২৭-২৮ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা'আলা তাঁর ইযত, শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব, বুযর্গী, মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের বর্ণনা দিচ্ছেন। নিজের পবিত্র গুণাবলী, মহান নাম ও অসংখ্য কালেমার বর্ণনা প্রদান করছেন। না কেউ তা গণনা করে শেষ করতে পারে, না তার পরিধি কারো জানা আছে। তার প্রকৃত তথ্য কারো জানা নেই। মানব-নেতা, শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) বলতেনঃ
لَا اُحْصِيْ ثَنَاءً عَلَيْكَ اَنْتَ كَمَا اَثْنَيْتَ عَلٰى نَفْسِكَ
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনার নিয়ামতের গণনা ততো আমি করতে পারবো না যতোটা আপনি নিজের নিয়ামতের বর্ণনা নিজেই দিয়েছেন” বা “আপনার প্রশংসা ও গুণকীর্তন করে আমি শেষ করতে পারবো না যেমন আপনি নিজের প্রশংসা নিজে করেছেন।”
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ জগতের সমস্ত গাছ-পালাকে যদি কলম বানানো হয় এবং সাগরের সমস্ত পানিকে যদি কালি বানানো হয়, এরপর আরো সাতটি সাগরের পানি মিলিত করা হয়, অতঃপর আল্লাহ তা'আলার শ্রেষ্ঠত্ব, গুণাবলী, বুযর্গী এবং বাণীসমূহ লিখতে শুরু করা যায় তবে এই সমুদয় কলম ও কালি শেষ হয়ে যাবে, তথাপি একক ও শরীক বিহীন আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলী শেষ হবে না। এতে এটা মনে করা চলবে না যে, যদি সাতের অধিক সাগরের পানি একত্রিত করা হয় তবে আল্লাহর গুণাবলী লিখার জন্যে যথেষ্ট হবে। এটা কখনো নয়। এ গণনা শুধু আধিক্য প্রকাশের জন্যে বলা হয়েছে। এটাও মনে করা চলবে না যে, মাত্র সাতটি সাগর আছে যা সমগ্র দুনিয়াকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে। অবশ্য বানী ইসরাঈলের রিওয়াইয়াতে এ সাতটি সাগরের কথা বলা হয়েছে বটে, তাকে আমরা সত্যও বলতে পারি না এবং মিথ্যাও না। তবে আমরা যে তাফসীর করেছি তার পৃষ্ঠপোষক নিম্নের আয়াতটিকে বলা যেতে পারে। মহান আল্লাহ বলেনঃ
قُلْ لَّوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِّكَلِمٰتِ رَبِّیْ لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ اَنْ تَنْفَدَ كَلِمٰتُ رَبِّیْ وَ لَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهٖ مَدَدًا
অর্থাৎ “(হে নবী সঃ)! তুমি বলঃ আমার প্রতিপালকের কথা লিপিবদ্ধ করবার জন্যে সমুদ্র যদি কালি হয়, তবে আমার প্রতিপালকের কথা শেষ হবার পূর্বেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে সাহায্যার্থে এর অনুরূপ আরো সমুদ্র আনলেও।” (১৮:১০৯) এখানে একটি সমুদ্র উদ্দেশ্য নয়, বরং এক একটি করে যতই হালে না কেন, তবুও আল্লাহর কালেমা শেষ হবে না।
হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন, যদি আল্লাহ তা'আলা লিখাতে শুরু করেন ও বলেনঃ এ কাজ লিখো, ও কাজ লিখো, এভাবে লিখতে লিখতে সমস্ত কলম ভেঙ্গে শেষ হয়ে যাবে, তবুও লিখা শেষ হবে না ।
মুশরিকরা বলতো যে, এ কালাম শেষ হয়ে যাবে। এ আয়াত দ্বারা তাদের উক্তিকে খণ্ডন করা হয়েছে। না আল্লাহর বিস্ময়কর ব্যাপারগুলো শেষ হবে, না তার জ্ঞানের পরিধি জরিপ করা যাবে, না তার জ্ঞান ও সিফাতের পরিমাপ করা সম্ভব হবে। আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় সমস্ত বান্দার জ্ঞান এমনই যেমন সমুদ্রের পানির তুলনায় এক ফোটা পানি। আল্লাহর কথা শেষ হবার নয়। আমরা তার যে প্রশংসা করি, তাঁর প্রশংসা এর বহু উপরে।
মদীনায় ইয়াহূদী আলেমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেছিল ও “আপনি যে পাঠ করে থাকেন وَ مَاۤ اُوْتِیْتُمْ مِّنَ الْعِلْمِ اِلَّا قَلِیْلًا অর্থাৎ “তোমাদেরকে খুব অল্প জ্ঞানই দেয়া হয়েছে। (১৭:৮৫) এর দ্বারা উদ্দেশ্য কারা, আমরা, না আপনার কওম?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমরা ও তোমরা সবাই।” তারা পুনরায় বলেঃ “তাহলে আপনি কালামুল্লাহর এ আয়াতের অর্থ কি করবেন যেখানে বলা হয়েছে যে, তাওরাতে সবকিছুরই বর্ণনা রয়েছে?” জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বলেনঃ “জেনে রেখো যে, তোমাদের কাছে যা কিছু রয়েছে ওগুলো আল্লাহ তা'আলার কালেমার তুলনায় অতি অল্প। তোমাদের জন্যে যথেষ্ট হয় এ পরিমাণই তিনি তোমাদের প্রতি নাযিল করেছেন।” ঐ সময় আল্লাহ তা'আলা وَلَوْ اَنَّ مَا فِى الْاَرْضِ مِنْ شَجَرَةٍ -এই আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। কিন্তু এর দ্বারা জানা যাচ্ছে আয়াতটি মাদানী হওয়া উচিত। অথচ এটা প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে যে, এটা মক্কী আয়াত। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
আল্লাহ তা'আলা সবকিছুর উপরই বিজয়ী। সবকিছুই তার কাছে যৎকিঞ্চিৎ ও বিজিত। কিছুই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারে না। তিনি নিজের কথায়, কাজে, আইন-কানুনে, বুদ্ধিতে ও অন্যান্য গুণাবলীতে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্ববিজয়ী এবং প্রতাপশালী ।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ সমস্ত মানুষকে সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে মেরে ফেলে পুনরুজ্জীবিত করা আমার কাছে একটি লোককে মেরে জীবিত করার মতই সহজ। কোন কিছু হওয়ার ব্যাপারে আমার শুধু হুকুম করাই যথেষ্ট। কোন কিছু করতে আমাকে চোখের পলক ফেলার সমানও সময় লাগে না। দ্বিতীয়বার হুকুম করার আমার প্রয়োজন হয় না। কোন উপকরণ ও যন্ত্রপাতিরও দরকার হয় না। একটা হুকুমেই কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। একটি শব্দ মাত্রই সবাই জীবিত হয়ে উঠবে। আল্লাহ সবকিছু শুনেন এবং সবকিছু দেখেন। একটি লোকের কথা ও কাজ যেমন তাঁর কাছে গোপন থাকে না, অনুরূপভাবে সারা দুনিয়ারও কিছুই তার কাছে লুক্কায়িত নয়।