আল বাকারা আয়াত ২২
الَّذِيْ جَعَلَ لَكُمُ الْاَرْضَ فِرَاشًا وَّالسَّمَاۤءَ بِنَاۤءً ۖوَّاَنْزَلَ مِنَ السَّمَاۤءِ مَاۤءً فَاَخْرَجَ بِهٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزْقًا لَّكُمْ ۚ فَلَا تَجْعَلُوْا لِلّٰهِ اَنْدَادًا وَّاَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ( البقرة: ٢٢ )
Allazee ja'ala lakumul arda firaashanw wassamaaa'a binaaa 'anw wa anzala minassamaaa'i maaa'an fa akhraja bihee minas samaraati rizqal lakum falaa taj'aloo lillaahi andaadanw wa antum ta'lamoon (al-Baq̈arah ২:২২)
English Sahih:
[He] who made for you the earth a bed [spread out] and the sky a ceiling and sent down from the sky, rain and brought forth thereby fruits as provision for you. So do not attribute to Allah equals while you know [that there is nothing similar to Him]. (Al-Baqarah [2] : 22)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা ও আকাশকে ছাদ করেছেন এবং আকাশ হতে পানি বর্ষণ ক’রে তদ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেন, কাজেই জেনে বুঝে কাউকেও আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করো না। (আল বাকারা [২] : ২২)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ সরূপ সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশ হতে পানি বর্ষণ ক’রে তার দ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেছেন। সুতরাং জেনে শুনে কাউকেও আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করো না।
হিদায়াত এবং গুমরাহীর দিক দিয়ে মানুষের তিনটি দলের কথা উল্লেখ করার পর মহান আল্লাহর একত্ববাদ এবং তাঁর ইবাদতের প্রতি আহবান প্রত্যেক মানুষকে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, যখন তোমাদের ও সারা বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা আল্লাহ, তোমাদের সমস্ত প্রয়োজনের ব্যবস্থাপক তিনিই, তখন তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদত কেন কর? অন্যকে তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপন কেন কর? যদি তোমরা আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচতে চাও, তাহলে তার একটাই উপায় এই যে, তোমরা আল্লাহকে একক মেনে নিয়ে কেবল তাঁরই ইবাদত করো এবং জেনে-শুনে শির্ক করো না।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
যিনি যমীনকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আসমানকে করেছেন ছাদ এবং আকাশ হতে পানি অবতীর্ণ করে তা দ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেছেন। কাজেই তোমরা জেনে শুনে কাউকে আল্লাহ্র সমকক্ষ [১] দাঁড় করিও না।
[১] আয়াতে উল্লেখিত (أنداد) শব্দটি (ند) এর বহুবচন। যার অর্থ সমকক্ষ স্থির করা। এখানে আল্লাহ্র সমকক্ষ স্থির করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এ সমকক্ষ স্থির করাটাই শির্ক। আর শির্ক হচ্ছে সবচেয়ে বড় গোনাহ। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ আল্লাহ্র নিকট সবচেয়ে বড় গোনাহ কোনটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ্র সাথে কাউকে শরীক করা, অথচ তিনি সৃষ্টি করেছেন...। [বুখারীঃ ৪৪৭৭]
শির্কের প্রকারভেদঃ শির্ক দু'প্রকার, যথা- বড় শির্ক ও ছোট শির্ক। বড় শির্ক আবার দু'প্রকার। আল্লাহ্র রুবুবিয়্যাত তথা প্রভূত্বে শির্ক করা। আল্লাহ্র উলুহিয়াত তথা ইবাদাতে শির্ক করা। আল্লাহ্র রুবুবিয়্যাত বা প্রভূত্বে শির্ক দু’ভাবে হয়ে থাকে –
১) জগতের রব বা পালনকর্তা আল্লাহ্র অস্তিত্বকে স্বীকার না করা যেমন কমু্যনিষ্ট, নাস্তিক, মুলহিদ ইত্যাদি সম্প্রদায়। আল্লাহ্র নাম, গুণ ও কর্মকাণ্ডকে স্বীকার না করা, যেমন- ঈসমাঈলী সম্প্রদায়, বাহাই সম্প্রদায়, বুহরা সম্প্রদায়, জাহমিয়া ও মু'তাজিলা সমপ্রদায়। অনুরূপভাবে আল্লাহ্ ও বান্দার মধ্যে পার্থক্য না করে সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে এক করে দেখা যেমন ওয়াহদাতুল অজুদে বিশ্বাসী সম্প্রদায়, যারা মনে করে যে, আল্লাহ্ কোন কিছুর সূরত ইখতিয়ার করে তাতে নিজেকে প্রকাশ করেন যেমন, হুলুলী সম্প্রদায় এবং যারা বিশ্বাস করে যে, কারো পক্ষে আল্লাহ্র সাথে একাকার হয়ে যাওয়া সম্ভব।
২) জগতের রব বা পালনকর্তা আল্লাহ্র সত্তা, নাম, গুণাবলী ও তাঁর কর্মকাণ্ডে কাউকে সমকক্ষ নির্ধারণ করা।
ক) আল্লাহ্র স্বত্ত্বার সমকক্ষ কোন সত্তা নির্ধারণ করার মত কোন শির্ক বনী আদমের মধ্যে বিরল। এ ধরণের দাবী প্রথম নমরূদ করেছিল, কিন্তু ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর সাথে বিতর্কে সে তার সে দাবীর সপক্ষে যুক্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়ে হেরে গিয়েছিল। অনুরূপভাবে ফিরআউনও প্রকাশ্যে এ ধরণের দাবী করেছিল। আল্লাহ্ তাকে স্বপরিবারে দলবলসহ ধ্বংস করে তার দাবীর অসারতা দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
খ) আল্লাহ্র নামসমূহের কোন নাম অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করার মত শির্ক বিভিন্ন জাতিতে বিদ্যমান। যারাই তাদের উপাস্যদেরকে আল্লাহ্র নামের মত নাম দেয় তারাই এ ধরণের শির্কে লিপ্ত। যেমন হিন্দুগণ তাদের বিভিন্ন অবতারকে আল্লাহ্র নামসমূহের মত নাম দিয়ে থাকে। অনুরূপভাবে কোন কোন বাতেনী গ্রুপের লোকেরা যেমন, দ্রুজ সম্প্রদায়, নুসাইরী সম্প্রদায়, আগাখানী ঈসমাঈলী সম্প্রদায় তাদের ঈমামদেরকে আল্লাহ্র নামসমূহে অভিহিত করে।
গ) আল্লাহ্র গুণ ও কর্মকাণ্ডকে অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করা। আল্লাহ্র গুণ ও কর্মকাণ্ডের কোন শেষ নেই। সেগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। আল্লাহ্র অপার শক্তির সাথে সম্পৃক্ত, তাঁর জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত এবং হুকুম ও শরীআতের সাথে সম্পৃক্ত।
