৫৩-৫৪ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছেন যারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে এসে নিজেদের ঈমানদারী ও শুভাকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ করতো এবং শপথ করে করে বলতো যে, তারা জিহাদে গমনের জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে। কিন্তু হুকুমের অপেক্ষায় রয়েছে। হুকুম হওয়া মাত্রই ঘরবাড়ী ও ছেলে মেয়ে ছেড়ে জিহাদের মাঠে পৌছে যাবে। আল্লাহ তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেনঃ “তোমরা শপথ করো না। তোমাদের আনুগত্যের মূলতত্ত্ব আমার জানা আছে। তোমাদের অন্তরে এক কথা, মুখে এক কথা। সুতরাং তোমাদের শপথের হাকীকত আমার অজানা নয়। তোমাদের মুখ যতটা মুমিন তোমাদের অন্তর ততটা কাফির। তোমাদের এই শপথগুলো শুধু মুসলমানদের সহানুভূতি লাভ করার জন্যে। হে মুমিনগণ! এই মুনাফিকরা তাদের শপথকে ঢাল বানিয়ে রেখেছে। তারা যে শুধু তোমাদের সামনে কসম করছে তা নয়, বরং কাফিরদের সামনেও তারা তাদের পক্ষ অবলম্বনের ও তাদের সাহায্য সহযোগিতার কসম খেয়ে থাকে। কিন্তু তারা এতো ভীরু ও কাপুরুষ যে, তাদের সাথেও তারা থাকতে পারে না।
এর ভাবার্থ এও হতে পারেঃ “হে মুনাফিকরা! তোমাদের জ্ঞানসম্মত ও পছন্দনীয় আনুগত্যের নীতি অবলম্বন করা উচিত ছিল, এভাবে শপথ করা মোটেই শোভনীয় নয়। তোমাদের সামনে মুসলমানরা বিদ্যমান রয়েছে। তাদেরকে তোমরা দেখতে পাচ্ছ যে, তারা না শপথ করছে, না বেড়ে বেড়ে কথা বলছে, বরং কাজের সময় তারা সবারই আগে বেরিয়ে পড়ছে। বেশী কথা না বলে কাজই তারা বেশী করছে। তোমরা যা কর আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত। তোমাদের কোন কাজই তাঁর কাছে গোপন নেই। প্রত্যেক অবাধ্য ও অনুগত তার কাছে প্রকাশমান। প্রত্যেকের ভিতরের খবর তিনি তেমনই জানেন যেমন জানেন বাইরের খবর। তোমরা বাইরে যা কিছুই প্রকাশ কর না কেন, তিনি তোমাদের অন্তরের লুক্কায়িত খবরও পূর্ণমাত্রায় রাখেন।
মহান আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি বলে দাও- তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য কর। অর্থাৎ তোমরা কুরআন ও হাদীসের অনুসরণ কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে জেনে রেখো যে, তোমাদের এই অপরাধের শাস্তি নবী (সঃ)-এর উপর পতিত হবে না। তার কাজ তো শুধু আল্লাহর পয়গাম মানুষের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া। তোমাদের উপর অর্পিত দায়িতের জন্যে তোমরাই দায়ী। আর তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব হচ্ছে রাসূল (সঃ)-এর কথা মেনে নেয়া এবং এর উপর আমল করা ইত্যাদি। হিদায়াত শুধু রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্যেই রয়েছে। কেননা, সরল সঠিক পথের দিকে আহ্বানকারী তিনিই। এই সরল সোজা পথ ঐ আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেবে যার রাজত্ব সমস্ত যমীন ও আসমানব্যাপী। রাসূল (সঃ)-এর দায়িত্ব শুধু পৌঁছিয়ে দেয়া। সবারই হিসাব গ্রহণের দায়িত্ব মহামহিমান্বিত আল্লাহর। যেমন তিনি বলেনঃ فَذَكِّرْ اِنَّمَاۤ اَنْتَ مُذَكِّرٌ ـ لَسْتَ عَلَیْهِمْ بِمُصَۜیْطِرٍ
অর্থাৎ “অতএব তুমি উপদেশ দাও; তুমি তো একজন উপদেশদাতা। তুমি তাদের কর্ম নিয়ন্ত্রক নও।” (৮৮: ২১-২২)।
