ আয়াতের বর্ণনায় মুফাসসিরগণ বিভিন্ন মত পোষন করেছেনঃ
১) এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এ কুরআন আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে।
২) তোমরা এ কুরআনের মধ্যে কোন সন্দেহ করো না। [ইবনে কাসীর]
৩) কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এর অর্থ তোমরা এ কুরআনের মধ্যে কোন সন্দেহে নিপতিত হবে না। অর্থাৎ এর সবকিছু স্পষ্ট।
৪) কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ যদি কিতাব দ্বারা ঐ কিতাব উদ্দেশ্য হয়, যাতে আল্লাহ্ তা'আলা সবকিছুর ভালমন্দ হওয়া লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, তাহলে (لا ريب) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, এতে কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন নেই।
[৩] ‘মুত্তাকীন’ শব্দটি ‘মুত্তাকী’-এর বহুবচন। মুত্তাকী শব্দের মূল ধাতু ‘তাকওয়া’। তাকওয়া হলো, নিরাপদ থাকা, নিরাপত্তা বিধান করা। শরী’আতের পরিভাষায় তাকওয়া হলো, বান্দা যেন আল্লাহ্র অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, আর তা করতে হলে যা করতে হবে তা হলো, তাঁর নির্দেশকে পুরোপুরি মেনে নেয়া, এবং তাঁর নিষেধকৃত বস্তুকে পুরোপুরি ত্যাগ করা। আর মুত্তাকী হলেন, যিনি আল্লাহ্র আদেশকে পুরোপুরি মেনে নিয়ে এবং তাঁর নিষেধ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থেকে তাঁর অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। [ইবনে কাসীর]
বর্ণিত আছে যে, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু উবাই ইবনে কা'ব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আপনি কি কখনো কাঁটাযুক্ত পথে চলেছেন? তিনি বললেন, অবশ্যই। উবাই বললেন, কিভাবে চলেছেন? উমর বললেন, কাপড় গুটিয়ে অত্যন্ত সাবধানে চলেছি। উবাই বললেন; এটাই হলো, তাকওয়া। [ইবনে কাসীর]
তবে প্রশ্ন হতে পারে যে, মুত্তাকীগণকে কেন হেদায়াত প্রাপ্তির জন্য নির্দিষ্ট করেছেন? এ ব্যাপারে আলেমগণ বলেন, মূলতঃ মুত্তাকীরাই আল্লাহ্র কুরআন থেকে হেদায়াত লাভ করতে পারেন, অন্যান্য যারা মুত্তাকী নন তারা হেদায়াত লাভ করতে পারেন না। যদিও কুরআন তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দেন। আর পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এ অর্থের উপর প্রমাণবহ। আল্লাহ্ বলেন, “নিশ্চয় এ কুরআন হিদায়াত করে সে পথের দিকে যা আকওয়াম তথা সুদৃঢ় এবং সৎকর্মপরায়ণ মু’মিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার”। [সূরা আল-ইসরা; ৯]
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, এ কুরআন তাদের জন্য হিদায়াত যারা হেদায়াত চেনার পর তা গ্রহণ না করার শাস্তির ভয়ে সদা কম্পমান। আর তারা তাঁর কাছ থেকে যা এসেছে তার সত্যায়নের মাধ্যমে রহমতের আশাবাদী। [তাফসীরে ইবনে কাসীর ও আততাফসীরুস সহীহ] তাছাড়া হিদায়াতের কোন শেষ নেই, মুত্তাকীরা সর্বদা আল্লাহ্র নাযিল করা হেদায়াতের মুখাপেক্ষী বিধায় হেদায়াতকে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। তবে অন্যান্য আয়াতে কুরআনকে সমস্ত মানবজাতির জন্য হেদায়াতকারী বলে উল্লেখ করেছেন, সেখানে এর অর্থ হলো, হিদায়াতের পথ তাদের দেখাতে পারে যদি তারা তা থেকে হিদায়াত নিতে চায়।
3 Tafsir Bayaan Foundation
এই সেই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত।