১. আল্লাহ্র অপার শক্তির সাথে যারা শির্ক করে তাদের উদাহরণ হলো, ঐ সমস্ত লোকেরা যারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে সৃষ্টি, মৃত্যু, জীবন, বিপদাপদ থেকে উদ্ধার, উদ্দেশ্য হাসিলকারী বলে বিশ্বাস করে। যেমন, অনেক অজ্ঞ মূৰ্খ মানুষ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে, অনেক সূফীরা তাদের পীর সাহেব সম্পর্কে বিশ্বাস করে থাকে। অনুরূপভাবে অনেকে কবরবাসী কোন লোক সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। তদ্রুপ অনেকে যাদুকর জাতীয় লোকদের সম্পর্কেও এ ধরণের বিশ্বাস করে। অনুরূপভাবে শিয়া সম্প্রদায়ও তাদের ইমামদের ব্যাপারে এ ধরণের বিশ্বাস করে।
২. আল্লাহ্র পরিপূর্ণ জ্ঞানের সাথে যারা শির্ক করে থাকে তাদের উদাহরণ হলো, ঐ সমস্ত লোকেরা যারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করে। যেমন, অনেক অজ্ঞ মূৰ্খ মানুষ রাসূল সাল্লাল্লাহু '‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে, অনেক সুফীরা তাদের পীর সাহেব সম্পর্কে বিশ্বাস করে যে তারা গায়েব জানে। আবার অনেকে কবরবাসী কোন কোন লোক সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। তদ্রুপ অনেকে গণক, জ্যোতিষ, জ্বিন, প্রেতাত্মা, ইত্যাদীতে বিশ্বাস করে যে, তারাও গায়েব জানে। অনুরূপভাবে শিয়া সম্প্রদায়ও তাদের ইমামদের ব্যাপারে বিশ্বাস করে যে, তারা গায়েব জানতো।
৩. আল্লাহ্র শরীআত ও হুকুমের সাথে যারা শির্ক করে থাকে তাদের উদাহরণ হলো, ঐ সমস্ত লোকেরা যারা আল্লাহ্র মত শরীআত প্রবর্তনের অধিকার তাদের আলেম ও শাসকদের দিয়ে থাকে। যেমন, ঐ সমস্ত জাতি যারা সরকার বা পার্লামেন্টকে আল্লাহ্র আইন বিরোধী আইন রচনার অনুমতি দিয়েছে। অনুরুপ যারা আল্লাহ্র আইন পরিবর্তন করে তদস্থলে অন্য আইনে বিচার করা শ্রেয় বা জায়েয বা আল্লাহ্র আইন ও অন্যান্য আইন সমমানের মনে করে থাকে। শির্কের এ সমস্ত প্রকার আল্লাহ্র রুবুবিয়্যাত তথা প্রভূত্বের সাথে সম্পৃক্ত।
আল্লাহ্র ইবাদাতে শির্কঃ আল্লাহ্র ইবাদাতে শির্ক বলতে বুঝায়, আল্লাহ্ যা কিছু ভালবাসেন সন্তুষ্ট হন বান্দার এমন সব কথা ও কাজ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা। যেমন আল্লাহ্ তাঁর কাছে দোআ করা ভালবাসেন, তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া ভালবাসেন, তাঁর কাছে উদ্ধার কামনা ভালবাসেন, তাঁর কাছে পরিপূর্ণভাবে বিনয়ী হওয়া ভালবাসেন, তাঁর জন্যই সিজদা, রুকু, সালাত, যবেহ,মানত ইত্যাদী ভালবাসেন। এর কোনকিছু যদি কেউ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে করে তবে তা হবে আল্লাহ্র ইবাদাতে শির্ক। অনুরুপভাবে কেউ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহ্র মত ভালবাসলে , অন্য কারো কাছে পরিপূর্ণ আশা করলে, অন্য কাউকে গোপন ভয় করলেও তা শির্ক হিসাবে গণ্য হবে। যেহেতু বান্দার ইবাদাতসমূহ বিশ্বাস, কথা ও কাজের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে, সে হিসাবে ইবাদতের মধ্যেও এ তিন ধরণের শির্ক পাওয়া যায়। অর্থাৎ কখনো কখনো ইবাদত হয় মনের ইচ্ছার মাধ্যমে, আন্তরিক আনুগত্যের মাধ্যমে, আবার কখনো কখনো তা সংঘটিত হয় বাহ্যিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আবার কখনো কখনো তা সংঘটিত হয়ে থাকে কথাবার্তার মাধ্যমে।
দ্বিতীয় প্রকার শির্ক হলোঃ ছোট শির্ক, কিন্তু তাও কবীরাগুনাহ হতে মারাত্মক। ছোট শির্কের উদাহরণ হলো, এ প্রকার বলা যে, কুকুর না ডাকলে চোর আসত, আপনি ও আল্লাহ্ যা চান, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা, সামান্য লোক দেখানোর জন্য কোন কাজ করা। ইত্যাদি। [ইবনুল কাইয়্যেম, আল-জাওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আনিদ দাওয়ায়িশ শাফী'; শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সুলাইমান আত-তামীমী, আল-ওয়াজিবুল মুতাহাত্তিমাতুল মারিফাহ'; আশ-শির্ক ফিল কাদীম ওয়াল হাদীস গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপিত]
3 Tafsir Bayaan Foundation
যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল-ফলাদি, তোমাদের জন্য রিয্কস্বরূপ। সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না।
4 Muhiuddin Khan
যে পবিত্রসত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ স্বরূপ স্থাপন করে দিয়েছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসাবে। অতএব, আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাকেও সমকক্ষ করো না। বস্তুতঃ এসব তোমরা জান।
5 Zohurul Hoque
যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে ফরাশ বানিয়েছেন, আর আকাশকে চাঁদোয়া, আর তিনি আকাশ থেকে পাঠান বৃষ্টি, তা’ দিয়ে তারপর ফলফসল উৎপাদন করেন তোমাদের জন্য রিযেক হিসেবে। অতএব আল্লাহ্র সাথে প্রতিদ্বন্ধী খাড়া করো না, অধিকন্তু তোমরা জানো।
6 Mufti Taqi Usmani
(সেই প্রতিপালকের), যিনি তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা বানিয়েছেন এবং আকাশকে ছাদ। আর আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন। তারপর তার মাধ্যমে তোমাদের জীবিকারূপে ফল-ফলাদি উদগত করেছেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর কোনও শরীক স্থির করো না- যখন তোমরা (এসব বিষয়) জান।
7 Mujibur Rahman
যিনি তোমাদের জন্য ভূতলকে শয্যা ও আকাশকে ছাদ স্বরূপ সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন, অতঃপর তদ্বারা তোমাদের জন্য উপজীবিকা স্বরূপ ফলপুঞ্জ উৎপাদন করেন, অতএব তোমরা আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করনা এবং তোমরা এটা অবগত আছ।
8 Tafsir Fathul Mazid
২১ ও ২২ নং আয়তের তাফসীর:
(یٰٓاَیُّھَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّکُمُ الَّذِیْ خَلَقَکُمْ.....)
