১৪৮-১৪৯ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন যে, কোন মুসলমানের জন্য বদ দু'আ করা বৈধ নয়। তবে যার উপর অত্যাচার করা হবে সে অত্যাচারীর জন্যে বদ দু'আ করতে পারে। কিন্তু সেও যদি ধৈর্যধারণ করে তবে ফযীলত তাতেই রয়েছে। সুনান-ই-আবি দাউদে রয়েছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর কোন জিনিস চুরি যায়। তখন তিনি চোরের জন্যে বদ দুআ করতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এটা শুনে বলেনঃ তার বোঝা হালকা করছো কেন? হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, তার জন্যে বদ দু'আ করা উচিত নয়, বরং নিম্নের দু'আটি পাঠ করা উচিতঃ اَللّٰهُمَّ اَعِنِّىْ عَلَيْهِ وَاسْتَخْرِجْ حَقِّىْ مِنْهُ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি আমাকে তার উপর সাহায্য করুন এবং তার নিকট হতে আমার প্রাপ্য বের করে দিন। এ মনীষী হতেই বর্ণিত আছে যে, অত্যাচারীর জন্যে বদ দু'আ করার অনুমতি যদিও অত্যাচারিত ব্যক্তির রয়েছে, কিন্তু সেটা যেন সীমা ছাড়িয়ে না যায়, সেদিকে তাকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
হযরত আবদুল করিম ইবনে মালিক জাযারী (রঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন যে, যে ব্যক্তি গালি দেবে অর্থাৎ মন্দ বলবে তাকে মন্দ বলা যাবে, কিন্তু কেউ অপবাদ দিলে তাকে অপবাদ দেয়া যারে না। অন্য একটি আয়াতে রয়েছেঃ وَ لَمَنِ انْتَصَرَ بَعْدَ ظُلْمِهٖ فَاُولٰٓىٕكَ مَا عَلَیْهِمْ مِّنْ سَبِیْلٍ অর্থাৎ যে অত্যাচারিত ব্যক্তি অত্যাচারী হতে তার অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণ করে তাদের উপর কোন জবাবদিহী নেই। (৪২:৪১) সুনান-ই-আবি দাউদে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘দু’জন গালিদাতা যা বলে ওর শাস্তি তার উপর রয়েছে যে প্রথমে গালি দিয়েছে যে পর্যন্ত না অত্যাচারিত ব্যক্তি সীমা অতিক্রম করে।
হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেনঃ “যদি কোন ব্যক্তি কারও নিকট অতিথি হিসেবে আগমন করে এবং অতিথি সেবক তার আতিথেয়তার হক আদায় না করে তবে অতিথি সেবকের দুর্নাম করতে পারে যে পর্যন্ত না সে জিয়াফতের হক আদায় করে।' সুনান-ই-আবি দাউদ, সুনান-ই-ইবনে মাজা প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে রয়েছে যে, সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট অভিযোগ পেশ করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি আমাদেরকে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে থাকেন। কোন কোন সময় এমনও হয় যে, তথাকার লোক আমাদের মেহমানদারী করে না। এতে আপনার অভিমত কি?' রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাদেরকে বলেনঃ যখন তোমরা কোন সম্প্রদায়ের নিকট গমন করবে তখন যদি তারা মেহমানের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তবে তোমরা তা কবুল করবে। আর যদি তারা তা না করে তবে তোমরা তাদের সাধ্য অনুপাতে তাদের নিকট হতে অতিথির উপযুক্ত প্রাপ্য আদায় করবে।'
মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে মুসলমান। কোন এক লোকের বাড়ীতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়, রাত্রি অতিবাহিত হয়ে যায় অথচ তারা তার আতিথ্যের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে না, সে সময় প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্যকর্তব্য হবে ঐ ব্যক্তির মাল হতে ও ক্ষেত হতে ঐ রাত্রির মেহমানদারীর জিনিস আদায় করে দিয়ে অতিথিকে সাহায্য করা।' অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ জিয়াফতের রাত্রি প্রত্যেক মুসলমানের উপর ওয়াজিব। যদি কোন মুসাফির সকাল পর্যন্ত বঞ্চিত থাকে, তবে এটা ঐ মেজবানের দায়িত্বে কর্জ রূপে থাকবে, এখন সে তা আদায় করুক বা ছেড়ে দিক।' এসব হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ মনীষীর মাযহাব এই যে, নিমন্ত্রণ ওয়াজিব।
সুনান-ই-আবি দাউদ প্রভৃতির মধ্যে রয়েছে, একটি লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরয করেঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার প্রতিবেশী আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে বলেনঃ “তুমি এক কাজ কর, তোমার বাড়ীর সমস্ত আসবাবপত্র বাইরে এনে রেখে দাও। লোকটি ঐ কাজই করে এবং সমস্ত আসবাবপত্র রাস্তার উপর রেখে বসে পড়ে। রাস্তা দিয়ে যেই গমন করে সেই তাকে জিজ্ঞেস করে-ব্যাপার কি? সে বলে, আমার প্রতিবেশী আমাকে জ্বালাতন করছে। আমি অধৈর্য হয়ে এখানে চলে এসেছি। সবাই তখন তার প্রতিবেশীকে ভাল-মন্দ বলতে থাকে। কেউ বলে যে, তার উপর আল্লাহ তা'আলার ক্রোধ বর্ষিত হোক। কেউ বলে যে, আল্লাহ তাআলা তাকে ধ্বংস করুন, তার প্রতিবেশী যখন এভাবে অপমানিত হওয়ার কথা জানতে পারে, তখন সে অনুরোধ করে তাকে বাড়ী নিয়ে যায় এবং বলে-আল্লাহর শপথ! এখন আর মৃত্যু পর্যন্ত আপনার প্রতি কোন অত্যাচার করবো না।
অতঃপর ইরশাদ হচ্ছে-‘হে লোক সকল! যদি তোমরা কোন সৎ কার্য প্রকাশ কর বা গোপন কর, কিংবা তোমার উপর কেউ হয়তো অত্যাচার করেছে, তাকে তুমি ক্ষমা কর তবে আল্লাহ তা'আলার নিকট তোমার জন্যে রয়েছে বড় পুণ্য ও মহা প্রতিদান। তিনি নিজেও ক্ষমাকারী এবং বান্দার মধ্যেও তিনি এ অভ্যাস পছন্দ করেন। প্রতিশোধ নেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ক্ষমা করে থাকেন। একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, আরশ বহনকারী ফেরেশতাগণ। আল্লাহ তা'আলার তাসবীহ পাঠ করে থাকেন। কেউ বলেন سُبْحَانَكَ عَلٰى حِلْمِكَ بَعْدَ عِلْمِكَ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি যে, আপনি জানা। সত্ত্বেও সহনশীলতা প্রদর্শন করছেন। আবার কেউ কেউ বলেন- سُبْحَانَكَ عَلٰى عَفُوِّكَ بَعْدَ قُدْرَتِكَ অর্থাৎ ‘হে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমকারী প্রভু! সমস্ত পবিত্রতা আপনার সত্তার জন্যই উপযুক্ত।
সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, সাদকা ও খায়রাতের কারণে কারও মাল কমে যায় না। ক্ষমা ও মাফ করে দেয়ার কারণে আল্লাহ তা'আলা সম্মান বৃদ্ধি করে থাকেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার নির্দেশক্রমে বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করে, আল্লাহ তা'আলা তার সম্মান ও মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দেন।