4 Muhiuddin Khan
এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য,
5 Zohurul Hoque
ঐ গ্রন্থ, এতে কোনো সন্দেহ নেই, মুত্তকীদের জন্য পথপ্রদর্শক --
6 Mufti Taqi Usmani
এটি এমন কিতাব, যার মধ্যে কোনও সন্দেহ নেই। এটা হিদায়াত এমন ভীতি অবলম্বনকারীদের জন্য
7 Mujibur Rahman
ইহা ঐ গ্রন্থ যার মধ্যে কোন সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই; ধর্ম-ভীরুদের জন্য এ গ্রন্থ পথনির্দেশ।
8 Tafsir Fathul Mazid
২ নং আয়াতের তাফসীর :
ذٰلِكَ - ‘ঐ’শব্দটি প্রকৃত অর্থে দূরের কোন কিছুকে ইঙ্গিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ হচ্ছে ‘ঐ’আবার কখনো নিকটবর্তী বস্তুর জন্যও ব্যবহৃত হয়। তখন এর অর্থ হবে ‘এই’। এ আয়াতে এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)।
ইবনু জুরাইজ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, এখানে ذٰلِكَ শব্দটি هٰذَا (এই) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আরবি ভাষায় এ দু’টি শব্দ অনেক সময় একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হয়ে থাকে। কারণ আরবরা এতদুভয়ের মাঝে তেমন কোন পার্থক্য করেন না। ইমাম বুখারী (রহঃ)ও আবূ ‘উবাইদাহ (রাঃ) থেকে এরূপ বর্ণনা রয়েছে।
ذٰلِكَ-এর উদ্দেশ্য: ذٰلِكَ-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুফাসসিরদের বিভিন্ন অভিমত থাকলেও সঠিক কথা হল এখানে ذٰلِكَ দ্বারা উদ্দেশ্য: কুরআনুল কারীম যা আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর নাযিল করেছেন। (আইসারুত তাফাসীর, জাযায়েরী)
كِتَابُ ‘গ্রন্থ’দ্বারা এখানে কুরআন মাজীদকে বুঝানো হয়েছে। যারা এর দ্বারা তাওরাত ও ইঞ্জিলকে উদ্দেশ্য করেছেন তাদের মতটি সঠিক নয়।
(لَا رَيْبَ فِيْهِ)
‘কোনরূপ সন্দেহ নেই’অর্থাৎ এতে কোন সংশয়-সন্দেহ নেই। এখানে رَيْبَ শব্দটি সন্দেহ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنْ كُنْتُمْ فِيْ رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلٰي عَبْدِنَا فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِثْلِه۪)
“এবং আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমরা যদি সন্দিহান হও, তবে তার সমতুল্য একটি ‘সূরা’তৈরি করে নিয়ে এসো।”(সূরা বাকারাহ ২:২৩)
এ শব্দটি আবার কখনো কখনো অপবাদ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন আরবি কবি জামীল বলেন:
بثينة قالت ياجميل أربتني فقلت كلا نا يابثينة مريب
‘অর্থাৎ বুসাইনা বলল, হে জামীল! তুমি আমাকে অপবাদ দিয়েছ? আমি বললাম: হে বুসাইনা! আমরা উভয়েই উভয়ের অপবাদ দানকারী।
আয়াতে সন্দেহ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এ কিতাব আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি নাযিল হয়েছে; এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অনুরূপ এ কিতাবে আলোচিত বিষয়সমূহ শতভাগ নিশ্চিত সত্য, এতেও কোন সন্দেহ করার সুযোগ নেই। পৃথিবীর মধ্যে কুরআন ব্যতীত অন্য কোন গ্রন্থ নেই যাকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন যে, এতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই
(هُدًي لِّلْمُتَّقِيْنَ)