অহাব ইবনে মুনাব্বাহ (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা'আলা বানী ইসরাঈলের নবীদের মধ্যে হযরত শাইয়া (আঃ) নামক একজন নবীর নিকট অহী করেনঃ “তুমি বানী ইসরাঈলের সমাবেশে দাঁড়িয়ে যাও। আমি তোমার মুখ দিয়ে যা বের করার বের করবো।” আল্লাহ তা'আলার এই নির্দেশক্রমেই হযরত শাইয়া (আঃ) দাঁড়িয়ে যান। তখন আল্লাহর হুকুমে তার মুখ দিয়ে নিম্ন লিখিত ভাষণ বের হয়ঃ
“হে আকাশ! শুন, এবং হে যমীন! চুপ থাকো। আল্লাহ তা'আলা একটা শান বা মাহাত্ম্য পূর্ণ করতে এবং একটা বিষয়ের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ইচ্ছা করেন। ওটা তিনি পূর্ণ করবেন। তিনি চান যে, জঙ্গলকে বাসযোগ্য করবেন, জনহীন মরুপ্রান্তরকে করবেন জনবসতিপূর্ণ, বালুকায়ময় মরুভূমিকে করবেন শ্যামল-সবুজ, দরিদ্রদেরকে করবেন সম্পদশালী এবং রাখালদেরকে তিনি বাদশাহ বানিয়ে দেবেন। তিনি অশিক্ষিতদের মধ্য হতে একজন নিরক্ষর লোককে নবী করে পাঠাবেন, যিনি চরিত্রহীন হবেন না এবং কর্কশ ভাষীও হবেন না। তিনি বাজারে হট্টগোল ও গোলমাল করবেন না। তিনি এতো বিনয়ী ও নম্র হবেন যে, তাঁর বস্ত্রের অঞ্চলের বাতাসে ঐ প্রদীপ নির্বাপিত হবে না যার পার্শ্ব দিয়ে তিনি গমন করবেন। তিনি যদি শুষ্ক বাঁশের উপর পা রেখেও চলেন তবুও ঐ বাঁশের চড়চড়ি শব্দ কারো কানে পৌঁছবে না। আমি তাকে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী রূপে পাঠাবো। তার মুখের ভাষা হবে মধুর ও পবিত্র। তাঁর আবির্ভাবের ফলে অন্ধ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে এবং বধির ফিরে পাবে শ্রবণশক্তি। তার বরকতে মোহরযুক্ত অন্তর খুলে যাবে। সমস্ত ভাল কাজ দ্বারা আমি তাকে শোভনীয় করবো। তাঁকে আমি সর্বদিক দিয়ে মধুর ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী করবো। সাকীনা বা চিত্ত প্রশান্তি হবে তাঁর পোশাক। পুণ্য হবে তাঁর রীতি-নীতি এবং তাঁর অন্তর হবে আল্লাহভীতিতে পরিপূর্ণ। তার কথা হবে জ্ঞানপূর্ণ এবং সত্যবাদিতা ও প্রতিজ্ঞা-পালন হবে তার স্বভাব। তার অভ্যাস ও প্রকৃতি হবে মার্জনা ও ক্ষমা এবং মঙ্গল কামনা। হক ও সত্য হবে তার শরীয়ত এবং আদল ও ইনসাফ হবে তার চরিত্র। হিদায়াত হবে তাঁর ইমাম এবং ইসলাম হবে তার মিল্লাত। তার নাম হবে আহমাদ (সঃ)। তাঁর কারণে আমি পথভ্রষ্টতার পরে হিদায়াত ছড়িয়ে দিবো। অজ্ঞতার পরে জ্ঞান বিকশিত হবে। তার কারণে অবনতির পরে উন্নতি হবে। তার মাধ্যমে অজানা জানার সাথে পরিবর্তিত হবে। স্বল্পতা আধিক্যে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। তারই কারণে আমি দারিদ্রকে পরিবর্তিত করবো ঐশ্বর্যে। যারা পরস্পর পৃথক পৃথক রয়েছে, তার মাধ্যমে আমি তাদেরকে পরস্পর মিলিত করবো। তার মাধ্যমে আমি পরস্পরের মধ্যে প্রেম-প্রীতি সৃষ্টি করবো। তাদের পরস্পরের মতানৈক্যের পর তার মাধ্যমে আমি তাদেরকে মতৈক্য পৌছিয়ে দিবো। তাঁর মাধ্যমে আমি পৃথক পৃথক হৃদয়কে এক হৃদয়ে পরিণত করবো। অর্থাৎ তারা পরস্পর শত্রুতা ভুলে গিয়ে একে অপরের বন্ধুতে পরিণত হয়ে যাবে, মনে হবে যেন একই হৃদয়। আল্লাহর অসংখ্য বান্দা ধ্বংস হতে রক্ষা পেয়ে যাবে। তার উম্মতকে আমি সমস্ত উম্মতের উপর মর্যাদা দান করবো, যারা জনগণের জন্যে উপকারী হবে। তারা ভাল কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজ হতে বিরত রাখবে। তারা হবে একত্ববাদী খাঁটি মুমিন। আল্লাহ তাআলার যতগুলো রাসূল আল্লাহ তা'আলার নিকট থেকে যত কিছু এনেছেন, এই শেষ নবী (সঃ) তাদের সকলকেই স্বীকার করবেন, কাউকেও অস্বীকার করবেন না।