আয়াতটি পূর্বের আয়াতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা তিন শ্রেণির (মু’মিন, কাফির ও মুনাফিক) লোকেদের কথা উল্লেখ করার পর সকল মানুষকে ডেকে একমাত্র তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ প্রদান করেন। মূলত এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ)
“আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও ইনসানকে এজন্য যে, তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করবে।”(সূরা জারিয়াত ৫১:৫৬)
ইবাদত অর্থ:
বিনয়-নম্র হওয়া, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় ইবাদত বলা হয়- বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রত্যেক ঐ সকল কথা ও কাজ যা আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন ও সন্তুষ্ট থাকেন। একজন মু’মিন যখন তার জীবনে সকল ইবাদত যথাযথ বাস্তবায়িত করতে পারবে তখন সে পরিপূর্ণতার উচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারবে। উবুদিয়্যাহ তথা আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও গোলাম হতে পারা মু’মিনের জন্য সবচেয়ে মর্যাদার বিষয় ও এতে সে আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়-পাত্রে পরিণত হয়। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ‘তাঁর আব্দ’তথা তাঁর বান্দা তথা গোলাম বলে সম্বোধন করেছেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও বলতেন: আমি একজন বান্দা, অতএব তোমরা আমাকে আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল বলেই সম্বোধন কর। (সহীহ ইবনু হিব্বান হা: ৪১৩)
সুতরাং এ থেকে প্রমাণ হয়, একজন মু’মিন ‘আব্দ’তথা আল্লাহ তা‘আলার বান্দা হওয়ায় শরীয়তের সীমার বাইরে যেতে পারে না যতই সে ইবাদতগুজারী হোক না কেন। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বেশি যিনি আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করেছেন তিনি হলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তিনি আল্লাহ তা‘আলার বান্দার সীমারেখার বাইরে যেতে পারেননি এবং তিনি বাইরে যেতে পছন্দও করতেন না। ঈসা (আঃ) নিজেও শিশু ও বৃদ্ধাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার বান্দা বলে পরিচয় দিতেন। অতএব যে সকল কথিত সূফী বলে থাকে- বান্দা ইবাদত করতে করতে এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যখন তার ইবাদতের দরকার হয় না, তখন শরীয়ত মানা আবশ্যক নয়। তাদের কথা ভ্রান্ত, তারা ইসলাম থেকে বহির্ভূত।
এ আয়াত থেকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর তাওহীদ বা এককত্ব ও তাঁর উলুহিয়্যাতের বর্ণনা শুরু করেছেন। তিনি স্বীয় বান্দাদেরকে অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, তিনিই প্রত্যেক প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নেয়ামত দান করেছেন। তিনিই জমিনকে বিছানাস্বরূপ বানিয়েছেন এবং আকাশকে ছাদস্বরূপ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَجَعَلْنَا السَّمَا۬ءَ سَقْفًا مَّحْفُوظًا وَّهُمْ عَنْ آيَاتِهَا مُعْرِضُونَ)
“এবং আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ; কিন্তু তারা আকাশে নিহিত নিদর্শনাবলী হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”(সূরা আম্বিয়াহ ২১:৩২) আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এমন সময়ে যখন মানুষ বৃষ্টির পূর্ণ মুখাপেক্ষী হয়। তারপর ঐ পানি দ্বারা বিভিন্ন ফলমূল উৎপন্ন করেন, যা থেকে মানুষ এবং জীবজন্তু উপকৃত হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(الَّذِیْ جَعَلَ لَکُمُ الْاَرْضَ فِرَاشًا وَّالسَّمَا۬ئَ بِنَا۬ئًﺕ وَّاَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ئِ مَا۬ئً فَاَخْرَجَ بِھ۪ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزْقًا لَّکُمْ)
“যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা ও আকাশকে ছাদস্বরূপ করেছেন এবং যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার দ্বারা তোমাদের জন্য উপজীবিকাস্বরূপ ফলসমূহ উৎপাদন করেন।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(اَللہُ الَّذِیْ جَعَلَ لَکُمُ الْاَرْضَ قَرَارًا وَّالسَّمَا۬ئَ بِنَا۬ئً وَّصَوَّرَکُمْ فَاَحْسَنَ صُوَرَکُمْ وَرَزَقَکُمْ مِّنَ الطَّیِّبٰتِﺚ ذٰلِکُمُ اللہُ رَبُّکُمْﺊ فَتَبٰرَکَ اللہُ رَبُّ الْعٰلَمِیْنَ)
“আল্লহই তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন বাসোপযোগী এবং আকাশকে করেছেন ছাদ এবং তোমাদের আকৃতি করেছেন উৎকৃষ্ট এবং তোমাদেরকে দান করেছেন উৎকৃষ্ট রিযিক। এই তো আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ কতই না বরকতময়!” (সূরা মু’মিন ৪০:৬৪)
অতএব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, পরিচালক ও সকলের মালিক। এ জন্যই তিনি সর্বপ্রকার ইবাদত পাওয়ার এবং তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপন না করার একমাত্র হকদার। তাই আল্লাহ তা‘আলা বললেন:
(فَلَا تَجْعَلُوْا لِلّٰهِ أَنْدَادًا وَّأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ)
