২১-২৫ নং আয়াতের তাফসীর:
এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলার আটটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের বিষদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
প্রথম নিদর্শন হল:
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর মানবাকৃতিতে পৃথিবীতে তাদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা আদম (عليه السلام)-কে একমুষ্টি মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন যা সমস্ত জমিন থেকে নিয়েছেন। ফলে আদম সন্তান সে মাটি অনুপাতেই। কেউ ফর্সা, কেউ লাল, কেউ কাল এবং কেউ উভয়ের মিশ্রিত বর্ণে। কেউ ভাল স্বভাবের, কেউ মন্দ স্বভাবের আবার কেউ উভয়ের মাঝামাঝি স্বভাবের। (তিরমিযী হা: ২৯৫৫, সহীহ)
এ সৃষ্টি সম্পর্কে সূরা হাজ্জের ৫ নং আয়াতে, সূরা ত্বহার ৫৫ নং এবং সূরা মু’মিনের ১২-১৪ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় নিদর্শন:
আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদের মধ্য থেকেই তাদের জীবনসঙ্গিণী স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন। আরবিতে زوج এর অর্থ হলো সঙ্গী বা জোড়া। অতএব পুরুষ নারীর ও নারী পুরুষের সঙ্গী বা জোড়া। নারীদেরকে পুরুষদের মধ্য হতেই সৃষ্টি করার অর্থ হলো পৃথিবীর প্রথম নারী মা হাওয়াকে আদম (عليه السلام)-এর বাম পার্শ্বের (পাঁজরের) হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর তাদের দুজন হতে মানুষের জন্মের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা স্ত্রীর মাঝে এমন একটি উপকরণ রেখে দিয়েছেন যখন স্বামী তার স্ত্রীর কাছে গমন করে তখন তার কাছে শান্তি পায়। আর উভয়ের মাঝে এমন ভালবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন যা পৃথিবীর অন্য কোন দুই ব্যক্তির মাঝে লক্ষ্য করা যায় না। বলা বাহুল্য, মানুষ এ শান্তি ও অগাধ প্রেম ভালবাসা সে দাম্পত্যের মাঝে লাভ করতে পারে যার সম্পর্কের ভিত্তি শরীয়তসম্মত বিবাহের ওপর প্রতিষ্ঠিত। পরন্তু ইসলাম একমাত্র বিবাহসূত্রের মাধ্যমেই আবদ্ধ দম্পতিকেই জোড়া বলে স্বীকার করে। অন্যথায় শরীয়ত বিরোধী দাম্পত্যের (লিভ টুগেদার) সম্পর্ককে ইসলাম জোড়া বলে স্বীকার করে না। বরং তাদেরকে ব্যভিচারী আখ্যায়িত করে এবং তাদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান প্রদান করেছে।
তৃতীয় নিদর্শন:
আল্লাহ তা‘আলা আকাশমণ্ডলী ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। আকাশকে তারকারাজি দ্বারা সুসজ্জিত করেছেন। চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করেছেন। এগুলো পৃথিবীতে আলো প্রদান করে থাকে। পক্ষান্তরে পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন পাহাড়-পর্বত, প্রশস্ত মাঠ, বন-জঙ্গল, নদী-নালা, সাগর-উপসাগর। উঁচু উঁচু টিলা, পাথর, বড় বড় গাছ ইত্যাদি সৃষ্টি করেছেন যা আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণ ক্ষমতার নিদর্শন।
চতুর্থ নিদর্শন:
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে মাত্র দুজন মানুষ আদম ও হাওয়া (عليه السلام) থেকে সৃষ্টি করার পরও তাদের মধ্যে ভাষার ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। কেউ কথা বলে বাংলায়, কেউ আরবি, কেউ উর্দু-ফারসি, হিন্দি, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষায়। এমনকি একই মানব থেকে সৃষ্টি হওয়ার পরও তাদের আকৃতি ও বর্ণ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কেউ কাল, কেউ শ্যামলা বর্ণের আবার কেউ সাদা বর্ণের। কারো সাথে কারো কোন প্রকারের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি কখনো কখনো সহোদর ভাইয়ের সাথেও কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এগুলো স্পষ্টভাবে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতার ওপর প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللّٰهَ أَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ءِ مَا۬ءً ج فَأَخْرَجْنَا بِه۪ ثَمَرٰتٍ مُّخْتَلِفًا أَلْوَانُهَا ط وَمِنَ الْجِبَالِ جُدَدٌۭبِيْضٌ وَّحُمْرٌ مُّخْتَلِفٌ أَلْوَانُهَا وَغَرَابِيْبُ سُوْدٌ)
“তুমি কি লক্ষ্য করনি? আল্লাহ আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন। তারপর আমি তা দিয়ে নানা বর্ণের ফলমূল উৎপন্ন করি। আর পর্বতমালারও রয়েছে বিভিন্ন বর্ণের গিরিপথন সাদা, লাল ও ঘোর কাল।” (সূরা ফাতির ৩৫:২৭)
পঞ্চম নিদর্শন:
