১২৪-১৩০ নং আয়াতের তাফসীর:
কিয়ামতের দিন একশ্রেণির মানুষ অন্ধ হয়ে উত্থিত হবে, অথচ তারা দুনিয়ায় চোখবিশিষ্ট ছিল, তার কারণ এ আয়াতগুলোতে বর্ণনা করা হচ্ছে। যারা আল্লাহ তা‘আলার যিকির ذِكْرِيْ তথা কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অমান্য করে, ইসলাম ও ঈমানের পরওয়া করে না তারাই কিয়ামতের দিন অন্ধ হয়ে উত্থিত হবে, তাদের জীবন হবে সংকটময়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلٰي وُجُوْهِهِمْ عُمْيًا وَّبُكْمًا وَّصُمًّا ط مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ ط كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنٰهُمْ سَعِيْرًا )
“কিয়ামতের দিন আমি তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায় অন্ধ, বোবা ও বধির করে। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম; যখনই তা স্তিমিত হবার উপক্রম হবে আমি তখনই তাদের জন্য অগ্নিশিখা বৃদ্ধি করে দেব” (সূরা ইসরা ১৭:৯৭)
(مَعِيْشَةً ضَنْكًا)
সংকীর্ণময় জীবন বলতে কেউ বলেছেন, কবরের জীবন উদ্দেশ্য। কেউ বলেছেন; দুনিয়াতে অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা ও ভয়-ভীতি অবস্থায় জীবন যাপন করবে।
কাফিররা কিয়ামতের দিন তাদের এ অন্ধত্বের কারণ জানতে চাইলে আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: তোমাদের কাছে দুনিয়াতে আমার নিদর্শনাবলী এসেছিল, কিতাব দিয়েছিলাম, রাসূল দিয়েছিলাম। তোমরা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মাধ্যমে আমাকে ভুলে ছিলে আজ আমিও তোমাদেরকে ভুলে যাব। অর্থাৎ জাহান্নামে দেয়া হবে, তার কোন কথাই শোনা হবে না। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(الَّذِيْنَ اتَّخَذُوْا دِيْنَهُمْ لَهْوًا وَّلَعِبًا وَّغَرَّتْهُمُ الْحَيٰوةُ الدُّنْيَا ج فَالْيَوْمَ نَنْسٰهُمْ كَمَا نَسُوْا لِقَا۬ءَ يَوْمِهِمْ هٰذَا لا وَمَا كَانُوْا بِاٰيٰتِنَا يَجْحَدُوْنَ )
“যারা তাদের দীনকে ক্রীড়া-কৌতুকরূপে গ্রহণ করেছিল এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে প্রতারিত করেছিল।’ সুতরাং আজ আমি তাদেরকে ভুলে যাব, যেভাবে তারা তাদের এদিনের সাক্ষাতকে ভুলে গিয়েছিল এবং যেভাবে তারা আমার নিদর্শনকে অস্বীকার করেছিল।” (সূরা আ‘রাফ ৭:৫১)
(وَكَذٰلِكَ نَجْزِيْ)
অর্থাৎ যারা কুফরী করে নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে, আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনেনি তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকেন। তাছাড়া তাদের জন্য পরকালে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি তো রয়েছেই।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা আশ্চর্যবোধক শব্দে বলছেন: তাদের পূর্বে কত জাতি ধ্বংস করেছি। তারা এখনও তাদের জনপদে হাঁটা-চলা করে, এগুলোও কি তাদেরকে হিদায়াত দিল না! নিশ্চয়ই জ্ঞানীদের জন্য এগুলোর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে। একটু চিন্তা করলেই অনুধাবন করতে পারত আমাদের পূর্বের এসব জাতিকে কেন ধ্বংস করা হল? নিশ্চয়ই তারা আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হয়েছিল, তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। কিয়ামতের দিন ও জাহান্নামের শাস্তি পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করা না থাকলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সাথে সাথেই ধ্বংস করে দিতেন।
(قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوْبِهَا)
সূর্যোদয়ের পূর্বে কথা দ্বারা ফজর ও সূর্যাস্তের পূর্বে কথা দ্বারা আসরের সালাত উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও তাসবীহসহ সালাত আদায় কর। যেমন হাদীসে এসেছে: জারীর বিন আবদুল্লাহ আল-বাজালী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বসেছিলাম। তিনি পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন: তোমরা সত্বরই তোমাদের রবকে এভাবেই দেখতে পাবে যেভাবে এ চাঁদকে কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই দেখতে পাচ্ছ। সুতরাং সম্ভব হলে তোমরা সূর্যোদয়ের পূর্বের ও সূর্যাস্তের পূর্বের সালাতের হেফাযত কর। এরপর তিনি উক্ত আয়াতটি পাঠ করেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫৫৪, সহীহ মুসলিম হা: ৪৩৯)
(وَمِنْ اٰنَآئِ اللَّيْلِ فَسَبِّحْ وَأَطْرَافَ النَّهَارِ)
এখানে রাত্রিকালে বলতে তাহাজ্জুদের সালাত বুঝানো হয়েছে। তবে কেউ কেউ বলেন, এর দ্বারা মাগরিব ও এশার সালাত বুঝানো হয়েছে। আর দিবসের প্রান্তসমূহেও, যাতে তুমি সন্তুষ্ট হতে পার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَسَوْفَ يُعْطِيْكَ رَبُّكَ فَتَرْضٰي)
“তোমার পালনকর্তা সত্বরই তোমাকে দান করবেন, অতঃপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন।” (সূরা যুহা ৯৩:৫) হাদীসে এসেছে আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: হে জান্নাতবাসীরা! তারা উত্তরে বলবে: হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা হাজির আছি। তখন তিনি বলবেন: তোমরা খুশী হয়েছ কি? তারা জবাব দেবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের কী হয়েছে যে, আমরা খুশী হব না? আপনি তো আমাদেরকে এমন কিছু দিয়েছেন যা আপনার সৃষ্টজীবের আর কাউকেও দেননি। আল্লাহ তা‘আলা তখন বলবেন, এগুলো অপেক্ষাও উত্তম জিনিস আমি তোমাদেরকে প্রদান করবো। তারা উত্তরে বলবে: এর চেয়েও উত্তম জিনিস আর কী আছে? আল্লাহ তা‘আলা জবাব দেবেন: আমি তোমাদেরকে আমার সন্তুষ্টি প্রদান করছি। এরপরে আর কোন দিন আমি তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হব না। (সহীহ বুখারী হা: ৬৫৪৯, সহীহ মুসলিম হা: ২৮২৯)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার বিধান থেকে যে বিমুখ হবে তাকে পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
২. আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সাথে কথা বলবেন।
৩. আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেকের জন্য একটি নির্দিষ্ট কাল ঠিক করে রেখেছেন।
৪. বিপদে-আপদে ধৈর্যধারণ করতে হবে।
৫. ফজর ও আসর এবং তাহাজ্জুদ সালাতের গুরুত্ব সম্পর্কে জানা গেল।
৬. আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করার গুরুত্ব জানা গেল।