হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এ সূরাটি মদীনা শরীফে অবতীর্ণ হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) হযরত যায়েদ ইবনে সাবিতও (রাঃ) এটাই বলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এও বর্ণিত আছে যে, যখন এ সূরাটি অবতীর্ণ হয় তখন রাসূলুল্লাহ বলেনঃ “এখন আর রুদ্ধরাখা নয়।” মুসতাদরিক-ই-হাকিমে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “সূরা-ই-নিসার মধ্যে পাঁচটি এমন আয়াত আছে যে, যদি আমি সারা দুনিয়া পেয়ে যেতাম তথাপি আমি তত খুশী হতাম না যত খুশী এ আয়াতগুলোতে হয়েছি। একটি আয়াত হচ্ছেঃ “আল্লাহ তা'আলা কারও উপর অণুপরিমাণও অত্যাচার করেন না, যার যে পুণ্য থাকে তার প্রতিদান তিনি তাকে বেশী বেশী করে দেন এবং নিজের পক্ষ হতে পুরস্কার হিসেবে যে বড় প্রতিদান তা তো পৃথক।” দ্বিতীয় আয়াত হচ্ছেঃ “তোমরা যদি বড় বড় পাপসমূহ হতে বেঁচে থাক তবে ছোট ছোট পাপগুলো তিনি নিজেই ক্ষমা করে দেবেন এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক জান্নাতে প্রবিষ্ট করবেন।” তৃতীয় আয়াত হচ্ছেঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সাথে অংশী স্থাপনকারীকে ক্ষমা করেন না এবং অবশিষ্ট পাপীদের যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করে থাকেন। চতুর্থ আয়াত হচ্ছেঃ “ঐ লোকগুলো যদি নিজেদের জীবনের উপর অত্যাচার করার পর তোমার নিকট এসে যেতো এবং নিজেও স্বীয় পাপের জন্যে আল্লাহ তাআলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতো ও রাসূল (সঃ) তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও দয়ালু পেতো।” ইমাম হাকিম (রঃ) বলেনঃ এর ইসনাদ সহীহ বটে, কিন্তু এর আবদুর রহমান নামক একজন বর্ণনাকারীর তার পিতার নিকট হতে শুনার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। আবদুর রায্যাকের বর্ণনায় এই আয়াতটির পরিবর্তে নিম্নের আয়াতটি রয়েছেঃ “যে ব্যক্তির দ্বারা কোন পাপকার্য সংঘটিত হয় কিংবা সে নিজের জীবনের উপর অত্যাচার করে, অতঃপর সে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে সে নিশ্চয় আল্লাহ তা'আলাকে ক্ষমাশীল, দয়ালু পাবে।” হাদীসদ্বয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য এই ভাবে হবে যে, প্রথম হাদীসে একটি আয়াতের বর্ণনা বাকী রয়ে গেছে এবং এর বর্ণনা দ্বিতীয় হাদীসে হয়েছে। তাহলে পূর্ববর্তী হাদীসের চার আয়াত এবং পরবর্তী হাদীসের, এক আয়াত মিলে মোট পাঁচ আয়াত হয়ে গেল। কিংবা اِنَّ اللهَ لَا يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَةٍ (৪:৪০) হতেই একটি আয়াত পূর্ণ হয়ে গেছে এবং وَاِنْ تَكُ حَسَنَةً-কে পৃথক আয়াত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, তবে দু’টি হাদীসেই পাঁচটি পাঁচটি করে আয়াত হয়ে গেল। তাফসীর-ই-ইবনে জারীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এ সূরায় এমন ৮টা আয়াত রয়েছে যেগুলো এ উম্মতের জন্যে প্রত্যেক ঐ জিনিস হতে উত্তম যার মধ্যে সূর্য উদিত ও অস্তমিত হয়। প্রথমটি হচ্ছেঃ “আল্লাহ স্বীয় আহকাম তোমাদের উপর পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করতে চান এবং তোমাদেরকে ঐ সৎ লোকদের পথ-প্রদর্শন করতে চান যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে ও তোমাদের তাওবা কবুল করতে চান, আল্লাহ মহাজ্ঞাতা, বিজ্ঞানময়। দ্বিতীয় আয়াত হচ্ছেঃ “আল্লাহ তোমাদের প্রতি করুণা বর্ষণ করতে এবং তোমাদের তাওবা কবুল করতে চান, আর স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসারীরা চায় যে, তোমরা সত্য পথ হতে বহু দূরে সরে পড়।” তৃতীয় আয়াতটি হচ্ছেঃ “মানুষকে যেহেতু দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাই আল্লাহ তোমাদের উপর হালকা করতে চান।” বাকী আয়াত হচ্ছে ঐগুলো যেগুলো পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আবি মালকিয়্যাহ (রঃ) বলেনঃ ‘আমি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে সূরা-ই-নিসা সম্পর্কে শুনেছি। কুরআন কারীম পড়েছি, অথচ আমি ছোট শিশু ছিলাম।' (মুসতাদরিক-ই-হাকিম)