“অতএব তোমরা জেনে শুনে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোন গুনাহ সবচেয়ে বড়? তিনি বললেন- আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশী স্থাপন করা অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫৬) মুআয বিন জাবাল (রাঃ) কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞাসা করে বললেন: হে মুআয! তুমি কি জান বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক কী? মুআয (রাঃ) বললেন: আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক হল- বান্দা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে অন্য কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫৬)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) অন্য বর্ণনায় বলেন:
(فَلَا تَجْعَلُوا لِلّٰهِ أَنْدَادًا)
“অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
انداد (সমকক্ষ) শির্ক। গভীর অন্ধকার রাতে কাল পাথরের ওপর কালো পিঁপড়ার চলাচল প্রত্যক্ষ করা যত সূক্ষ্ম, শির্ক তার চেয়ে বেশি সূক্ষ্ম। কখন কিভাবে একজন ব্যক্তি শির্কে লিপ্ত হয়ে যায় সে নিজেও বুঝতে পারে না। যেমন মানুষ বলে যে, যদি কুকুরটি না থাকত তাহলে চোর ঘরে ঢুকে পড়ত, এটা বলা শির্ক। কারণ চোর হতে বাঁচানোর মালিক একমাত্র আল্লাহ।
অনুরূপ অনেক শির্কী আকিদাহ, কথা ও কাজ আছে যা মানুষের মাঝে খুব প্রচলিত। এমনকি শির্কী কাজকে অনেকে অজ্ঞতাবশত ইবাদত মনে করে খুব বিনয়ের সাথে পালন করে থাকে। আকীদাহগত শির্ক যেমন: এরূপ বিশ্বাস করা- আল্লাহ স্ব-স্বত্তায় সর্বত্র বিরাজমান, ওলী-আউলিয়া অনেকক্ষেত্রে ভাল মন্দের মালিক, আল্লাহ ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, গাউস-কুতুব, ফকীর-দরবেশ বা জ্যোতিষী গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করা, কবরস্থ ব্যক্তি দু‘আ শুনতে পারে এবং বিপদাপদ প্রতিহত করে কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে, আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবাসার ন্যায় নিজের পীর ও অন্যান্য মানুষকে ভালবাসা, অন্তরে পীর ও অলিদের অনিষ্টের গোপন ভয় করা, তাদের কবরের মাটি, গাছ, নিকটস্থ কূপের পানি ও জীব-জন্তুর দ্বারা উপকারে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ওপর ভরসা করা ইত্যাদি।
বাচনিক শির্ক হয় এরূপ বললে যে: আল্লাহ যা চান আর আপনি যা চান, আমার সন্তানের কসম বা আল্লাহ ছাড়া যে কোন বস্তুর নামে কসম করা ইত্যাদি।
কর্মে শির্ক হয় যেমন: রোগ নিরাময় বা কোন প্রকার অনিষ্ট থেকে বাচাঁর জন্য শরীরে তা‘বীজ বা বালা ব্যবহার করা, মাযার ও কবরে দান করা, হাদিয়া দেয়া, মানত করা, কুরবানীর জন্য কোন পশু দেয়া, তাদের জন্য রুকু-সিজদা করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, তাদের কাছে সন্তান চাওয়া, ভাস্কর্য, স্মৃতিসৌধ, ওলী-আউলিয়া, দরবেশ, ফকীর বা মাযারের পাশ দাঁড়িয়ে নিরবতা ও বিনয় প্রকাশ করা, মানব রচিত বিধান ও আইন দ্বারা শাসন ও বিচার কার্য পরিচালনা করা, অলিদেরকে আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মাধ্যম নির্ধারণ করা ও তাদের কাছে শাফাআত চাওয়া। আল্লাহ যা হারাম করে দিয়েছেন তা কোন শাসক বা আলেম হালাল করে দিলে সে হারামকে হালাল হিসেবে মেনে নেয়া ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে ইবাদতের নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে তা পালনের ফলাফল উল্লেখ করে বলেন:
(لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)
যাতে তোমরা মুত্তাকী বা আল্লাহ-ভীরু হতে পার। সূরা বাকারার ২ নং আয়াতে মুত্তাকীদের পরিচয় ও তাদের বৈশিষ্ট্য এবং তাকওয়ার ফলাফল আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে পুনরুত্থান এর ব্যাপারে তিনটি দলীলের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যা অন্যান্য আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
১ নং দলীল: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রথমবার মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করতে সক্ষম তিনি দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে আরো অধিক সক্ষম। তিনি বলেন:
(كَمَا بَدَأْنَآ أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيدُه۫)
“যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করবো।”(সূরা আম্বিয়া ২১:১০৪) এরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীন: ৭৯, সূরা ক্বফ: ১৫, বানী ইসরাঈল: ৫১, সূরা হজ্জ এবং সূরা ওয়াকিয়া: ৬২ নং আয়াতে পুনরুত্থানের কথা আলোচনা করেছেন।
২ নং দলীল: আল্লাহ তা‘আলা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এর দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন:
(اَوَ لَمْ یَرَوْا اَنَّ اللہَ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ وَلَمْ یَعْیَ بِخَلْقِھِنَّ بِقٰدِرٍ عَلٰٓی اَنْ یُّحْیِ الْمَوْتٰ)
“তারা কি এটুকুও বোঝে না, যে আল্লাহ জমিন ও আসমান সৃষ্টি করলেন এবং এগুলো সৃষ্টি করতে তিনি ক্লান্ত হননি, সে আল্লাহ মৃতুকে অবশ্যই জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন।”(সূরা আহক্বাফ ৪৬:৩৩)
এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীন ৮১, সূরা বানী ইসরাঈল ৯৯, সূরা নাযিয়াত ২৭-২৮ নং আয়াতে এ ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন।
৩ নং দলীল: আল্লাহ তা‘আলা জমিন নির্জীব হবার পর পুনরায় তা জীবিত করেন। এটা পুনরুত্থানের সবচেয়ে বড় দলীল। এর দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ءِ مَا۬ءً فَأَخْرَجَ بِه۪ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًالَّكُمْ)
“এবং যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার দ্বারা তোমাদের জন্য উপজীবিকাস্বরূপ ফলসমূহ উৎপাদন করেন।”(সূরা বাকারাহ ২:২২)
অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَحْيَيْنَا بِه۪ بَلْدَةً مَّيْتًا كَذٰلِكَ الْخُرُوجُ)
“বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ; আমি বৃষ্টি দ্বারা জীবিত করি মৃত ভূমিকে; এভাবেই পুনরুত্থান ঘটবে।”(সূরা ক্বফ ৫০:১১)
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা সূরা হা-মীম-সিজদাহ: ৩৯, সূরা রূম: ১৯, আ‘রাফ: ৫৭ নং আয়াতে এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে আকাশ-জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং বৃষ্টি দ্বারা নির্জীব জমিনকে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম সেভাবে তিনি মানুষের মৃত্যুর পর হিসাব-নিকাশের জন্য পুনরুত্থিত করতে সক্ষম।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সৃষ্টিকর্তা যিনি ইবাদত পাওয়ার হকদার তিনিই আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। সুতরাং তিনিই সকল প্রকার ইবাদত পাওয়ার যোগ্য।
২. সকল মুসলিম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনীত শরীয়তের অধীন। কেউ যদি বিশ্বাস করে দুনিয়াতে এমন ওলী, কুতুব ও বুজুর্গ যারা শরীয়ত মেনে চলার ঊর্ধ্বে তাহলে তারা মুসলিম থাকবে না।
৩. শির্ক সবচেয়ে বড় জুলুম। অতএব তা থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে সকল প্রকার শির্ক হতে মুক্ত থাকতে হবে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা বান্দার হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করতে ও প্রত্যেকের প্রাপ্য প্রদান করার জন্য সকলকে পুনরুত্থিত করবেন। এটা তাঁর জন্য কঠিন কিছুই নয়।
৫. যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের দুনিয়াবী ও পরকালীন ফলাফল অবগত হলাম।
9 Fozlur Rahman
যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা এবং আকাশকে শামিয়ানা বানিয়ে দিয়েছেন; আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তার সাহায্যে তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপন্ন করেছেন। তোমরা তাই সবকিছু জেনে আল্লাহর জন্য অংশীদার সাব্যস্ত করো না।
10 Mokhtasar Bangla
২২. তিনিই তোমাদের জন্য জমিনকে বিস্তৃত বিছানা তথা বসবাস উপযোগী বানিয়েছেন। আর আকাশকে তার উপরে মজবুত ছাদ হিসেবে বানিয়ে রেখেছেন। তিনিই তোমাদের উপর বৃষ্টি অবতীর্ণ করেন নিয়ামত হিসেবে। যার মাধ্যমে তিনি জমিন থেকে বহু ধরনের ফল-ফলাদি তোমাদের রিযিক হিসেবে উৎপন্ন করেন। তাই তোমরা আল্লাহর সাথে কোন শরীক ও সমকক্ষ স্থাপন করবে না। অথচ তোমরা জানো যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ¯্রষ্টা নেই।
11 Tafsir Ibn Kathir
২১-২২ নং আয়াতের তাফসীর
এখান থেকে আল্লাহ তা'আলার তাওহীদ বা একত্ববাদ ও তাঁর উলুহিয়্যাতের বর্ণনা শুরু হচ্ছে। তিনি স্বীয় বান্দাগণকে অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বের দিকে টেনে এনেছেন, তিনিই প্রত্যেক প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নিয়ামত দান করেছেন, তিনিই যমীনকে বিছানা স্বরূপ বানিয়েছেন এবং আকাশকে ছাদ করেছেন। যেমন অন্য আয়াতে আছেঃ আমি আকাশকে নিরাপদ চাঁদোয়া বা ছাদ বানিয়েছি এবং এতদসত্ত্বেও তারা নিদর্শনাবলী হতে মুখ ফিরিয়ে থাকে। আকাশ হতে বারিধারা বর্ষণ করার অর্থ হচ্ছে মেঘমালা হতে বৃষ্টি বর্ষণ করা এমন সময়ে যখন মানুষ ও পূর্ণ মুখাপেক্ষী থাকে। অতঃপর ঐ পানি থেকে বিভিন্ন প্রকারের ফলমূল উৎপন্ন করা, যা থেকে মানুষ এবং জীবজন্তু উপকৃত হয়। যেমন কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় এর বর্ণনা এসেছে। এক স্থানে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ “তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্যে যমীনকে বিছানা ও আকাশকে ছাদ স্বরূপ বানিয়েছেন, সুন্দর সুন্দর কমনীয় আকৃতি দান করেছেন, ভাল ভাল এবং স্বাদে অতুলনীয় আহার্য পৌছিয়েছেন, তিনিই আল্লাহ যিনি বরকতময় সারা বিশ্বজগতের প্রতিপালক, সকলের সৃষ্টিকর্তা, সকলের আহারদাতা, সকলের মালিক আল্লাহ তাআলাই এবং এ জন্যেই তিনি সর্বপ্রকার ইবাদত ও তাঁর জন্যে অংশীদার স্থাপন না করার আসল হকদার। এজন্যে আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ “আল্লাহ তা'আলার জন্যে অংশীদার স্থাপন করো না, তোমরা তো বিলক্ষণ জান ও বুঝ।