আল্লাহ তা‘আলা মানুষের নিদ্রা ও জীবিকা অন্বেষণ করার জন্য রাত ও দিন সৃষ্টি করেছেন এবং এসব অন্বেষণ করার মাধ্যমে যেন আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ বা দয়া কামনা করে। এ সম্পর্কে সূরা বানী ইসরাঈলের ১২ নং আয়াতসহ অন্যান্য আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
ষষ্ঠ নিদর্শন:
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে বিজলী দ্বারা বিদ্যুৎ প্রদর্শন করেন ভয় ও আশা সঞ্চারকরূপে। এ সম্পর্কে সূরা রা‘দের ১২ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
সপ্তম নিদর্শন:
সপ্তম নিদর্শন হল, আল্লাহ তা‘আলা আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে মৃত ভূমিকে জীবিত করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاٰیَةٌ لَّھُمُ الْاَرْضُ الْمَیْتَةُﺊ اَحْیَیْنٰھَا وَاَخْرَجْنَا مِنْھَا حَبًّا فَمِنْھُ یَاْکُلُوْنَﭰ وَجَعَلْنَا فِیْھَا جَنّٰتٍ مِّنْ نَّخِیْلٍ وَّاَعْنَابٍ وَّفَجَّرْنَا فِیْھَا مِنَ الْعُیُوْنِﭱﺫ)
“আর তাদের জন্য একটি নিদর্শন মৃত জমিন। আমি তাকে সজীব করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, ফলে তা থেকে তারা খেয়ে থাকে। আমি তাতে সৃষ্টি করি খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান এবং প্রবাহিত করি তাতে ঝরণাধারা।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৩৩-৩৪) এখানে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন হল-মৃত জমিনকে বৃষ্টির পানি দ্বারা যেমন জীবিত করা হয় তেমনি আল্লাহ তা‘আলা মানুষের কর্মের হিসাব নেয়ার জন্য পুনরুত্থিত করবেন।
অষ্টম নিদর্শন:
ল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে আকাশ ও জমিন স্থিতিশীল রয়েছে। আমরা জানি প্রথমে জমিন কম্পিত হচ্ছিল, তারপর আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে পাহাড় বদ্ধমূল করে দিলেন। ফলে জমিন স্থিতিশীল হয়েছে । আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللّٰهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَّا فِي الْأَرْضِ وَالْفُلْكَ تَجْرِيْ فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِه۪ ط وَيُمْسِكُ السَّمَا۬ءَ أَنْ تَقَعَ عَلَي الْأَرْضِ إِلَّا بِإِذْنِه۪ ط إِنَّ اللّٰهَ بِالنَّاسِ لَرَؤُوْفٌ رَّحِيْمٌ)
“তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন পৃথিবীতে যা কিছু আছে তৎসমুদয়কে এবং তাঁর নির্দেশে সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানসমূহকে? আর তিনিই আকাশকে স্থির রাখেন যাতে তা পতিত না হয় পৃথিবীর ওপর তাঁর অনুমতি ব্যতীত। আল্লাহ নিশ্চয়ই মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।” (সূরা হাজ্জ ২২:৬৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(إِنَّ اللّٰهَ يُمْسِكُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضَ أَنْ تَزُوْلَا ﹰ وَلَئِنْ زَالَتَآ إِنْ أَمْسَكَهُمَا مِنْ أَحَدٍ مِّنْۭ بَعْدِه۪ط إِنَّه۫ كَانَ حَلِيْمًا غَفُوْرًا)
“নিশ্চয়ই আল্লাহই আসমান ও জমিনকে স্থির রাখেন, যাতে তা টলে না যায়। যদি এরা টলে যায় তবে তিনি ছাড়া কে এদেরকে স্থির রাখবে? তিনি অতিশয় সহনশীল, পরম ক্ষমাশীল।” (সূরা ফাতির ৩৫:৪১)
(ثُمَّ إِذَا دَعَاكُمْ دَعْوَةً)
অর্থাৎ যখন তিনি তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে উঠানোর জন্য একবার আহ্বান করবেন তথা শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে তখন সকলেই সেখান থেকে উঠে আল্লাহ তা‘আলার দিকে ছুটে আসবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(يَوْمَ يَدْعُوْكُمْ فَتَسْتَجِيْبُوْنَ بِحَمْدِه۪ وَتَظُنُّوْنَ إِنْ لَّبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيْلًا)
‘যেদিন তিনি তোমাদেরকে আহ্বান করবেন, এবং তোমরা তাঁর প্রশংসার সাথে তাঁর আহ্বানে সাড়া দেবে এবং তোমরা মনে করবে, তোমরা অল্প সময়ই (দুনিয়াতে) অবস্থান করেছিলে।’ (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৫২)
অতএব মানুষ আল্লাহ তা‘আলার এ সকল নিদর্শন বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক সর্বশেষে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সম্মুখেই উপস্থিত হতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
২. মানুষ সৃষ্টির মূল উপাদান হল মাটি, অতঃপর পিতা-মাতার মিলনে সৃষ্টির পরম্পরা বহাল রয়েছে।
৩. জীবন ও মৃত্যু সকল কিছুর ক্ষমতা আল্লাহ তা‘আলারই হাতে।
৪. ইসলাম বিবাহের মাধ্যমে নারী-পুরুষের বন্ধনকে স্বীকার করে কিন্তু লিভ-টুগেদারকে স্বীকার করে না।