আল্লাহ তা'আলা স্বীয় বান্দাদেরকে মুত্তাকী হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তারা যেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে এবং অন্তরে যেন তাঁরই ভয় রাখে। অতঃপর তিনি স্বীয় ব্যাপক ক্ষমতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন-আল্লাহ তোমাদের সকলকে একই ব্যক্তি হতে অর্থাৎ হযরত আদম (আঃ) হতে সৃষ্টি করেছেন। এবং ঐ ব্যক্তি হতেই তিনি হযরত হাওয়া (আঃ)-কেও সৃষ্টি করেছেন। হযরত আদম (আঃ) ঘুমিয়ে ছিলেন, এমতাবস্থায় আল্লাহ তা'আলা তার বাম পাজরের পিছন দিক হতে হযরত হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন। তিনি জাগ্রত হয়ে তাঁকে দেখতে পান এবং তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর প্রতিও হযরত হাওয়া (আঃ)-এর ভালবাসার সৃষ্টি হয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, স্ত্রীকে পুরুষ হতে সৃষ্টি করা হয়েছে, এ জন্যে তার প্রয়োজন ও কামভাব পুরুষের মধ্যেই রাখা হয়েছে। আর পুরুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি দ্বারা এ জন্যেই তার প্রয়োজন মাটিতেইঙ্খা হয়েছে। সুতরাং তোমরা স্বীয় স্ত্রীদেরকে রুদ্ধ রাখ। বিশুদ্ধ হাদীসে রয়েছেঃ “স্ত্রীলোককে পাঁজর হতে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সবচেয়ে উঁচু পাঁজর হচ্ছে সবচেয়ে বেশী বক্র। সুতরাং তুমি যদি তাকে সম্পূর্ণ সোজা করার ইচ্ছে কর তবে তাকে ভেঙ্গে দেবে। আর যদি তার মধ্যে কিছু বক্রতা রেখে দিয়ে উপকার লাভ করতে চাও তবে অবশ্যই উপকার লাভ করতে পারবে।'
অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘দু’জন হতে অর্থাৎ হযরত আদম (আঃ) ও হযরত হাওয়া (আঃ) হতে বহু নর ও নারী সৃষ্টি করতঃ দুনিয়ার চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন, যাদের প্রকারে, বিশেষণে, রঙ্গে, আকারে এবং কথাবার্তায় বিভিন্নতা রয়েছে। এ সমস্ত যেমন পূর্বে আল্লাহ তাআলারই অধিকারে ছিল, তিনি তাদেরকে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন ঠিক তেমনই এক সময়ে তিনি সকলকে একত্রিত করে পুনরায় নিজের দখলে নিয়ে নেবেন এবং একটি মাঠে জমা করবেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহ তা'আলাকে ভয় করতে থাক, তার আনুগত্য ও ইবাদত করতে থাক। তোমরা সেই আল্লাহরই মাধ্যম দিয়ে তার নামেরই দোহাই দিয়ে একে অপরের নিকট তাগাদা করে থাক। যেমন কেউ বলে- আমি আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এবং আত্মীয়তাকে মনে করিয়ে দিয়ে তোমাকে এ কথা বলছি।' মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে তোমরা তারই নামে শপথ করে থাক এবং অঙ্গীকার দৃঢ় করে থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় করতঃ আত্মীয়তার রক্ষণাবেক্ষণ করে, ওর বন্ধন ছিন্ন করো না, বরং যুক্ত রাখ। একে অপরের সাথে সদ্ব্যবহার কর। একটি পঠনে اَرْحَامِ ও রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর নামে এবং আত্মীয়তার মাধ্যমে। আল্লাহ তা'আলা তোমাদের সমস্ত অবস্থা ও কার্যাবলীর সংবাদ রাখেন এবং তিনি খুব ভালভাবে তোমাদের তত্ত্বাবধান করতে রয়েছেন। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ وَاللهُ عَلٰى كُلِّ شَىْءٍ شَهِيْدٌ অর্থাৎ আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের উপর সাক্ষী রয়েছেন।
বিশুদ্ধ হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত কর যে, যেন তুমি তাকে দেখছো, অথবা তুমি তাকে না দেখলেও তিনি তোমাকে দেখছেন।' ভাবার্থ এই যে, তোমরা তাঁর প্রতি মনোযোগ দাও যিনি তোমাদের উঠায়, বসায়, চলায় ও ফেরায় তোমাদের রক্ষক হিসেবে রয়েছেন। এখানে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “হে মানবমণ্ডলী! একই বাপ-মায়ের মাধ্যমে তো তোমাদের জন্ম হয়েছে। সুতরাং তোমরা পরস্পরে একে অপরের প্রতি প্রেম-প্রীতি বজায় রেখো, দুর্বলদের সহায়তা কর এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার কর। সহীহ মুসলিমে একটি হাদীসে রয়েছে যে, মুযা’র ঘোত্র যখন নিজেদেরকে চাদরে আবৃত করে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করে, কেননা, তাদের শরীরে কাপড় পর্যন্ত ছিল না, তখন রাসূলুল্লাহ যোহরের নামাযের পর দাঁড়িয়ে ভাষণ দান করেন, যাতে তিনি উপরোক্ত আয়াতটি পাঠ করতঃ নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেনঃ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ لْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ অর্থাৎ “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকেই যেন দেখে যে, সে আগামীকালের জন্যে কি সামনে পাঠিয়েছে?' (৫৯:১৮) অতঃপর তিনি জনগণকে দান-খয়রাতের প্রতি উৎসাহিত করেন। ফলে যে যা পারলেন ঐ লোকগুলোকে দান করলেন। স্বর্ণ মুদ্রা, রৌপ্য মুদ্রা, খেজুর, গম ইত্যাদি সব কিছুই দিলেন। মুসনাদ ও সুনানের মধ্যে অভাবের ভাষণের বর্ণনায় রয়েছে যে, পরে তিনি তিনটি আয়াত পাঠ করেন যার মধ্যে একটি এ আয়াতটিই।