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে, হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সবচেয়ে বড় পাপ কোনটি? তিনি উত্তরে বলেনঃ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে অংশীদার স্থাপন করা। আর একটি হাদীসে আছে, হযরত মু'আযকে (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ বান্দার উপরে আল্লাহর হক কি তা কি তুমি জান? (তা হচ্ছে এই যে,) তাঁর ইবাদত। করবে এবং তাঁর ইবাদতে অন্য কাউকেও অংশীদার করবে না। অন্য একটি হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তোমাদের মধ্যে যেন কেউ একথা না বলে যে, যা আল্লাহ একা চান ও অমুক চায়। বরং যেন এই কথা বলে যে, যা কিছু আল্লাহ একাই চান অতঃপর অমুক চায়। হযরত আয়িশার (রাঃ) বৈমাত্রেয় ভাই হযরত তুফাইল বিন সাখবারাহ (রাঃ) বলেনঃ “আমি স্বপ্নে কতকগুলো ইয়াহূদকে দেখে জিজ্ঞেস করলামঃ “তোমরা কে?' তারা বললোঃ “আমরা ইয়াহূদী।' আমি বললাম, আফসোস! তোমাদের মধ্যে বড় অন্যায় এই আছে যে, তোমরা হযরত উযায়েরকে (রাঃ) আল্লাহর পুত্র বলে থাক। তারা বললোঃ ‘তোমরাও ভাল লোক, কিন্তু দুঃখের বিষয়, তোমরা বলে থাক যে, যা আল্লাহ চান ও মুহাম্মদ (সঃ) চান।' অতঃপর আমি খৃষ্টানদের দলের নিকট গেলাম এবং তারাও এ উত্তর দিল। সকাল হলে আমি আমার স্বপ্নের কথা কতকগুলি লোককে বললাম, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে তার কাছেও ঘটনাটি বর্ণনা করলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কারও কাছে স্বপ্নের কথা বর্ণনা করেছ কি?' আমি বললাম জি হাঁ। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আল্লাহর হামদ ও সানা বর্ণনা করার পর বললেনঃ তুফাইল (রাঃ) একটি স্বপ্ন দেখেছে এবং তোমাদের কারও কারও কাছে বর্ণনাও করেছে। আমি তোমাদেরকে একথাটি বলা হতে বিরত রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক কার্যের কারণে এ পর্যন্তও বলতে পারিনি। স্মরণ রেখো! এখন হতে আর কখনও যা আল্লাহ চান ও মুহাম্মদ (সঃ) চান’ একথা বলবে, বরং বলবে যা শুধু মাত্র আল্লাহ একাই চান’ (তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই)।
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে বললঃ যা আল্লাহ চান ও হযরত মুহাম্মদ (সঃ) চান। তিনি বললেনঃ তুমি কি আমাকে আল্লাহর অংশীদার করছো? এ কথা বল-যা আল্লাহ একাই চান’ (তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই)। এ সমস্ত কথা সরাসরি একত্ববাদের বিপরীত। আল্লাহর একত্ববাদের জন্যে এসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং আল্লাহই এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী জানেন। সমস্ত কাফির ও মুনাফিককে আল্লাহ তা'আলা তার ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর অর্থাৎ তার একত্ববাদের অনুসারী হয়ে যাও, তাঁর সঙ্গে কাউকেও অংশীদার করো না-যে কোন উপকারও করতে পারে না এবং ক্ষতিও না। তোমরা তো জান যে তিনি ছাড়া কোন প্রভু নেই, তিনি তোমাদেরকে আহার্য দান করেন এবং তোমরা এটাও জান যে আল্লাহর রাসূল (সঃ) তোমাদেরকে এই একত্ববাদের দিকে আহ্বান করেছেন এবং যার সত্যতায় কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। শিরক এটা থেকেও বেশী গোপনীয় যেমন পীপিলিকা-যা অন্ধকার রাতে কোন পরিষ্কার পাথরের উপর চলতে থাকে। মানুষের একথা বলা যে-যদি এ কুকুর না থাকতো তবে রাত্রে চোর আমাদের ঘরে ঢুকে পড়তো-এটাও শিরক। মানুষের একথা বলা যে, যদি হাঁস বাড়ীতে না থাকতো তবে চুরি হয়ে যেতো, এটাও শিরক। কারও একথা বলা। যে, যা আল্লাহ চান ও আপনি চান’ একথাও শিরক। কারও একথা বলা যে, যদি আল্লাহ না হতেন অমুক না হতো' এ সমস্তই শিরকের কথা।
সহীহ হাদীসে আছে কোন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে বললেনঃ যা আল্লাহ চান ও আপনি চান, তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ তুমি কি আমাকে আল্লাহর অংশীদার রূপে দাঁড় করছো? অন্য হাদীসে আছেঃ তোমরা কতই না উত্তম লোক হতে যদি তোমরা শিরক না করতে! তোমরা বলছে যে, যা আল্লাহ চান এবং অমুক চায়।' হযরত আবুল আলিয়া (রঃ) বলেন যে انداد -এর অর্থ হচ্ছে অংশীদার ও সমতুল্য। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, তোমরা তাওরাত ও ইঞ্জীল পড়ছ এবং জানছো যে আল্লাহ অংশীদার বিহীন, অতঃপর জেনেশুনে জ্ঞাতসারে আল্লাহ তা'আলার জন্যে অংশীদার স্থাপন করছ কেন?
মুসনাদ-ই- আহমাদে আছে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ মহাসম্মানিত আল্লাহ হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) কে পাঁচটি জিনিসের নির্দেশ দিয়ে বললেনঃ ‘এগুলোর উপর আমল কর এবং বানী ইসরাঈলকেও এর উপর আমল করার নির্দেশ দাও।' তিনি এ ব্যাপারে প্রায়ই বিলম্ব করে দিলে হযরত ঈসা (আঃ) তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেনঃ আপনার উপর বিশ্ব প্রভুর যে নির্দেশ ছিল যে,পাঁচটি কাজ আপনি নিজেও পালন করবেন এবং অপরকেও পালন করার নির্দেশ দিবেন। সুতরাং আপনি নিজেই বলে দিন বা আমি পেীছিয়ে দিই।' হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) বললেনঃ আমার ভয় হচ্ছে যে, যদি আপনি আমার অগ্রগামী হয়ে যান, তবে না জানি আমাকে শাস্তি দেয়া হবে বা মাটির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) বানী ইসরাঈলকে বাইতুল মুকাদ্দাসে একত্রিত করলেন। যখন মসজিদ ভরে গেল তখন তিনি উঁচু স্থানে বসলেন, আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তনের পর বললেনঃ আল্লাহপাক আমাকে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি নিজেও পালন করি এবং তোমাদেরকেও পালন করার নির্দেশ দেই। (তা হচ্ছে এই যে) (১) তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে, তার সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করবে না। এর দৃষ্টান্ত এই রূপ যেমন একটি লোক নিজস্ব মাল দিয়ে একটি গোলাম খরিদ করলো। গোলাম কাজ কাম করে এবং যা পায় তা অন্য লোককে দিয়ে দেয়। লোকটির গোলাম এরূপ হওয়া কি তোমরা পছন্দ কর? ঠিক এরকমই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা, তোমাদের আহার্য দাতা, তোমাদের প্রকৃত মালিক এক আল্লাহ, যার কোন অংশীদার নেই। সুতরাং তোমরা তাঁরই ইবাদত করবে এবং তার সঙ্গে অন্য কাউকেও অংশীদার করবে। (২) তোমরা নামায প্রতিষ্ঠিত করবে। বান্দা যখন নামাযের মধ্যে এদিক ওদিক না তাকায় তখন আল্লাহ তাআলা তার মুখোমুখী হন। যখন তোমরা নামায পড়বে তখন সাবধান! এদিক ওদিক তাকাবে না। (৩) তোমরা রোযা রাখবে। এর দৃষ্টান্ত এই যে, যেমন একটি লোকের কাছে থলে ভর্তি মৃগনাভি রয়েছে, যার সুগন্ধে তার সমস্ত সঙ্গীর মস্তিষ্ক সুবাসিত হয়েছে। স্মরণ রেখো যে, রোযাদার ব্যক্তির মুখের সুগন্ধি আল্লাহর নিকট এই মৃগনাভির সুগন্ধি হতেও বেশী পছন্দনীয়। (৪) সাদকা ও দান খায়রাত করতে থাকবে। এর দৃষ্টান্ত এরূপ যে, যেমন কোন এক ব্যক্তিকে শত্রুরা বন্দী করে ফেলেছে এবং তার ঘাড়ের সঙ্গে হাত বেঁধে দিয়েছে গর্দান উড়িয়ে দেয়ার জন্য বধ্যভূমিতে নিয়ে চলেছে। তখন সে বলছেঃ “আমাকে তোমরা মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দাও।' সুতরাং কম বেশী যা কিছু ছিল তা দিয়ে সে তার প্রাণ রক্ষা করলো। (৫) খুব বেশী তাঁর নামের অযিফা পাঠ করবে এবং তার খুব যিক্র করবে। এর দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির মত যার পিছনে খুব দ্রুত বেগে শত্রু দৌড়িয়ে আসছে এবং সে একটি মজবুত দুর্গে ঢুকে পড়ছে ও সেখানে নিরাপত্তা পেয়ে যাচ্ছে। এভাবে আল্লাহর যিকর দ্বারা শয়তান হতে রক্ষা পাওয়া যায়।'
একথা বলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আবার বলেনঃ ‘আমিও তোমাদের পাঁচটি জিনিসের নির্দেশ দিচ্ছি, যার নির্দেশ মহান আল্লাহ আমাকে দিয়েছেনঃ (১) মুসলমানদের দলকে আঁকড়ে ধরে থাকবে। (আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সঃ) এবং স্বীয় যুগের মুসলমান শাসন কর্তার নির্দেশাবলী মেনে চলা)। (২) (ধর্মীয় উপদেশ) শ্রবণ করা। (৩) মান্য করা। (৪) হিজরত করা এবং (৫) আল্লাহর পথে জিহাদ করা। যে ব্যক্তি কনিষ্ঠাঙ্গুলি পরিমাণ দল থেকে সরে গেল সে নিজের গলদেশ হতে ইসলামের হাঁসুলী নিক্ষেপ করে দিল। হ্যা, তবে যদি সে ফিরে আসে তবে তা অন্য কথা। যে ব্যক্তি অজ্ঞতা যুগের নাম ধরে ডেকে থাকে। সে দোযখের খড়কুটো। জনগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যদিও সে রোযাদার ও নামাযী হয়?' তিনি বললেন, যদিও সে নামায পড়ে রোযা রাখে এবং নিজেকে মুসলমান মনে করে। মুসলমানদেরকে তাদের সেই নামে ডাকতে থাকা যে নাম স্বয়ং কল্যাণময় আল্লাহ তা'আলা রেখেছেন, (তা হচ্ছে) মুসলেমীন, মুমেনীন এবং ইবাদুল্লাহ।'
এ হাদীসটি হাসান। এই আয়াতের মধ্যেও এটাই বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তোমাদেরকে আহার্য দিচ্ছেন। সুতরাং ইবাদতও তাঁরই কর। তাঁর সঙ্গে কাউকেও অংশীদার করো না। এ আয়াত দ্বারা সাব্যস্ত হচ্ছে যে, ইবাদতের মধ্যে আল্লাহ তা'আলার একত্ববাদের পূর্ণ খেয়াল রাখা উচিত। সমগ্র ইবাদতের যোগ্য একমাত্র তিনিই। ইমাম রাযী (রঃ) প্রভৃতি মনীষীগণ আল্লাহ তা'আলার অস্তিত্বের উপরেও এই আয়াত দ্বারা প্রমাণ গ্রহণ করেছেন এবং প্রকৃত পক্ষেও এই আয়াতটি আল্লাহ তা'আলার অস্তিত্বের উপরে খুব বড় দলিল। আকাশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন আকার, বিভিন্ন রং, বিভিন্ন স্বভাব এবং বিভিন্ন উপকারের প্রাণীসমূহ, ওদের সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব, তার ব্যাপক ক্ষমতা ও নৈপুণ্য এবং তার বিরাট সাম্রাজ্যের সাক্ষ্য বহন করছে।
কোন একজন বেদুঈনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ আল্লাহ যে আছে তার প্রমাণ কি? সে উত্তরে বলেছিলঃ সুবহানাল্লাহ! উটের বিষ্ঠা দেখে উট আছে এর প্রমাণ পাওয়া যায়, পায়ের চিহ্ন দেখে পথিকের পথ চলার প্রমাণ পাওয়া যায়; তাহলে এই যে বড় বড় নক্ষত্র বিশিষ্ট আকাশ, বহু পথ বিশিষ্ট যমীন, বড় বড় ঢেউ বিশিষ্ট সমুদ্র কি সেই মহাজ্ঞানী ও সূক্ষ্মদর্শী আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ দেয় না?
খলীফা হারুনুর রশীদ হযরত ইমাম মালিককে প্রশ্ন করেছিলেনঃ আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ কি?' তিনি বলেছিলেনঃ