‘মুত্তাক্বীদের জন্য হিদায়াত’অর্থাৎ এ কুরআন মুত্তাকী তথা আল্লাহভীরুদের জন্য হিদায়াত দানকারী। যারা কাফির-মুশরিক তাদেরকে হিদায়াত দানকারী নয়। এমনটিই আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে বলেছেন, যেহেতু মুত্তাকীরাই প্রকৃতপক্ষে কুরআনের মাধ্যমে উপকৃত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(قُلْ ھُوَ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا ھُدًی وَّشِفَا۬ئٌﺚ وَالَّذِیْنَ لَا یُؤْمِنُوْنَ فِیْٓ اٰذَانِھِمْ وَقْرٌ وَّھُوَ عَلَیْھِمْ عَمًیﺚ)
“বলঃ মু’মিনদের জন্য এটা পথ-নির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার; কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে তাদের জন্য অন্ধত্ব।”(সূরা হা-মীম সিজদাহ ৪১:৪৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا ھُوَ شِفَا۬ئٌ وَّرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ)
“আমি অবতীর্ণ করি কুরআন, যা মু’মিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমতস্বরূপ।”(সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৮২)
এখানে হিদায়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো-
الهدي الخاص
(বিশেষ হিদায়াত) অর্থাৎ দীন ইসলামের দিকে হিদায়াত দিয়ে অনুগ্রহ করা, এটা শুধু মু’মিনদের জন্য। তবে الهدي العام (সাধারণ হিদায়াত), যার উদ্দেশ্য হলো সত্যকে সুস্পষ্ট করে দেয়া, তাতে মু’মিন ও কাফির তথা সকল মানুষ শামিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْٓ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًي لِّلنَّاسِ وَبَيِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰي وَالْفُرْقَانِ)
“রমযান তো সেই মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে যা মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক এবং হিদায়েতের স্পষ্ট নিদর্শন ও ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী)।”(সূরা বাকারাহ ২:১৫৮) (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)
সুতরাং যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে হিদায়াত গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে কুরআন তেলাওয়াত ও গবেষণা করবে আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে তারাই হিদায়াত পাবে। অন্যথায় কেউ কুরআন তেলাওয়াত করে মুখস্ত ও গবেষণা করে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারে কিন্তু হিদায়াত পাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা যে উদ্দেশে কুরআন নাযিল করেছেন তা গ্রহণ করে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমীন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআনুল কারীম সকল প্রকার সংশয়-সন্দেহের ঊর্ধ্বে।
২. কুরআন শব্দ ও অর্থ উভয় দিক দিয়েই আল্লাহ তা‘আলার কালাম। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এসেছে আবার তাঁর কাছেই ফিরে যাবে।
৩. কুরআন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য একটি সর্বোত্তম গাইড ও জীবন বিধান।
৪. কুরআন দ্বারা কেবল মু’মিন-মুত্তাকীরা উপকৃত হয় বলে মুত্তাকীদের হিদায়াত দানকারী বলা হয়েছে। মূলত কুরআন সকলের জন্য পথ প্রদর্শক।
মুত্তাকীদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য পরবর্তী তিনটি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
9 Fozlur Rahman
এই তো কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই, আছে মোত্তাকীদের (অন্যায় পরিহারকারী, আল্লাহভীরু, সৎকর্মশীল ও ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের) জন্য পথনির্দেশ;
10 Mokhtasar Bangla
২. এটি হলো এমন এক মহান কুরআন যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। না তার নাযিল হওয়ার দিক থেকে, না তার শব্দ ও অর্থের দিক থেকে। অতএব, এটি আল্লাহর বাণী। যা মুত্তাকীদেরকে এমন এক পথের সন্ধান দেয় যা সরাসরি তাঁর নিকটই তাদেরকে পৌঁছিয়ে দেয়।
11 Tafsir Ibn Kathir
ইবনু জুরাইজ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, এখানে ذٰلِكَ শব্দটি هٰذَا-র অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মুজাহিদ (রঃ), ইকরামা (রঃ), সাঈদ বিন যুবাইর (রঃ), সুদ্দী (রঃ), মুকাতিল বিন হিব্বান, (রঃ) যায়েদ বিন আসলাম (রঃ) এবং ইবনে জুরাইজেরও (রঃ) এটাই মত। আরবী ভাষায় এই দু’টি শব্দ অধিকাংশই একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হয়ে থাকে। কারণ আরবরা। এতদুভয়ের মাঝে তেমন কোন পার্থক্য করে না। ইমাম বুখারী (রঃ) হযরত আবু উবাইদাহ (রাঃ) থেকেও এটাই নকল করেছেন। ভাবার্থ এই যে, ذٰلِكَ প্রকৃত পক্ষে দূরের ইঙ্গিতের জন্যে ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ হচ্ছে ‘ঐ’ কিন্তু আবার কখনও কখনও নিকটবর্তী বস্তুর জন্যেও আসে। তখন তার অর্থ হবে ‘এই'। এখানেও এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। যামাখশারী (রঃ) বলেন যে, এই ذٰلِكَ দ্বারা الــم-এর দিকে ইশারা করা হয়েছে। যেমন নিম্নের এ আয়াতে রয়েছেঃ لَّا فَارِضٌ وَّ لَا بِكْرٌعَوَانٌۢ بَیْنَ ذٰلِكَؕ অর্থাৎ ‘গরুটি বৃদ্ধও নয় আর একেবারে বাচ্চাও নয়, বরং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী জোয়ান।' (২:৬৮) অন্য জায়গায় আল্লাহ পাক বলেছেনঃ ذٰلِكُمْ حُكْمُ اللّٰهِؕ یَحْكُمُ بَیْنَكُمْؕ
অর্থাৎ ‘এটা আল্লাহর নির্দেশ, যিনি তোমাদের মধ্যে নির্দেশ দেন।' (৬০:১০) অন্য জায়গায় আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ذٰلِكُمُ اللهُ অর্থাৎ ইনিই হলেন আল্লাহ।' এ রকম আরও বহু স্থান আছে যেখানে পূর্বোল্লিখিত বস্তুর দিকে ذٰلِكَ দ্বারা ইশারা করা হয়েছে। আল্লাহই সবচেয়ে বেশী জানেন।
কোন কোন মুফাসসির বলেন যে, এই ذٰلِكَ দ্বারা কুরআন মাজীদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা অবতীর্ণ করার অঙ্গীকার রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে করা হয়েছিল। কেউ তাওরাতের দিকে কেউ ইঞ্জিলের দিকে ইঙ্গিতের কথাও বলেছেন। এই প্রকারের দশটি মত রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মুফাসসির ওগুলোকে দুর্বল বলেছেন।
كِتٰبٌ এর অর্থ কুরআন কারীম। যারা বলেছেন যে, ذٰلِكَ الْكِتٰبُ বলে তাওরাত ও ইঞ্জিলের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তারা খুব দূরের রাস্তা অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন অথবা খুব কষ্ট স্বীকার করেছেন। অকারণে এমন কথা বলেছেন যার সুষ্ঠু ও সঠিক জ্ঞান আদৌ তাঁদের নেই। رَيْبَ-এর অর্থ হচ্ছে সংশয় ও সন্দেহ। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং আরও কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) হতে এ অর্থ বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবুদারদা (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত সাঈদ বিন যুবাইর (রঃ), হযরত আবু মালিক নাফি’ (রঃ), যিনি হযরত ইবনে উমারের কৃতদাস, আতা’ (রঃ), আবুল আলিয়া (রঃ), রাবী’ বিন আনাস (রঃ), মুকাতিল বিন হিব্বান (রঃ), সুদ্দী (রঃ), কাতাদাহ (রঃ) এবং ইসমাঈল বিন আবু খালিদ (রঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে। ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বলেন যে, মুফাসসিরগণের মধ্যে এতে কোন মতভেদ নেই। رَيْبَ শব্দটি আরবদের কবিতায় অপবাদের অর্থেও এসেছে। যেমন প্রখ্যাত কবি জামীল বলেনঃ بُثَيْنَةُ قَالَتْ يَاجَمِيْلُ اَرْبِتْنِيْ ـ فَقُلْتُ كِلَانَا يَابُثَيْنُ مُرِيْبٌ অর্থাৎ ‘বুসাইনা বললো-হে জামীল! তুমি আমাকে অপবাদ দিয়েছে। আমি তখন বললাম-হে বুসাইনা! আমরা উভয়েই উভয়ের অপবাদ দানকারী।
এছাড়া প্রয়োজনের অর্থেও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আরব কবি বলেনঃ قَضَيْنَا مِنْ تِهَامَةَ كُلَّ رَيْبٍ ـ وَخَيْبَرَ ثُمَّ اَجْمَمْنَا السُّيُوْفَا অর্থাৎ তেহামার নিম্নভূমি থেকে এবং খাইবারের মালভূমি থেকেও সব প্রয়োজন মিটিয়ে নিলাম, অবশেষে তলোয়ার গুটিয়ে নিলাম। তাহলে لَارَيْبَ فِيْهِ-এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, এই কুরআন আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। যেমন সূরা-ই-সিজদার মধ্যে আছেঃ (নিশ্চয় এই কুরআন) বিশ্ব প্রতিপালকের তরফ হতে অবতীর্ণ। কেউ কেউ বলেছেন যে, এটা خَبَر হলেও نَهِىْ-এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ لَاتَرْتَابُوْا فِيْهِ ‘তোমরা এতে আদৌ সন্দেহ করো না। কোন কোন কার لَارَيْبَ এর উপরে وَقْف করে থাকেন এবং فِیْهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِیْنَ কে পৃথক বাক্য রূপে পাঠ করেন। কিন্তু لَارَيْبَ فِيْهِ এর উপর وَقْف করা বা না থামা খুবই উত্তম। কেননা, একই বিষয় এভাবেই সূরা-ই-সিজদার আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে এবং এর মধ্যে তুলনামূলক ভাবে فِیْهِ هُدًى এর চেয়ে বেশী مُبَالَغَة হয়। هُدًا শব্দটি আরবী ব্যাকরণ হিসেবে صِفَت হয়ে مَرْفُوْع হতে পারে এবং حَال হিসেবে مَنْصُوْب ও হতে পারে। এ স্থানে হিদায়াতকে মুক্তাকীনের সঙ্গে বিশিষ্ট করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ قُلْ هُوَ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا هُدًى وَّ شِفَآءٌ وَ الَّذِیْنَ لَا یُؤْمِنُوْنَ فِیْۤ اٰذَانِهِمْ وَقْرٌ وَّ هُوَ عَلَیْهِمْ عَمًىؕ অর্থাৎ এই কুরআন ঈমানদারদের জন্যে হিদায়াত ও শিফা বা আরোগ্য স্বরূপ এবং অবিশ্বাসীদের কর্ণ বধির এবং চক্ষু অন্ধ।' (৪১:৪৪) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ وَ نُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا هُوَ شِفَآءٌ وَّ رَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَۙ-وَ لَا یَزِیْدُ الظّٰلِمِیْنَ اِلَّا خَسَارًا
অর্থাৎ ‘এ কুরআন ঈমানদারদের জন্যে হিদায়াত ও শিফা বা প্রতিষেধক ও রহমত এবং অত্যাচারী লোকদের শুধু ক্ষয়-ক্ষতি বেড়ে চলেছে।' (১৭:৮২) এ বিষয়ের আরও ভূরি ভূরি আয়াত রয়েছে এবং এগুলোর বার্থ এই যে, যদিও কুরআন কারীম সকলের জন্যেই হিদায়াত স্বরূপ, তথাপি শুধু সৎ লোকেরাই এর দ্বারা উপকার পেয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ قَدْ جَآءَتْكُمْ مَّوْعِظَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ شِفَآءٌ لِّمَا فِی الصُّدُوْرِۙ۬-وَ هُدًى وَّ رَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ অর্থাৎ হে লোক সকল! তোমাদের নিকট তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে উপদেশ ও অন্তর-রোগের আরোগ্য এসে গেছে, যা মু'মিনদের জন্যে হিদায়াত ও রহমত স্বরূপ।' (১০:৫৭)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হিদায়াতের অর্থ হচ্ছে আলো। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, মুত্তাকীন তারাই যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করতঃ শিরক হতে দূরে থাকেন এবং আল্লাহ তা'আলার নির্দেশাবলী মেনে চলেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, মুত্তাকীন তারাই যারা আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করতঃ হিদায়াতকে পরিত্যাগ করেন না এবং তাঁর রহমতের আশা রেখে তার তরফ থেকে অবতীর্ণ কিতাবকে বিশ্বাস করে থাকেন। সুফইয়ান সাওরী (রঃ) ও হযরত হাসান বসরী বলেন, 'মুত্তাকীন তারাই যারা হারাম থেকে বেঁচে থাকেন এবং অবশ্য করণীয় কাজ নত মস্তকে পালন করে থাকেন। হযরত আবু বাকর বিন আইয়াশ (রঃ) বলেন, 'আমাকে হযরত আমাশ (রঃ) প্রশ্ন করেন, মুত্তাকী কারা?' আমি উত্তর দেই। তখন তিনি বলেন, হযরত কালবী (রঃ) কে একটু জিজ্ঞেস করে দেখুন।তিনি বলেন- মুত্তাকীন তাঁরাই যারা কাবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকেন। এতে দু'জনেই একমত হন।" হযরত কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, মুত্তাকীন তাঁরাই যাঁদের সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা আলোচ্য আয়াতের পরে বলেনঃ الَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِالْغَیْبِ وَ یُقِیْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَ مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ ـ وَ الَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكَ وَ مَاۤ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَۚ-وَ بِالْاٰخِرَةِ هُمْ یُوْقِنُوْنَ
যারা অদৃষ্ট বিষয়গুলিতে বিশ্বাস করে এবং যথা নিয়মে নামায কায়েম রাখে, আর আমি তাদেরকে যে সব রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে, আর তোমার প্রতি (হে রাসূল) যা নাযিল করা হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা নাযিল করা হয়েছিল তাতে যারা বিশ্বাস করে এবং আখেরাত সম্বন্ধে যারা দৃঢ় ইয়াকীন রাখে।' (২:৩-৪)
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেন যে, এসব গুণ মুত্তাকীনের মধ্যে একত্রে জমা হয়। জামে তিরমিযী ও সুনান-ই-ইবনে মাজার হাদীসে আতীয়াহ সা'দী থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ বান্দা প্রকৃত মুত্তাকী হতে পারে না যে পর্যন্ত না সে ঐ সমুদয় জিনিস ছেড়ে দেয় যাতে কোন দোষ নেই এই ভয়ে যে, দোষের মধ্যে যেন না পড়ে। মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমে আছে, হযরত মু'আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেনঃ “কিয়ামতের দিন যখন সমস্ত মানুষকে একটি ময়দানে আটক করা হবে সে সময় একজন আহ্বানকারী ডাক দিয়ে বলবেন, মুত্তাকীন কোথায়? এ ডাক শুনে তারা দাড়িয়ে যাবেন এবং আল্লাহ তাদেরকে তাঁর বাহুতে নিয়ে নেবেন এবং কোন পর্দা ছাড়াই তাদেরকে স্বীয় দর্শন দ্বারা সম্মানিত করবেন। আবু আফীফ (রঃ) স্বীয় উস্তাদ মুআয (রঃ) কে প্রশ্ন