৪৪-৪৭ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা'আলা স্বীয় শেষ নবী (সঃ)-এর নবুওয়াতের দলীল দিচ্ছেন যে, তিনি এমন একজন লোক যার কোন আক্ষরিক জ্ঞান নেই, যিনি একটি অক্ষরও কারো কাছে শিক্ষা করেননি, পূর্ববর্তী কিতাবগুলো যাঁর কাছে সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত, যার কওমের সবাই বিদ্যাচর্চা ও অতীতের ইতিহাস হতে সম্পূর্ণ বে-খবর, তিনি স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে এবং পূর্ণ বাকপটুতার সাথে ও সঠিকভাবে অতীতের ঘটনাবলী এমনভাবে বর্ণনা করছেন যে, যেন তিনি সেগুলো স্বচক্ষে দর্শন করেছেন এবং তিনি যেন সেগুলো সংঘটিত হওয়ার সময় তথায় বিদ্যমান ছিলেন। এটা কি একথার প্রমাণ নয় যে, তাঁকে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে শিক্ষাদান করা হয়েছে, স্বয়ং আল্লাহ অহীর মাধ্যমে ওগুলো তাকে জানিয়ে দিয়েছেন? হযরত মারইয়াম (আঃ)-এর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়েও এটা পেশ করেছেন এবং বলেছেনঃ
وَ مَا كُنْتَ لَدَیْهِمْ اِذْ یُلْقُوْنَ اَقْلَامَهُمْ اَیُّهُمْ یَكْفُلُ مَرْیَمَ وَ مَا كُنْتَ لَدَیْهِمْ اِذْ یَخْتَصِمُوْنَ
অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! মারইয়াম (আঃ)-এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব কে গ্রহণ করবে এর জন্যে যখন তারা তাদের কলম নিক্ষেপ করছিল তুমি তখন তাদের নিকট ছিলে না এবং তারা যখন বাদানুবাদ করছিল তখনও তুমি তাদের নিকট ছিলে না।” (৩:৪৪) সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ) বিদ্যমান না থাকা এবং অবহিত থাকা সত্ত্বেও এ ঘটনাকে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, যেন তিনি তথায় বিদ্যমান ছিলেন এবং তাঁর সামনেই ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল, এটা তাঁর নবুওয়াতের স্পষ্ট দলীল ও পরিষ্কার নিদর্শন যে, তিনি অহীর মাধ্যমে এগুলোর খবর দিয়েছেন। অনুরূপভাবে হযরত নূহ (আঃ)-এর ঘটনা বর্ণনা করার পর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
تِلْكَ مِنْ اَنْۢبَآءِ الْغَیْبِ نُوْحِیْهَاۤ اِلَیْكَ مَا كُنْتَ تَعْلَمُهَاۤ اَنْتَ وَ لَا قَوْمُكَ مِنْ قَبْلِ هٰذَا فَاصْبِرْ اِنَّ الْعَاقِبَةَ لِلْمُتَّقِیْنَ
অর্থাৎ “এগুলো অদৃশ্যের সংবাদ যেগুলো আমি তোমাকে অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছি, ইতিপূর্বে এগুলো না তুমি জানতে, না তোমার কওম জানতো, সুতরাং তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং জেনে রেখো যে, শুভ পরিণাম আল্লাহভীরুদেরই।” (১১:৪৯) সূরায়ে ইউসুফেরও শেষে ইরশাদ হয়েছে
ذٰلِكَ مِنْ اَنْۢبَآءِ الْغَیْبِ نُوْحِیْهِ اِلَیْكَ وَ مَا كُنْتَ لَدَیْهِمْ اِذْ اَجْمَعُوْۤا اَمْرَهُمْ وَ هُمْ یَمْكُرُوْنَ
অর্থাৎ “এটা অদৃশ্যলোকের সংবাদ যা তোমাকে আমি অহীর দ্বারা অবহিত করছি; ষড়যন্ত্রকালে যখন তারা মতৈক্যে পৌছেছিল, তখন তুমি তাদের সাথে ছিলে না।” (১২:১০২) সূরায়ে তোয়াহা-তে রয়েছে
كَذٰلِكَ نَقُصُّ عَلَیْكَ مِنْ اَنْۢبَآءِ مَا قَدْ سَبَقَ
অর্থাৎ “পূর্বে যা ঘটেছে তার সংবাদ আমি এইভাবে তোমার নিকট বিবৃত করি।” (২০:৯৯) অনুরূপভাবে এখানেও হযরত মূসা (আঃ)-এর জন্ম, নবুওয়াতের সূচনা ইত্যাদি প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করার পর বলেনঃ “(হে মুহাম্মদ সঃ!) যখন আমি মূসা (আঃ)-কে বিধান দিয়েছিলাম তখন তুমি পশ্চিম প্রান্তে উপস্থিত ছিলে না এবং তুমি প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলে না। বস্তুতঃ আমি অনেক মানবগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটিয়েছিলাম; অতঃপর তাদের বহু যুগ অতিবাহিত হয়েছে। তুমি তো মাদইয়ানবাসীদের মধ্যে বিদ্যমান ছিলে না তাদের নিকট আমার আয়াত আবৃত্তি করবার জন্যে। আমিই ছিলাম রাসূল প্রেরণকারী। আর হে নবী (সঃ)! যখন আমি মূসা (আঃ)-কে আহ্বান করেছিলাম তখন তুমি তূর পর্বত পার্শ্বে হাযির ছিলে না।”