ভাষা পৃথক হওয়া, শব্দ আলাদা হওয়া, স্বর মাধুর্য পৃথক হওয়া আল্লাহ আছেন বলে সাব্যস্ত করছে। হযরত ইমাম আবু হানীফাকেও (রঃ) এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেনঃ “আমাকে ছেড়ে দাও, আমি এখন অন্য চিন্তায় আছি। জনগণ আমাকে বলেছে যে, একখানা বড় নৌকা আছে যার মধ্যে বিভিন্ন ব্যবসায়ের মাল রয়েছে, ওর না আছে কোন রক্ষক বা না আছে কোন চালক। এটা সত্ত্বেও ওটা বরাবর নদীতে যাতায়াত করছে এবং বড় বড় ঢেউগুলো নিজে নিজেই চিরে ফেড়ে চলে যাচ্ছে। থামবার জায়গায় থামছে, চলবার জায়গায় চলছে, ওতে কোন মাঝিও নেই, কোন নিয়ন্ত্রকও নেই।' তখন প্রশ্নকারীরা বললোঃ আপনি কি বাজে চিন্তায় পড়ে আছেন? কোন্ জ্ঞানী এ কথা বলতে পারে যে, এত বড় নৌকা শৃংখলার সাথে তরঙ্গময় নদীতে আসছে-যাচ্ছে অথচ ওর কোন চালক নেই? তিনি বললেনঃ ‘আফসোস তোমাদের জ্ঞানে! একটি নৌকা চালক ছাড়া শৃংখলার সঙ্গে চলতে পারে না, কিন্তু এই সারা দুনিয়া, আসমান ও যমীনের সমুদয় জিনিস ঠিকভাবে আপন আপন কাজে লেগে রয়েছে অথচ ওর কোন মালিক, পরিচালক এবং সৃষ্টিকর্তা নেই? উত্তর শুনে তারা হতভম্ব হয়ে গেল এবং সত্য জেনে নিয়ে মুসলমান হয়ে গেল।
হযরত ইমাম শাফিঈ (রঃ) কেও এই প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেনঃ উঁত গাছের একই পাতা একই স্বাদ। ওকে পোকা, মৌমাছি, গরু, ছাগল, হরিণ ইত্যাদি সবাই খেয়ে থাকে ও চরে থাকে। এটা খেয়েই পোকা হতে রেশম বের হয়, মৌমাছি মধু দেয়, হরিণের মধ্যে মৃগনাভি জন্মলাভ করে এবং গরু-ছাগল গোবর ও লাদি দেয়। এটা কি ঐ কথার স্পষ্ট দলীল নয় যে, একই পাতার মধ্যে বিভিন্ন প্রকৃতির সৃষ্টিকারী একজন আছেন” তাকেই আমরা আল্লাহ মেনে থাকি, তিনিই আবিষ্কারক এবং তিনিই শিল্পী। হযরত ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের (রঃ) নিকটেও একবার আল্লাহর অসিত্বের উপর দলীল চাওয়া হলে তিনি বলেনঃ ' জেনে রেখো! এখানে একটি মজবুত দুর্গ রয়েছে। তাতে কোন দরজা নেই, কোন পথ নেই এমনকি ছিদ্র পর্যন্তও নেই। বাহিরটা চাদির মত চকচক করছে এবং ভিতরটা সোনার মত জ্বল জ্বল করছে, আর উপর নীচ, ডান বাম চারদিক সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ রয়েছে। বাতাস পর্যন্তও ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। হঠাৎ ওর একটি প্রাচীর ভেঙ্গে পড়লো এবং ওর ভিতর হতে চক্ষু কর্ণ বিশিষ্ট, চলৎ শক্তি সম্পন্ন সুন্দর আকৃতি অধিকারী একটি জীবন্ত প্রাণী বেরিয়ে আসলো। আচ্ছা বলতো এই রুদ্ধ ও নিরাপদ ঘরে এ প্রাণীটির সৃষ্টিকারী কেউ আছে কি নেই? সেই স্রষ্টার অস্তিত্ব মানবীয় অস্তিত্ব হতে উচ্চতর এবং তার ক্ষমতা অসীম কি-না? তার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, ডিমকে দেখ, ওর চারদিকে বন্ধ রয়েছে, তথাপি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ওর ভিতর জীবন্ত মুরগীর বাচ্চা সৃষ্টি করেছেন। এটাই আল্লাহর অস্তিত্ব ও তার একত্ববাদের প্রমাণ
হযরত আবু নুয়াস (রঃ) এই জিজ্ঞাস্য বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে বলেছিলেনঃ ‘আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষিত হওয়া ও তা হতে বৃক্ষরাজি সৃষ্টি হওয়া এবং তরতাজা শাখার উপর সুস্বাদু ফলের অবস্থান আল্লাহ তা'আলার অস্তিত্ব এবং তার একত্ববাদের দলীল হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। ইবনে মুআয (রঃ) বলেনঃ ‘আফসোস! আল্লাহ তা'আলার অবাধ্যতা এবং তাঁর সত্তাকে অবিশ্বাস করার। উপর মানুষ কি করে সাহসিকতা দেখাচ্ছে অথচ প্রত্যেক জিনিসই সেই বিশ্ব প্রতিপালকের অস্তিত্ব এবং তার অংশীবিহীন হওয়ার উপর সাক্ষ্য প্রদান করছে!
অন্যান্য গুরুজনের বচন হচ্ছে
তোমরা আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত কর, ওর উচ্চতা, প্রশস্ততা, ওর ছোট বড় উজ্জ্বল তারকারাজির প্রতি লক্ষ্য কর, ওগুলির ঔজ্জ্বল্য ও আঁকজমক, ওদের আবর্তন ও স্থিরতা এবং ওদের প্রকাশ পাওয়া ও গোপন হওয়ার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ কর। অতঃপর সমুদ্রের দিকে চেয়ে দেখ যার ঢেউ খেলতে রয়েছে ও পৃথিবীকে ঘিরে আছে। তারপর উচু নীচু পাহাড়গুলোর দিকে দেখ যা যমীনের বুকে গাড়া রয়েছে এবং ওকে নড়তে দেয়, ওদের রং ও আকৃতি বিভিন্ন। বিভিন্ন প্রকারের সৃষ্ট বস্তুর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ কর, আবার ক্ষেত্র ও বাগানসমূহকে সবুজ সজীবকারী ইতস্ততঃ প্রবাহমান সুদৃশ্য নদীগুলোর দিকে তাকাও, ক্ষেত্র ও বাগানের সবজীগুলো এবং ওদের নানা প্রকার ফল, ফুল এবং সুস্বাদু মেওয়াগুলোর কথা চিন্তা কর যে, মাটিও এক এবং পানিও এক, কিন্তু আকৃতি, গন্ধ, রং স্বাদ এবং উপকার দান পৃথক পৃথক। এসব কারিগরী কি তোমাদেরকে বলে দেয় না যে, ওদের একজন কারিগর আছেন? এসব আবিষ্কৃত জিনিস কি উচ্চরবে বলে না যে, ওদের আবিষ্কারক কোন একজন আছেন? এ সমৃদয় সৃষ্টজীব কি স্বীয় সষ্টিকর্তার অস্তিত্ব, তাঁর, সত্তা ও একত্ববাদের সাক্ষ্য প্রদান করে না? এ হচ্ছে দলীলের বোঝা বা মহা সম্মানিত ও মহা মর্যাদাবান আল্লাহ স্বীয় সত্তাকে স্বীকার করার জন্যে প্রত্যেক চক্ষুর সামনে রেখে দিয়েছেন যা তার ব্যাপক ক্ষমতা, পূর্ণ নৈপুণ্য, অদ্বিতীয় রহমত, অতুলনীয় দান এবং অফুরন্ত অনুগ্রহের উপর সাক্ষ্য দান করার জন্য যথেষ্ট। আমরা স্বীকার করছি যে, তিনি ছাড়া অন্য কোন পালনকর্তা, সৃষ্টিকর্তা এবং রক্ষাকর্তা নেই। তিনি ছাড়া কোন সত্য উপাস্যও নেই এবং নিঃসন্দেহে তিনি ছাড়া সিজদার হকদারও আর কেউ নেই। হ্যা, হে দুনিয়ার লোকেরা! তোমরা শুনে রেখো যে, আমার আস্থা ও ভরসা তাঁরই উপর রয়েছে, আমার কাকুতি মিনতি প্রার্থনা তারই নিকট, তারই সামনে আমার মস্তক অবনত হয়, তিনিই আমার আশ্রয় স্থল, সুতরাং আমি তারই নাম জপছি।