করেনঃ জনাব! মুত্তাকীন কে?' তিনি বলেন, যারা শিরক হতে এবং মুর্তিপূজা হতে বেঁচে থাকেন এবং খাটি অন্তরে তাঁর ইবাদত করেন, তাদেরকেই এরূপ সম্মানের সঙ্গে জান্নাতে পৌছিয়ে দেয়া হবে।' কখনও কখনও হিদায়াতের অর্থ হয় অন্তরের মধ্যে ঈমানের স্থিতিশীলতা। বান্দার অন্তরে এই হিদায়াতের উপর মহান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ক্ষমতা রাখে না। পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হচ্ছেঃ اِنَّكَ لَا تَهْدِیْ مَنْ اَحْبَبْتَ
অর্থাৎ হে নবী (সঃ)! যাকে তুমি হিদায়াত করতে চাও তাকে হিদায়াত করতে পার না।' (২৮:৫৬) আল্লাহ পাক আরও বলেনঃ لَیْسَ عَلَیْكَ هُدٰىهُمْ অর্থাৎ তাদেরকে হিদায়াত করার দায়িত্ব তোমার নেই।' (২:২৭২) অন্য স্থানে তিনি বলেছেনঃ مَنْ یُّضْلِلِ اللّٰهُ فَلَا هَادِیَ لَهٗؕ
অর্থাৎ আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার পথ প্রদর্শনকারী কেউ নেই।' (৭:১৮৬) আর এক জায়গায় তিনি বলেছেনঃ مَنْ یَّهْدِ اللّٰهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِۚ-وَ مَنْ یُّضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَهٗ وَلِیًّا مُّرْشِدًا অর্থাৎ যাকে তিনি পথ প্রদর্শন করেন সে-ই পথ প্রাপ্ত, আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন (হে নবী (সঃ)!) তুমি তার জন্যে কস্মিনকালেও সাহায্যকারী ও পথ প্রদর্শক পাবে না।' (১৮:১৭)
এই প্রকারের আরও আয়াত আছে। কখনও কখনও হিদায়াতের অর্থ হয়ে থাকে সত্য, সত্যকে প্রকাশ করা এবং সত্য পথ প্রদর্শন করা। যেমন আল্লাহ পাক বলেছেনঃ وَ اِنَّكَ لَتَهْدِیْۤ اِلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ অর্থাৎ নিশ্চয়ই তুমি সোজা পথ প্রদর্শনকারী।' (৪২:৫২) অন্য জায়গায় আল্লাহ বলেছেনঃ اِنَّمَاۤ اَنْتَ مُنْذِرٌ وَّ لِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ অর্থাৎ তুমি তো শুধু ভয় প্রদর্শক এবং প্রত্যেক কওমের জন্যে ভয় প্রদর্শক আছে।' (১৩:৭) পবিত্র কুরআনের অন্য স্থানে আছেঃ وَ اَمَّا ثَمُوْدُ فَهَدَیْنٰهُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمٰى عَلَى الْهُدٰى
অর্থাৎ ‘আমি সামুদ সম্প্রদায়কে সত্য পথ দেখিয়েছি, কিন্তু তারা সত্য পথের পরিবর্তে অন্ধত্বকে পছন্দ করেছে।' (৪১:১৭) অন্য স্থানে আল্লাহ পাক বলেছেনঃ وَهَدَيْنٰهُ النَّجْدَيْنِ অর্থাৎ ‘আমি তাদেরকে দু'টি পথ দেখিয়েছি অর্থাৎ মঙ্গল ও অমঙ্গলের পথ।' تَقْوٰى শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে খারাপ বা অপছন্দনীয় জিনিস থেকে বেঁচে থাকা। এটা মূলে ছিল وَقْىٌ যা وِقَايَةٌ হতে নেয়া হয়েছে। কবি নাবিগা যুবিয়ানী বলেনঃ سَقَطَ النَّصِفُ وَلَمْ تُرِدْ اِسْقَاطَهٗ ـ قَتَنَاوَلَتْهُ وَاِتَّقَتْنَا بِالْيَدِ অনুরূপভাবে আরও একজন কবি বলেনঃ فَالْقَتْ قَناعًا دُوْنَهُ الشَّمْسُ وَاتَّقَتْ ـ بِاَحْسَنِ مَوْصُوْلِيْنَ كَفِّ وَّمِعْصَمٍ অর্থাৎ সূর্য কিরণকে আড়াল করে সে (নারী)র ওড়না নিক্ষেপ করলো আর এভাবে স্বীয় কব্জি ও করতল মিলিয়ে সুন্দরভাবে নিজেকে রক্ষা করলো।'
হযরত উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) হযরত উবাই বিন কাবকে (রাঃ) প্রশ্ন করেনঃ তাওয়া কি?' তিনি উত্তরে বলেনঃ কাঁটাযুক্ত দুর্গম পথে চলার আপনার কোন দিন সুযোগ ঘটেছে কি?' তিনি বলেনঃ ‘হ’ তখন হযরত উবাই (রাঃ) বলেনঃ “সেখানে আপনি কি করেন?