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আওয়ায দেয়া হয়ঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)-এর উম্মত! তোমাদের চাওয়ার পূর্বেই আমি তোমাদেরকে প্রদান করেছি এবং তোমরা দু'আ করবে তার পূর্বেই আমি ককূল করে নিয়েছি।” (এ হাদীসটি ইমাম আবদুর রহমান আন নাসাঈ (রঃ) তার সুনান গ্রন্থে এ আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেছেন)
হযরত মুকাতিল (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তোমরা যখন তাদের বাপ-দাদাদের পৃষ্ঠদেশে ছিলে তখনই আমি তাদেরকে ডাক দিয়েছিলাম যে, আমি যখন তোমাকে নবী করে প্রেরণ করবো তখন তারা তোমার অনুসরণ করবে।”
কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলো: “আমি মূসা (আঃ)-কে আহ্বান করেছিলাম। এটাই বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা, উপরেও এরই বর্ণনা রয়েছে। উপরে সাধারণভাবে বর্ণনা ছিল এবং এখানে বিশিষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ
وَ اِذْ نَادٰى رَبُّكَ مُوْسٰۤى
অর্থাৎ “যখন তোমার প্রতিপালক মূসা (আঃ)-কে আহ্বান করলেন।” (২৬:১০) আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ
اِذْ نَادٰىهُ رَبُّهٗ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى
অর্থাৎ “তার প্রতিপালক যখন তাকে পবিত্র ভূর উপত্যকায় আহ্বান করেন।” (৭৯:১৬) মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর একটি আয়াতে বলেনঃ
وَ نَادَیْنٰهُ مِنْ جَانِبِ الطُّوْرِ الْاَیْمَنِ وَ قَرَّبْنٰهُ نَجِیًّا
অর্থাৎ “তাকে আমি আহ্বান করেছিলাম তূর পর্বতের দক্ষিণ দিক হতে এবং আমি অন্তরঙ্গ আলাপে তাকে নিকটবর্তী করেছিলাম।” (১৯:৫২)
মহান আল্লাহ বলেনঃ এগুলোর মধ্যে একটি ঘটনাও তোমার উপস্থিতকালে এবং তোমার চোখের সামনে সংঘটিত হয়নি, বরং তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে দয়া স্বরূপ, যাতে তুমি এমন এক সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পার, যাদের নিকট তোমার পূর্বে কোন সতর্ককারী আসেনি, যেন তারা উপদেশ গ্রহণ করে। এটা এ জন্যেও যে, তাদের কাছে যেন কোন দলীল বাকী না থাকে এবং ওর করারও কিছু না থাকে যে, তাদের কাছে কোন রাসূল আসেননি এবং তাদেরকে কেউ সুপথ প্রদর্শন করেননি, করলে অবশ্যই তারা আল্লাহর নিদর্শন মেনে চলতো এবং তারা মুমিন হতো।
যেমন আল্লাহ তা'আলা অন্য জায়গায় স্বীয় পবিত্র কিতাব কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ করার পর বলেনঃ “এটা এই জন্যে যে, তোমরা যেন বলতে না পারকিতাব তো আমাদের পূর্বে দুটি দলের উপর অবতীর্ণ করা হয়েছিল, কিন্তু আমরা তো এর পাঠ ও শিক্ষাদান হতে ছিলাম সম্পূর্ণ উদাসীন। যদি এ কিতাব আমাদের উপর অবতীর্ণ করা হতো তবে অবশ্যই আমরা তাদের চেয়ে বেশী সুপথগামী হতাম। এখন জেনে রেখো যে, তোমাদের কাছেও তোমাদের প্রতিপালকের দলীল, হিদায়াত ও রহমত এসে গেছে। অন্য একটি আয়াতে রয়েছেঃ “এরা হলো সুসংবাদদাতা ও ভয়-প্রদর্শনকারী রাসূল যাতে লোকদের জন্যে রাসূলদের পরে কোন হুজ্জত বাকী না থাকে। আর একটি আয়াতে রয়েছেঃ
یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ قَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلُنَا یُبَیِّنُ لَكُمْ عَلٰى فَتْرَةٍ مِّنَ الرُّسُلِ اَنْ تَقُوْلُوْا مَا جَآءَنَا مِنْۢ بَشِیْرٍ وَّ لَا نَذِیْرٍ
অর্থাৎ “হে আহলে কিতাব! তোমাদের কাছে রাসূলশূন্য যুগে আমার রাসূল এসে গেছে যে তোমাদের কাছে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে, যাতে তোমরা বলতে না পার- আমাদের কাছে কোন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী আসেনি, কারণ এখন তো তোমাদের কাছে সুসংবাদদাতা ও ভয়-প্রদর্শনকারী এসে গেছে।” (৫:১৯) এ ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে।