নামকরণ ও ফযীলত :
(الدُّخَانُ) দুখান শব্দের অর্থ ধোঁয়া। কিয়ামত সংঘঠিত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে এর আলামতস্বরূপ আকাশ সম্পূর্ণরূপে ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হয়ে যাবে, সেদিন আকাশে ধোঁয়া ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পাওয়া যাবে না। অত্র সূরার ১০ নম্বর আয়াতে উল্লেখিত দুখান শব্দ থেকে এ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
এ সূরার ফযীলতের ব্যাপারে যত বর্ণনা রয়েছে প্রায় সকল বর্ণনাই ত্র“টিযুক্ত। সুতরাং তা উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
১-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
حٰمٓ (হা-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা আল বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর সঠিক উদ্দেশ্য ও অর্থ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট কিতাব তথা পবিত্র কুরআনের শপথ করে বলেন, নিশ্চয়ই আমি এ কুরআন অবতীর্ণ করেছি বরকতময় রাতে। এ বরকতময় রাতটি হলো রমাযান মাসের কদরের রাত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْٓ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًي لِّلنَّاسِ وَبَيِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰي وَالْفُرْقَانِ)
“রমাযান তো সেই মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক এবং হিদায়াতের স্পষ্ট নিদর্শন ও ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী)।” (সূরা বাকারাহ্ ২ : ১৮৫)
কদরের রাতে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّآ أَنْزَلْنٰهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ)
“নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআন) নাযিল করেছি কদরের রাতে।” (সূরা ক্বাদ্র ৯৭ : ১)
আর এ শবে কদর রমাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে কোন একটি রাত।
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমরা লাইলাতুল কদর অšে¦ষণ করো রমাযানের শেষ দশকে। (সহীহ বুখারী হা. ২০২১)
সুতরাং কুরআন অবতীর্ণ হয় রমাযান মাসের কদরের রাতে, যা বরকতময় রাত হিসেবে এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ রাত বরকতময় এ জন্য যে :
১. এ রাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
২. এ রাতে বহু ফেরেশতাসহ জিবরীল আমীন পৃথিবীতে অবতরণ করেন।
৩. সারা বছরে সংঘটিত হবে এমন কার্যের ফায়সালা করা হয়।
৪. এ রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : ইবরাহীম (আঃ)-এর সহীফাসমূহ রমাযানের প্রথম তারিখে, তাওরাত ছয় তারিখে, যাবূর বার তারিখে, ইঞ্জিল আঠার তারিখে এবং কুরআন চব্বিশ তারিখে অবতীর্ণ হয়েছে। (সিলসিলা সহীহাহ হা. ১৫৭৫)
কুরআন শবে কদরে নাযিল হওয়ার অর্থ এই যে, লাওহে মাহফূয থেকে সমগ্র কুরআন দুনিয়ার আকাশে এ রাতেই নাযিল হয়েছে। অতঃপর নবুওয়াতের তেইশ বছরে প্রয়োজনানুপাতে খণ্ড খণ্ড করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি নাযিল করা হয়েছে। কেউ বলেছেন, প্রতি বছর যতটুকু কুরআন নাযিল হওয়া প্রয়োজন ছিল, ততটুকুই শবে কদরে দুনিয়ার আকাশে নাযিল হয়েছে। (কুরতুবী)
কেউ কেউ (لَيْلَةٌ مُبَارَكَةٌ) (বরকতময় রাত) বলতে শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে বলে থাকেন। এ কথা সঠিক নয়। কুরআনের স্পষ্ট উক্তি দ্বারা এ কথা সাব্যস্ত যে, কুরআন কদরের রাতে অবতীর্ণ হয়েছে, আর কদরের রাত রমাযান মাসে হয়, শাবান মাসে নয়। সুতরাং সূরা কদর ও সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াত বলে দিচ্ছে- এ বরকতময় রাত্রি হচ্ছে কদরের রাত, এ থেকে শবে বরাত অর্থ নেয়া কোনক্রমেই সঠিক নয়। তাছাড়া শবে বরাত এর ব্যাপারে যে-সব বর্ণনাতে মাহাত্ম্য ও ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে অথবা এ রাতকে ভাগ্য নির্ধারণের রাত বলা হয়েছে, সে সমস্ত বর্ণনাগুলো সনদের দিক থেকে জাল ও বানোয়াট। অতএব কুরআন কদরের রাতে অবতীর্ণ হয়েছে; এটাই সঠিক কথা। যারা বলবে, কুরআন শবে বরাতের রাতে অবতীর্ণ হয়েছে তাদের কথা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আর এ রাত্রিতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফায়সালা করা হয়। অর্থাৎ লাওহে মাহফূয হতে লেখক ফেরেশতাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
সারা বছরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন বয়স, জীবিকা এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত যা ঘটবে ইত্যাদি স্থিরীকৃত হয়। সাহাবা ও তাবেঈগণ উক্ত আয়াতের এরূপ ব্যাখ্যাই করেছেন। আর এ সমস্ত কার্য-কলাপ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশক্রমেই হয়ে থাকে। এমন কোনই কার্য সম্পাদন হয় না যা তিনি জানেন না।
(رَحْمَةً مِّنْ رَّبِّکَ)
এখানে রহমত বলতে যা বুঝোনো হয়েছে তা হলো, গ্রন্থসমূহ অবতীর্ণ করার সাথে সাথে রাসূলগণকে প্রেরণ করা। যাতে নাবী-রাসূলগণ উক্ত কিতাবের বিধি-বিধানগুলো স্পষ্টভাবে মানুষের নিকট বর্ণনা করে দেন।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনিই আকাশসমূহ ও জমিনের মালিক এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু রয়েছে তারও। আর তিনিই একমাত্র ইলাহ, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। এ সম্পর্কে সূরা আল আ‘রাফ-এর ১৫৮ নম্বর আয়াতেও আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কুরআন শবে কদরে অবতীর্ণ হয়েছে, শবে বরাতে নয়।
২. শবে কদর একটি বরকতময় রাত, যে রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম।
৩. শবে কদরে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত করা হয়।
৪. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন সকলের জন্য রহমতস্বরূপ।