হযরত উমর (রাঃ) বলেনঃ ‘কাপড় ও শরীরকে কাঁটা হতে রক্ষা করার জন্য সতর্কতা অবলম্বন করি। তখন হযরত উবাই (রাঃ) বলেনঃ تَقْوٰى ও ঐ রকমই নিজেকে রক্ষা করার নাম। ইবনুল মুআ'য তাঁর নিম্নের কবিতায় এ অর্থই গ্রহণ করেছেনঃ خَلِّ الذُّنُوْبَ صَغِيْرَهَا ـ وَكَبِيْرَهَا ذَاكَ التَّقِىُّ ، وَاصْنَعْ كَمَاشٍ فَوْقَ اَرْضِ ـ الشَّوْكِ يَحْذَرُ مَايَرٰى، لَا تَحْقِرَنَّ صَغِيْرَةً ـ اِنَّ الْجِبَالَ مِنَ الْحِصٰى অর্থাৎ ‘ছোট ও বড় পাপসমূহ পরিত্যাগ কর, এটাই তাওয়া। এমনভাবে কাজ কর যেমন বন্ধুর কন্টকাকীর্ণ পথের পথিক যা দেখে সে সম্পর্কে সতর্ক ও সজাগ থাকে। ছোট পাপগুলোকেও হালকা মনে করনা, জেনে রেখো যে, ছোট ছোট নুড়ি পাথর দ্বারাই পর্বত তৈরী হয়ে থাকে।
হযরত আবু দারদা (রাঃ) স্বীয় কবিতায় বলেনঃ يُرِيْدُ الْمَرْءُ اَنْ يُّوْتٰى مُنَاهٗ ـ وَيَاْبَى اللهُ اِلَّا مَا اَرَادَا، يَقُوْلُ الْمَرْءُ فَائِدَتِىْ وَمَالِىْ ـ وَتَقْوَى اللهِ اَفْضَلُ مَا اسْتَفَادَا অর্থাৎ মানুষ চায় যে, তার অন্তরের বাসনা কামনা পূরণ হোক, কিন্তু আল্লাহ তা অস্বীকার করেন। শুধু মাত্র সেটাই পূরণ হয় যেটা তিনি চান। মানুষ বলে এটা আমার লাভ আর এটা আমার মাল, কিন্তু আল্লাহর তাকওয়াই’ হচ্ছে তার লাভ ও মাল থেকে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ।
সুনান-ই-ইবনে মাজার হাদীসে হযরত আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর রাসূল (সঃ) বলেছেনঃ মানুষ সর্বোত্তম উপকার যা লাভ করে তা হচ্ছে আল্লাহর ভয়, এর পর সতী সাধ্বী স্ত্রী; স্বামী যখন তার দিকে চায় তখন সে তাকে সন্তুষ্ট করে এবং তাকে যা নির্দেশ দেয় তা সে পালন করে, কোন কসম দিলে তা পূর্ণ করে দেখায় এবং সে অনুপস্থিত থাকলে তার স্ত্রী তার মাল এবং স্বীয় নফসের রক্ষণাবেক্ষণ করে।